ইসলামবিদ্বেষ সমস্যার কোনো সমাধান নয় by ইব্রাহিম কালিন
গত ৫
জুন এক বিরল বিদেশ সফরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর ও নোবেল শান্তি
পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি হাঙ্গেরি যান এবং সে দেশের প্রধানমন্ত্রী
ভিক্টর অরবানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর হাঙ্গেরির সরকারের প্রকাশ করা
এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দুই নেতা বর্তমানে তাঁদের উভয়ের দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়া ও ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—অভিবাসনের ওপর আলোকপাত করেছেন।
তাঁরা উল্লেখ করেছেন, মুসলমান অভিবাসন বৃদ্ধির কারণে তাঁরা এই চ্যালেঞ্জের
মুখে পড়েছেন।’
এটা আসলেই বিস্ময়কর যে অং সান সু চি ও অরবান উভয়েই তাঁদের দেশে ‘মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির’ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যে সমস্যাটি তাঁদের দেশে আদৌ নেই। হাঙ্গেরিতে মাত্র পাঁচ হাজার মুসলমান রয়েছে, যদিও গত কয়েক বছরে যে কয়েক লাখ শরণার্থী সে দেশ অতিক্রম করে পশ্চিমে গিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই মুসলমান। তাদের মাত্র কয়েকজন হাঙ্গেরিতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং দেশটির সরকার তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মিয়ানমারেও ‘মুসলিম অভিবাসন বৃদ্ধির’ সমস্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে, কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হাজার হাজার মুসলমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যে রাজ্যটি কিনা কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। তবে বার্মিজ ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের দাবি হচ্ছে, মুসলমানরা সাম্প্রতিক ‘অভিবাসী’। তাদের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। বাস্তব কোনো ভিত্তি না থাকলেও অং সান সু চি ও ভিক্টর অরবান উভয়েই এই বলে জোর দিচ্ছেন যে তাঁদের দেশ ‘মুসলিম অভিবাসনের’ হুমকির সম্মুখীন।
মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের সমর্থক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রশংসিত অং সান সু চি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, যারা কিনা মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে। তারা হাজার হাজার মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছে। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ও প্রাণ বাঁচাতে ২০১৬ সালে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদিকে মিয়ানমারে এখনো যেসব মুসলমান রয়ে গেছে, তারা সহিংসতার হুমকিতে রয়েছে এবং নানাভাবে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১০ হাজারের বেশি নাগরিককে ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করা হয়, যেখানে আন্তর্জাতিক পরিদর্শক এবং গণমাধ্যমের প্রবেশের অনুমোদন নেই।
অং সান সু চি অবশ্য সামরিক বাহিনীর পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের খুব সামান্যই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের নৃশংস নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে যে এ পরিস্থিতিতেই বুদ্ধ নিশ্চয়ই সেই দরিদ্র মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। তারপরও আমি তাদের জন্য খুব বেদনা অনুভব করছি।’ এরপর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত থাকলেও দালাই লামা এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলেননি।
মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন বন্ধে কারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে সিরিয়ার সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করার ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেই। আট বছর ধরে সেখানে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০১৫ সালে ইউরোপে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের স্রোত ঠেকানোর জন্য ইউরোপীয় নেতারা তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার লোভ দেখিয়ে তারা তুরস্কের ঘাড়ে ৩৫ লাখ সিরীয় শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দেয়। বাইরের বিশ্ব থেকে এই শরণার্থীরা খুব কম সাহায্যই পেয়ে থাকে।
সিরিয়ার যুদ্ধে এ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকে এখনো একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে। তাদের অনেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যাচ্ছে। তবু ইউরোপীয়রা সিরিয়ার যুদ্ধ অবসানে খুব সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের উদ্বেগ কেবল মুসলিম অভিবাসন নিয়ে।
অবশ্যই মুসলমান অভিবাসন মিয়ানমার ও হাঙ্গেরির সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য মুসলমান অভিবাসনকে তাদের হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করছে দুটি দেশ। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, লোকরঞ্জনবাদের উত্থান ও ডানপন্থীদের আন্দোলন, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের ক্ষয়, মূলধারার রাজনীতির ব্যর্থতা ইত্যাদি তাদের দেশের আসল সমস্যা, মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যার কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করলেই ইউরোপ বা এশিয়ার সমস্যার সমাধান হবে না। প্রায় ১৫০ বছর আগে কার্ল মার্ক্স একেবারে ঠিক বলেছিলেন যে ইউরোপের স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি ইহুদিদের অন্তর্ভুক্তির ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে আজ ইউরোপ, এশিয়া বা অন্য কোথাও, এটা মুসলমানদের সমান মানুষ এবং সহ-নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার ওপর নির্ভর করছে।
>>>আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত। ইব্রাহিম কালিন তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র।
এটা আসলেই বিস্ময়কর যে অং সান সু চি ও অরবান উভয়েই তাঁদের দেশে ‘মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির’ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যে সমস্যাটি তাঁদের দেশে আদৌ নেই। হাঙ্গেরিতে মাত্র পাঁচ হাজার মুসলমান রয়েছে, যদিও গত কয়েক বছরে যে কয়েক লাখ শরণার্থী সে দেশ অতিক্রম করে পশ্চিমে গিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই মুসলমান। তাদের মাত্র কয়েকজন হাঙ্গেরিতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং দেশটির সরকার তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মিয়ানমারেও ‘মুসলিম অভিবাসন বৃদ্ধির’ সমস্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে, কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হাজার হাজার মুসলমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যে রাজ্যটি কিনা কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। তবে বার্মিজ ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের দাবি হচ্ছে, মুসলমানরা সাম্প্রতিক ‘অভিবাসী’। তাদের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। বাস্তব কোনো ভিত্তি না থাকলেও অং সান সু চি ও ভিক্টর অরবান উভয়েই এই বলে জোর দিচ্ছেন যে তাঁদের দেশ ‘মুসলিম অভিবাসনের’ হুমকির সম্মুখীন।
মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের সমর্থক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রশংসিত অং সান সু চি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, যারা কিনা মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে। তারা হাজার হাজার মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছে। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ও প্রাণ বাঁচাতে ২০১৬ সালে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদিকে মিয়ানমারে এখনো যেসব মুসলমান রয়ে গেছে, তারা সহিংসতার হুমকিতে রয়েছে এবং নানাভাবে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১০ হাজারের বেশি নাগরিককে ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করা হয়, যেখানে আন্তর্জাতিক পরিদর্শক এবং গণমাধ্যমের প্রবেশের অনুমোদন নেই।
অং সান সু চি অবশ্য সামরিক বাহিনীর পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের খুব সামান্যই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের নৃশংস নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে যে এ পরিস্থিতিতেই বুদ্ধ নিশ্চয়ই সেই দরিদ্র মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। তারপরও আমি তাদের জন্য খুব বেদনা অনুভব করছি।’ এরপর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত থাকলেও দালাই লামা এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলেননি।
মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন বন্ধে কারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে সিরিয়ার সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করার ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেই। আট বছর ধরে সেখানে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০১৫ সালে ইউরোপে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের স্রোত ঠেকানোর জন্য ইউরোপীয় নেতারা তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার লোভ দেখিয়ে তারা তুরস্কের ঘাড়ে ৩৫ লাখ সিরীয় শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দেয়। বাইরের বিশ্ব থেকে এই শরণার্থীরা খুব কম সাহায্যই পেয়ে থাকে।
সিরিয়ার যুদ্ধে এ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকে এখনো একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে। তাদের অনেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যাচ্ছে। তবু ইউরোপীয়রা সিরিয়ার যুদ্ধ অবসানে খুব সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের উদ্বেগ কেবল মুসলিম অভিবাসন নিয়ে।
অবশ্যই মুসলমান অভিবাসন মিয়ানমার ও হাঙ্গেরির সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য মুসলমান অভিবাসনকে তাদের হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করছে দুটি দেশ। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, লোকরঞ্জনবাদের উত্থান ও ডানপন্থীদের আন্দোলন, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের ক্ষয়, মূলধারার রাজনীতির ব্যর্থতা ইত্যাদি তাদের দেশের আসল সমস্যা, মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যার কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করলেই ইউরোপ বা এশিয়ার সমস্যার সমাধান হবে না। প্রায় ১৫০ বছর আগে কার্ল মার্ক্স একেবারে ঠিক বলেছিলেন যে ইউরোপের স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি ইহুদিদের অন্তর্ভুক্তির ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে আজ ইউরোপ, এশিয়া বা অন্য কোথাও, এটা মুসলমানদের সমান মানুষ এবং সহ-নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার ওপর নির্ভর করছে।
>>>আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত। ইব্রাহিম কালিন তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র।
No comments