মক্কা বিজয়: বিশ্বনবীর (সা) দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও শান্তিকামীতার সাক্ষ্য
২০ রমজান মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক বার্ষিকী। অষ্টম
হিজরির এই দিনে প্রায় বিনা রক্তপাতে বিশ্বনবী (সা)’র নেতৃত্বে মুসলমানরা জয়
করেন পবিত্র মক্কা।
মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসের এক অতি
আকর্ষণীয় অধ্যায়। আবার একই সাথে তা শিক্ষণীয় এবং তা মহানবী (সা.)-এর পবিত্র
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো এবং তাঁর মহান চরিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইতিহাসের এ অধ্যায়ে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যে
সব বিষয় সম্পর্কে স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেসবের প্রতি মহানবী (সা.) এবং
তাঁর অনুসারীগণের বিশ্বস্ততা স্পষ্ট হয়ে যায়, আর এর বিপরীতে হুদায়বিয়ার
সন্ধিপত্রের ধারাগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কুরাইশ বংশীয় মুশরিকদের কপটতা ও
বিশ্বাসঘাতকতাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
ইতিহাসের এ অধ্যায় অধ্যয়ন ও মূল্যায়ন করলে
শত্রুর সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি জয় করার ক্ষেত্রে মহানবীর
দক্ষতা, পরিকল্পনা,কর্মকৌশল এবং বিজ্ঞজনোচিত রাজনীতি প্রমাণিত হয়ে যায়। এমন
প্রতীয়মান হয় যে, এ পবিত্র ব্যক্তিত্ব তাঁর জীবনের একটি অংশ এক
গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন এবং একজন চৌকস সমরাধিনায়কের
মতো বিজয়-পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করেছেন,যাতে মুসলমানরা অনায়াসে সর্ববৃহৎ
বিজয় অর্জন করেছিল।
অবশেষে এ অধ্যায়ে রক্তপিপাসু শত্রুদের
জীবন ও ধন-সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে মহানবীর মানব দরদী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়।
এ মহামানব বিশেষ বিচক্ষতা দিয়ে এ মহান বিজয় অর্জিত হবার পর কুরাইশদের
যাবতীয় অপরাধ উপেক্ষা করেন এবং সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন।
মক্কা বিজয়ের পটভূমি
হিজরতের ষষ্ঠ বর্ষে কুরাইশ নেতৃবর্গ ও
মহানবী (সা.)-এর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির তৃতীয় ধারা
মোতাবেক মুসলমান ও কুরাইশরা যে কোন গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তি করতে পারবে। এ
ধারার ভিত্তিতে খুযাআহ্ গোত্র মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়
এবং মহানবী তাদের জীবন, ধন-সম্পদ এবং ভূ-খণ্ড রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আর বনী কিনানাহ্ গোত্র, যারা খুযাআহ্ গোত্রের পুরানো শত্রু এবং প্রতিবেশী
ছিল, কুরাইশ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। দশ-সালা ওই চুক্তি আরব
উপদ্বীপের সমুদয় অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা ও সর্বসাধারণের শান্তি
সংরক্ষণকারী ছিল।
এ চুক্তি মোতাবেক উভয় পক্ষ (কুরাইশ ও
মুসলমানরা) একে অপরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করবে না অথবা তাদের নিজ নিজ
মিত্রকে প্রতিপক্ষের মিত্রদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে না এবং উস্কানী দেবে
না বলে স্থির হয়। এ চুক্তির পর থেকে দু’ বছর গত হয় এবং উভয় পক্ষ নিরাপত্তার
সাথে ও সুখ-শান্তিতে বসবাস করছিলেন। এর ফলে মুসলমানগণ হিজরতের সপ্তম বর্ষে
পূর্ণ স্বাধীনতাসহ পবিত্র বাইতুল্লাহ্ শরীফ যিয়ারতের জন্য পবিত্র মক্কা
নগরী যান এবং হাজার হাজার মূর্তিপূজারী মুশরিক শত্রুর চোখের সামনে নিজেদের
ইসলামী দায়িত্ব ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আঞ্জাম দেন ।
অসহায় মুসলিম প্রচারকগণকে রোম সাম্রাজ্যের
যে সব চর কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করেছিল, তাদেরকে দমন ও কঠোর শাস্তি প্রদান
করার জন্য হিজরতের অষ্টম বর্ষের জমাদিউল আওয়াল মাসে মহানবী তিন জন
ঊর্দ্ধতন মুসলিম সমরাধিনায়কের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী
শামের সীমান্ত অঞ্চলগুলোয় পাঠান। মুসলিম সেনাবাহিনী এ সমরাভিযান থেকে
নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছিল এবং মাত্র তিন জন অধিনায়ক ও কয়েকজন সৈন্য ছাড়া এ
বাহিনীর আর কোন ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে নি। তবে ইসলামের মুজাহিদদের কাছ
থেকে যে সামরিক সাফল্যের আশা করা হয়েছিল, তা অর্জন ছাড়াই এ সেনাদল মদীনায়
ফিরে আসে এবং তাদের এ অভিযানের বেশিরভাগই ‘আঘাত কর ও পালাও’ এ কৌশল-সদৃশ
ছিল। কুরাইশ গোত্রপতিদের মাঝে এ সংবাদ প্রচারিত হবার ফলে তাদের সাহস বেড়ে
যায়। তারা ভাবল, ইসলামের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে গেছে এবং মুসলমানরা লড়াই
করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে তারা, বিরাজমান শান্ত পরিবেশ নষ্ট করার
সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে তারা বনী বকর গোত্রের মাঝে অস্ত্র বিতরণ করে এবং
তাদেরকে মুসলমানদের মিত্র খুযাআহ্ গোত্রের ওপর রাতের আঁধারে আক্রমণ করে
তাদের একাংশকে হত্যা ও আরেক অংশকে বন্দী করার জন্য প্ররোচিত করে। এমনকি
তারা এতটুকুতেও সন্তুষ্ট থাকে নি। একদল কুরাইশ রাতের বেলা খুযাআহ্ গোত্রের
বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আর এভাবে তারা হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ
করে দু’ বছর ধরে বিরাজমান শান্ত অবস্থাকে যুদ্ধ ও রক্তপাতে রূপান্তরিত
করেছিল।
রাতের বেলা অতর্কিত এ হামলায় খুযাআহ্
গোত্রের ঘুমন্ত বা ইবাদত-বন্দেগীরত একাংশ নিহত এবং আরেক অংশ বন্দী
হয়েছিলেন। খুযাআহ্ গোত্রের একদল লোক নিজেদের ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে আরবদের কাছে
নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে বিবেচিত পবিত্র মক্কা নগরীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
পবিত্র মক্কায় আসা শরণার্থীরা বুদাইল ইবনে ওয়ারকা র ঘরে গিয়ে নিজ গোত্রের
হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন।
খুযাআহ্ গোত্রের অত্যাচারিত ব্যক্তিরা
তাদের অত্যাচারিত হওয়ার বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর গোচরীভূত করার জন্য নিজেদের
গোত্রপতি আমর ইবনে সালিমকে মদীনায় মহানবীর কাছে পাঠান। তিনি মদীনায় পৌঁছে
সরাসরি মসজিদে নববীতে চলে যান এবং জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক
স্বরে খুযাআহ্ গোত্রের অত্যাচারিত অবস্থা ও সাহায্য প্রার্থনার কথা ব্যক্ত
করে এমন একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং মহানবী (সা.) খুযাআহ্ গোত্রের সাথে যে
মৈত্রীচুক্তি করেছিলেন তাঁকে সেই চুক্তির মর্যাদা রক্ষার দোহাই দেন এবং
মযলুমদের সাহায্য ও তাদের খুনের প্রতিশোধ নেয়ার আহবান জানান।
তিনি কবিতাটির শেষে বলেছিলেন :
هم بیّتونا بالوتیر هجّداً و قتلونا رکّعاً و سجّداً
“হে নবী! তারা মধ্যরাতে যখন আমাদের একাংশ
ওয়াতীর জলাশয়ের কাছে নিদ্রায় আচ্ছন্ন এবং আরেক অংশ রুকূ-সিজদাহরত ছিল, তখন এ
অসহায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছে।”
এ কবি মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি এবং যুদ্ধ
করার সাহস ও মনোবৃত্তি জাগ্রত করার জন্য বারবার বলছিলেন :قُتلنا و قد
أسلمنا “ আমরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি, তখন (ঈমানের অবস্থায়) গণহত্যার
শিকার হয়েছি।”
খুযাআহ্ গোত্রপতির এ ধরনের আবেগধর্মী,
মর্মস্পর্শী ও উদ্দীপনা সঞ্চারী কবিতা তার প্রভাব রেখেছিল। মহানবী (সা.)
বিশাল মুসলিম জনতার সামনে আমরের দিকে মুখ তুলে বলেছিলেন :“ হে আমর ইবনে
সালিম! তোমাকে আমি সাহায্য করব।” এ অকাট্য নিশ্চয়তামূলক প্রতিশ্রুতি আমরকে
অভিনব প্রশান্তি দিয়েছিল। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, মহানবী শীঘ্রই এ ঘটনার
কারণ কুরাইশদের থেকে খুযাআহ্ গোত্রের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। তবে তিনি কখনোই
ভাবতে পারেন নি, পবিত্র মক্কা বিজয় ও কুরাইশদের অত্যাচারী শাসনের পতনের
মধ্য দিয়ে এ কাজের পরিসমাপ্তি হবে।
অল্প সময়ের মধ্যে সাহায্য প্রার্থনা করার
জন্য বুদাইল ইবনে ওযারকা খুযাআহ্ গোত্রের এক দল লোককে সাথে নিয়ে মদীনায়
মহানবীর কাছে যান এবং তাঁর কাছে খুযাআহ্ গোত্রের তরুণ-যুবকদের হত্যা করার
ব্যাপারে বনী বাকর গোত্রের সাথে কুরাইশদের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন।
অতঃপর তিনি মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যান।
মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বিগ্ন কুরাইশরা
কুরাইশরা তাদের এ অন্যায়ের ব্যাপারে খুব
অনুতপ্ত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারে যে, তারা হুদায়বিয়ার
সন্ধিচুক্তির বিপক্ষে একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে এবং এভাবে তারা এ চুক্তি
ভঙ্গ করেছে। এ কারণে তারা মহানবী (সা.)-এর ক্রোধ প্রশমন এবং দশ-সালা
চুক্তিটির অনুমোদন ও দৃঢ়ীকরণ এবং আরেকটি বর্ণনামতে নবায়ন করার জন্য নিজেদের
নেতা আবু সুফিয়ানকে মদীনায় প্রেরণ করে, যাতে সে যে কোনভাবে তাদের অন্যায় ও
আগ্রাসনের বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। সে মদীনার পথ ধরে যাত্রা করে
এবং‘ আসফান’ নামক স্থানে মক্কাস্থ খুযাআহ্ গোত্রের নেতা বুদাইলের সাথে তার
দেখা হয়। সে তাঁর কাছে জানতে চায়, তিনি মদীনায় ছিলেন কি না এবং সাম্প্রতিক
ঘটনাবলীর কথা মহানবীর কাছে উত্থাপন করেছেন কি না? তিনি জবাব দিয়েছিলেন,
তিনি নিজ গোত্রের লোকদের সান্ত্বনা দেবার জন্য তাদের কাছে গিয়েছিলেন এবং
কখনোই তিনি মদীনা গমন করেন নি। তিনি এ কথা বলেই পবিত্র মক্কার দিকে অগ্রসর
হন। কিন্তু আবু সুফিয়ান তাঁর উটের মলের মধ্যে মদীনার খেজুরের আঁটি দেখতে
পায় এবং তা থেকে নিশ্চিত হয়ে যায়, বুদাইল মহানবীর সাথে দেখা করতে
গিয়েছিলেন।
আবু সুফিয়ান মদীনায় প্রবেশ করে সরাসরি নিজ
কন্যা উম্মে হাবীবার কাছে যায়। উল্লেখ্য, উম্মে হাবীবাহ্ মহানবী (সা.)-এর
স্ত্রী ছিলেন। সেখানে সে মহানবীর তোষকের উপর বসতে চাইলে তার কন্যা তৎক্ষণাৎ
তা গুটিয়ে ফেলেন। আবু সুফিয়ান তার মেয়েকে বলেছিল :“ তুমি কি বিছানাকে
তোমার পিতার অনুপযুক্ত মনে করেছ, নাকি তোমার পিতাকে এর অনুপযুক্ত ভেবেছ?”
তখন পিতার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন :“ এ বিছানা মহানবী (সা.)-এর, আর
তুমি একজন কাফির। তাই আমি চাই না, একজন অপবিত্র-কাফির ব্যক্তি মহানবীর
পবিত্র বিছানার উপর বসুক।”
এ উক্তি ঐ ব্যক্তির কন্যার যে পুরো বিশটি
বছর ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অনেকগুলো বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অনেক
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এ মহীয়সী নারী (উম্মে হাবীবাহ্) ইসলামের ক্রোড়ে
এবং তাওহীদী আদর্শের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন বলে তাঁর মধ্যে ধর্মের
প্রতি ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে, অভ্যন্তরীণ প্রবণতা সত্বেও তিনি
পিতা-সন্তানের মধ্যেকার আবেগকে তাঁর ধর্মীয় আবেগের কাছে অবনত করিয়েছিলেন।
আবু সুফিয়ান মদীনায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল
কন্যার আচরণে খুবই মর্মাহত হয়, আর এ কারণেই সে তার বাসগৃহ ত্যাগ করে
মহানবীর কাছে উপস্থিত হয়। সে মহানবীর কাছে হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি নবায়ন ও
দৃঢ়ীকরণের বিষয়টি উত্থাপন করে। কিন্তু মহানবী কোন কথাই বললেন না। তাঁর
নীরবতা প্রমাণ করে, তিনি আবু সুফিয়ানের কথার কোন গুরুত্ব দেন নি।
আবু সুফিয়ান মহানবীর কয়েকজন সাহাবীর সাথে
যোগাযোগ করে যাতে তাঁদের মাধ্যমে আবার মহানবীর সাথে যোগাযোগ করে নিজ
উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়। কিন্তু এসব যোগাযোগ তার কোন উপকারেই আসে নি।
অবশেষে সে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর ঘরে গিয়ে তাঁকে বলেছিল :“ এ
নগরীতে আপনারাই আমার সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়। কারণ আমার সাথে আপনাদের ঘনিষ্ঠ
রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। তাই আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি যাতে আপনি
মহানবীর কাছে আমার ব্যাপারে সুপারিশ করেন।” হযরত আলী (আ.) তার এ কথার জবাবে
বললেন :“মহানবী যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সে ব্যাপারে আমরা কখনোই
হস্তক্ষেপ করি না।” সে হযরত আলীর এ কথা শুনে হতাশ হয়ে গেল। হঠাৎ সে আলী
(আ.)-এর সহধর্মিনী মহানবীর কন্যা হযরত যাহরা (আ.)-এর দিকে তাকালো। তখন তাঁর
নয়নের দ্যূতি হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর সামনে খেলায় ব্যস্ত
ছিলেন। সে হযরত ফাতিমার আবেগকে নাড়া দেয়ার জন্য বলল :“ হে নবীকন্যা! আপনার
সন্তানদেরকে মক্কার অধিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার আদেশ দেয়া আপনার পক্ষে কি
সম্ভব? আর এর ফলে যতদিন এ পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, ততদিন তাঁরা আরবদের নেতা
থাকবেন।” হযরত যাহরা আবু সুফিয়ানের অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই
তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন :“এ কাজ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট
এবং বর্তমানে আমার সন্তানদের এমন অবস্থাও নেই।” সে আবার হযরত আলীর দিকে
তাকিয়ে বলল :“ হে আলী! আমাকে এ ব্যাপারে কিছু দিক নিদের্শনা দান করুন।”
হযরত আলী তাকে বললেন :“ আমার চোখে কেবল এ পথ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর
হচ্ছে না যে, তুমি মসজিদে গিয়ে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণা দেবে।”
আবু সুফিয়ান বলল :“ আমি যদি এ কাজ করি, তা
হলে কি কোন উপকার হবে?” তিনি বললেন :“ খুব একটা উপকার হবে না। তবে এ কাজ
করা ছাড়া আর কিছুই আমার দৃষ্টিতে আসছে না।” আবু সুফিয়ান আমীরুল মুমিনীন আলী
(আ.)-এর সত্যবাদিতা, সততা ও নিষ্ঠার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল বিধায় সে তাঁর
প্রস্তাব মসজিদে নববীতে গিয়ে বাস্তবায়ন করল। এরপর সে মসজিদ থেকে বের হয়ে
এসে উটের পিঠে আরোহণ করে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। মক্কার কুরাইশ নেতাদের
কাছে নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়ার মাঝে হযরত আলীর প্রস্তাবের
ব্যাপারে কথা উঠলে সে বলল :“আমি আলীর প্রস্তাব মোতাবেক মসজিদে গিয়েছি এবং
মুসলমানদেরকে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছি।”উপস্থিত ব্যক্তিরা তাকে জিজ্ঞেস
করল :“ মুহাম্মদ কি তোমার এ কাজ অনুমোদন করেছে?” সে বলল :“ না।” তারা বলল
:“ আলীর প্রস্তাব ঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কারণ মহানবী তোমার আশ্রয়
দানের ঘোষণার প্রতি মোটেই ভ্রূক্ষেপ করে নি। আর একতরফা চুক্তির কোন কল্যাণ
নেই।” এরপর তারা মুসলমানদের ক্রোধ প্রশমনের অন্য পথ খুঁজে বের করার জন্য
অনেকগুলো পরামর্শসভার আয়োজন করেছিল।
এক গুপ্তচর আটক
মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস থেকে এ
পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যায় যে, তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন যাতে শত্রু সত্যের
সামনে আত্মসমর্পণ করে। আর তিনি কখনোই শত্রুর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ ও
তাকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় পোষণ করতেন না।
যে সব যুদ্ধে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করতেন,
সেসবের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বা যখন তিনি কোন সেনাদলকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণ
করতেন, তখন লক্ষ্য থাকতো শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা, শত্রুপক্ষের সৈন্য
সমাবেশ ও সংহতি বিনষ্ট করা এবং তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া। তিনি ভালোভাবেই
জানতেন যে, ইসলাম ধর্ম প্রচারের পথে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা হলে
মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে ইসলাম ধর্মের শক্তিশালী যুক্তি তার প্রভাব ফেলবেই
এবং এ লোকগুলো- যাদের সামরিক সমাবেশ ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে
বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল,- তাদেরকে যদি নিরস্ত্র করা হয় এবং তারা যুদ্ধরত
অবস্থার অবসান ঘটায় ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করার
চিন্তা মনের মধ্যে লালন না করে, তা হলে তারা নিজেদের অজান্তেই মানব প্রকৃতি
বা ফিতরাতের দিকনির্দেশনার দ্বারা তাওহীদবাদী ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হবে ও
ইসলামের সাহায্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
এ কারণেই অনেক পরাজিত জাতি যারা ইসলামের
সামরিক শক্তির কাছে পরাজয় বরণ করেছে এবং এরপর বিশৃঙ্খল-মুক্ত পরিবেশে
ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছে, তারাই দীন
ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং একনিষ্ঠভাবে এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টার ইবাদতের
ধর্ম প্রসার ও প্রচারকাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু মক্কা বিজয়েও এ
সত্য পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। মহানবী (সা.) জানতেন, যদি
তিনি পবিত্র মক্কা জয় করেন এবং শত্রুদের অস্ত্রমুক্ত করে পরিবেশকে মুক্ত ও
শান্ত করেন, তা হলে অল্প দিনের মধ্যেই বর্তমানে ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর শত্রু
এ দলটি সাহায্যকারী ও ইসলাম ধর্মের পথে মুজাহিদ হয়ে যাবে। অতএব, শত্রুর
ওপর অবশ্যই বিজয়ী হতে হবে এবং তাকে পরাভূত করতেই হবে। তবে কখনোই তাদেরকে
ধ্বংস করা বাঞ্ছনীয় নয়, আর যতদূর সম্ভব রক্তপাত এড়ানো উচিত। এ পবিত্র
লক্ষ্য (বিনা রক্তপাতে শত্রুকে পরাজিত করা) অর্জনের জন্য শত্রুকে
কিংকতর্ব্যবিমূঢ় করার মূলনীতি ব্যবহার করা উচিত। নিজেদের রক্ষা করার জন্য
প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনী সংগ্রহ করার চিন্তা-ভাবনা করার আগেই শত্রুপক্ষকে
অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে নিরস্ত্র করতে হবে।
শত্রুপক্ষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করার মূলনীতি
তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন ইসলামের যাবতীয় সামরিক রহস্য ও গোপনীয়তা
সংরক্ষিত থাকবে এবং তা শত্রুর হস্তগত হবে না। মূলনীতিগতভাবে শত্রুপক্ষ
জানবে না, মহানবী তাদের ওপর আক্রমণ করবেন কি না। আর যদি আক্রমণের
চিন্তা-ভাবনা করা হয়ে থাকে, তা হলে তারা ঘূণাক্ষরেও অভিযান পরিচালনা করার
উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর যাত্রাকাল ও গতিপথ সম্পর্কে যেন অবগত না হয়। এর
অন্যথা হলে এ সামরিক মূলনীতি বাস্তবায়িত হবে না।
পবিত্র মক্কা নগরী বিজয় শিরক ও
মূর্তিপূজার সবচেয়ে সুরক্ষিত ও মজবুত দুর্গের পতন এবং কুরাইশদের যালিম
প্রশাসন, যা ছিল তাওহীদবাদী ধর্মের প্রচার ও প্রসারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা,
তা উচ্ছেদ করার জন্য মহানবী (সা.) রণপ্রস্ততির কথা ঘোষণা করেন। তিনি মহান
আল্লাহর কাছে দুআ করেন, কুরাইশদের গুপ্তচররা যেন মুসলিম সেনাবাহিনীর যাত্রা
ও গতিবিধি সম্পর্কে অবগত না হয়। মুহররম মাসের শুরুতেই মদীনা নগরীর
আশে-পাশের অঞ্চলগুলো থেকে মদীনায় এক বিশাল সেনাসমাবেশ করা হয় যার বিশেষ
বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা লিখেছেন :
তিন শ’ অশ্ব ও তিন পতাকা সমেত সাত শ’
মুহাজির যোদ্ধা, সাত শ’ অশ্ব ও অনেক পতাকা সমেত চার হাজার আনসার যোদ্ধা, এক
শ’ অশ্ব,এক শ’ বর্ম ও তিন পতাকা সহ বনী মাযীনাহ্ গোত্র থেকে এক হাজার
যোদ্ধা, বনী আসলাম গোত্র থেকে ত্রিশটি অশ্ব ও দু’ টি পতাকা সহ চার শ’
যোদ্ধা; জুহাইনা গোত্র থেকে পঞ্চাশটি অশ্ব ও চারটি পতাকা সহ আট শ’ যোদ্ধা,
বনী কা’ ব থেকে তিনটি পতাকা সহ পাঁচ শ’ যোদ্ধা;সেনাদলের অবশিষ্টাংশ গিফার,
আমাজা ও বনী সালীম গোত্রের যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত।
ইবনে হিশাম বলেন :“ মুসলিম বাহিনীর
সেনাসংখ্যা দশ হাজারে উপনীত হয়।” এরপর তিনি আরো বলেন :“ বনি সালীম গোত্র
থেকে সাত শ’এবং আরেকটি বর্ণনানুসারে এক হাজার যোদ্ধা, বনী গিফার গোত্র থেকে
চার শ’ যোদ্ধা, আসলাম গোত্র থেকে চার শ’ যোদ্ধা, মাযীনাহ্ গোত্র থেকে এক
হাজার তিন শ’ যোদ্ধা এবং বাকী অংশ মুহাজির, আনসার ও তাঁদের মিত্রগণ এবং বনী
তামীম, কাইস ও আসাদ গোত্র থেকে কতিপয় লোকের সমন্বয়ে গঠিত।”
এ অভিযান বাস্তবায়িত করার জন্য পবিত্র
মক্কা অভিমুখী সকল সড়কপথ ইসলামী হুকুমতের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণের
(সার্বক্ষণিক) নযরে রাখা হয়েছিল এবং শক্তভাবে সকল যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা
হচ্ছিল। ইসলামী সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করার প্রাক মুহূর্তে হযরত জিবরীল
(আ.) এসে মহানবী (সা.)-কে জানালেন, মুসলমানদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত এক
সরলমনা লোক কুরাইশদের কাছে চিঠি লিখেছে এবং‘ সারাহ্’নামের এক মহিলার সাথে
চুক্তি করেছে যে, কিছু অর্থ নিয়ে সে তার চিঠিটা কুরাইশদের কাছে পৌঁছে
দেবে। আর সে ঐ চিঠিতে মক্কা নগরীর ওপর মুসলমানদের অত্যাসন্ন আক্রমণ চালানোর
কথাও ফাঁস করে দিয়েছিল। সারাহ্ মক্কার গায়িকা ছিল এবং সে কখনো কখনো
কুরাইশদের শোকানুষ্ঠানগুলোতে শোকগাঁথাও গাইত। বদর যুদ্ধের পরে মক্কায় তার
কাজের প্রসার ও চাকচিক্য কমে গিয়েছিল। কারণ বদর যুদ্ধে কতিপয় কুরাইশ নেতা
নিহত হয়েছিল এবং মক্কা নগরী জুড়ে তখন শোক ও দুঃখের মাতম চলছিল। এ কারণেই
মক্কায় তখন গান-বাজনা ও আমোদ-প্রমোদের আসর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশদের
ক্রোধ ও শত্রুতার আগুন প্রজ্বলিত রাখতে এবং বদর যুদ্ধে নিহতদের প্রতিশোধ
গ্রহণের অনুভূতি জনগণের মধ্য থেকে বিদূরিত না হওয়ার লক্ষ্যে শোকগাঁথা গাওয়া
সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ কারণেই বদর যুদ্ধের দু’বছর পর সে মদীনায়
আসে। মহানবী (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন :“ তুমি কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করেছ?” সে বলেছিল :“ না।” মহানবী তখন বলেছিলেন :“তা হলে তুমি এখানে কেন
এসেছ?” সে উত্তরে বলেছিল :“ কুরাইশ আমার গোত্র ও বংশ। তাদের একদল নিহত
হয়েছে এবং আরেকদল মদীনায় হিজরত করেছে। বদর যুদ্ধের পরে আমার পেশার পসার ও
চাকচিক্য হারিয়ে গেছে। তাই আমি অভাবগ্রস্ত হয়ে ও প্রয়োজনের তাকীদেই এখানে
এসেছি।” মহানবী তাকে পর্যাপ্ত পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য-দ্রব্য দেয়ার জন্য
তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন।
সারাহ্ মহানবীর কাছ থেকে আনুকূল্য পাওয়া
সত্বেও হাতিব ইবনে আবী বালতাআর কাছ থেকে মাত্র দশ দীনার নিয়ে ইসলাম ও
মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ভার গ্রহণ করে এবং
মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের প্রস্ততি গ্রহণের কথা ফাঁস করা তার পত্র কুরাইশদের
কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
মহানবী (সা.) তাঁর তিন বীরকে ডেকে নিয়ে
তাঁদের দায়িত্ব দিলেন, তাঁরা মক্কার পথে অগ্রসর হয়ে এ গুপ্তচর নারীকে
যেখানে পাবেন, সেখানে গ্রেফতার করে তার থেকে ঐ চিঠিটা উদ্ধার করবেন। মহানবী
(সা.) এ অভিযানের দায়িত্ব হযরত আলী, যুবাইর ও মিকদাদকে প্রদান করেন।
তাঁরা‘ রাওযাতু খাখ্’ নামক স্থানে ঐ নারী গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে তাকে
তল্লাশী চালান। কিন্তু তাঁরা তার কাছে কিছুই পেলেন না। অন্যদিকে ঐ নারী
গুপ্তচরটি হাতিবের কাছ থেকে চিঠি নেয়ার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করে।
তখন হযরত আলী বললেন :“ মহান আল্লাহর শপথ!
মহানবী কখনোই মিথ্যা বলেন না। তুমি চিঠিটা দিয়ে দাও। নইলে আমরা যে কোনভাবেই
হোক, তোমার কাছ থেকে চিঠিটা উদ্ধার করব।”
সারাহ্ বুঝতে পারল, আলী এমন সৈনিক যিনি
মহানবীর আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না। এ কারণেই সে
হযরত আলীকে বলল : “ একটু দূরে যান।” এরপর সে তার চুলের দীর্ঘ বেনীর ভাঁজের
ভেতর থেকে চিঠি বের করে হযরত আলীর কাছে হস্তান্তর করে।
দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন
মুসলমান, যে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের ক্রান্তিকালে তাদের সাহায্যার্থে
দ্রুত ছুটে যেত, সে এ ধরনের দুষ্কর্মে হাত দিয়েছে বিধায় মহানবী ভীষণ
অসন্তষ্ট ও দুঃখিত হয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি হাতিবকে ডেকে কুরাইশদের এ ধরনের
তথ্য প্রদানের ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইলেন। সে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের
নামে শপথ করে বলল :“ আমার ঈমানে সামান্য পরিমাণ দ্বিধা-সংশয় প্রবেশ করে নি।
তবে মহানবী অবগত আছেন, আমি মদীনায় একাকী বসবাস করছি এবং আমার
সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনরা কুরাইশদের চাপ ও নির্যাতনের মধ্যে মক্কায়
জীবন-যাপন করছে। আমার এ সংবাদ দেয়ার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কুরাইশরা কিছুটা
হলেও যেন তাদের থেকে চাপ ও নির্যাতনের মাত্রা লাঘব করে।”
হাতিবের দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা
থেকে বোঝা যায়, মুসলমানদের গোপন বিষয়াদি সংক্রান্ত তথ্য অর্জন করার জন্য
কুরাইশ নেতারা মক্কায় তাদের (মুসলমানদের) আত্মীয়-স্বজনদের চাপের মুখে রাখত
এবং তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা লাঘব করার ব্যাপারে শর্তারোপ করে বলত যে,
তাদেরকে মদীনার মুসলমানদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত গোপন তথ্যাবলী সংগ্রহ করে
তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তার দুঃখ প্রকাশ,ক্ষমা প্রার্থনা ও কারণ
দর্শানো যথার্থ ও যুক্তিসংগত না হওয়া সত্বেও মহানবী তার অতীত কর্মকাণ্ড ও
অবদানসমূহের মতো কতকগুলো কল্যাণের কথা বিবেচনা করে তার অজুহাত গ্রহণ করেন
এবং তাকে মুক্ত করে দেন। এমনকি হযরত উমর মহানবী (সা.)-এর কাছে তার
শিরচ্ছেদের আবেদন জানালে মহানবী বলেছিলেন :“ সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে
এবং একদিন সে মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র ছিল। এ কারণেই আমি তাকে
ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি না ঘটার জন্য এ প্রসঙ্গে
কয়েক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল :
) یا أیّها الّذین آمنوا لا تتّخذوا عدوّى و عدوّکم أولیاء.(
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না...”
মহানবী (সা.)-এর যাত্রা
অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে
কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার মূলনীতি রক্ষার জন্য যাত্রার নির্দেশ জারীর
মুহূর্ত পর্যন্ত যাত্রা করার সময়কাল, গতিপথ এবং লক্ষ্যস্থল কারো কাছেই
স্পষ্ট ছিল না। হিজরতের অষ্টম বর্ষের ১০ রমযান যাত্রার নির্দেশ দেয়া হয়।
তবে মদীনার সকল মুসলমানকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
মহানবী (সা.) মদীনা থেকে বের হওয়ার দিন
আবু রহম গিফারী নামের এক লোককে মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে মদীনার
অদূরে মুসলিম সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করতে যান। তিনি মদীনা থেকে
একটু দূরে‘ কাদীদ্’ নামক স্থানে গিয়ে সামান্য পানি আনিয়ে রোযা ভঙ্গ করলেন
এবং সবাইকে রোযা ভাঙার আদেশ দিলেন। অনেকেই রোযা ভাঙলেন, কিন্তু অল্প সংখ্যক
ব্যক্তি মনে করল যে, তারা রোযা রেখে জিহাদ করলে তাদের পুরস্কার বা সওয়াব
আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে। সেজন্য তারা রোযা ভঙ্গ করা থেকে বিরত রইল।
এ সব সরলমনা লোক মোটেই ভাবে নি যে, যে নবী
রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, সেই নবী আবার তাদেরকে রোযা ভঙ্গ করার নির্দেশ
দিয়েছেন। তিনি যদি সৌভাগ্যের নেতা ও সত্যপথ প্রদর্শক হয়ে থাকেন, তা হলে
তিনি উভয় অবস্থা এবং উভয় নির্দেশ দানের ক্ষেত্রেও জনগণের সৌভাগ্যই কামনা
করবেন এবং তাঁর নির্দেশসমূহের মধ্যে কোন বৈষম্যের অস্তিত্ব নেই।
মহানবী (সা.) থেকে অগ্রগামী হওয়া অর্থাৎ
তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এ ধরনের মনোবৃত্তি আসলে সত্য থেকে এক ধরনের বিচ্যূতি
এবং তা আসলে মহানবী ও তাঁর শরীয়তের প্রতি এদের পূর্ণ বিশ্বাস না থাকার কথাই
ব্যক্ত করে। এ কারণেই পবিত্র কুরআন এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে ভর্ৎসনা ও
তিরস্কার করে বলেছে :
) یا أیّها الّذین آمنوا لا تُقدّموا بین یدى الله و رسوله(
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না।” (সূরা হুজুরাত : ১)
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব মক্কা নগরীতে
বসবাসরত মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তিনি গোপনে মহানবীকে কুরাইশদের
(গৃহীত) সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে অবহিত করতেন। তিনি খাইবর যুদ্ধের পর ইসলাম
ধর্মের ব্যাপারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন; তবে কুরাইশ নেতাদের সাথে তাঁর
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি সর্বশেষ মুসলিম পরিবার হিসেবে পবিত্র
মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। আর মহানবী (সা.) মক্কা
অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং
পথিমধ্যে জুহ্ফাহ্ অঞ্চলে মহানবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। মক্কা
বিজয়কালে আব্বাসের উপস্থিতি অনেক কল্যাণকর এবং উভয় পক্ষের জন্য উপকারী
হয়েছিল। আর তিনি না থাকলে হয় তো কুরাইশদের প্রতিরোধবিহীন অবস্থায় মক্কা
বিজয় সম্পন্ন হতো না।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে মহানবী (সা.)-এর
নির্দেশেই তাঁর মক্কা ত্যাগ করে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করা মোটেই অসম্ভব নয়
যাতে করে তিনি এর মধ্যে তাঁর শান্তিকামী ও মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করতে
সক্ষম হন।
ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা প্রদর্শন
মহানবী (সা)-এর উজ্জ্বল জীবন-ইতিহাস, তাঁর
সুমহান নৈতিক চরিত্র ও উন্নত মানসিকতা এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর
সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা তাঁর জ্ঞাতি-গোত্র ও নিকটাত্মীয়দের
কাছে স্পষ্ট ছিল এবং মহানবীর সকল আত্মীয় জানতেন যে, তিনি সমগ্র গৌরবময়
জীবনে কখনোই পাপ ও অন্যায়ের পেছনে যান নি, কারো ওপর সামান্যতম জুলুম করার
ইচ্ছা করেন নি এবং সত্যের পরিপন্থী কোন কথা তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় নি। এ
কারণেই তাঁর সাধারণ জনতার প্রতি আহবান বা দীনের দাওয়াত দেয়ার প্রথম দিনেই
বনী হাশিমের প্রায় সকল লোক তাঁর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং তাঁরা তাঁর
চারপাশে প্রদীপের কাছে পতঙ্গ যেমন জড়ো হয়, তেমনি সমবেত হয়েছিলেন।
একজন সুবিবেচক প্রাচ্যবিদ এ ব্যাপারকে
মহানবীর পবিত্রতা, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার প্রতীক বলে বিবেচনা করেছেন এবং
বলেছেন :“ কোন ব্যক্তি, তা তিনি যতই সতর্ক এবং রক্ষণশীল হোন না কেন, বংশ ও
নিকটাত্মীয়-স্বজনদের কাছে ব্যক্তিগত জীবনের সমুদয় দিক গোপন রাখতে সক্ষম নন।
মুহাম্মদ মন্দ মন-মানসিকতা ও চরিত্রের অধিকারী হলে তা কখনোই তাঁর
নিকটাত্মীয় ও গোত্রের কাছে গোপন থাকত না এবং তারা এত তাড়াতাড়ি তাঁর প্রতি
আকৃষ্ট হতেন না ও ঝুঁকে পড়তেন না।”
বনী হাশিমের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েক ব্যক্তি
তাঁর প্রতি ঈমান আনে নি এবং আবু লাহাবের পরে আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে
আবদুল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ ইবনে আবী উমাইয়্যা নাম্নী মহানবী (সা.)-এর
মাত্র দু’ জন আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যারা তাঁর বিরুদ্ধে
শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন তো করেই নি; বরং
সত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং মহানবীকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দিত।
আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস মহানবীর
পিতৃব্যপুত্র এবং তাঁর দুধ-ভাই ছিল এবং মহানবীর নবুওয়াত লাভের আগে তাঁর
প্রতি অত্যন্ত মমতা ও ভালোবাসা পোষণ করত। কিন্তু নবুওয়াত লাভের পর মহানবীর
কাছ থেকে সে তার পথকে পৃথক করে ফেলে। উম্মে সালামার ভাই আবদুল্লাহ মহানবীর
ফুফু ও আবদুল মুত্তালিবের কন্যা আতিকার পুত্র ছিল।
সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও
প্রসার এ দু’ ব্যক্তিকে মক্কা ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ করার
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। মহানবী (সা.) যখন মক্কা বিজয়ের জন্য
যাত্রা করছেন, তখন পথিমধ্যে‘সানীয়াতুল উকাব’ বা‘ নাবকুল উকাব’-এ মুসলিম
সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। মহানবীর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি
দানের ব্যাপারে তাদের শত পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও মহানবী তাদের কথা মেনে নেন নি।
এমনকি উম্মে সালামাহ্ অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কণ্ঠে সুপারিশ করলেন। কিন্তু
মহানবী তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন :“ এটা ঠিক যে, আবু সুফিয়ান আমার
পিতৃব্যপুত্র; কিন্তু সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তিটি
আমার কাছে অনেক অযৌক্তিক আবদার করেছিল এবং সে নিজেও অন্যদের ঈমান আনার পথে
অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মহানবীর মন-মানসিকতা এবং তাঁর আবেগ-অনুভূতি
উদ্দীপ্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাদের
দু’ জনকে বললেন :“ আপনারা মহানবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং ইউসুফের ভাইয়েরা
নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য যে কথা তাঁকে বলেছিল,
আপনারাও তাঁকে তা বলুন।”
ইউসুফের ভাইয়েরা ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছিল :
) لقد آثرك الله علينا و إن كنّا لخاطئين(
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং (নিশ্চয়ই) আমরা পাপী।” (সূরা ইউসুফ : ৯১)
হযরত ইউসুফ (আ.) এ বাক্য শোনার পর তাদেরকে নিম্নোক্ত কথা বলে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন :
) لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم و هو أرحم الرّاحمين(
“আজ তোমাদের থেকে জবাবদিহি আদায় করা হবে না। মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন এবং তিনিই সবচেয়ে দয়ালু।” (সূরা ইউসুফ : ৯২)
এরপর হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) আরো
বললেন :“ যদি আপনারা প্রথম বাক্য উচ্চারণ করেন, তা হলে তিনি অবশ্যই দ্বিতীয়
বাক্যের দ্বারা এর জবাব দেবেন; কারণ তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনোই
মানতে প্রস্তুত নন যে, অন্য কোন ব্যক্তি তাঁর চেয়ে অধিকতর মিষ্টভাষী হোক।”
যে পথ হযরত আলী (আ.) তাদেরকে দেখিয়েছিলেন, সে পথই তারা অবলম্বন করলেন।
মহানবীও হযরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তারা দু’ জনই তখন
থেকেই জিহাদের পোশাক পরিধান করেন। তারা তাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত
তাওহীদী আদর্শ ও দ্বীন ইসলামের ওপর অটল থেকেছেন। অতীত জীবনের ক্ষতিপূরণ
করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান একটি কাসীদাহ্ রচনা করেন যা নিম্নরূপ :
لـعمـرك إنّى يوم أحـمل راية لتغلب خـيل اللّات خـيل مـحمّد
فكالـمدلج الحيران أظـلم ليله فهذا أوانِى حـين أهدي فـاهتدى
-তোমার জীবনের শপথ, যেদিন আমি পতাকা কাঁধে
বহন করছিলাম, যাতে করে লাতের (মক্কাস্থ জাহিলী যুগের একটি মূর্তির নাম)
বাহিনী মুহাম্মদের বাহিনীর ওপর হয় জয়যুক্ত, সেদিন আমি ছিলাম রাতের
উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো, যে আঁধারে পথ চলে। তবে এখন হচ্ছে ঐ সময় যখন আমাকে
পথ প্রদর্শন করানো হবে; অতএব, আমি সুপথ প্রাপ্ত হব।
ইবনে হিশাম লিখেছেন : মহানবী (সা)-এর
পিতৃব্যপুত্র আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব তাঁর কাছে
নিম্নোক্ত বার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন :“ যদি আপনি আমার ঈমান আনার ব্যাপারে
স্বীকৃতি না দেন, তা হলে আমি আমার শিশুপুত্রের হাত ধরে মরু-প্রান্তরে ঘুরে
বেড়াব (এবং সেখানে বাকী জীবন কাটিয়ে দেব)।
উম্মে সালামাহ্ মহানবী (সা.)-এর আবেগকে উদ্দীপ্ত করার জন্য তখন বললেন :“ আমরা আপনার কাছ থেকে বারবার শুনেছি :إنّ الإسلام يَجُبُّ ما كان قبله
“ নিশ্চয়ই ইসলাম মানুষকে তার অতীত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় (অর্থাৎ
তার অতীত জীবনের পাপকে মুছে দেয়)।” আর এ কারণেই মহানবীও তাঁদের দু’ জনকে
গ্রহণ করে নিলেন।৩৪৪
ইসলামী সেনাবাহিনীর আকর্ষণীয় রণকৌশল
মাররুয যাহরান মক্কা নগরী থেকে কয়েক
কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মহানবী (সা.) পূর্ণ দক্ষতার সাথে পবিত্র মক্কার
প্রান্তসীমা পর্যন্ত দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পরিচালনা করেন। ঐ সময়
কুরাইশ ও তাদের গুপ্তচর এবং ঐ সব ব্যক্তি, যারা তাদের স্বার্থে কাজ করত,
কস্মিনকালেও ইসলামী সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা সম্পর্কে অবগত ছিল না। মহানবী
মক্কাবাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার, মক্কা নগরীর বাসিন্দাদের প্রতিরোধ করা
ছাড়াই আত্মসমর্পণ এবং এ বিশাল ঘাঁটি ও পবিত্র কেন্দ্র বিনা রক্তপাতে জয় করা
সম্ভব করে তোলার জন্য নির্দেশ দেন, মুসলিম সৈন্যরা উঁচু উঁচু এলাকায় গিয়ে
আগুন জ্বালাবে। তিনি অধিক ভীতি সৃষ্টির জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে পৃথক
পৃথকভাবে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেন, যাতে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার একটি
(উজ্জ্বল) রেখা সবগুলো পাহাড় ও উঁচু এলাকা ছেয়ে ফেলে।
কুরাইশ ও তাদের মিত্ররা সবাই তখন গভীর
নিদ্রামগ্ন। অন্যদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় উঁচু এলাকাগুলো বিশাল
অগ্নিকুণ্ডের রূপ দান করেছিল এবং মক্কাবাসীদের বাড়িগুলোকে আলোকিত করে
ফেলেছিল। এর ফলে মক্কাবাসীদের অন্তরে ভীতির সৃষ্টি হয় এবং উঁচু এলাকাগুলোর
দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
তখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং হাকিম ইবনে
হিশামের ন্যায় মক্কার কুরাইশ নেতারা প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য মক্কার বাইরে
এসে অনুসন্ধান কাজে মনোনিবেশ করে।
জুহ্ফাহ্ থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে
সর্বক্ষণ পথ চলার সাথী আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব চিন্তা করলেন, ইসলামী
সেনাবাহিনী কুরাইশদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে কুরাইশ বংশীয় বহু লোক নিহত
হবে। তাই শ্রেয়তর হবে যদি তিনি উভয় পক্ষের কল্যাণার্থে কোন ভূমিকা পালন
করেন এবং কুরাইশদের আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করেন।
তিনি মহানবীর সাদা খচ্চরের উপর আরোহণ করে
রাতের বেলা পবিত্র মক্কার পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকেন, যাতে তিনি মক্কা নগরী
অবরোধের কথা কুরাইশ নেতাদের গোচরীভূত করেন এবং তাদেরকে ইসলামী সেনাবাহিনীর
সংখ্যাধিক্য ও তাঁদের বীরত্বব্যঞ্জক মনোবল ও সাহসিকতা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন
এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে, আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।
তিনি দূর থেকে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকার কথোপকথন শুনতে পেলেন। তারা বলছিল :
আবু সুফিয়ান : আমি এ পর্যন্ত এত প্রকাণ্ড আগুন এবং এত বিশাল সেনাবাহিনী দেখি নি!
বুদাইল ইবনে ওয়ারকা : তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত খুযাআহ্ গোত্র হবে।
আবু সুফিয়ান : যারা এত প্রকাণ্ড আগুন প্রজ্বলিত করছে এবং এত বড় সেনাছাউনী স্থাপন করেছে, তাদের চেয়ে খুযাআহ্ গোত্র সংখ্যায় অতি অল্প।
এরই মধ্যে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব
সেখানে এসে তাদের কথা থামিয়ে দিয়ে আবু সুফিয়ানকে সম্বোধন করে বললেন :“ আবু
হানযালাহ্ (আবু সুফিয়ানের উপনাম)!” আবু সুফিয়ান আব্বাসের কণ্ঠধ্বনি চিনতে
পেরে বলল :“ আবুল ফযল (আব্বাসের উপনাম)! আপনি কী বলেন?” আব্বাস তখন বললেন
:“ মহান আল্লাহর শপথ! এ অগ্নিকুণ্ড ও শিখাগুলোর সবই মুহাম্মদের সৈন্যদের।
তিনি এক শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে কুরাইশদের কাছে এসেছেন এবং কখনোই এ
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কুরাইশদের হবে না।”
আব্বাসের এ কথাগুলো আবু সুফিয়ানের গায়ে
তীব্র কম্পন সৃষ্টি করে। তখন তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল এবং তার দাঁতে খিল
লাগার উপক্রম হয়েছিল। সে হযরত আব্বাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল :“ আমার
পিতা-মাতা তোমার জন্য উৎসর্গীকৃত হোক! এখন উপায় কী?”
আব্বাস বললেন :“ একমাত্র উপায় হচ্ছে এটাই
যে, তুমি আমার সাথে মহানবীর সকাশে সাক্ষাৎ করতে যাবে এবং তাঁর কাছে
নিরাপত্তা প্রার্থনা করবে; আর তা না হলে কুরাইশদের জীবন হুমকির সম্মুখীন।”
অতঃপর তিনি তাকে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে ইসলামী
সেনাশিবিরের দিকে গমন করেন এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের জন্য আবু
সুফিয়ানের সাথে আসা ঐ দু’ ব্যক্তি পবিত্র মক্কায় ফিরে গেল।
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের উদ্যোগ
ইসলামের স্বার্থে এসেছিল এবং তা কুরাইশদের চিন্তাশীল ব্যক্তিটি অর্থাৎ আবু
সুফিয়ানকে ইসলামের ক্ষমতা ও মুসলিম সেনাবাহিনী সম্পর্কে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত
করেছিল যে, একমাত্র আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় আসছিল না। এসব
কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি আবু সুফিয়ানকে পবিত্র মক্কায় ফিরে যেতে বাধা দেন, রাতের
বেলা তাকে মুসলিম সেনাশিবিরে নিয়ে আসেন, সব দিক থেকে তার পথ আটকে দেন এবং
তাকে আর মক্কায় ফিরে যেতে দেন নি। কারণ, মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর
চরমপন্থি কুরাইশদের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কয়েক ঘণ্টা প্রতিরোধ করার জন্য
নির্বোধের ন্যায় তার হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করার সম্ভাবনা ছিল।
মুসলিম সেনাশিবিরের মাঝখান দিয়ে আবু সুফিয়ানসহ আব্বাসের গমন
মহানবী (সা.)-এর পিতৃব্য আব্বাস মহানবীর
বিশেষ খচ্চরটির পিঠে বসা ছিলেন এবং আবু সুফিয়ানকে নিজের সাথে রেখেছিলেন।
তিনি আবু সুফিয়ানকে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রজ্বলিত প্রকাণ্ড
অগ্নিকুণ্ডগুলোর মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যেসব সেনারক্ষী হযরত আব্বাস ও
মহানবীর বিশেষ খচ্চর চিনত তারা তাঁর পথ অতিক্রম করার ব্যাপারে বাধা দেয়
নি; বরং তারা তাঁর জন্য পথ খুলে দিচ্ছিল।
পথিমধ্যে খচ্চরের পিঠে হযরত আব্বাসের পেছনে
বসা আবু সুফিয়ানের উপর দৃষ্টি পড়লে হযরত উমর তাকে সেখানেই হত্যা করতে
চাইলেন। কিন্তু মহানবীর চাচা তাকে নিরাপত্তা দান করায় তিনি এ চিন্তা ত্যাগ
করেন। অবশেষে মহানবীর তাঁবুর অদূরে আব্বাস ও আবু সুফিয়ান খচ্চরের পিঠ থেকে
নামেন। মহানবীর চাচা অনুমতি নিয়ে তাঁর তাঁবুতে প্রবেশ করেন এবং তাঁর
উপস্থিতিতে হযরত আব্বাস ও হযরত উমরের মধ্যে ভীষণ বিতর্ক হয়। উমর পীড়াপীড়ি
করছিলেন যে, আবু সুফিয়ান মহান আল্লাহর শত্রু এবং এখনই তাকে হত্যা করতে হবে।
কিন্তু আব্বাস বলছিলেন :“ আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি এবং আমার নিরাপত্তা
প্রদানের প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং তা সম্মানিত বলে
বিবেচনা করতে হবে।” মহানবী (সা.) এক কথায় এ বিতর্কের অবসান ঘটান এবং হযরত
আব্বাসকে নির্দেশ দেন, তিনি আবু সুফিয়ানকে সারা রাত একটি তাঁবুতে আটকে
রাখবেন এবং সকালে তাকে তাঁর কাছে উপস্থিত করবেন।
মহানবী (সা.) সকাশে আবু সুফিয়ান
হযরত আব্বাস সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আবু
সুফিয়ানকে মহানবীর কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর চারপাশ মুহাজির ও আনসারগণ ঘিরে
রেখেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি আবু সুফিয়ানের উপর পড়লে তিনি বললেন :“ মহান আল্লাহ
ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই- এ সত্য তোমার উপলব্ধির কি এখনো সময় হয় নি?” আবু
সুফিয়ান তাঁর উত্তরে বলেছিল :“ আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি
আপনার নিজ আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে কতখানি ধৈর্যশীল, উদার এবং দয়াবান!
আমি এখন বুঝেছি, যদি মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ থাকত, তা হলে সে
আমাদের স্বার্থে একটা কিছু অবশ্যই করত।” মহান আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে আবু
সুফিয়ানের স্বীকারোক্তির পর মহানবী বললেন :“ আমি যে মহান আল্লাহর নবী, তা
তোমার জানার সময় কি এখনো হয় নি?” আবু সুফিয়ান তখন পূর্বের উক্তির
পুনরাবৃত্তি করে বলল :“আপনি আপনার নিজ জ্ঞাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে
কতখানি ধৈর্যশীল, উদার ও দয়াবান! আমি এখন আপনার রিসালাতের ব্যাপারেই চিন্তা
করছি।” আব্বাস আবু সুফিয়ানের দ্বিধাগ্রস্ততা দেখে মর্মাহত হলেন এবং বললেন
:“ যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ না কর, তা হলে তোমার প্রাণ হুমকির সম্মুখীন হবে।
তোমার উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহান আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মদ (সা.)-এর
রিসালাতের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া।” আবু সুফিয়ান তখন মহান আল্লাহর একত্ব ও
রাসুলুল্লাহর রিসালাতের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি প্রদান করে মুসলমানদের
অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
আবু সুফিয়ান ভয়-ভীতির মাঝে ঈমান আনয়ন
করেছিল এবং এ ধরনের ঈমান আনা কখনোই মহানবী (সা.) এবং তাঁর দীনের লক্ষ্য ও
উদ্দেশ্য ছিল না। তবে কতিপয় কল্যাণের ভিত্তিতে আবু সুফিয়ানের মুসলমানের
কাতারভুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল, যাতে করে মক্কার অধিবাসীদের ইসলাম
ধর্ম গ্রহণ করার পথে বিদ্যমান সবচেয়ে বড় বাধা এভাবে অপসারিত হয়ে যায়। কারণ
আবু সুফিয়ান, আবু জাহল, ইকরামাহ্, সাফওয়া ইবনে উমাইয়্যা সহ কয়েকজনের মতো
কতিপয় (প্রভাবশালী) ব্যক্তি বহু বছর ধরে (২১ বছর) এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি
করে রেখেছিল এবং কোন ব্যক্তি ইসলামের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা বা এ
ধর্মের প্রতি নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করার সাহস পর্যন্ত পেত না। আবু
সুফিয়ানের বাহ্যিক ইসলাম গ্রহণ তার নিজের জন্য সুফল বয়ে না আনলেও মহানবী
(সা.) এবং যেসব ব্যক্তি তার কর্তৃত্বাধীন ছিলেন এবং তার সাথে যাঁদের
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, তাঁদের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর হয়েছিল।
এ সত্ত্বেও মহানবী (সা.) আবু সুফিয়ানকে
ছেড়ে দেবার নির্দেশে প্রদান করলেন না। কারণ মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত
তিনি আবু সুফিয়ানের উস্কানিমূলক তৎপরতায় হাত দেয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে
পারছিলেন না। এ কারণে তিনি কতিপয় প্রমাণবশত একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় তাকে
আটকে রাখার জন্য হযরত আব্বাসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আব্বাস তখন মহানবীর
দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন :“ যে আবু সুফিয়ান নেতৃত্ব, মর্যাদা ও গৌরব খুব
পছন্দ করে, এখন তার অবস্থা যখন এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তখন এ মহা ঘটনা
প্রবাহে তাকে (অন্তত) একটা মর্যাদা দান করুন।”
দীর্ঘ বিশ বছর যাবত আবু সুফিয়ান ইসলাম ও
মুসলমানদের ওপর বড় বড় আঘাত হানা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) কিছু কল্যাণের
ভিত্তিতে তাকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তাঁর মহৎ আত্মারই পরিচায়ক
ঐতিহাসিক বাক্য তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন :
আবু সুফিয়ান জনগণকে নিশ্চয়তা প্রদান করতে
পারবে যে, যে কেউ মসজিদুল হারামের সীমারেখার মধ্যে আশ্রয় নেবে বা মাটির উপর
অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের নিরপেক্ষ থাকার কথা ঘোষণা দেবে বা আবু সুফিয়ানের
ঘরে আশ্রয় নেবে (ভিন্ন বর্ণনা মতে হাকিম ইবনে হিযামের ঘরে), সে মুসলিম
সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবে।
পবিত্র মক্কার রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ
মুসলিম সেনাবাহিনী পবিত্র মক্কার কয়েক
কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে পৌঁছে গেল। মহানবী (সা) প্রতিরোধ ও রক্তপাতের
ঘটনা ছাড়াই মক্কা নগরী জয় করতে এবং শত্রুপক্ষকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের
সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন।
গোপনীয়তা সংরক্ষণ ও শত্রুকে অতর্কিতে
আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার মূলনীতি ছাড়াও এ মহান লক্ষ্য
বাস্তবায়নের ব্যাপারে যেসব কারণ সাহায্য করেছিল এবং অনুকূলে কাজ করছিল,
সেসবের মধ্যে এটাও ছিল যে, মহানবীর চাচা আব্বাস একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে
কুরাইশদের কাছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে (কৌশলে) মুসলিম সেনাশিবিরে নিয়ে
আসেন। আর আবু সুফিয়ানকে ছাড়া কুরাইশ নেতারা কোন জোরালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করতে পারত না।
আবু সুফিয়ান যখন মহানবী (সা.)-এর অভূতপূর্ব
মর্যাদা ও গৌরবের সামনে মাথা নত করল এবং ঈমান আনার ঘোষণা দিল, তখন মহানবী
মুশরিকদের আরো হতাশাগ্রস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করার ব্যাপারে এ অবস্থার
সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে চাইলেন। তাই তিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁর চাচা
আব্বাস যেন আবু সুফিয়ানকে একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আটকে রাখেন যাতে করে
ইসলামের নবগঠিত সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ নিজেদের বড় বড় অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি
সহ তার সামনে দিয়ে প্যারেড করে যেতে পারে। এভাবে সে ইসলামের সামরিক শক্তি
সম্পর্কে ধারণা পাবে এবং পবিত্র মক্কায় ফিরে গিয়ে সেখানকার জনগণকে ইসলামের
সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভয় দেখাবে এবং তাদের মাথা থেকে প্রতিরোধের সকল
চিন্তা দূর করে দেবে।
এখন ইসলামী সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের বর্ণনা নিম্নে দেয়া হলো :
১. খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে বনী সালীম
গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার দল। তাঁদের দু’ টি পতাকা ছিল এবং এর একটি ছিল
আব্বাস ইবনে মিরদাসের হাতে এবং অন্যটি মিকদাদের হাতে।
২. যুবাইর ইবনে আওয়ামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ
শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দু’ টি ব্রিগেড। তাঁর হাতে একটি কালো পতাকা ছিল। এ
দু’ টি ব্রিগেডের অধিকাংশ যোদ্ধাই মুহাজির ছিলেন।
৩. আবু যার গিফারীর নেতৃত্বাধীন বনী গিফার গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত সেনাদল। আবু যারের হাতে এ দলটির পতাকা ছিল।
৪. ইয়াজিদ ইবনে খুসাইবের নেতৃত্বে বনী আসলাম গোত্রের চার শ’ যোদ্ধা দ্বারা গঠিত সেনাদল। এ দলের পতাকা ইয়াজিদ ইবনে খুসাইবের হাতে ছিল।
৫. বাশার বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন বনী কা’ ব গোত্রের পাঁচ শ’ যোদ্ধার দল। এ দলের পতাকা বাশার বিন সুফিয়ান বহন করছিলেন।
৬. মুযাইনা গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার
সমন্বয়ে গঠিত দল। এর তিনটি পতাকা ছিল। এ সব পতাকা নুমান ইবনে মাকরা, বিলাল
ইবনুল হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর বহন করছিলেন।
৭. জুহাইনাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দল। এর
চারটি পতাকা যথাক্রমে মা’বাদ ইবনে খালিদ, নুওয়াইদ ইবনে সাখরা, রা’ ফে ইবনে
মালীস ও আবদুল্লাহ ইবনে বাদর বহন করছিলেন।
৮. আবু ওয়াকিদ লাইসীর নেতৃত্বে বনী
কিনানাহ্, বনী লাইস ও যামরাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দু’ টি দল এবং তাদের
পতাকা আবু ওয়াকিদ লাইসীর হাতে ছিল।
৯. বনী আশজা’ গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার দল, যার দু’ টি পতাকার একটি মাকাল ইবনে সিনান ও অপরটি নাঈম ইবনে মাসউদের হাতে ছিল।
এ সেনা ইউনিটগুলো আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে
অতিক্রম করার সময় সে সাথে সাথে হযরত আব্বাসকে সেনা ইউনিটগুলোর বিশেষ
বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করছিল এবং তিনিও বেশ উত্তর দিচ্ছিলেন।
যে বিষয়টি এ সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল
সেনাবাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করেছিল, তা ছিল এই, যখনই আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের
সামনে সেনা ইউনিটসমূহের অধিনায়কগণ প্যারেড করে উপস্থিত হচ্ছিলেন, তখনই
তাঁরা তিন বার উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিচ্ছিলেন এবং ইউনিটসমূহের সৈনিকরাও
অধিনায়কদের তাকবীর দেবার পরপরই সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী স্লোগান হিসেবে তিন বার
উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিতে থাকেন। এ তাকবীর পবিত্র মক্কা নগরীর উপত্যকাসমূহে
এতটা প্রতিধ্বনিত হয় যে, তা মিত্রদের ইসলাম ধর্মের প্রতি আরো অনুরাগী করে
তুলে এবং শত্রুদের অন্তর বিদীর্ণ করে ও তাদেরকে ভয়-ভীতির অতল গহ্বরে
নিমজ্জিত করে।
আবু সুফিয়ান একেবারে ধৈর্যহারা হয়ে এমন এক
সেনা ইউনিটকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল যার মাঝে মহানবী (সা.) থাকবেন। তাই
তার সামনে দিয়ে প্রতিটি ইউনিট কুচকাওয়াজ করে অতিক্রম করার সময় হযরত
আব্বাসকে জিজ্ঞেস করছিল :“ মুহাম্মদ কি এ ইউনিটের মধ্যে আছেন?” তিনি জবাবে
বলছিলেন :“ না।” অবশেষে এক বিশাল সেনাদল যার সৈন্য-সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ
হাজার, আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উল্লেখ্য, এ সেনাদলে
বর্ম পরিহিত দু’ হাজার সৈন্য ছিল এবং এক নির্দিষ্ট দূরত্বে অসংখ্য পতাকা
সেনাদলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের অধিনায়কদের হাতে ছিল। এ সেনা ইউনিটটির নাম
ছিল‘ আল কাতীবাতুল খাদরা’ অর্থাৎ‘ সবুজ ব্রিগেড’ যা আপাদমস্তক সশস্ত্র ও
যুদ্ধের উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। এ সেনাদলের সৈন্যদের পুরো দেহ বিভিন্ন
ধরনের যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। কেবল তাদের উজ্জ্বল চোখগুলো ছাড়া
দেহের আর কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এ সেনাদলের মধ্যে দ্রুতগামী আরবী ঘোড়া ও
লাল পশমের উট বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।
মহানবী (সা.) এ সেনাদলের মাঝখানে তাঁর
বিশেষ উটের উপর সওয়ার হয়ে পথ চলছিলেন এবং বড় বড় আনসার ও মুহাজির সাহাবী
তাঁর চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবী তখন তাঁদের সাথে কথোপকথন করছিলেন।
এ সেনাদলের মর্যাদা ও গৌরব আবু সুফিয়ানকে
এতটা ভীত করেছিল যে, সে নিজের অজান্তেই আব্বাসের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল :“ এ
সেনাবাহিনীর সামনে কোন শক্তিই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। আব্বাস! তোমার
ভ্রাতুষ্পুত্রের রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত
হয়েছে।”
আব্বাস এ কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিরস্কার করে
বললেন :“ আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে
প্রাপ্ত নবুওয়াত ও রিসালাত; আর পার্থিব শক্তিগুলোর সাথে এর কোনই সম্পর্ক
নেই।”
মক্কার পথে আবু সুফিয়ান
এ পর্যন্ত আব্বাস তাঁর ভূমিকা যথাযথভাবে
পালন করেন এবং আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামরিক শক্তি সম্পর্কে সন্ত্রস্ত করে
তোলেন। এ সময় মহানবী আবু সুফিয়ানকে মুক্ত করে দেয়ার মধ্যেই কল্যাণ দেখতে
পেলেন। কারণ পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনী প্রবেশ করার আগেই সে
সেখানে পৌঁছে সেখানকার অধিবাসীদের মুসলমানদের অস্বাভাবিক শক্তি ও ক্ষমতা
সম্পর্কে অবহিত করবে এবং তাদেরকে সম্ভাব্য মুক্তির পথও দেখাবে। মুক্তির পথ
দেখানো ছাড়া কেবল জনগণকে ভয় দেখানোর মাধ্যমে মহানবীর লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে
না।
আবু সুফিয়ান মক্কা নগরীতে ফিরে গেল। জনগণ-
যারা আগের রাত থেকেই তীব্র অস্থিরতা ও ভীতির মধ্যে ছিল এবং তার সাথে
পরামর্শ না করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না- তার চারপাশে জড়ো হলো। সে
ফ্যাকাসে মুখে কাঁপতে কাঁপতে মদীনার দিকে ইশারা করে জনগণের দিকে তাকিয়ে বলল
:
“দুর্নিবার ইসলামী সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ
পুরো শহর ঘিরে ফেলেছে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই শহরে প্রবেশ করবে। তাদের
অধিনায়ক ও নেতা মুহাম্মদ আমাকে কথা দিয়েছেন, যে কেউ মসজিদ ও পবিত্র কাবার
প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেবে বা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজের ঘরের
দরজা বন্ধ করে দেবে অথবা আমার বা হাকিম ইবনে হিযামের ঘরে প্রবেশ করবে, তার
জান-মাল সম্মানিত বলে গণ্য হবে এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।”
মহানবী (সা.) শুধু এটুকুকেও পর্যাপ্ত মনে
করেন নি। পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করার পর এ তিন ধরনের আশ্রয়স্থল ছাড়াও
আবদুল্লাহ ইবনে খাস আমীর হাতে একটি পতাকা দিয়ে নির্দেশ দিলেন, যেন তিনি
উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন যে, যে কেউ তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবে সেও
নিরাপত্তা লাভ করবে।৩৪৭
আবু সুফিয়ান এ বাণী ঘোষণা করার মাধ্যমে
পবিত্র মক্কার অধিবাসীদের মনোবল এতটা দুর্বল করে দেয় যে, কোন দলের মধ্যে
প্রতিরোধ মনোবৃত্তি অবশিষ্ট থাকলেও সার্বিকভাবে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং
বিগত রাত থেকে হযরত আব্বাসের মাধ্যমে যে সব পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ
গৃহীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়। আর বস্তুবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কুরাইশদের
বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজয় একটা সন্দেহাতীত বিষয় হয়ে যায়। জনগণ
ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যে যেখানে পারল সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং পুরো শহর জুড়ে
ছুটোছুটি, পলায়ন ও আশ্রয় গ্রহণ চলতে লাগল। এভাবে মহানবী (সা.)-এর প্রাজ্ঞ
পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে ইসলাম ধর্মের প্রধান শত্রু ইসলামী সেনাবাহিনীর
অনুকূলে সবচেয়ে বড় সেবাটি আনজাম দিয়েছিল।
ইত্যবসরে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ
মক্কাবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছিল এবং তার স্বামীর প্রতি
অত্যন্ত অশোভন উক্তি করছিল। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় নি। সব ধরনের চিৎকার
আসলে কামারের নেহাইয়ের ওপর মুষ্টিবদ্ধ আঘাতস্বরূপ ছিল। সাফওয়ান ইবনে
উমাইয়্যা, ইকারামাহ্ ইবনে আবী জাহল এবং সুহাইল ইবনে আমরের (হুদাইবিয়ার
সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কুরাইশদের বিশেষ প্রতিনিধি) মতো কতিপয়
উগ্রবাদী কুরাইশ নেতা শপথ করল, তারা পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী বাহিনীর
প্রবেশে বাধা দেবে। আর একদল মক্কাবাসীও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খোলা
তলোয়ার হাতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রথম ইউনিটের প্রবেশের পথে বাধা দেয়।
পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রবেশ
পবিত্র মক্কা নগরীর সড়কসমূহে ইসলামী বাহিনী
প্রবেশ করার আগেই মহানবী (সা.) সকল সেনাপতিকে উপস্থিত করে বলেছিলেন :“
বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের জন্যই হচ্ছে আমার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা। তাই
নিরীহ জনগণকে হত্যা থেকে তোমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। তবে ইকরামাহ্ ইবনে
আবী জাহল, হাব্বার ইবনে আসওয়াদ, আবদুল্লাহ ইবনে সা’ দ ইবনে আবী সারাহ্,
মিকয়াস্ হুবাবাহ্ লাইসী, হুয়াইরিস ইবনে নুকাইয, আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল,
সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ্, হযরত হামযার ঘাতক ওয়াহশী ইবনে হারব, আবদুল্লাহ
ইবনুয্ যুবাইরী এবং হারিস ইবনে তালাতিলাহ্ নামের দশ জন পুরুষ এবং চার
মহিলাকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের হত্যা করতে হবে। উল্লেখ্য, এ দশ
ব্যক্তির প্রত্যেকেই হত্যা ও অপরাধ করেছিল বা (ইসলামের বিরুদ্ধে) অতীত
যুদ্ধগুলোর আগুন জ্বালিয়েছিল।
এ নির্দেশ সেনাপতি ও সামরিক অধিনায়কগণ
তাঁদের নিজ নিজ সকল সৈন্যের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর
কাছে মক্কাবাসীদের আত্মিক অবস্থা স্পষ্ট হলেও পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করার
সময় তিনি সামরিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সতর্কতামূলক
পরিকল্পনা ছিল এরূপ :
সকল সামরিক ইউনিট এক পথে যী তূওয়ায় পৌঁছে।
যী তূওয়া একটি উঁচু স্থান, যেখান থেকে পবিত্র মক্কা নগরী, বাইতুল্লাহ্
(কাবা) এবং মসজিদুল হারাম দৃষ্টিগোচর হয়। ঐ সময় মহানবী (সা.) পাঁচ হাজার
সৈন্যের একটি সেনা-ব্রিগেড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। মহানবীর দৃষ্টি পবিত্র
মক্কার ঘর-বাড়িগুলোর উপর পড়লে তাঁর দু’ চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় এবং
কুরাইশদের প্রতিরোধ ছাড়াই যে মহান বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা
প্রকাশে মাথা এতটা নত করেন যে, তাঁর পবিত্র দাড়ি মুবারক উটের উপর স্থাপিত
গদি স্পর্শ করেছিল। তিনি সতর্কতা অবলম্বন স্বরূপ তাঁর সেনাবাহিনীকে কয়েকটি
অংশে বিভক্ত করেছিলেন। একটি অংশকে পবিত্র মক্কার উঁচু অংশ দিয়ে এবং আরেকটি
অংশকে পবিত্র মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে পরিচালনা করেছিলেন। এতটুকু করেও তিনি
ক্ষান্ত হন নি। তিনি শহরগামী সকল সড়ক থেকে বেশ কয়েকটি সেনা ইউনিট শহরের
দিকে প্রেরণ করেন। সকল সেনা ইউনিট সংঘর্ষ ছাড়াই পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ
করে এবং ঐ সময় শহরের দ্বারগুলো উন্মুক্ত ছিল। তবে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের
নেতৃত্বাধীন সেনা ইউনিটের প্রবেশপথের দ্বারে ইকরামাহ্ ও সুহাইল ইবনে আমরের
প্ররোচনায় এক দল লোক মুসলিম সেনা ইউনিটটির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা তীর
নিক্ষেপ ও তরবারি সঞ্চালন করে মুসলিম সেনা ইউনিটটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
সৃষ্টি করেছিল। তবে তাদের বারো বা তের জন নিহত হলে প্ররোচণাকারীরা পালিয়ে
যায় এবং অন্যরাও পলায়নে বাধ্য হয়। আবারও আবু সুফিয়ান এ ঘটনায় নিজের
অজান্তেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের অনুকূলে কাজ করেছিল। তখনও ভয়-ভীতি তাকে
ঘিরে রেখেছিল এবং সে ভালোভাবে জানত যে, বাধাদান কেবল ক্ষতিই বয়ে আনবে। তাই
রক্তপাত এড়ানোর জন্য সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল :“ কুরাইশ গোত্র!
তোমরা তোমাদের জীবন বিপদের সম্মুখীন করো না। কারণ, মুহাম্মদের সুশৃঙ্খল
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধে আসলেই কোন ফায়দা হবে না। তোমরা
মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজেদের ঘর-বাড়িতে বসে থাক এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে
দাও বা মসজিদুল হারাম ও পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নাও। তা হলে তোমাদের
জীবন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।”
আবু সুফিয়ানের এ বক্তব্য কুরাইশদের মধ্যে
বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। তাই একদল কুরাইশ নিজেদের ঘর-বাড়িতে এবং আরেক দল
মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছিল।
মহানবী (সা.) আযাখির নামক একটি স্থান থেকে
খালিদ ইবনে ওয়ালীদের সেনা ইউনিটের সৈন্যদের তরবারি পরিচালনায় সৃষ্ট ঝলকানির
দ্যুতি-যা তখন উঠা-নামা করছিল,- দেখতে পেলেন এবং সংঘর্ষের কারণ জানতে পেয়ে
বললেন :قضاء الله خير “ মহান আল্লাহর ফয়সালাই সর্বোত্তম।”
মহানবী (সা.)-কে বহনকারী উট পবিত্র মক্কা
নগরীর সবচেয়ে উঁচু এলাকা দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে এবং হুজূন এলাকায় মহানবীর
চাচা হযরত আবু তালিবের কবরের পাশে এসে থামে। বিশ্রাম করার জন্য এখানে একটি
বিশেষ তাঁবু স্থাপন করা হয়। কারো বাড়িতে থাকার জন্য জোর অনুরোধ করা হলেও
মহানবী তা গ্রহণ করেন নি।
মূর্তি ভাঙ্গা ও পবিত্র কাবা ধোয়া
যে মক্কা নগরী বহু বছর যাবত শিরক ও
মূর্তিপূজার ঘাঁটি ছিল, তা তাওহীদী আদর্শের (ইসলাম) সেনাবাহিনীর কাছে
আত্মসমর্পণ করে এবং এ নগরীর সকল অঞ্চল ইসলামের সৈনিকদের অধিকারে আসে।‘
হুজূন’ নামক স্থানে মহানবী (সা.) তাঁর জন্য খাটানো তাঁবুতে কিছু সময়
বিশ্রাম করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে মহান আল্লাহর ঘর (কাবা)
যিয়ারত ও তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামের দিকে রওয়ানা হন। তিনি যুদ্ধের
পোশাক ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত ছিলেন এবং আনসার ও মুহাজিরগণ খুব মর্যাদার সাথে
তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবীর উটের লাগাম মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে ছিল
এবং তাঁর চলার পথের দু’ ধারে মুসলিম ও মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।
একদল ক্রোধে ও ভীতি-জনিত কারণে হতবাক হয়ে গিয়েছিল এবং আরেক দল আনন্দ
প্রকাশ করছিল। মহানবী কতিপয় কারণে উটের পিঠ থেকে নামলেন না এবং উটের পিঠে
আরোহণ করেই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন। হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) সামনে
স্থিত হয়ে হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ ছোঁয়ার পরিবর্তে তাঁর হাতে যে বিশেষ ছড়ি
ছিল, তা দিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে তাকবীর দিলেন।
মহানবী (সা.)-এর চারপাশ ঘিরে প্রদীপের
চারপাশে ঘূর্ণনরত পতঙ্গের মতো আবর্তিত সাহাবীগণ মহানবীকে অনুসরণ করে
উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দিলেন। তাঁদের তাকবীর-ধ্বনি মক্কার মুশরিকদের কানে
পৌঁছলে তারা নিজেদের বাড়ি এবং উঁচু এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নিল। মসজিদুল
হারামে এক অভিনব শোরগোল প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জনগণের তুমুল
হর্ষ-ধ্বনির কারণে মহানবী প্রশান্ত মনে ও চিন্তামুক্তভাবে তাওয়াফ করতে
পারছিলেন না। জনগণকে শান্ত করার জন্য মহানবী তাদের দিকে এক ইশারা করলেন।
অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মসজিদুল হারাম জুড়ে সুমসাম নীরবতা নেমে এলো। এমনকি
শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন বুকের মধ্যে বন্দী হয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ মানুষের
শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না)। মসজিদুল হারামের ভেতরে ও বাইরে
অবস্থানরত জনতার দৃষ্টি তখন তাঁর দিকে নিবদ্ধ ছিল। তিনি তাওয়াফ শুরু করলেন।
তাওয়াফের প্রথম পর্যায়েই পবিত্র কাবার দরজার উপর স্থাপিত হুবাল, ইসাফ ও
নায়েলা নামের কতিপয় বড় বড় প্রতিমার উপর মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি
হাতের বর্শা দিয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত করে ঐ প্রতিমাগুলো মাটিতে ফেলে দিলেন এবং
নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন :
) قل جاء الحق و زهق الباطل إنّ الباطل كان زهوقا(
“আপনি বলে দিন : সত্য (গৌরবের সাথে ও বিজয়ী
বেশে) প্রকাশিত হয়েছে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা (প্রথম
থেকেই) ভিত্তিহীন ছিল।” (সূরা বনী ইসরাঈল)
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে মুশরিকদের চোখের
সামনেই হুবালের প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো। এ বড় মূর্তিটি- যা বছরের পর বছর ধরে
আরব উপদ্বীপের জনগণের চিন্তা-চেতনার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল,-
তাদের চোখের সামনে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। ঠাট্টা করে যুবাইর আবু সুফিয়ানের
দিকে মুখ তুলে বললেন :“ হুবাল- এ বড় প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো।”
আবু সুফিয়ান অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে
যুবাইরকে বলেছিল :“ আমাদের থেকে হাত উঠিয়ে নাও তো (অর্থাৎ এ ধরনের কথা আর
বলো না)। হুবালের দ্বারা যদি কোন কাজ হতো, তা হলে পরিণামে আমাদের ভাগ্য এমন
হতো না।” আর সে বুঝতে পেরেছিল, তাদের ভাগ্য আসলে কখনোই তার হাতে ছিল না।
তাওয়াফ শেষ হলে মহানবী মসজিদুল হারামের এক
কোণে একটু বসলেন। তখন পবিত্র কাবার চাবি-রক্ষক ছিল উসমান ইবনে তালহা এবং এ
পদটি তার বংশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহাল ছিল। মহানবী (সা.) হযরত
বিলালকে উসমানের ঘরে গিয়ে পবিত্র কাবার চাবি নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন।
বিলাল চাবি-রক্ষকের কাছে মহানবীর নির্দেশ-বার্তা পৌঁছে দিলেন। কিন্তু তার
মা তাকে মহানবীর কাছে চাবি হস্তান্তরে বাধা দিল এবং বলল :“ পবিত্র কাবার
চাবি রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের বংশীয় গৌরব এবং আমরা কখনই এ গৌরব হাতছাড়া হতে দেব
না।” উসমান মায়ের হাত ধরে নিজের বিশেষ কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলল :“ আমরা যদি
নিজ ইচ্ছায় চাবি না দিই, তা হলে তুমি নিশ্চিত থেকো, বলপ্রয়োগ করে আমাদের
থেকে তা নিয়ে নেয়া হবে।” চাবি-রক্ষক এসে পবিত্র কাবার তালা খুলে দিল।
মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পেছনে উসামাহ্ ইবনে
যায়েদ ও বিলাল প্রবেশ করলেন এবং স্বয়ং চাবি-রক্ষকও প্রবেশ করলো। মহানবী
(সা.)-এর নির্দেশে পবিত্র কাবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ
পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়ে জনতাকে দরজার সামনে ভিড় করা থেকে বিরত
রাখছিলেন। পবিত্র কাবার অভ্যন্তরীণ প্রাচীর নবীগণের চিত্রকলা দিয়ে পূর্ণ
ছিল। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে কাবার প্রাচীরগুলো যমযম কূপের পানি দিয়ে
ধোয়া হলো এবং কাবার দেয়ালে যে সব চিত্র ছিল, সেগুলো উঠিয়ে এনে ধ্বংস করা
হলো।
মহানবী (সা.)-এর কাঁধে হযরত আলী (আ.)
মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ বলেন :“ পবিত্র
কাবার ভেতরে বা বাইরে স্থাপিত কিছু প্রতিমা হযরত আলী (আ.) ধ্বংস করেছিলেন।
মহানবী (সা.) হযরত আলীকে বললেন :“ আলী! তুমি বসে পড়, আমি তোমার কাঁধে উঠে
প্রতিমাগুলো ধ্বংস করব।” হযরত আলী (আ.) পবিত্র কাবার প্রাচীরের পাশে
মহানবীকে নিজ কাঁধে উঠালেন। কিন্তু তিনি বেশ ভার ও দুর্বলতা অনুভব করতে
লাগলেন। তখন মহানবী হযরত আলীর অবস্থা বুঝতে পেরে তাঁকে কাঁধে উঠার নির্দেশ
দিলেন। হযরত আলী মহানবীর কাঁধে উঠলেন এবং তামা দিয়ে নির্মিত কুরাইশদের
সর্ববৃহৎ মূর্তি মাটিতে নিক্ষেপ করলেন। এরপর তিনি অন্যান্য মূর্তিও মাটির
উপর ফেলতে লাগলেন।
হিজরি নবম শতকের কবিদের অন্তর্ভুক্ত হিল্লার সুবক্তা কবি ইবনে আরান্দাস এ ফযিলত প্রসঙ্গে এক কাসীদায় বলেছেন :
وَ صُعُوْدُ غَارِبِ أَحْمَدَ فَضْلٌ لَهُ دُوْنَ الْقَرَابَةِ وَ الصَّحَابَةِ أَفْضَلَا
“আহমদের কাঁধের উপর আরোহণ তাঁর (আলীর) একটি ফযিলত। আর এ ফযিলত (মহানবীর সাথে) তাঁর আত্মীয়তা ও সাহচর্য অপেক্ষাও শ্রেয়।”
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে পবিত্র কাবার
দরজা খোলা হলো। তখন তিনি কাবার দরজার উপর হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং জনতা
তাঁর উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় পবিত্র মুখমণ্ডলের দিকে তাকাচ্ছিল। ঐ অবস্থায়
জনগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বললেন :
الحمد لله الذى صدق وعده و نصر عبده و هزم الأحزاب وحده
“ঐ মহান আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা, যিনি তাঁর
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং নিজেই সকল
দল ও গোষ্ঠীকে পরাজিত করেছেন।”
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একখানা আয়াতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি মহানবীকে তাঁর আপন মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন। এ আয়াত হলো :
) إنّ الّذى فرض عليك القرآن لرادّك إلى معاد(
“যিনি আপনার ওপর এ কুরআনের বিধান পাঠিয়েছেন
(এবং এ কুরআন প্রচার করতে গিয়ে আপনি নিজ দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন),
তিনিই আপনাকে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।” (সূরা কাসাস : ৮৫)
‘মহান আল্লাহ নিজ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ
করেছেন’- এ কথা বলার মাধ্যমে মহানবী (সা.) এ গায়েবী প্রতিশ্রুতি যে
বাস্তবায়িত হয়েছে, সে ব্যাপারে সবাইকে অবগত করলেন। এভাবে আবারও তিনি তাঁর
সত্যবাদিতার কথা প্রমাণ করলেন।
মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গণ ও এর বাইরে
সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস যেন বুকের মধ্যে আটকে গিয়েছিল
এবং জনগণের মন-মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনা প্রভাব বিস্তার
করেছিল। মক্কাবাসী ঐ মুহূর্তগুলোয় নিজেদের ঐ সকল অন্যায়, অত্যাচার ও
শত্রুতামূলক আচরণের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা করছিল।
এখন ঐ গোষ্ঠী,- যারা বহু বার মহানবীর
বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধ বাঁধিয়ে তাঁর তরুণ অনুসারী ও সাহাবীগণকে হত্যা
করেছিল এবং অবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, রাতের আঁধারে তাঁর বাড়িতে হামলা
চালিয়ে তাঁকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে,- এখন তারাই তাঁর শক্তিশালী হাতের
মুঠোয় বন্দী হয়ে গেছে এবং মহানবীও তাদের ওপর যে কোন ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণ
করতে পারেন।
এ লোকগুলো নিজেদের বড় বড় অপরাধের কথা স্মরণ
করে পরস্পর বলাবলি করছিল :“ তিনি অবশ্যই আমাদের সবাইকে হত্যা করবেন বা
কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে হত্যা এবং কিছুসংখ্যককে বন্দী করবেন। আর তিনি আমাদের
নারী ও শিশুদেরও দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করবেন।”
তাদের বিভিন্ন শয়তানী চিন্তায় ব্যস্ত থাকাকালে হঠাৎ মহানবী (সা.) এ কথার মাধ্যমে সকল নীরবতার অবসান ঘটালেন। তিনি বললেন :ماذا تقولون؟ و ماذا تظنّون؟ “ তোমাদের বক্তব্য কী? কী ধারণা করছ?”
তখন জনগণ হতবাক, অস্থির ও ভীত হয়ে
ভাঙা-ভাঙা ও কাঁপা কণ্ঠে মহানবীর সুমহান দয়া, মমত্ববোধ ও আবেগ-অনুভূতির কথা
স্মরণ করে বলেছিল :“ আমরা আপনার ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা ছাড়া আর
কিছুই ভাবছি না। আমরা আপনাকে আমাদের‘ মহান ভাই’ এবং‘ মহান ভাইয়ের সন্তান’
ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।” তাদের আবেগপূর্ণ এ কথাগুলোর মুখোমুখি হলে
স্বভাবগতভাবেই দয়ালু, ক্ষমাশীল ও উদার মহানবী (সা.) বললেন :“ আমার ভাই
ইউসুফ তাঁর অত্যাচারী ভাইদের যে কথা বলেছিলেন, আমিও তোমাদের সে একই কথা বলব
:
) لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم و هو أرحم الرّاحمين(
আজকের এ দিনে তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই; মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং তিনি সবচেয়ে দয়ালু।” (সূরা ইউসুফ : ৯২)
মহানবীর কালাম উচ্চারণের আগে যে বিষয়টি
মক্কাবাসীদের বেশ আশাবাদী করেছিল, তা ছিল, মক্কা নগরীতে প্রবেশ করার সময়
একজন মুসলিম সেনা কর্মকর্তা যে স্লোগানটি দিয়েছিলেন তার প্রতি মহানবী তীব্র
বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। সে সময় ঐ সেনা কর্মকর্তা বলছিলেন :
اليـوم يـوم الـملحـمة اليـوم تستـحلّ الـحرمة
“আজ যুদ্ধের দিন; আজ তোমাদের জান-মাল হালাল
গণ্য হবে (তাদেরকে হত্যা ও তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা হবে)।” মহানবী (সা.)
এ ধরনের কবিতা ও স্লোগান শুনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন এবং তিনি ঐ সেনা
কর্মকর্তার হাত থেকে পতাকা কেড়ে নিয়ে তাঁকে সেনানায়কের পদ থেকে অপসারণ করার
নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর কাছ থেকে পতাকা নেয়ার
দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আরেকটি বর্ণনা মতে, ঐ সেনা কর্মকর্তার পুত্র তাঁর পদে
অধিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পিতার হাত থেকে পতাকা গ্রহণ করেছিল। এ সেনা কর্মকর্তা
ছিলেন খাযরাজ গোত্রপতি সাদ ইবনে উবাদাহ্। এ ধরনের দয়ার্দ্র আচরণ,- তাও আবার
মক্কার পরাজিত অধিবাসীদের চোখের সামনে- তাদেরকে মহানবীর পক্ষ থেকে সাধারণ
ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল। আর সেই মুহূর্তে আবু
সুফিয়ান বাইতুল্লাহ্-এ বা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেয়া বা নিজেদের বাড়িতে
দরজা বন্ধ করে অবস্থান রত একদল লোককে নিরাপত্তা প্রদানের ঘোষণা করে।
মহানবী (সা.)-এর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
মহানবী (সা.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন
:“ তোমরা, হে লোকসকল! অত্যন্ত অনুপযুক্ত স্বদেশবাসী আমাকে আমার বাস্তুভিটা
থেকে বহিষ্কার করেছিলে। তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলে। কিন্তু এত
অপরাধ সত্ত্বেও তোমাদের আমি ক্ষমা করে দিচ্ছি এবং তোমাদের পা থেকে দাসত্বের
শৃঙ্খল আমি খুলে দিচ্ছি ও ঘোষণা করছি :
إذهبوا فأنتم الطّلقاء
-যাও, তোমরা মুক্ত জীবন যাপন কর; কারণ তোমরা সবাই মুক্ত।”
হযরত বিলালের আযান
যুহরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল।
আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্মের মুয়ায্যিন (বিলাল) পবিত্র কাবার ছাদে উঠে ঐ
সাধারণ সমাবেশে সমগ্র জনতার কানে বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাওহীদ ও রিসালাতের ধ্বনি
পৌঁছে দিলেন। একগুঁয়ে মুশরিকরা সবাই যে যার মতো মন্তব্য করছিল। তাদের একজন
বলল :“ অমুকের জন্য সাধুবাদ; কারণ সে মারা গেছে বলেই তাকে আর আযানের ধ্বনি
শুনতে হলো না।” ইত্যবসরে আবু সুফিয়ান বলল :“ আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলব না।
কারণ মুহাম্মদের গোয়েন্দা সংস্থা এত শক্তিশালী যে, আমি ভয় পাচ্ছি মসজিদের এ
সব ধূলিকণাও আমাদের কথা-বার্তা তাকে অবগত করবে।”
এ অবিবেচক বৃদ্ধ (আবু সুফিয়ান), জীবনের শেষ
মুহূর্ত পর্যন্ত যার অন্তর ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত ও আলোকিত হয় নি, গায়েবী
ইলাহি জগৎ থেকে তথ্য লাভ ও বাস্তবতাসমূহ অবগত হওয়া এবং পার্থিব জগতের
অত্যাচারী গুপ্তচরবৃত্তি অভিন্ন বলেই মনে করত এবং এ দু’ টি বিষয়কে গুলিয়ে
ফেলেছিল। গায়েবী বিষয়াদি সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর অবগত হওয়া এমন এক বিষয়
যা স্বাভাবিক জাগতিকতার গণ্ডির বাইরে। অন্যদিকে গোপন অবস্থা সম্পর্কে
রাজনীতিজ্ঞদের অবগতি ভিন্ন একটি বিষয়, যা কোন গোষ্ঠী বা দলকে কাজে লাগিয়ে
তারা অর্জন করে থাকে।
মহানবী (সা.) যুহরের নামায আদায় করলেন।
অতঃপর উসমান ইবনে তালহাকে ডেকে পবিত্র কাবার চাবি তাঁকে দিয়ে বললেন :“ এ পদ
তোমাদের বংশের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং তা তোমাদের বংশের জন্যই সংরক্ষিত
থাকবে।” মহানবীর কাছ থেকে এ ছাড়া অন্য কিছু আশা করারও ছিল না। ইনি সেই নবী,
যিনি মহান আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হন জনগণের মাঝে ঘোষণা করার
জন্য :
) إنّ الله يأمركم أن تؤدُّوا الأمانات إلى أهلها(
“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাদেরকে প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সূরা নিসা : ৫৮)
এমন নবীই এ ধরনের মহা আমানত উপযুক্ত
ব্যক্তির কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে অবশ্যই অগ্রগামী হবেন। তিনি কখনই
সামরিক ক্ষমতা ও বাহুবলের দ্বারা জনগণের অধিকার পদদলিত করেন না এবং
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জনগণকে বলেন :“ পবিত্র কাবার চাবি রক্ষণাবেক্ষণ ইবনে
তালহার সুনিশ্চিত অধিকার এবং এ ক্ষেত্রে আর কোন ব্যক্তির কোন অধিকার নেই।”
ইত্যবসরে মহানবী (সা.) পবিত্র কাবা
সংক্রান্ত সকল পদ বিলুপ্ত করেন। তবে যে সব পদ জনগণের জন্য কল্যাণকর, কেবল
সেসব, যেমন পবিত্র কাবার চাবি রক্ষণাবেক্ষণ, পবিত্র কাবার উপর পর্দা বা
গিলাফ দেয়া ও হাজীগণকে খাবার পানি সরবরাহ করার পদ ইত্যাদি বহাল রাখেন।
আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর নসিহত
মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়বর্গ যাতে অবগত
হন যে, মহানবীর সাথে তাঁদের আত্মীয়তা ও রক্ত-সম্পর্ক তাঁদের কাঁধ থেকে কোন
বোঝা তো লাঘব করেই নি; বরং তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আরো ভারী করেছে, এ
কারণেই মহানবী এক ভাষণ দেন, যাতে করে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, তাঁর
সাথে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন অবমাননা ও
উপেক্ষা করার কারণ না হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার
সুবাদে তাঁরা যেন কোন ধরনের অসৎ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ না করেন। তাই তিনি
হাশিম ও আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের এক সমাবেশে যে কোন ধরনের অবৈধ বৈষম্যের
তীব্র নিন্দা এবং সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্য
প্রতিষ্ঠা করার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন:
“হে হাশিম ও আবদুল মুত্তালিবের বংশধরগণ!
আমি তোমাদের কাছেও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল এবং আমার ও
তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও মমতার বন্ধন অটুট। তবে তোমরা ভেবো না যে, কিয়ামত
দিবসে কেবল আত্মীয়তার এ সম্পর্ক তোমাদের মুক্তি দিতে সক্ষম। এ কথাটা
তোমাদের সবার জানা থাকা উচিত, তোমাদের ও অন্যদের মধ্যে আমার বন্ধু হচ্ছে
সেই ব্যক্তি, যে খোদাভীরু এবং যারা কিয়ামত দিবসে ভারী পাপের বোঝা নিয়ে মহান
আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং
কিয়ামত দিবসে আমার দ্বারা কোন উপকারই সাধিত হবে না। আর আমি ও তোমরা
প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মের জন্য (মহান আল্লাহর কাছে) দায়বদ্ধ (و اَنّ لِى عملى و لكم عملكم )।”
মসজিদুল হারামে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ
মসজিদুল হারামে বাইতুল্লাহর চারপাশে এক
বিশাল ও মহতী গণ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলমান ও মুশরিক- শত্রু-মিত্র
সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল এবং ইসলাম ধর্মের মহত্ত্ব ও মহানবী (সা.)-এর
মহানুভবতা মসজিদুল হারামকে ঘিরে রেখেছিল। সমগ্র মক্কা নগরীর ওপর প্রশান্তির
ছায়া বিস্তৃতি লাভ করেছিল। আর তখন মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত দাওয়াতের রূপ
জনগণের সামনে উপস্থাপন করারও যথার্থ সময় এসে গিয়েছিল। মহানবী (সা.) যে কথা
বিশ বছর আগে বলা শুরু করেছিলেন এবং মুশরিকদের অপকর্ম ও দুর্বৃত্তপনার কারণে
তা সম্পাদন করতে সক্ষম হন নি, তা আজ সম্পন্ন করার সময় এসে গেল।
মহানবী (সা.) স্বয়ং ঐ পরিবেশেরই সন্তান
ছিলেন এবং আরব সমাজের দুঃখ-বেদনা এবং এর উপশম সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ পরিচিতি ও
জ্ঞান ছিল। তিনি জানতেন, পবিত্র মক্কার অধিবাসীদের অধঃপতনের কারণ কী? এ
কারণেই তিনি আরব সমাজের ব্যথা-বেদনাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে এ সব বিরানকারী
ব্যাধি পূর্ণরূপে নিরাময়ের সংকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে আমরা মহানবীর ভাষণের কতক বিশেষ
উল্লেখযোগ্য দিক উপস্থাপন করব। উল্লেখ্য, এ ভাষণের প্রতিটি অংশ (মানব
জাতির) এক একটি ব্যাধি নিরাময় করার জন্যই বর্ণিত হয়েছে।
১. বংশ-কৌলীন্যের গর্ব
পরিবার, বংশ ও গোত্র নিয়ে বড়াই করার বিষয়টি
আরব সমাজের মৌলিক ও সনাতন ব্যাধিগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরব সমাজে একজন
লোকের সবচেয়ে বড় অহংকার ছিল এটাই যে, সে কুরাইশ গোত্রের মতো একটি প্রসিদ্ধ
গোত্রোদ্ভূত। মহানবী (সা.) এ কল্পিত মূলনীতিটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার জন্য বললেন
:
أيّها النّاس إنّ الله قد أذهب عنكم نخوة الجاهلية و تفاخرها بآبائها ألا إنّكم من آدم و آدم من طين ألا أنّ خير عباد الله عبد اتقاه
“হে জনগণ! মহান আল্লাহ ইসলাম ধর্মের আলোকে
জাহিলী যুগের গর্ব এবং বংশ-গৌরব ও কৌলীন্য তোমাদের মধ্য থেকে বিলুপ্ত করে
দিয়েছেন। তোমাদের সবাই আদম থেকে এসেছ (সৃষ্ট হয়েছ) এবং তিনিও কাদামাটি থেকে
সৃষ্ট হয়েছেন। সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ সেই ব্যক্তি, যে পাপ ও খোদাদ্রোহিতা
থেকে বিরত থাকে (মহান আল্লাহকে ভয় করে)।”
ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি কেবল
তাকওয়া, তা জগতবাসীকে বোঝানোর জন্য ভাষণের এক অংশে মহানবী (সা.) সমগ্র মানব
জাতিকে দু’ শ্রেণীতে ভাগ করেছেন এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব ঐ ব্যক্তিদের বলে
গণ্য করেছেন যাঁরা মুত্তাকী, পরহেজগার। আর এ শ্রেণীবিন্যাসের দ্বারা তিনি
শ্রেষ্ঠত্বের সমুদয় কাল্পনিক মাপকাঠি বাতিল করে দিয়েছেন।
তিনি ভাষণে বলেন :
إنّما النّاس رجلان : مؤمن تقىّ كريم علي الله و فاخر شقىّ هيّن علي الله
“মহান আল্লাহর কাছে মানব জাতি দু’ শ্রেণীতে
বিভক্ত : পরহেজগার মুমিনদের দল- যারা মহান আল্লাহর কাছে সম্মানিত এবং সীমা
লঙ্ঘনকারী ও পাপী- যারা মহান আল্লাহর কাছে লাঞ্ছিত।
২. আরব হবার কারণে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব
মহানবী (সা.) জানতেন, এ জাতি আরব হওয়া এবং এ
জাতির সাথে সংশ্লিষ্টতা ও সম্পর্ককে নিজেদের অন্যতম গৌরব ও মর্যাদা বলে
বিশ্বাস করে। আরব জাতীয়তাবাদের গর্ব এদের হৃদয়গুলোর গভীরে ও রক্ত-মজ্জার
মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। তিনি এ ব্যথার উপশম এবং ঠুনকো শ্রেষ্ঠত্ব ও
মর্যাদার কল্পিত প্রাসাদ ধূলিসাৎ করার জন্য জনগণের দিকে তাকিয়ে বললেন :
ألا أنّ العربيّة ليست ب< اب> والد و لكنها لسان ناطق، فمن قصر عمله لم يبلغ به حسبه
“হে লোকসকল! আরব হওয়া তোমাদের সত্তার অংশ
নয়; বরং তা হচ্ছে একটি সাবলীল ভাষা; আর যে কেউ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন
করার ক্ষেত্রে অবহেলা করবে, বংশ-কৌলীন্য তাকে কোথাও (মর্যাদার অবস্থানে)
পৌঁছে দেবে না (এবং তার কর্মের দোষ-ত্রুটি ও অপূর্ণতা পূরণ করে দেবে না)।”
এ কথার চেয়ে অধিকতর বলিষ্ঠ ও সাবলীল বক্তব্য পাওয়া যাবে কি?
৩. সমগ্র জাতির জন্য
মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রকৃত আহবায়ক সমগ্র মানব জাতির ও মানব সমাজের মধ্যেকার সাম্য দৃঢ়ীকরণের লক্ষ্যে বললেন :
إنّ النّاس من عهد آدم إلى يومنا هذا مثل أسنان المشط لا فضل للعربِىّ علي العجمىّ و لا للأحمر علي الأسود إلّا بالتّقوي
“আদম (আ.)-এর যুগ থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত
সমগ্র মানব জাতি চিরুনির দাঁতগুলোর মতো পরস্পর সমান। অনারবের ওপর আরব জাতির
এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের
একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।”
মহানবী (সা.) এ কথার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল
জাতির মধ্য থেকে সব ধরনের অবৈধ বৈষম্য (শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকাপ্রসূত
পার্থক্য) ও সকল সংকীর্ণতাবোধ বিলুপ্ত করে দিয়েছেন এবং যে কাজ মানবাধিকার
ঘোষণার সনদপত্র বা মুক্তি ও স্বাধীনতার সনদ অথবা মানব জাতির সাম্যের
প্রবক্তারা এত হৈ চৈ করে এবং ঢাক-ঢোল পিটিয়েও যা সমাপ্ত করতে পারে নি, তা
তিনি ঐ অতীত যুগে আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।
৪. শত বছরব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং পুরনো শত্রুতা
আরব জাতি ও গোত্রগুলো অগণিত গৃহযুদ্ধ ও
অবিরাম রক্তপাতের কারণে এক শত্রু মনোভাবাপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছিল এবং
সর্বদা তাদের মধ্যে যুদ্ধের দাবানল প্রজ্বলিত হতো। আরব-উপদ্বীপের ওপর পূর্ণ
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর মহানবী (সা.) এ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ও শান্তির জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ
রোগের উপশম আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। মহানবী এ সমস্যা সমাধানের উপায় এর মাঝে
দেখতে পেলেন যে, তিনি আপামর জনগণের কাছে আহবান জানাবেন যেন তারা
জাহিলিয়াতের যুগে যে সব রক্ত ঝরানো হয়েছে ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে,
সেগুলো (প্রতিশোধ গ্রহণ করা) থেকে বিরত থাকে এবং এভাবে ঐ যুগের সকল বিবাদের
চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘোষণা করে। এর ফলে যে কোন ধরনের রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড-
যা শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে দেয়,- প্রতিহত করা সম্ভব হবে এবং প্রতিশোধ
গ্রহণ ও আক্রমণ মোকাবেলা করার ধুয়ো তুলে যে সব আক্রমণ, লুটতরাজ ও
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার সম্ভাবনা ছিল, সেগুলোর চিন্তাও আরবদের মন-মগজ থেকে
বের করে দেয়া সম্ভব হবে।
মহানবী (সা.) এ ধরনের লক্ষ্য অর্জন করার জন্য ঘোষণা করলেন :
ألا إنّ كلّ مال و مأثرة و دم فِى الجاهليّة تحت قدمىّ هاتين
“আমি জাহিলী যুগের প্রাণ ও ধন-সম্পদ
সংক্রান্ত যাবতীয় ঝগড়া-বিবাদ এবং কল্পিত গর্ব আমার এ দুই পদতলে রেখে দিলাম
এবং সেসব কিছুকে আমি বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করছি।”
৫. ইসলামী ভ্রাতৃত্ব
মহানবী (সা.)-এর ঐ দিনের ভাষণের একটি অংশ
মুসলমানদের একতা ও সংহতি এবং পারস্পরিক অধিকারসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এ
সব ইতিবাচক বিষয় বর্ণনা করার ক্ষেত্রে মহানবীর লক্ষ্য ছিল, ইসলাম ধর্মের
বাইরে যারা আছে, তারা এ ধরনের একতা ও সৌহার্দ্যবোধ প্রত্যক্ষ করে
আন্তরিকতার সাথে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়বে এবং এ ধর্ম গ্রহণ করবে।
মহানবী (সা.) বললেন :
المسلم أخ المسلم و المسلمون إخوة، و هم يد واحدة علي من سواهم تتكافؤ دمائهم يسعي بذمّتهم أدناهم
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই এবং সকল
মুসলমান পরস্পর ভাই এবং অমুসলিমদের বিপক্ষে তারা সবাই একটি হাতের মতো
(ঐক্যবদ্ধ)। তাদের সবার রক্ত এক সমান (অর্থাৎ তাদের সবার জীবন-পণ এক ও
অভিন্ন। তাই কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতে পারবে না), এমনকি মুসলমানদের
পক্ষে তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে ছোট ব্যক্তিও প্রতিশ্রুতি বা চুক্তিবদ্ধ হতে
পারবে।”
অপরাধীদের গ্রেফতার
এ বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই যে, মহানবী
(সা.) করুণা, উদারতা ও ক্ষমার সবচেয়ে বড় নমুনা ছিলেন এবং চরমপন্থি গোষ্ঠী
রূঢ় আচরণ প্রকাশ করা সত্ত্বেও তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে ঐ
উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ছিল, যারা অনেক ভয়াবহ অপরাধ
করেছিল এবং এতসব ভয়ঙ্কর অপরাধ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করার পর তারা যে মুসলমানদের
মধ্যে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করবে, তা কখনই কল্যাণকর ও বাঞ্ছনীয় ছিল না।
কারণ ভবিষ্যতে এ ধরনের ক্ষমা ঘোষণার যথেচ্ছ অপব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে
উস্কানিমূলক তৎপরতা চালানো হতে পারে।
মুসলমানরা রাস্তা-ঘাটে বা মসজিদুল হারামে এ
জঘন্য অপরাধীদের কয়েকজনকে হত্যা করেছিল এবং তাদের মধ্য থেকে দু’ জন হযরত
আলী (আ.)-এর বোন উম্মে হানীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আলী (আ.)
অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উম্মে হানীর বাড়ি ঘেরাও করে ফেললেন। উম্মে হানী
ঘরের দরজা খুললেন এবং একজন অপরিচিত সেনাপতির মুখোমুখি হলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি
নিজের পরিচয় প্রদান করলেন এবং বললেন :“ আমি একজন মুসলিম নারী হিসাবে এ
দু’ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছি। মুসলিম নারীর আশ্রয়দান মুসলিম পুরুষের মতোই
সম্মান পাওয়ার যোগ্য।” হযরত আলী এ সময় যুদ্ধের শিরস্ত্রাণ মাথা থেকে উঠিয়ে
ফেলেন যাতে উম্মে হানী তাঁকে চিনতে পারেন। বোনের দৃষ্টি তখন ভাইয়ের উপর
পড়ল। বহু বছরের ঘটনাবলী এ দু’ ভাই-বোনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। সাথে সাথে
তাঁর দু’ চোখ জলে পূর্ণ হয়ে গেল এবং তিনি ভাইয়ের কাঁধের উপর দু’ হাত
রাখলেন। অতঃপর তাঁরা দু’ জন মহানবী (সা.)-এর কাছে গেলেন এবং মহানবীও এ
নারীর প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে সা’ দ ইবনে আবী সারাহ্, যে
প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং পরে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল, সেও ঐ দশ
ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে সে
হযরত উসমানের সুপারিশ ও মধ্যস্থতায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
ইকরামাহ্ ও সাফ্ওয়ানের কাহিনী
বদর যুদ্ধের পরবর্তী যুদ্ধগুলোর অগ্নি
প্রজ্বলনকারী ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহল ইয়েমেনে পলায়ন করে। তবে তার স্ত্রীর
সুপারিশে সে মুক্তি পেয়েছিল। সাফ্ওয়ান ইবনে উমাইয়্যা বিভিন্ন ধরনের জঘন্য
অপরাধ ছাড়াও বদর যুদ্ধে নিহত তার পিতা উমাইয়্যার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ
করার জন্য এক মুসলমানকে মক্কায় প্রকাশ্য দিবালোকে জনতার চোখের সামনে
ফাঁসীতে ঝুলিয়েছিল। এ কারণে মহানবী (সা.) তার রক্ত বৈধ ঘোষণা করেন। সে ঐ
সময় শাস্তি পাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে সমুদ্রপথে হিজায থেকে পালিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিশেষ করে যখন সে জানতে পেরেছিল, ঐ দশ ব্যক্তির তালিকায়
তার নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
উমাইর ইবনে ওয়াহাব মহানবী (সা.)-এর কাছে
এসে তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার আবেদন জানিয়েছিল। মহানবীও তার আবেদন গ্রহণ
করেন এবং মক্কায় প্রবেশকালীন পরিহিত তাঁর পাগড়ী তাকে নিরাপত্তার প্রতীক
হিসেবে প্রদান করেন। তিনি ঐ প্রতীক নিয়ে জেদ্দায় যান এবং সাফ্ওয়ানকে সাথে
নিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি যখন যুগের সবচেয়ে
বড় অপরাধীর ওপর পড়ল তখন তিনি পূর্ণ মহানুভবতা সহকারে বললেন :“ তোমার প্রাণ ও
ধন-সম্পদ সম্মানিত; তবে তোমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা হবে উত্তম।” সে তখন
দু’ মাসের সময় চায়, যাতে সে ইসলামের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
মহানবী (সা.) তখন বললেন :“ আমি তোমাকে দু’ মাসের স্থলে চার মাসের ফুরসৎ
দিচ্ছি এজন্য যে, তুমি পূর্ণ বিচক্ষণতা, জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে এ
ধর্ম গ্রহণ কর।” চার মাস গত হতে না হতেই সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
এ ঘটনা সংক্ষিপ্ত অধ্যয়ন করলে ইসলাম ধর্মের
এক অকাট্য বাস্তবতা- যা স্বার্থান্বেষী প্রাচ্যবিদরা দুর্দমনীয়ভাবে
অস্বীকার করে থাকে- স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। শিরকের প্রতিভূরা ও মুশরিক
নেতারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে; আর
বাধ্যবাধকতা ও ভীতি প্রদর্শনের তো কোন অস্তিত্বই ছিল না। বরং চেষ্টা করা
হয়েছে, সঠিক চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার মাধ্যমেই যেন একমাত্র এ আসমানি ধর্ম
গ্রহণ করা হয়।
মক্কা বিজয়ের উল্লেখযোগ্য ও শিক্ষণীয় ঘটনাবলী বর্ণনা করার আগে এখানে নিম্নোক্ত দু’ টি আকর্ষণীয় ঘটনার দিকে আমরা ইঙ্গিত করব :
মক্কার মহিলাদের মহানবী (সা.)-এর বাইআত (আনুগত্য)
আকাবার বাইআতের পর মহানবী (সা.) প্রথম
বারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে নিম্নোক্ত দায়িত্বগুলো পালন করার জন্য মহিলাদের
কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেছিলেন :
১. মহান আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করবে না;
২. বিশ্বাসঘাতকতা করবে না;
৩. যিনা বা ব্যভিচার করবে না;
৪. নিজ সন্তানদের হত্যা করবে না;
৫. যে সন্তানরা অন্যদের ঔরসজাত তাদেরকে স্বামীদের সাথে সম্পর্কিত করবে না;
৬. কল্যাণকর কাজসমূহের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর বিরোধিতা করবে না।
বাইআতের আনুষ্ঠানিকতা ঠিক এমনই ছিল :
মহানবী (সা.) পানি-ভর্তি একটি পাত্র আনার নির্দেশ দিলেন। পাত্রটি আনা হলে
তিনি তাতে কিছু সুগন্ধি ঢাললেন। অতঃপর তিনি ঐ পাত্রের মধ্যে হাত রাখলেন এবং
যে আয়াতে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তা তেলাওয়াত করলেন। তিনি
নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং মহিলাদের বললেন : যারা এ শর্তাবলীসহ
আমার কাছে বাইআত করতে প্রস্তুত, তারা এ পাত্রে হাত রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে
তাদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের কথা ঘোষণা দেবে।
এ বাইআত গ্রহণের কারণ ছিল এই যে,
মক্কাবাসীদের মধ্যে অনেক অপবিত্র ও অসতী মহিলা ছিল এবং তাদের থেকে
প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা না হলে অশ্লীল কার্যকলাপ গোপনে চালিয়ে যাওয়ার
সম্ভাবনা ছিল।
এদেরই একজন ছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী
মুয়াবিয়ার মা হিন্দ। তার চারিত্রিক রেকর্ড অত্যন্ত খারাপ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন
ছিল। সে যে বিশেষ ধরনের সহিংসতা ও রূঢ়তা পোষণ করত, সে কারণে সে তার
চিন্তা-ভাবনা স্বামী আবু সুফিয়ানের ওপর চাপিয়ে দিত। আবু সুফিয়ান সন্ধি ও
শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ার দিন সে জনগণকে যুদ্ধ ও রক্তপাতের দিকে আহবান
জানাচ্ছিল (মক্কা বিজয় দিবসে)।
এ নারীর প্রত্যক্ষ উস্কানি উহুদ প্রান্তরে
যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হবার কারণ হয়েছিল এবং তা নির্বাপিত করার জন্য
মহানবীকে সত্তর ব্যক্তিকে কুরবানি দিতে হয়েছিল, যাঁদের একজন ছিলেন হামযাহ্।
এ নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারী নারী বিশেষ এক ধরনের হিংস্রতা সহ হযরত হামযার
পার্শ্বদেশ ছিঁড়ে তাঁর কলিজা বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে টুকরো টুকরো করেছিল।
প্রকাশ্যে সবার সামনে এ মহিলার মতো নারীদের
বাইআত গ্রহণ ছাড়া মহানবী (সা.)-এর আর কোন উপায়ও ছিল না। মহানবী বাইআতের
ধারাসমূহ পাঠ করছিলেন। যখন তিনি‘ তারা চুরি করবে না’- এ ধারায় উপনীত হলেন,
তখন হিন্দ- যে নিজের মাথা ও মুখমণ্ডল খুব ভালোভাবে ঢেকে রেখেছিল,- তার আসন
ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল :“ হে রাসূলাল্লাহ্! আপনি নির্দেশ দিচ্ছেন, মহিলারা
যেন চুরি না করে। তবে আমি কী করতে পারি, যখন আমার এক অত্যন্ত কৃপণ ও কঠোর
স্বামী আছে। এ কারণেই আমি অতীতে তার অর্থ ও সম্পদে হাত লাগিয়েছি।”
আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে বলল :“ আমি অতীতকে
হালাল করে দিলাম। তোমাকেও কথা দিতে হবে যে, তুমি ভবিষ্যতে চুরি করবে না।”
মহানবী (সা.) আবু সুফিয়ানের কথায় হিন্দকে চিনতে পেরে বললেন :“ তুমি কি
উতবার কন্যা?” সে বলল :“ জী। হে রাসূলাল্লাহ্! আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিন,
তা হলে মহান আল্লাহও আপনার প্রতি অনুগ্রহ করবেন।”
মহানবী যখন‘ তারা ব্যভিচার করবে না’- এ
বাক্য উচ্চারণ করলেন, তখন হিন্দ আবারও নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে
দোষমুক্ত প্রমাণ করার জন্য একটি কথা বলল, যা তার অজান্তেই তার অপবিত্র
অন্তরকে ফাঁস করে দিল। সে বলল :“ মুক্ত নারী কি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়?”
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বয়ং এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন আসলে ব্যক্তির
গোপন অন্তরকেই প্রকাশ করে দেয়ার নামান্তর মাত্র। যেহেতু হিন্দ নিজেকে এ
ধরনের গর্হিত নোংরা কাজ সম্পন্নকারিণী হিসেবে বিবেচনা করত এবং সে নিশ্চিত
ছিল, জনগণ এ কথা শোনার মুহূর্তে তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, তাই সে তার
থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য তৎক্ষণাৎ বলেছিল :“ মুক্ত নারী কি কখনো
অশ্লীলতা ও নোংরামিতে লিপ্ত হয়ে নিজেকে অপবিত্র করতে পারে?” ঘটনাচক্রে
জাহিলিয়াতের যুগে তার সাথে যাদের অবৈধ সম্পর্ক ছিল, তারা সবাই তার এ
অস্বীকৃতির কারণে খুব আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল ও তারা এতে হেসেছিল। তাদের হাসা
এবং হিন্দের আত্মপক্ষ সমর্থন তার অধিক অপমানের কারণ হয়েছিল।
মক্কা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের প্রতিমালয়গুলোর ধ্বংস সাধন
পবিত্র মক্কার চারপাশে অসংখ্য প্রতিমালয়
ছিল, যেগুলো আশ-পাশের গোত্রগুলোর কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও পবিত্র বলে গণ্য
হতো। পবিত্র মক্কা অঞ্চলে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার মূলোৎপাটন করার জন্য
মহানবী (সা.) মক্কার আশে-পাশে বেশ কিছু বাহিনী প্রেরণ করেন যাতে তারা
প্রতিমালয়গুলো ধ্বংস করে। স্বয়ং মক্কা নগরীতে ঘোষণা করা হয়, কারো ঘরে কোন
মূর্তি থাকলে সে যেন তা তৎক্ষণাৎ ভেঙে ফেলে। এক্ষেত্রে আমর ইবনে আস ও সা’ দ
ইবনে যাইদ যথাক্রমে‘ সুওয়া’ ও‘ মানাত’ প্রতিমা ধ্বংস করার দায়িত্ব পান।
খালিদ ইবনে ওয়ালীদ, জাযীমাহ্ বিন আমীর
গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া এবং‘ উয্যা’ নামক মূর্তি ভাঙার জন্য একটি
সেনাদলের অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে ঐ গোত্রের আবাসভূমির দিকে রওয়ানা হন।
মহানবী (সা.) তাঁকে রক্তপাত ও যুদ্ধ না করার নির্দেশ দেন এবং আবদুর রহমান
ইবনে আউফকে তাঁর সহকারী নিযুক্ত করেন।
জাহিলিয়াতের যুগে বনী জাযীমাহ্ গোত্র
ইয়েমেন থেকে ফেরার পথে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের চাচা ও আবদুর রহমানের পিতাকে
হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। আর খালিদ মনে মনে তাদের প্রতি
শত্রুতা পোষণ করতেন। তিনি বনী জাযীমার মুখোমুখি হলে তাদের সবাইকে
অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ও আত্মরক্ষা করার জন্য প্রস্তুত দেখতে পেলেন।
সেনাদলের অধিনায়ক উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন :“ তোমরা তোমাদের অস্ত্র মাটিতে
ফেলে দাও। কারণ মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার দিন শেষ হয়ে গেছে এবং উম্মুল
কুরার (পবিত্র মক্কা নগরী) পতন হয়েছে এবং সেখানকার সকল অধিবাসী ইসলামের
সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।” গোত্রের নেতারা অস্ত্র জমা দিয়ে
মুসলিম সেনাদলের কাছে আত্মসমর্পণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে। ঐ গোত্রের এক
ব্যক্তি বিশেষ বুদ্ধিমত্তার কারণে বুঝতে পারে যে, সেনাদলের অধিনায়কের
অসদিচ্ছা রয়েছে। তাই সে গোত্রপতিদের বলল :“ আত্মসমর্পণের পরিণতি হবে
বন্দীদশা এবং এরপর মৃত্যু।” অবশেষে গোত্রপতিদের মতই বাস্তবায়িত হলো এবং
তারা ইসলামের সৈনিকদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করল। এ সময় সেনাদলের অধিনায়ক
অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে এবং পবিত্র ইসলামের সুস্পষ্ট বিধানের বিপক্ষে ঐ
গোত্রের পুরুষদের হাত পেছনের দিকে বেঁধে বন্দী করার আদেশ দেন। অতঃপর ভোরের
বেলা বন্দীদের মধ্য থেকে একটি দলকে খালিদের নির্দেশে হত্যা করা হয় এবং আরেক
দলকে মুক্তি দেয়া হয়।
খালিদের ভয়ঙ্কর অপরাধের সংবাদ মহানবী
(সা.)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি
তৎক্ষণাৎ হযরত আলী (আ.)-কে ঐ গোত্রের কাছে গিয়ে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এবং নিহত
ব্যক্তিদের রক্তমূল্য (দিয়াত) প্রদান করার নির্দেশ ও দায়িত্ব দেন। হযরত
আলী (আ.) মহানবীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এতটা সূক্ষ্মদর্শিতা
অবলম্বন করেছিলেন যে, এমনকি গোত্রের কুকুরগুলো যে কাঠের পাত্রে পানি পান
করত এবং খালিদের আক্রমণের কারণে ভেঙে গিয়েছিল, সেটার মূল্যও প্রদান করলেন।
এরপর তিনি সকল শোকসন্তপ্ত গোত্রপতিকে ডেকে
নিয়ে বললেন :“ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের রক্তমূল্য কি
যথাযথভাবে প্রদান করা হয়েছে?” তখন সবাই বলল :“ হ্যাঁ।” এরপর আলী (আ.), ঐ
গোত্রের আরো কিছু ক্ষয়-ক্ষতি ঘটে থাকতে পারে, যে ব্যাপারে তারা তখনো জ্ঞাত
নয় বা তারা তখনো উপলব্ধি করতে পারে নি বিধায় আরো অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে
পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি মহানবীকে তাঁর কাজের বিস্তারিত
প্রতিবেদন প্রদান করেন। মহানবী তাঁর এ কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এরপর তিনি
কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দু’ হাত উপরের দিকে তুলে সানুনয় দুআ করলেন :
اللّهمّ إنّى أبرء إليك ممّا صنع خالد بن الوليد
“ হে আল্লাহ! আপনি জ্ঞাত থাকুন, আমি খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অপরাধের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট এবং আমি কখনো তাকে যুদ্ধের আদেশ দিই নি।”
হযরত আমীরুল মুমিনীন ঐ গোত্রের অধিবাসীদের
মানসিক ও আত্মিক ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিকার বিধান করার বিষয়টিও বিবেচনা
করেছিলেন। এ কারণে তিনি যে সব ব্যক্তি খালিদের আক্রমণের ফলে ভয় পেয়েছিল,
তাদেরকেও কিছু পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিলেন এবং তাদের মনোরঞ্জন করেছিলেন।
মহানবী (সা.) যখন হযরত আলীর এ ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতির কথা জানতে পারলেন, তিনি
বলেছিলেন :“ হে আলী! আমি তোমার এ কাজ অগণিত লাল পশমবিশিষ্ট উট দিয়েও বিনিময়
করব না। হে আলী! তুমি আমার সন্তুষ্টি অর্জন করেছ; মহান আল্লাহও তোমার
প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। হে আলী! তুমি মুসলমানদের পথ প্রদর্শক। ঐ ব্যক্তি
সৌভাগ্যবান যে তোমাকে ভালোবাসে এবং তোমার পথে চলে; ঐ ব্যক্তি দুর্ভাগা, যে
তোমার বিরোধিতা করে এবং তোমার পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও বিচ্যুত হয়।” “
মূসার কাছে হারুন যেমন, আমার কাছে তুমিও ঠিক তেমনি। তবে আমার পর কোন নবী
নেই।” # (সূত্র: আয়াতুল্লাহ জা'ফর সুবহানির লেখা 'চিরভাস্বর মহানবী'
শীর্ষক বই)
No comments