কফিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন ‘হ্যাঁ’ by ইজাজ আহ্মেদ মিলন
কোনোভাবেই
হিসেবটা মেলাতে পারছিলেন না সৈকত চৌধুরী। মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। নানা রকম
ভাবনা ভিড় করছে মস্তিষ্কে। কেন এমনটা হলো! আনিকা শেলীর এমন আচরণে
খ্যাতিমান লেখক সৈকত চৌধুরী শুধু ভেঙেই পড়েননি- চরম অপমানবোধও কাজ করছে তার
ভেতরে। ‘খাঁটো’ উপন্যাসটির জন্য বেসরকারি একটি ব্যাংক প্রবর্তিত সাহিত্য
পুরস্কার পেয়েছেন কথাশিল্পী সৈকত চৌধুরী। পুরস্কার হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা,
ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র পেয়েছেন। সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন
আনিকা শেলী। ক্ষোভ আর অভিমানে পুরস্কার পাওয়ার খবরটিও শৈলীকে জানায়নি
সৈকত। পত্রিকায় ছবিসহ খবরটি দেখে আনন্দে শেলী সেদিন কেঁদেছিলেন। জাতীয়
জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শেষে নীরবে ফিরে আসেন
শেলী। সৈকতের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু দেখা করেননি। ভালোবাসার
মানুষের এমন প্রাপ্তি শেলীকে সব সময় আনন্দ দেয়-খুশি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই শেলীর প্রেমে পড়েন সৈকত। গভীর প্রেম। সৈকত চৌধুরী জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায় নিয়মিত গল্প লেখেন। সৈকতের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘ খাঁটো’। বইটি তাকে রাতারাতি পরিচিতি এনে দেয়। ‘খাঁটো’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেন আনিকা শৈলীকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন- ‘আমার ছন্দহীন একটি জীবনকে ছন্দময় করেছে, জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে সহযোগিতা করেছে- প্রিয়তমা আনিকা শেলীকে।’ সৈকত চৌধুরীর লেখালেখি মোটেও পছন্দের ছিল না শেলীর। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বহুবার মান অভিমান হয়েছে। এক পর্যায়ে সম্পর্ক ভেঙেও যায়। সৈকত চৌধুরী লেখালেখি ছাড়তে পারেননি। শেলীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তিনি লেখেন ‘খাঁটো’ উপন্যাস।
নীলক্ষেত এলাকার পুরনো বইয়ের দোকান থেকে প্রায় সময়ই প্রয়োজনীয় বই কিনে আনেন সৈকত। কখনো কখনো পল্টন এলাকায়ও যান। সত্যজিৎ রায়ের ‘অ্যাবস্ট্রাকশান’ নামের গল্পের বইটি কেনার জন্য সেদিন নীলক্ষেতের পরিমল বককর্ণারে পুরনো বইগুলো উল্টোচ্ছিলেন সৈকত চৌধুরী। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে নিজের লেখা ‘খাঁটো’ উপন্যাস। চমকে উঠেন সৈকত চৌধুরী। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকেন। বলপয়েন্টে নিজের হাতের লেখা ‘প্রিয়তমা, আনিকা শেলীকে। তোমাকে এখনো আপনজন ভাবি, স্বপ্ন দেখি-সংসার গড়ার স্বপ্ন। বইটা পড়লে খুশি হবো। -সৈকত চৌধুরী। কপাল ঘেমে উঠছে। হাত কাঁপছে। এই বই এখানে? বিড় বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করেন সৈকত। বছরখানেক আগে সুকৌশলে পুরান ঢাকার বাসায় গিয়ে বইটা তিনি শেলীর হাতে দিয়ে এসেছিলেন। সেই বই এখানে? বইটা কিনে নিলেন তিনি। আটশ টাকা মূল্য। তিনশ দিয়ে কিনলেন। পাশের একটি চা-স্টলে বসে সিগারেট ধরানোর সময় সৈকতের মনে হলো- আমার সঙ্গে বিশ্বনন্দিত আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ এর সঙ্গে দারুণ একটি মিল পেলাম। জর্জ বার্নার্ড শ এর জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করছিলেন চা-স্টলে বসে। জর্জ বার্নার্ড শ তার লেখা একটি নাটকের বই একবার প্রিয় এক অভিনেত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন ‘নাট্যকারের ভালোবাসাসহ- জর্জ বার্নার্ড শ।’ এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।
জর্জ বার্নার্ড শ’রও অভ্যাস ছিল পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় বই খুঁজে বের করে সেটা কিনে আনার। একদিন পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ। দুষ্প্রাপ্য কোনো বই খোঁজছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তার হাতে উঠে এলো সেই বই, যেটা তিনি প্রিয় অভিনেত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ’র বোঝতে আর বাকি রইলো না বইটি প্রিয় অভিনেত্রী বিক্রি করে দিয়েছেন। পুরনো দোকান থেকে নিজের লেখা নাটকের বইটি কিনে নিলেন জর্জ বার্নার্ড শ । বইটি আবার পাঠালেন প্রিয় অভিনেত্রীর কাছে। উপহার পেয়ে অভিনেত্রী এবার লজ্জা পান। কারণ, প্রথমবারের লেখার নিচেই জর্জ বার্নার্ড শ এবার লিখেছেন ‘আবার নতুন করে ভালোবাসা জানিয়ে’। জর্জ বার্নার্ড শ’র এই ঘটনা মনে করে সৈকত চৌধুরী খানিকটা হাসলেন। চা বিক্রেতা সৈকতের হাসির দৃশ্য দেখে ফেলেন। জানতে চান- স্যার, আফনে হাসলে ক্যান? আমার লুঙ্গিটা ছেঁড়া দেইখ্যা? সৈকত সাহেব তো হতবম্ব ! চা বিক্রেতার লুঙ্গির দিকে তো দৃষ্টিই পড়েনি। বললেন, আরে না! আমি তো আপনার লুঙ্গির দিকে তাকাই-ই নি। তাকালেই কি ছেঁড়া লুঙ্গি দেখে আমি হাসবো! এমনিতেই হাসলাম। একটা কথা মনে পড়েছে তো !
সৈকত চৌধুরী এবার হাঁটতে থাকলেন। নানা রকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মানে শেলী বইটি খুলেওনি? উপহার দেয়ার পরদিনই হয়তো ফেরিওয়ালার কাছে পুরনো পত্রিকার সাথে হয়তো বিক্রি করে ফেলেছে। বইটা তো অন্তত খুলে দেখা উচিৎ ছিল! ভাঁজও খুলেনি- সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কী করা যায়! জর্জ বার্নার্ড শ’র মতো আবার কি বইটি শেলীর কাছে পাঠাবেন? নাকি অপমান বুকে জিইয়েই রাখবেন? এমন সব চিন্তা করতে করতে আজিমপুর বাসায় পৌঁছে যান সৈকত চৌধুরী। লেখালেখির কারণে শেলীর সাথে সম্পর্কই টেকেনি। সেই শেলীকে বই দিয়ে আসা এক ধরণে অপরাধ হয়েছিল, আবার পাঠাবো? প্রশ্ন করে নিজেকে। উত্তর আসে- ‘না’।
দুপুরের ঠিক পর বাসায় পৌঁছে ফ্যানটা অন করে বিছানায় গা এলিয়ে ক্লান্ত সৈকত চৌধুরী শুয়ে পড়েন। বের হওয়ার সময় টিভিটা অব করতে খেয়াল ছিল না। শুয়েই টিভির দিকে চোখ রাখেন সৈকত সাহেব। টিভিতে স্ক্রল যাচ্ছে ‘পুরান ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড : বহু হতাহতের আশঙ্কা’। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে শেলীর নাম্বারে কল করলেন। ফোন বন্ধ। আনিকা শেলী পুরানা ঢাকাতেই জরাজীর্ণ একটি ভবনে থাকেন। বাবা মারা গেছেন দশ বারো বছর আগে। মা আর ভাই থাকেন নওগাঁর রানীনগরের গ্রামের বাড়িত। একমাত্র ছোট ভাই সেলিম সবজির ব্যবসা করে শেলীর পড়াশোনার খবর দেন। পড়াশোনা শেষ হয়েছে কেবল। একটি চাকরি জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন শেলী। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভাইভার জন্য অপেক্ষা। তার সব কিছুই ভালো লাগে- শুধু লেখালেখি ছাড়া। ছোট বেলায় স্কুলে এক শিক্ষক তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছেন- লেখকরা ছন্নছাড়া হয়, তারা বেখেয়ালি হয়, জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের, লেখকরা সংসারী হয় না। সংসার গড়লেও টেকাতে পারে না- এ সব নানা নেগেটিভ ধারণা। শিক্ষকের সেই কথা এখনো মনে আছে শেলীর। এ কারণে ভালোবাসার মানুষ লেখক হবে এবং তার সঙ্গে সংসার হবে এমনটা শেলী কখনো চায়নি। তার চাওয়াই পূরণ হয়েছে। সৈকত চৌধুরীর সঙ্গে তার ছেদ ঘটে।
চৌধুরী সাহেব টিভি চ্যানেলে লাইভে দেখছিলেন সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। বারবার শিউরে উঠছিলেন। শেলী জীর্ণ ভবনটিতে বাস করতেন সেই ভবনেই আগুন। তার মোবাইলটাও বন্ধ। ওই অবস্থাতেই দ্রুত বের হয়ে পুরান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন সৈকত। ভবনের সামনে হাজার হাজার মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আগুন নেভাতে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। স্বজনদের খোঁজছেন কেউ কেউ। সময় যতোই যাচ্ছে ততোই সেখানকার আকাশ ভারি হচ্ছে। পোড়া মানুষের গন্ধ বেরোচ্ছে। সৈকত খোঁজছেন তার প্রিয়তমা শেলীকে। অভিমান বুকে জমা থাকলেও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। রাত ৩টা দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা একটার পর একটা লাশ বের করে আনতে থাকেন। ইতোমধ্যে শেলীর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন করে ওই ভবনে আগুন লাগার খবরটি জানিয়ে দেন। নওগাঁ থেকে শেলীর মা আর ভাই ঢাকা আসার জন্য গাড়িতে চড়েছেন। শেলীর সঙ্গে থাকতো তার এক প্রতিবেশী। নাম রুবী আক্তার। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। রুমী টেলিফোন করে তার ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে শেলী পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আগুন লাগার সময় রুবী বাইরে ছিলেন বলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। সৈকত চৌধুরী খোঁজছেন শেলীকে।এরই মধ্যে রুমী তাকেও ফোন দিয়ে জানায় শেলী আর নেই। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশগুলো বাইরে এনে রাখা হচ্ছে। সারিবদ্ধ লাশের দিকে তাকানো যায় না। তবুও সৈকত প্রিয়তমাকে খোঁজছিলেন মানুষের ভিড়ে, কখনো আবার লাশের সারিতে। বাম হাতে একটা কাটা দাগ ছিল শেলীর। গলায় ছিল সোনার চেইন। চেইনটা খুব পরিচিত সৈকতের। এটা দেখে শেলীর অঙ্গার হয়ে যাওয়া নিথর দেহ শনাক্ত করেন তিনি। রাত কেটে যায় বীভিষিকাময় ভবনের সামনে। ভয়াবহ সে আগুনের ঘটনায় ৫১ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়।
ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে সৈকত চৌধুরী বাসায় ফেরেন। শেলীর নম্বর থেকে আসা ক্ষুদে বার্তাগুলো দেখতে থাকেন। তিনদিন আগে সর্বশেষ ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন শেলী। ক্ষুদে বার্তাটি তার চোখে পড়েনি। বেখেয়ালীপনার কারণেই হয়তো। সেখানে শেলী লিখেছেন ‘মাফ করে দিও। আমি তোমার বইটা ধরেও দেখিনি। অভিমান আর ক্ষোভে। তুমি আমার সঙ্গে জেদ করে লেখক হয়েছো। বিখ্যাতও হয়েছো। আমি খুব আনন্দিত। ভুলটা বোঝতে পেরেছি। আমি আবার তোমার ভালোবাসার আঁচলে জড়াত চাই। তোমার সঙ্গেই সংসার গড়তে চাই। ঠাঁই দিবে তো? বিসিএসে চূড়ান্তভাবে টেকার পরপরই বিয়ে করে ফেলবো।’ এরই মধ্যে শেলীর মায়ের ফোন আসে তার মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কথা বলতে পারছিলেন না কন্যা হারা মা। নির্বাক সৈকত চৌধুরীও। ফোন কেটে দেয়ার পর শেলীর ক্ষুদে বার্তার উত্তর কী লিখবেন ভাবছিলেন। শুধু লিখলেন ‘হ্যাঁ’। কিন্তু এই বার্তা শেলী পাবে কী করে? তার মোবাইল তো পুড়ে গেছে- শেলীও তো অঙ্গার। এক টুকরো কাগজে সৈকত চৌধুরী লিখলেন ‘হ্যাঁ’। এবার মর্গে গিয়ে শৈলীর কফিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন সেই কাগজ। কাগজে লেখা শুধু ‘হ্যাঁ’। অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হলো কফিন। সৈকত চৌধুরী অপলক তাকিয়ে রইলেন অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে…।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই শেলীর প্রেমে পড়েন সৈকত। গভীর প্রেম। সৈকত চৌধুরী জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায় নিয়মিত গল্প লেখেন। সৈকতের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘ খাঁটো’। বইটি তাকে রাতারাতি পরিচিতি এনে দেয়। ‘খাঁটো’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেন আনিকা শৈলীকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন- ‘আমার ছন্দহীন একটি জীবনকে ছন্দময় করেছে, জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে সহযোগিতা করেছে- প্রিয়তমা আনিকা শেলীকে।’ সৈকত চৌধুরীর লেখালেখি মোটেও পছন্দের ছিল না শেলীর। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বহুবার মান অভিমান হয়েছে। এক পর্যায়ে সম্পর্ক ভেঙেও যায়। সৈকত চৌধুরী লেখালেখি ছাড়তে পারেননি। শেলীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তিনি লেখেন ‘খাঁটো’ উপন্যাস।
নীলক্ষেত এলাকার পুরনো বইয়ের দোকান থেকে প্রায় সময়ই প্রয়োজনীয় বই কিনে আনেন সৈকত। কখনো কখনো পল্টন এলাকায়ও যান। সত্যজিৎ রায়ের ‘অ্যাবস্ট্রাকশান’ নামের গল্পের বইটি কেনার জন্য সেদিন নীলক্ষেতের পরিমল বককর্ণারে পুরনো বইগুলো উল্টোচ্ছিলেন সৈকত চৌধুরী। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে নিজের লেখা ‘খাঁটো’ উপন্যাস। চমকে উঠেন সৈকত চৌধুরী। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকেন। বলপয়েন্টে নিজের হাতের লেখা ‘প্রিয়তমা, আনিকা শেলীকে। তোমাকে এখনো আপনজন ভাবি, স্বপ্ন দেখি-সংসার গড়ার স্বপ্ন। বইটা পড়লে খুশি হবো। -সৈকত চৌধুরী। কপাল ঘেমে উঠছে। হাত কাঁপছে। এই বই এখানে? বিড় বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করেন সৈকত। বছরখানেক আগে সুকৌশলে পুরান ঢাকার বাসায় গিয়ে বইটা তিনি শেলীর হাতে দিয়ে এসেছিলেন। সেই বই এখানে? বইটা কিনে নিলেন তিনি। আটশ টাকা মূল্য। তিনশ দিয়ে কিনলেন। পাশের একটি চা-স্টলে বসে সিগারেট ধরানোর সময় সৈকতের মনে হলো- আমার সঙ্গে বিশ্বনন্দিত আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ এর সঙ্গে দারুণ একটি মিল পেলাম। জর্জ বার্নার্ড শ এর জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করছিলেন চা-স্টলে বসে। জর্জ বার্নার্ড শ তার লেখা একটি নাটকের বই একবার প্রিয় এক অভিনেত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন ‘নাট্যকারের ভালোবাসাসহ- জর্জ বার্নার্ড শ।’ এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।
জর্জ বার্নার্ড শ’রও অভ্যাস ছিল পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় বই খুঁজে বের করে সেটা কিনে আনার। একদিন পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ। দুষ্প্রাপ্য কোনো বই খোঁজছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তার হাতে উঠে এলো সেই বই, যেটা তিনি প্রিয় অভিনেত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ’র বোঝতে আর বাকি রইলো না বইটি প্রিয় অভিনেত্রী বিক্রি করে দিয়েছেন। পুরনো দোকান থেকে নিজের লেখা নাটকের বইটি কিনে নিলেন জর্জ বার্নার্ড শ । বইটি আবার পাঠালেন প্রিয় অভিনেত্রীর কাছে। উপহার পেয়ে অভিনেত্রী এবার লজ্জা পান। কারণ, প্রথমবারের লেখার নিচেই জর্জ বার্নার্ড শ এবার লিখেছেন ‘আবার নতুন করে ভালোবাসা জানিয়ে’। জর্জ বার্নার্ড শ’র এই ঘটনা মনে করে সৈকত চৌধুরী খানিকটা হাসলেন। চা বিক্রেতা সৈকতের হাসির দৃশ্য দেখে ফেলেন। জানতে চান- স্যার, আফনে হাসলে ক্যান? আমার লুঙ্গিটা ছেঁড়া দেইখ্যা? সৈকত সাহেব তো হতবম্ব ! চা বিক্রেতার লুঙ্গির দিকে তো দৃষ্টিই পড়েনি। বললেন, আরে না! আমি তো আপনার লুঙ্গির দিকে তাকাই-ই নি। তাকালেই কি ছেঁড়া লুঙ্গি দেখে আমি হাসবো! এমনিতেই হাসলাম। একটা কথা মনে পড়েছে তো !
সৈকত চৌধুরী এবার হাঁটতে থাকলেন। নানা রকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মানে শেলী বইটি খুলেওনি? উপহার দেয়ার পরদিনই হয়তো ফেরিওয়ালার কাছে পুরনো পত্রিকার সাথে হয়তো বিক্রি করে ফেলেছে। বইটা তো অন্তত খুলে দেখা উচিৎ ছিল! ভাঁজও খুলেনি- সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কী করা যায়! জর্জ বার্নার্ড শ’র মতো আবার কি বইটি শেলীর কাছে পাঠাবেন? নাকি অপমান বুকে জিইয়েই রাখবেন? এমন সব চিন্তা করতে করতে আজিমপুর বাসায় পৌঁছে যান সৈকত চৌধুরী। লেখালেখির কারণে শেলীর সাথে সম্পর্কই টেকেনি। সেই শেলীকে বই দিয়ে আসা এক ধরণে অপরাধ হয়েছিল, আবার পাঠাবো? প্রশ্ন করে নিজেকে। উত্তর আসে- ‘না’।
দুপুরের ঠিক পর বাসায় পৌঁছে ফ্যানটা অন করে বিছানায় গা এলিয়ে ক্লান্ত সৈকত চৌধুরী শুয়ে পড়েন। বের হওয়ার সময় টিভিটা অব করতে খেয়াল ছিল না। শুয়েই টিভির দিকে চোখ রাখেন সৈকত সাহেব। টিভিতে স্ক্রল যাচ্ছে ‘পুরান ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড : বহু হতাহতের আশঙ্কা’। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে শেলীর নাম্বারে কল করলেন। ফোন বন্ধ। আনিকা শেলী পুরানা ঢাকাতেই জরাজীর্ণ একটি ভবনে থাকেন। বাবা মারা গেছেন দশ বারো বছর আগে। মা আর ভাই থাকেন নওগাঁর রানীনগরের গ্রামের বাড়িত। একমাত্র ছোট ভাই সেলিম সবজির ব্যবসা করে শেলীর পড়াশোনার খবর দেন। পড়াশোনা শেষ হয়েছে কেবল। একটি চাকরি জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন শেলী। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভাইভার জন্য অপেক্ষা। তার সব কিছুই ভালো লাগে- শুধু লেখালেখি ছাড়া। ছোট বেলায় স্কুলে এক শিক্ষক তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছেন- লেখকরা ছন্নছাড়া হয়, তারা বেখেয়ালি হয়, জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের, লেখকরা সংসারী হয় না। সংসার গড়লেও টেকাতে পারে না- এ সব নানা নেগেটিভ ধারণা। শিক্ষকের সেই কথা এখনো মনে আছে শেলীর। এ কারণে ভালোবাসার মানুষ লেখক হবে এবং তার সঙ্গে সংসার হবে এমনটা শেলী কখনো চায়নি। তার চাওয়াই পূরণ হয়েছে। সৈকত চৌধুরীর সঙ্গে তার ছেদ ঘটে।
চৌধুরী সাহেব টিভি চ্যানেলে লাইভে দেখছিলেন সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। বারবার শিউরে উঠছিলেন। শেলী জীর্ণ ভবনটিতে বাস করতেন সেই ভবনেই আগুন। তার মোবাইলটাও বন্ধ। ওই অবস্থাতেই দ্রুত বের হয়ে পুরান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন সৈকত। ভবনের সামনে হাজার হাজার মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আগুন নেভাতে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। স্বজনদের খোঁজছেন কেউ কেউ। সময় যতোই যাচ্ছে ততোই সেখানকার আকাশ ভারি হচ্ছে। পোড়া মানুষের গন্ধ বেরোচ্ছে। সৈকত খোঁজছেন তার প্রিয়তমা শেলীকে। অভিমান বুকে জমা থাকলেও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। রাত ৩টা দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা একটার পর একটা লাশ বের করে আনতে থাকেন। ইতোমধ্যে শেলীর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন করে ওই ভবনে আগুন লাগার খবরটি জানিয়ে দেন। নওগাঁ থেকে শেলীর মা আর ভাই ঢাকা আসার জন্য গাড়িতে চড়েছেন। শেলীর সঙ্গে থাকতো তার এক প্রতিবেশী। নাম রুবী আক্তার। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। রুমী টেলিফোন করে তার ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে শেলী পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আগুন লাগার সময় রুবী বাইরে ছিলেন বলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। সৈকত চৌধুরী খোঁজছেন শেলীকে।এরই মধ্যে রুমী তাকেও ফোন দিয়ে জানায় শেলী আর নেই। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশগুলো বাইরে এনে রাখা হচ্ছে। সারিবদ্ধ লাশের দিকে তাকানো যায় না। তবুও সৈকত প্রিয়তমাকে খোঁজছিলেন মানুষের ভিড়ে, কখনো আবার লাশের সারিতে। বাম হাতে একটা কাটা দাগ ছিল শেলীর। গলায় ছিল সোনার চেইন। চেইনটা খুব পরিচিত সৈকতের। এটা দেখে শেলীর অঙ্গার হয়ে যাওয়া নিথর দেহ শনাক্ত করেন তিনি। রাত কেটে যায় বীভিষিকাময় ভবনের সামনে। ভয়াবহ সে আগুনের ঘটনায় ৫১ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়।
ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে সৈকত চৌধুরী বাসায় ফেরেন। শেলীর নম্বর থেকে আসা ক্ষুদে বার্তাগুলো দেখতে থাকেন। তিনদিন আগে সর্বশেষ ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন শেলী। ক্ষুদে বার্তাটি তার চোখে পড়েনি। বেখেয়ালীপনার কারণেই হয়তো। সেখানে শেলী লিখেছেন ‘মাফ করে দিও। আমি তোমার বইটা ধরেও দেখিনি। অভিমান আর ক্ষোভে। তুমি আমার সঙ্গে জেদ করে লেখক হয়েছো। বিখ্যাতও হয়েছো। আমি খুব আনন্দিত। ভুলটা বোঝতে পেরেছি। আমি আবার তোমার ভালোবাসার আঁচলে জড়াত চাই। তোমার সঙ্গেই সংসার গড়তে চাই। ঠাঁই দিবে তো? বিসিএসে চূড়ান্তভাবে টেকার পরপরই বিয়ে করে ফেলবো।’ এরই মধ্যে শেলীর মায়ের ফোন আসে তার মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কথা বলতে পারছিলেন না কন্যা হারা মা। নির্বাক সৈকত চৌধুরীও। ফোন কেটে দেয়ার পর শেলীর ক্ষুদে বার্তার উত্তর কী লিখবেন ভাবছিলেন। শুধু লিখলেন ‘হ্যাঁ’। কিন্তু এই বার্তা শেলী পাবে কী করে? তার মোবাইল তো পুড়ে গেছে- শেলীও তো অঙ্গার। এক টুকরো কাগজে সৈকত চৌধুরী লিখলেন ‘হ্যাঁ’। এবার মর্গে গিয়ে শৈলীর কফিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন সেই কাগজ। কাগজে লেখা শুধু ‘হ্যাঁ’। অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হলো কফিন। সৈকত চৌধুরী অপলক তাকিয়ে রইলেন অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে…।
No comments