কাশ্মীরে মন্দির পুনর্নির্মাণে একসাথে কাজ করছে মুসলিম আর পন্ডিতেরা by আমির আলী ভাট
নির্মাণাধিন মন্দির |
দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামার সামরিক অধ্যুষিত আচান গ্রামে সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে স্থানীয় অধিবাসীরা। প্রতিবেশী মুসলিম ও
হিন্দু সম্প্রদায় মিলে সেখানে একটি মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ করছে।
স্বামী জাগ্গারনাথ আস্থাপান নামে এই মন্দিরটি হয়তো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রার্থনার জন্য খুলে দেয়া হবে। আশি বছরের পুরো মন্দিরটির কাঠামো একই রকম থাকবে – গম্বুজাকৃতির ছাদ, সিলিং থেকে ঝুলন্ত একটি ঘন্টা এবং শিব লিঙ্গ ঘিরে রঙিন দেয়াল।
পুলওয়ামা হামলার পর সারা দেশে কাশ্মীরী শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীদের ওপর
হামলা শুরু হলে এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ থমকে যায়। সপ্তাহ খানিক আগে কাজ
আবার শুরু হয়েছে।
মন্দিরে যারা কাজ করছে, তাদের চা খাওয়ানো ছাড়াও মুসলিম প্রতিবেশীরা
প্রতিদিন মন্দিরের জায়গাটিতে সফর করেছে এবং কাজের তত্ত্বাবধান করছে।
নব্বই দশকের আগে প্রায় ৬০টি পণ্ডিত পরিবার আচানে এসে বসতি স্থাপন করে।
সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থান হলে অন্যান্য গ্রাম আর শহরের মতো এখানকার পন্ডিত
পরিবারগুলোও অন্য জায়গায় চলে যায়। শুধুমাত্র ভুষণলালের পরিবার এখানে থেকে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভুষণের বাড়ি মন্দির থেকে কয়েক গজ মাত্র দূরে। তিন ভাই সঞ্জয় কুমার, দিপ কুমার এবং অশোক কুমারের সাথে সেখানে বাস করছেন তিনি।
ভুষণ দ্য ওয়্যারকে বলেন, “আমি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজের
গ্রাম কেন ছেড়ে যাবো? এমনকি নব্বইয়ের দশকের সময়েও আমি প্রতিদিন মন্দিরে
প্রার্থনার জন্য যেতাম। কিন্তু এটার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল”।
গত বছর ভুষণ মসজিদ আওকাফ কমিটির সাথে কথা বলে তাদেরকে পরিস্থিতি
সম্পর্কে অবগত করে। ভুষণ বলেন, “সব সময়ের মতো এবারও মুসলিম ভাইদের কাছ থেকে
ইতিবাচক সাড়া পাই আমি। এক সাথে মিলে আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তার
কাছে বিষয়টি উত্থাপন করি। প্রতিটি পদক্ষেপ মুসলিম ভাইয়েরা আমাকে সাহায্য
করেছে”।
যদিও গ্রামে একটি মাত্র পন্ডিত পরিবার বাস করছে, কিন্তু গ্রামবাসীরা মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়।
গত মাসে সরকার যখন তহবিল ছাড় দেয়, মুসলিম প্রতিবেশীদের সহায়তা নিয়ে মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করে ভুষণ।
ভুষণ লাল |
রঙের কাজ করেন শাবির আহমেদ মির। এখন তিনি মন্দিরে কাজ করছেন। শাবির
বলেন, “ভুষণলাল যখন আমাকে মন্দির নির্মাণের কথা বললো, তখন আমি আমার সব কাজ
বাতিল করেছি। মন্দিরের কাজটা সবার আগে করতে চেয়েছি আমি। ভুষণ লাল একাকি
অনুভব করুক, এটা আমি চাইনি। আমরা মসজিদকে যেভাবে সম্মান করি, সেভাবে
মন্দিরকেও সম্মান করা উচিত। এখানে কাজের সময়, সবকিছুরই দেখভাল করি আমরা”।
আরও যারা মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ করছে, তাদের মধ্যে রয়েছে গুলাম নবী
শেখ, মুশতাক আহমেদ মালিক, তানভির আহমেদ মালিক এবং ভুষণের ছোট ভাই অশোক
কুমার।
ভুষণ বলেন, দক্ষিণ কাশ্মীরে যে সব মন্দিরকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখানো
হয়, তার মধ্যে এটা একটা। নব্বইয়ের দশকের আগে অন্যান্য গ্রাম থেকে এখানে
হাজার হাজার পন্ডিত সফরে আসতো।
ভুষণ বলেন, “নব্বই দশকের আগে প্রতি বছর আমরা এই মন্দিরে রাজি কাঠ (বকরি
উৎসর্গ উৎসব) উদযাপন করতাম। বকরি জবাইয়ের পর আমরা সেটা রান্না করে উপস্থিত
মানুষদের মধ্যে বন্টন করতাম”।
মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটা মসজিদ। দুইয়ে মিলে গ্রামের ধর্মীয় চেহারাটাকে
অনন্য করে তুলেছে। একই পথ দিয়ে মসজিদ ও মন্দিরে যাতায়াত করতে হয়।
গ্রামের একজন গোলাম নবী বললেন, “নব্বই দশকের আগে মুসলিম হিন্দু তাদের
ধর্মীয় উপাসনালয়ে ঢোকার আগে এক রাস্তা দিয়েই হাঁটতো, একে অন্যের সাথে গল্প
করতো। আমরা চাই সেই দিনগুলো ফিরে আসুক”।
নিজের বাবা কাশি নাথের মতো ভুষণ নিজেও একজন হিন্দু পুরোহিত। পাঁচ বছর
আগে কাশি যখন মারা যান, তখন শত শত মুসলিমরাও শোক করেছিল। তার শেষকৃত্যে অংশ
নিয়েছিল।
মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ। পেছনে শাবির আহমদ মীর |
ভুষণ বলেন, “এই গ্রামে কখনও নিজেকে একা মনে করিনি। আমি এমনকি জানিও না
কিভাবে আমার বাবার দাহ করার ব্যবস্থা হয়েছিল। কে তার মরদেহ সেখানে বহন করে
নিয়ে গিয়েছিল”।
আচানের অধিকাংশ পন্ডিতই উচ্চ শিক্ষিত। তাদের একজন ছিলেন চামান লাল
চামান। একসময় তিনি ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি এই গ্রাম থেকে
চলে যান। গ্রামের লোকজন তার ভালো কাজের কথা এখনও স্মরণ করে।
রঙমিস্ত্রি শাবির বলেন, “চামানজি ছিলেন একজন সৎ মানুষ। তিনি নিশ্চিত
করেছিলেন যাতে রোডগুলো নির্মিত হয়। তার চেষ্টাতেই সরকারী স্কুল এবং দরকারী
সরকারী সুবিধাগুলো গ্রামে এসেছিল”।
শাবিরের পাশে বসে আরেক গ্রামবাসী জাভেদ আহমেদ নিজের পন্ডিত শিক্ষকের কথা
বললেন। “আমার শিক্ষক অশোক স্যারের কথা কখনও ভুলব না। আমাদের গ্রামের
সবচেয়ে ভালো শিক্ষক ছিলেন তিনি”।
মন্দিরের কাজ কবে শেষ হবে, তার অপেক্ষায় আছে গ্রামবাসীরা। তারা আশা
করছেন, মন্দিরের কাজ শেষ হলে, হাজার হাজার পন্ডিত আবারও এখানে আসতে শুরু
করবে।
শাবির বলেন, “ধর্ম আমাদেরকে ঘৃণা শেখায় না। এটা আসে আমাদের নোংরা
মানসিকতা থেকে। পন্ডিত ভাইদের ছাড়া আমাদের গ্রামটি অসম্পূর্ণ। আমরা খুবই
খুশি হবো যদি তারা আবার এখানে ফিরে এসে বসবাস শুরু করেন”।
আচান গ্রামে পরিত্যক্ত পন্ডিত বাড়ি |
No comments