নগ্ন জারোয়া দেখানোর ‘হিউমেন সফারি’ by পরিতোষ পাল
দেশে
বিদেশে ‘হিউমেন সফারি’র কথাটা প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছে। আন্দামানে
পর্যটকদের নাকি বিজ্ঞাপন দিয়ে এই ‘হিউমেন সফারি’তে নিয়ে যাওয়া হয়। আসলে
জঙ্গলে বন্যপ্রাণী দেখার চেষ্টা থাকে, এক্ষেত্রে প্রাণী নয়, সভ্যতার আলো
থেকে যোজন দূরে থাকা বিশ্বের আদিমতম নগ্ন মানুষগুলিকে দেখার আকাঙ্ক্ষা থাকে
বলেই একে বলা হচ্ছে হিউমেন সফারি।
বিদেশি পর্যটকরাই ব্যাপারে আগ্রহী বেশি। কয়েক বছর আগে বৃটেনে প্রচারিত একটি ফুটেজে দেখানো হয়েছে বিদেশি পর্যটকদের সামনে এক জারোয়া যুবতীকে নাচতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরপরই প্রবল বিতর্কের ঝড় ওঠে।
তবে অভিযোগ শোনা গেছে, পর্যটকদের এই আকাঙক্ষা তৈরি করেছে আন্দামান প্রশাসনের তৈরি একটি সিদ্ধান্ত। বিতর্ক সত্ত্বেও প্রশাসন জারোয়াদের সংরক্ষিত অঞ্চল ফুঁড়ে নিয়ে গিয়েছে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড নামের হাইওয়েকে। সড়ক পথে দক্ষিণ আন্দামান থেকে মধ্য হয়ে উত্তর আন্দামানে যাওয়ার এই হাইওয়ের ফলে জারোয়ারা অনেকটাই বেআব্রু হয়ে পড়েছে। ফলে তারা মাঝে মধ্যেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে চলে আসছে হাইওয়ের উপরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্য মানুষের স্পর্শ পেয়ে তাদের চাহিদাও বেড়েছে নানা কিছুর।
এই প্রতিবেদক কিছুদিন আগে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রওনা হয়েছিল উত্তর আন্দামানের দিগলিপুরের বাঙালিরা কেমন আছে তা অনুসন্ধান করতে। পথেই জারোয়া সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রবেশ পথে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ‘হিউমেন সফারি’ নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রবল বিতর্কের পর এখন আইনের কড়াকড়ি যথেষ্ট। কোনও গাড়িকেই এই সংরক্ষিত এলাকায় সকাল নটা থেকে বিকেল তিনটের পর আর যেতে দেওয়া হয় না। ফলে সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রবেশের মুখে চেকপোস্টে আটকে পড়েছিলাম। বিশাল গাড়ির লাইন। তখনও নটা বাজেনি।
ঠিক নটায় চেকপোস্টে নথিবদ্ধ করে গাড়ির কনভয় রওনা দিল। সঙ্গে তিনটি মোটর সাইকেলে মোবাইল পুলিশ। গোটা সংরক্ষিত আঞ্চলের পথ এরা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তবে চেকপোস্টেই কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সংরক্ষিত অঞ্চলে কোনও গাড়ি থামানো চলবে না। গতিও ৪০ কিলোমিটারের নীচে রাখা চলবে না। আর ছবি তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে বিশাল জরিমানা। সঙ্গে হুজ্জোতি।
রওনা দেবার পর কয়েক কিলোমিটার যাবার পরই হঠাৎ আমাদের সঙ্গের নজরদারি পুলিশ মোটর সাইকেলটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়তেই দেখি একটি জারোয়া পরিবার উঠে এসেছে রাস্তায়। স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান। সকলেই নগ্ন। মহিলার উর্দ্ধাঙ্গে কোনও কিছু নেই। নীচে লজ্জা নিবারণের জন্য সামান্য কিছু লতা-পাতা। তবে গলায় সামুদ্রিক জিনিষ দিয়ে তৈরি হার। পুরুষটির হাতে তীর, ধনুক।
পুলিশ এগিয়ে গিয়ে তাদের জঙ্গলে ফিরে যেতে ধমক দেওয়া মাত্র পুরুষ জারোয়াটি পুলিশের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। আমাদের গাড়ির চালক রাকেশ জানালো, কাঁচা সুপারি জাতীয় জিনিষের খোঁজ করছে। আন্দামানের অধিকাংশ মানুষই কাঁচা সুপারির খুব ভক্ত। আর এদের কাছ থেকেই এই নেশার হদিস পেয়ে জারোয়াদেরও এর চাহিদা বেড়েছে।
গাড়ি এগিয়ে চলল, এবার দেখা এক ষোল-সতের বছরের জারোয়া যুবকের সঙ্গে। রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে। এর পরণে অবশ্য একটি হাফফ্যান্ট। হাতে তীর, ধনুক। ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এর খানিক পরেই ফের মোবাইল পুলিশের তৎপরতা দেখে সচকিত হয়ে তাকাতেই দেখি উল্টোদিক থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে একটি গাড়ি বোঝাই পুরুষ ও মহিলা জারোয়াদের একটি দলকে। বেশ কয়েকজন মেয়ে জারোয়া গাড়িতে জায়গা না পেয়ে পেছনে ঝুলছে। পরণে কিছু না থাকলেও গলায় ও কোমরে সামুদ্রিক জিনিষের তৈরি অলঙ্কারের বাহার দেখার মত।
আমাদের গাড়ির চালকই জানালো, জঙ্গল থেকে এরা বেরিয়ে আসায় প্রশাসন এদের নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসছে। এটা নাকি মাঝে মাঝেই করা হয়। এর খানিক পরে ফের দেখা একজোড়া জারোয়া যুবকেরও । এদেরও হাতে তীরধনুক। তবে পরণে হাফ প্যান্ট। এই ভাবেই কথিত ‘হিউমেন সফারি’ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বারাটাং।
সেখান থেকে কমলাপুরে আরেকটি জারোয়া সংরক্ষিত অঞ্চল পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। এখানে পুলিশের পাহারা না থাকলেও সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রবেশ পথে সতর্কতার বিধি-নিষেধ একই রকম।
তবে আমরা এখানেও একজোড়া বয়স্ক জারোয়া রমণীর দেখা পেয়েছিলাম। এইভাবে জারোয়া দেখানোর কৃতীত্বটাকেই পুঁজি করে অনেক ভ্রমণ সংস্থা। তবে বিদেশিদেরই এই প্রলোভন দেখানো হয় বেশি করে। এমন অভিযোগ আদিবাসীদের নিযে যারা কাজ করেন তাদের।
আসলে একুশ শতকে পৌঁছেও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা জারোয়া, সম্পেন, ওঙ্গি, সেন্টিনেল প্রভৃতি উপজাতির মানুষরা সভ্যতাকে বরণ করে নেয়নি। বরং সভ্য মানুষকে ঘৃণাই করে। জঙ্গলে তাদের বাসস্থান। আর নগ্নতাই আশ্রয়। হাতে লড়াইয়ের অস্ত্র তীর ধনুক। খাবার বলতে ফলমূল, বুনো শূয়র আর সামুদ্রিক মাছ।
তবে আন্দামানে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে জারোয়া দেখানোর কথা প্রচার করার একটা প্রবণতা দেখতে পেয়েছি। এ ব্যাপারে পর্যটকরাও যথেষ্ট আগ্রহ দেখান।
জারোয়া ছাড়া অন্য আদিম বাসিন্দরা থাকে প্রত্যন্ত দ্বীপগুলিতে, যার অধিকাংশতেই পর্যটকদের যাওয়া বারণ। নৃতত্বের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, কয়েক শ বছর আগে এই সব মানুষ আফ্রিকা থেকে আন্দামানে এসেছিল। এদের চেহারায় নিগ্রোদের প্রভাব স্পষ্ট। তবে একটি অংশের মধ্যে স্পষ্ট মঙ্গোলয়েড প্রভাব। এখনও তারা যেসব জায়গায় থাকে সেখানে মানুষকে প্রবেশ করতে দেয় না তারা। এদের তীরের বিষ স্পর্শে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তবে এরা এক একটি আলাদা অঞ্চলে বা দ্বীপে থাকে।
অন্যান্য উপজাতির মধ্যে হিংস্রতা এখনও প্রবল হলেও জারোয়াদের একাংশ সভ্যতার ছোঁয়া পেতে আগ্রহী হয়েছে। তবে গভীর জঙ্গলে যেসব জারোয়া থাকে তাদের কাছে পৌঁছানো এখনও সম্ভব হয়নি। তেমনি সম্ভব হয়নি সেন্টিনেলদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। নৃতত্ত্ববিদদের চিন্তার কারণ হল এদের সংখ্যা কমতির দিকে।
সাম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা গেছে, জারোয়ারা সংখ্যায় মাত্র তিনশোর কাছাকাছি। ওঙ্গিদের সংখ্যা ১০৫, সেন্টিনেলদের সংখ্যা ২৫০, সোম্পেনদের সংখ্যা ২০০ থেকে ২৫০। সবচেয়ে কম হল গ্রেট আন্দামানিজরা। এদের সংখ্যা সাকুল্যে ৪৫ জন। এই সব আদিমতম মানুষগুলিকে টিকিয়ে রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্চ হয়ে উঠেছে।
তবে ১৯৯৮ সাল থেকে জারোয়ারা গভীর জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসা শুরু করে। এর পেছনে অবশ্য রয়েছে একটি ছোট্ট ঘটনা। এনমাই নামে এক জারোয়া যুবক পা ভেঙ্গে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। প্রশাসন খবর জানতে পেরে তাকে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে। সেখানে তার দীর্ঘ চিকিৎসা চলে। জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি সূত্র খুঁজে যায় প্রশাসনও। এনমাইকে সভ্য সমাজের মাঝে বেশ কিছুদিন রেখে পরে ফেরত পাঠানো হয়েছিল জঙ্গলে। সে জঙ্গলে গিয়েই প্রথম প্রবল উৎসাহে সভ্য সমাজের কথা, আর তার সুফলের কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিল তার সমাজকে। তখন থেকেই বাইরের জগতের মানুষ সম্পর্কে বিদ্বেষ ছেড়ে জারোয়াদের একটি অংশ আসতে শুরু করে হাইওয়েতে নানা জিনিষ পাবার আকর্ষনে।
প্রশাসনের কর্তারাও এটিকে সভ্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ধরা পড়ে যে, জারোয়ারা ক্রমশ বিভিন্ন নেশা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তেমনি বর্হিজগতের সংস্পর্শে এসে জারোয়ারা মিজলস, মামস, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি নানা রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। যেসব রোগ আগে তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।
অভিযোগ উঠেছে, জারোয়া যুবতীদের নিয়ে যৌনতায় উৎসাহ দিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ। তাই বর্তমানে আদিবাসীদের কল্যাণের কাজে যুক্তরা মনে করছেন, জারোয়াদের মত আদিম মানুষগুলিকে যতদিন সভ্য সমাজের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা যাবে ততই ভাল।
এনথ্রোপলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আন্দামান শাখার প্রধানের মতে, জারোয়াদের মত আদিমতম মানুষগুলোকে জোর করে সভ্য সমাজের সঙ্গে সহাবস্থানের চেষ্টা করা হলে তা হবে তাদের গণহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া।
বিদেশি পর্যটকরাই ব্যাপারে আগ্রহী বেশি। কয়েক বছর আগে বৃটেনে প্রচারিত একটি ফুটেজে দেখানো হয়েছে বিদেশি পর্যটকদের সামনে এক জারোয়া যুবতীকে নাচতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরপরই প্রবল বিতর্কের ঝড় ওঠে।
তবে অভিযোগ শোনা গেছে, পর্যটকদের এই আকাঙক্ষা তৈরি করেছে আন্দামান প্রশাসনের তৈরি একটি সিদ্ধান্ত। বিতর্ক সত্ত্বেও প্রশাসন জারোয়াদের সংরক্ষিত অঞ্চল ফুঁড়ে নিয়ে গিয়েছে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড নামের হাইওয়েকে। সড়ক পথে দক্ষিণ আন্দামান থেকে মধ্য হয়ে উত্তর আন্দামানে যাওয়ার এই হাইওয়ের ফলে জারোয়ারা অনেকটাই বেআব্রু হয়ে পড়েছে। ফলে তারা মাঝে মধ্যেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে চলে আসছে হাইওয়ের উপরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্য মানুষের স্পর্শ পেয়ে তাদের চাহিদাও বেড়েছে নানা কিছুর।
এই প্রতিবেদক কিছুদিন আগে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রওনা হয়েছিল উত্তর আন্দামানের দিগলিপুরের বাঙালিরা কেমন আছে তা অনুসন্ধান করতে। পথেই জারোয়া সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রবেশ পথে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ‘হিউমেন সফারি’ নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রবল বিতর্কের পর এখন আইনের কড়াকড়ি যথেষ্ট। কোনও গাড়িকেই এই সংরক্ষিত এলাকায় সকাল নটা থেকে বিকেল তিনটের পর আর যেতে দেওয়া হয় না। ফলে সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রবেশের মুখে চেকপোস্টে আটকে পড়েছিলাম। বিশাল গাড়ির লাইন। তখনও নটা বাজেনি।
ঠিক নটায় চেকপোস্টে নথিবদ্ধ করে গাড়ির কনভয় রওনা দিল। সঙ্গে তিনটি মোটর সাইকেলে মোবাইল পুলিশ। গোটা সংরক্ষিত আঞ্চলের পথ এরা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তবে চেকপোস্টেই কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সংরক্ষিত অঞ্চলে কোনও গাড়ি থামানো চলবে না। গতিও ৪০ কিলোমিটারের নীচে রাখা চলবে না। আর ছবি তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে বিশাল জরিমানা। সঙ্গে হুজ্জোতি।
রওনা দেবার পর কয়েক কিলোমিটার যাবার পরই হঠাৎ আমাদের সঙ্গের নজরদারি পুলিশ মোটর সাইকেলটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়তেই দেখি একটি জারোয়া পরিবার উঠে এসেছে রাস্তায়। স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান। সকলেই নগ্ন। মহিলার উর্দ্ধাঙ্গে কোনও কিছু নেই। নীচে লজ্জা নিবারণের জন্য সামান্য কিছু লতা-পাতা। তবে গলায় সামুদ্রিক জিনিষ দিয়ে তৈরি হার। পুরুষটির হাতে তীর, ধনুক।
পুলিশ এগিয়ে গিয়ে তাদের জঙ্গলে ফিরে যেতে ধমক দেওয়া মাত্র পুরুষ জারোয়াটি পুলিশের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। আমাদের গাড়ির চালক রাকেশ জানালো, কাঁচা সুপারি জাতীয় জিনিষের খোঁজ করছে। আন্দামানের অধিকাংশ মানুষই কাঁচা সুপারির খুব ভক্ত। আর এদের কাছ থেকেই এই নেশার হদিস পেয়ে জারোয়াদেরও এর চাহিদা বেড়েছে।
গাড়ি এগিয়ে চলল, এবার দেখা এক ষোল-সতের বছরের জারোয়া যুবকের সঙ্গে। রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে। এর পরণে অবশ্য একটি হাফফ্যান্ট। হাতে তীর, ধনুক। ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এর খানিক পরেই ফের মোবাইল পুলিশের তৎপরতা দেখে সচকিত হয়ে তাকাতেই দেখি উল্টোদিক থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে একটি গাড়ি বোঝাই পুরুষ ও মহিলা জারোয়াদের একটি দলকে। বেশ কয়েকজন মেয়ে জারোয়া গাড়িতে জায়গা না পেয়ে পেছনে ঝুলছে। পরণে কিছু না থাকলেও গলায় ও কোমরে সামুদ্রিক জিনিষের তৈরি অলঙ্কারের বাহার দেখার মত।
আমাদের গাড়ির চালকই জানালো, জঙ্গল থেকে এরা বেরিয়ে আসায় প্রশাসন এদের নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসছে। এটা নাকি মাঝে মাঝেই করা হয়। এর খানিক পরে ফের দেখা একজোড়া জারোয়া যুবকেরও । এদেরও হাতে তীরধনুক। তবে পরণে হাফ প্যান্ট। এই ভাবেই কথিত ‘হিউমেন সফারি’ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বারাটাং।
সেখান থেকে কমলাপুরে আরেকটি জারোয়া সংরক্ষিত অঞ্চল পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। এখানে পুলিশের পাহারা না থাকলেও সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রবেশ পথে সতর্কতার বিধি-নিষেধ একই রকম।
তবে আমরা এখানেও একজোড়া বয়স্ক জারোয়া রমণীর দেখা পেয়েছিলাম। এইভাবে জারোয়া দেখানোর কৃতীত্বটাকেই পুঁজি করে অনেক ভ্রমণ সংস্থা। তবে বিদেশিদেরই এই প্রলোভন দেখানো হয় বেশি করে। এমন অভিযোগ আদিবাসীদের নিযে যারা কাজ করেন তাদের।
আসলে একুশ শতকে পৌঁছেও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা জারোয়া, সম্পেন, ওঙ্গি, সেন্টিনেল প্রভৃতি উপজাতির মানুষরা সভ্যতাকে বরণ করে নেয়নি। বরং সভ্য মানুষকে ঘৃণাই করে। জঙ্গলে তাদের বাসস্থান। আর নগ্নতাই আশ্রয়। হাতে লড়াইয়ের অস্ত্র তীর ধনুক। খাবার বলতে ফলমূল, বুনো শূয়র আর সামুদ্রিক মাছ।
তবে আন্দামানে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে জারোয়া দেখানোর কথা প্রচার করার একটা প্রবণতা দেখতে পেয়েছি। এ ব্যাপারে পর্যটকরাও যথেষ্ট আগ্রহ দেখান।
জারোয়া ছাড়া অন্য আদিম বাসিন্দরা থাকে প্রত্যন্ত দ্বীপগুলিতে, যার অধিকাংশতেই পর্যটকদের যাওয়া বারণ। নৃতত্বের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, কয়েক শ বছর আগে এই সব মানুষ আফ্রিকা থেকে আন্দামানে এসেছিল। এদের চেহারায় নিগ্রোদের প্রভাব স্পষ্ট। তবে একটি অংশের মধ্যে স্পষ্ট মঙ্গোলয়েড প্রভাব। এখনও তারা যেসব জায়গায় থাকে সেখানে মানুষকে প্রবেশ করতে দেয় না তারা। এদের তীরের বিষ স্পর্শে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তবে এরা এক একটি আলাদা অঞ্চলে বা দ্বীপে থাকে।
অন্যান্য উপজাতির মধ্যে হিংস্রতা এখনও প্রবল হলেও জারোয়াদের একাংশ সভ্যতার ছোঁয়া পেতে আগ্রহী হয়েছে। তবে গভীর জঙ্গলে যেসব জারোয়া থাকে তাদের কাছে পৌঁছানো এখনও সম্ভব হয়নি। তেমনি সম্ভব হয়নি সেন্টিনেলদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। নৃতত্ত্ববিদদের চিন্তার কারণ হল এদের সংখ্যা কমতির দিকে।
সাম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা গেছে, জারোয়ারা সংখ্যায় মাত্র তিনশোর কাছাকাছি। ওঙ্গিদের সংখ্যা ১০৫, সেন্টিনেলদের সংখ্যা ২৫০, সোম্পেনদের সংখ্যা ২০০ থেকে ২৫০। সবচেয়ে কম হল গ্রেট আন্দামানিজরা। এদের সংখ্যা সাকুল্যে ৪৫ জন। এই সব আদিমতম মানুষগুলিকে টিকিয়ে রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্চ হয়ে উঠেছে।
তবে ১৯৯৮ সাল থেকে জারোয়ারা গভীর জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসা শুরু করে। এর পেছনে অবশ্য রয়েছে একটি ছোট্ট ঘটনা। এনমাই নামে এক জারোয়া যুবক পা ভেঙ্গে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। প্রশাসন খবর জানতে পেরে তাকে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে। সেখানে তার দীর্ঘ চিকিৎসা চলে। জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি সূত্র খুঁজে যায় প্রশাসনও। এনমাইকে সভ্য সমাজের মাঝে বেশ কিছুদিন রেখে পরে ফেরত পাঠানো হয়েছিল জঙ্গলে। সে জঙ্গলে গিয়েই প্রথম প্রবল উৎসাহে সভ্য সমাজের কথা, আর তার সুফলের কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিল তার সমাজকে। তখন থেকেই বাইরের জগতের মানুষ সম্পর্কে বিদ্বেষ ছেড়ে জারোয়াদের একটি অংশ আসতে শুরু করে হাইওয়েতে নানা জিনিষ পাবার আকর্ষনে।
প্রশাসনের কর্তারাও এটিকে সভ্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ধরা পড়ে যে, জারোয়ারা ক্রমশ বিভিন্ন নেশা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তেমনি বর্হিজগতের সংস্পর্শে এসে জারোয়ারা মিজলস, মামস, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি নানা রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। যেসব রোগ আগে তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।
অভিযোগ উঠেছে, জারোয়া যুবতীদের নিয়ে যৌনতায় উৎসাহ দিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ। তাই বর্তমানে আদিবাসীদের কল্যাণের কাজে যুক্তরা মনে করছেন, জারোয়াদের মত আদিম মানুষগুলিকে যতদিন সভ্য সমাজের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা যাবে ততই ভাল।
এনথ্রোপলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আন্দামান শাখার প্রধানের মতে, জারোয়াদের মত আদিমতম মানুষগুলোকে জোর করে সভ্য সমাজের সঙ্গে সহাবস্থানের চেষ্টা করা হলে তা হবে তাদের গণহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া।
No comments