আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর (আ.) জীবনের শেষ ক'টি দিন ও ঘণ্টা!
ইরাকের নাজাফ আল আশরাফে হযরত আলীর পবিত্র মাজারের একাংশ। পবিত্র কুরআন পড়ছেন অনুরাগীরা এই রমজানে |
আজ ২১ রমজান হযরত আলীর শাহাদাত বার্ষিকী। ইসলামের
ইতিহাসে চরমপন্থী হিসেবে বিবেচিত খাওয়ারেজ বা খারেজীরা আলী (আ.)-কে শহীদ
করার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাদের একজন ইবনে মুলজিম ১৯ রমজান কুফার মসজিদে
নামাজে সিজদারত হযরত আলীর ওপর তরবারির আঘাত হানে যা তাঁর মাথায় বিদ্ধ হয়।
আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ)’ যখন কুফার
মসজিদে ১৯ রমজান ভোরবেলায় নামাজে সিজদারত অবস্থায় তাঁর মাথা-মুবারকে
অভিশপ্ত খারিজি ইবনে মুজলিমের বিষ-মাখানো তরবারির আঘাতের শিকার হলেন তখন
তিনি আহ্-উহ্ বা আর্তনাদ করেননি কিংবা কেঁদে ওঠেননি! বরং তিনি খুব
শান্তভাবে বললেন: বিসমিল্লাহি ওয়া বিল্লাহি ওয়া ফি সাবিলিল্লাহি, ফুজতু ওয়া
রাব্বিল কা’বা! অর্থাৎ মহান আল্লাহর নামে ও আল্লাহর মাধ্যমে ও আল্লাহর
পথে, কাবার প্রভুর শপথ আমি সফল!.... কিছুক্ষণ পর ইমাম হাসান মুজতাবা (আ)
আসলেন ও বাবার মাথাকে নিজের কোলে রাখলেন।...
হযরত আলীর মস্তক মুবারক থেকে রক্ত গড়িয়ে
পড়ছিল এবং তাঁর দাড়ি মুবারকও রক্ত-রঞ্জিত হল। ইমাম হাসান তাঁর বাবার দিকে
তাকাচ্ছিলেন আর তাঁর চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে যাচ্ছিল, তাঁর এক ফোটা অশ্রু এসে
পড়ল হযরত আলীর চেহারা মুবারকে। তিনি চোখ খুলে বললেন, প্রিয় হাসান আমার!
তুমি কাঁদছ!? কেঁদনা! আমি এ মুহূর্তে এমন অনেকের মধ্যে উপস্থিত যারা আমাকে
সালাম করছেন!.. রাসুল (সা) এখানে আছেন, ফাতিমা জাহরা এখানে আছেন! ... হযরত
আলীকে উঠিয়ে নেয়া হয়। এরপর ইমাম হাসান কুফার ওই মসজিদেই নামাজ পড়লেন। হযরত
আলীও বসা অবস্থায় নামাজ পড়লেন।... তিনি কখনও একদিকে হেলে পড়তে যাচ্ছিলেন
আবার কখনও নিজেকে সামলে নিচ্ছিলেন। অবশেষে তাঁকে নিজ ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া
হয়। সঙ্গীদের অনেকেই ও কুফাবাসী শুনলেন একটি গায়েবি আওয়াজ: আল্লাহর শপথ!
হেদায়াতের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে!... নিহত হয়েছে আলী!
(পুরো বাক্যটি এমন: “ধর্ম বা দীনের
স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে, তাকওয়ার ধ্বজা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে
পড়েছে, মুস্তাফা (সাঃ)’র চাচাতো ভাই ও ওয়াসীকে হত্যা করা হয়েছে, আলী
মোর্তজা(আ.) নিহত হয়েছেন, তাঁকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হত্যা করেছে।”)
সবাই ছুটে আসল কুফার মসজিদের দিকে!
চারদিকে শোকার্ত কলরব কোলাহল! মহানবীর ওফাতের দিনের মতই কুফাতে কান্নার রোল
উঠল। শোকে নিমগ্ন হল গোটা কুফা। বর্ণনায় এসেছে, আলী (আ)কে আনা হল। কাছেই
ইমাম হাসান। ইমাম হাসান এত বেশি কাঁদলেন যে তাঁর চোখের পলকগুলো ক্ষত-বিক্ষত
হল। কিন্তু হযরত আলীর চোখ হাসানের ওপর পড়ার পর তিনি বললেন, আমার হাসান
কেঁদোনা! ধৈর্য ধর, শক্ত হও, এসব কিছুই না! এমনসব ঘটনা ঘটেই ও এসব অতিক্রম
হয়ে যায়। তিনি বড় ছেলেকে এভাবে সান্ত্বনা দিলেন।
হযরত আলীকে আনা হল তাঁর ঘরে, তাঁরই
নামাজের স্থানে। তিনি নিজেই তাঁকে নামাজের এই জায়গায় আনতে বলেছিলেন।
সেখানেই তাঁর জন্য বিছানা করা হল। তাঁকে সেখানে রাখা হল। হযরত আলীর কন্যারা
সেখানে এলেন। এলেন হযরত যাইনাব ও উম্মে কুলসুম। তারা বাবার পাশে বসলেন।
এরপর কাঁদতে লাগলেন। ইমাম হাসানের কান্নার বেলায় তাকে ধৈর্য ধরার নসিহত ও
সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও কন্যাদের কান্না আর সহ্য করতে পারলেন না। এবার
তিনি নিজেও কেঁদে আকুল হলেন! হায়! মুমিনদের নেতা! আপনি এখানে যাইনাবের
কান্না সহ্য করতে পারলেন না! আশুরার দিনে যাইনাবের কান্না ও বিলাপ যদি
দেখতেন ও তাঁর শোকের মর্সিয়া যদি শুনতেন তাহলে কি করতেন?!
হাবিব ইবনে আমরু থেকে আবু হামযা সুমালি
বর্ণনা করেছেন: জীবনের শেষ ঘণ্টাগুলোতে সেই ২১ রমজানের রাতে আমিরুল
মু’মিনিনকে দেখতে গেলাম! দেখলাম হযরতের একজন কন্যা সেখানে আছেন। সেই কন্যা
কাঁদছিলেন! আমারও কান্না চলে আসল! কাঁদতে লাগলাম! কক্ষের বাইরে জড়-হওয়া
মানুষেরাও আলী-তনয়ার কান্না শুনে কাঁদতে লাগল। আমিরুল মুমিনিন চোখ খুললেন।
তিনি বললেন, আমি যা দেখছি তোমরাও যদি তা দেখতে তাহলে কাঁদতে না! আমি বললাম:
হে আমিরুল মু’মিনিন! আপনি কি দেখছেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর ফেরেশতাদের
দেখছি, আকাশের ফেরেশতাদের দেখছি ও সব নবী-রাসুলকে দেখতে পাচ্ছি, তাঁরা
সারিবদ্ধ হয়ে আমাকে সালাম করছেন ও আমাকে সম্বর্ধনা দিচ্ছেন বা স্বাগতঃ
জানাচ্ছেন। মহানবীকে (সা) দেখছি যে তিনি আমার পাশে বসে আছেন ও বলছেন: প্রিয়
আলী আরও জলদি চলে আস! আমি কাঁদলাম ও এরপর উঠে এলাম। তখনও হযরত আলীর ঘর
থেকে পুরোপুরি বের হইনি আলীর পরিবারের ফরিয়াদ শুনে অনুভব করলাম যে তিনি
দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন! (ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর
একটি ভাষণ থেকে সংগৃহীত)
হযরত আলী(আ.)’র শক্তিমত্তার একটি বর্ণনা (নাহজুল বালাগা থেকে)। তিনি বলেছেন,
لَمّا انزلَ ألله سبحانهُ قو له ”الم احسبَ النَّاسُ ان یترکوا ان یقو لوا امنّا و هم لا یفتنون٭ علمتُ انَّ الفتنة لا تنزلُ بنا و رسلُ الله (ص) بین اَظهرناَ
‘যখন এ আয়াত ‘মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা
ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে
না’ (আনকাবুত ১-২) নাযিল হলো তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
মৃত্যুর পর এ উম্মতের জন্য ফেতনা ও কঠিন পরীক্ষা আসবে।
فَقُلتُ :یا رَسولُ الله (ص) ماهذهِ الفتنةٌ الّتی اخبرک الله تعالى بها
তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ আয়াতে আল্লাহ যে ফেতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন :
یا علىُّ اِنِّ امتى سیفتنونَ من بعدی
‘হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার
সম্মুখীন হবে।’ যখন আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁর পরে কঠিন
পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন,
یا رسول الله اَوَ لیسَ قد قُلتَ لى یومَ اُحدٍ حیثُ استشهدَ مَنِ استشهدَ منَ المسلمینَ و حیّزتِ عنّى الشّهادةُ
‘ইয়া রসুলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ
হওয়ার তাঁরা শহীদ হলেন এবং শাহাদাত আমার থেকে দূরে চলে গেল, আমি এর থেকে
বঞ্চিত হলাম এবং খুবই দুঃখ পেয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলাম, কেন এ মর্যাদা আমার
ভাগ্যে ঘটল না।আপনি বললেন, ابشرُ فانّ الشّهادةَ مِن ورائک
যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে।’
[আলী(আ.) এ সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হলো হযরত ফাতেমা যাহরা
(সা.)-কে বিবাহ করেছেন এবং এক সন্তানের জনক। এ বয়সের যুবক যখন জীবনকে
সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন আলী(আ.) শাহাদাতের প্রত্যাশী।
উল্লেখ্য, ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে সত্তর জন শহীদ হয়েছিলেন যাদের
নেতা ছিলেন হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব-রা. এবং আলী-আ. ওহুদের
শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের একজন ছিলেন।] তারপর মহানবী (সা.) বললেন,
انَّ ذ'لک لکذ'لک فکیفَ صبرکَ اذن
‘অবশ্যই এমনটি হবে তখন তুমি কিভাবে ধৈর্যধারণ করবে। এখানে ধৈর্যের স্থান নয়, বরং শোকর করার স্থান।’ (নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা নং ১৫৪)
রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে নিজের
শাহাদাত সম্পর্কে যে খবর তিনি শুনেছিলেন সে সাথে বিভিন্ন আলামত যা তিনি
দেখতেন, কখনো কখনো তা বলতেন যা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং নিকটবর্তী
শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাহাবীদের মধ্যে শঙ্কা ও কষ্ট বৃদ্ধি করত। তিনি আশ্চর্যজনক
কিছু কথা বলতেন। এ রমযান মাসে নিজের ছেলে-মেয়েদের ঘরে ইফতার করতেন। প্রতি
রাতে যে কোন এক ছেলে বা মেয়ের ঘরে মেহমান হতেন- কোন রাতে ইমাম হাসানের(আ.) ঘরে, কোন রাতে ইমাম হুসাইনের(আ.) ঘরে, কোন রাতে হযরত যয়নাবের(সা.)
ঘরে (যিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফরের স্ত্রী ছিলেন)। এ মাসে অন্যান্য সময়ের
চেয়ে কম খাবার খেতেন। সন্তানরা এতে খুবই কষ্ট পেতেন। তাঁরা কখনো প্রশ্ন
করতেন, ‘বাবা, কেন এত কম খান?’ তিনি বলতেন, ‘আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায়
মিলিত হতে চাই যে উদর ক্ষুধার্ত থাকে।’ সন্তানরা বুঝতেন তাঁদের পিতা কিছুর
জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। কখনো কখনো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘আমার ভাই ও বন্ধু রাসূল (সা.) আমাকে যে খবর দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। তাঁর কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। খুব শীঘ্রই তা সত্যে পরিণত হবে।’
১৩ই রমযান এমন কিছু বললেন যা অন্য সব দিনের
চেয়ে পরিবেশকে বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলল। সম্ভবত জুমআর দিন খুতবা পড়লেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-কে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা এ মাসের কত দিন বাকি রয়েছে?’
উত্তর দিলেন, ‘হে পিতা, ১৭ দিন।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে আর দেরি নেই। এ মাথা
আর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হবে। এ শ্মশ্রু শিগগিরই রঙ্গিন হবে।’
উনিশে রমযান আলী (আ.)-এর সন্তানরা রাতের
একটি অংশ তাঁর সঙ্গে কাটালেন। ইমাম হাসান(আ.) নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলী(আ.)
জায়নামাজে বসলেন। শেষ রাতে উদ্বিগ্নতার কারণে ইমাম হাসান(আ.) বাবার
নামাযের স্থানে গিয়ে বসলেন(অথবা প্রতি রাতই হয়তো এ রকম করতেন) । (ইমাম
হাসান-আ. ও ইমাম হুসাইন-আ. হযরত ফাতেমা যাহরা-সা.’র সন্তান বলে
ইমাম আলী-আ. এঁদের প্রতি আলাদা রকম স্নেহ করতেন। কারণ এঁদের প্রতি স্নেহকে
রাসূলুল্লাহ-সা. ও ফাতেমা যাহরা-সা.’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলে মনে
করতেন) যখন ইমাম হাসান(আ.) তাঁর কাছে আসলেন তখন তিনি বললেন,
ملکتنی عینى و انا جالسٌ فسنح لى رسول الله (ص) فقلتُ یا رسول الله ماذا لقیتُ من امّتک من الاود واللددِ فقال ادعُ علیهم فقلتُ ابدلنى الله بهم خیراً منهم و ابدلهم بى شرَّ لهم منِّی
‘হে পুত্র, হঠাৎ
স্বপ্নের মধ্যে রাসূলকে আবির্ভূত হতে দেখলাম। যখন রাসূলকে দেখলাম তখন
বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মতের হাতে আমার অন্তর রক্তাক্ত
হয়েছে।’ প্রকৃতপক্ষে তাঁর সঙ্গে মানুষের অসহযোগিতা এবং তাঁর
নির্দেশিত পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের অনীহা আলী (আ.)-কে তীব্র যন্ত্রণা
দিয়েছে। উষ্ট্রের যুদ্ধের বায়আত ভঙ্গকারীরা, সিফফিনে মুয়াবিয়ার প্রতারণা
(মুয়াবিয়া অত্যন্ত ধূর্ত ছিল, ভালোভাবেই জানত কি করলে আলীর হৃদয়কে
ক্ষত-বিক্ষত করা যাবে। আর সে তা-ই করত), সবশেষে খারেজীদের রূহবিহীন
আকীদা-বিশ্বাস যারা ঈমান ও এখলাছ মনে করে আলী (আ.)-কে কাফের ও ফাসেক বলত।
আমরা জানি না আলী(আ.)’র সঙ্গে এরা কি আচরণ করেছে! সত্যিই আলী(আ.)’র উপর
আপতিত মুসিবতগুলো দেখে কেউই বিস্মিত না হয়ে পারে না। একটি পাহাড়ও এত ব্যাপক
ও কঠিন মুসিবত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। এমন অবস্থা যে, আলী(আ.) তাঁর
এইসব মুসিবতের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এখন যখন রাসূলে আকরাম (সা.)-কে
স্বপ্নে দেখলেন তখন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মত আমার হৃদয়কে
ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এদের নিয়ে আমি কি করব?’ তারপর ইমাম হাসানকে বললেন,
‘পুত্র, তোমার নানা আমাকে নির্দেশ দিলেন এদের প্রতি অভিশাপ দিতে। আমিও
স্বপ্নের মধ্যেই অভিশাপ দিয়ে বললাম : “হে আল্লাহ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মৃত্যু দান কর এবং এদের উপর এমন ব্যক্তিকে প্রভাব ও প্রতিপত্তি দান কর এরা যার উপযুক্ত।”
বোঝা যায়, এ বাক্যের সাথে কতটা হৃদয়ের
বেদনা ও দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে! আলী (আ.) সুবহে সাদিকের সময় ঘর থেকে যখন বের
হচ্ছিলেন বাড়ির হাঁসগুলো অসময়ে ডেকে উঠল। আলী বললেন,
دعوهنَّ فانّهنَّ صوائحُ تتبعها نوائح
‘এখন পাখির কান্না শোনা যাচ্ছে, বেশি দেরি
নয় এরপর এখান থেকেই মানুষের কান্না শোনা যাবে।’ উম্মে কুলসুম আমিরুল
মুমিনীনের সামনে এসে বাধা দিলেন। তিনি বললেন, ‘বাবা, আপনাকে মসজিদে যেতে
দেব না। অন্য কাউকে আজ নামায পড়াতে বলুন।’ প্রথমে বললেন, ‘ (বোনের পুত্র)
জুদাহ ইবনে হুবাইরাকে বল জামাআত পড়াতে।’ পরক্ষণেই আলী(আ.) বললেন, ‘না আমি
নিজেই যাব।’ বলা হলো, অনুমতি দিন আপনার সঙ্গে কেউ যাক। তিনি বললেন, ‘না,
আমি চাই না কেউ আমার সঙ্গে যাক।’
হযরত আলী(আ.)’র জন্য রাতটি ছিল অত্যন্ত
পবিত্র । আল্লাহ জানেন তাঁর মধ্যে সে রাত্রে কেমন উত্তেজনা ছিল! তিনি
বলছেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি এ আকস্মিক শিহরণের রহস্য উদঘাটন করব।’ যদিও
তাঁর ধারণা ছিল যে কোন বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যেমন নাহজুল বালাগায় আলী (আ.)
নিজেই বলছেন,
کم اطردت الایّام ابحثها عن مکنون هذا الامر فابى الله الا اخفاءهُ
‘অনেক চেষ্টা করেছি এ রহস্যের গোপনীয়তা উদঘাটন করব, কিন্তু আল্লাহ চাননি, বরং তিনি এটা গোপন রেখেছেন।’
নিজেই ফজরের আজান দিতেন। সুবহে সাদিকের সময়
নিজেই মুয়াজ্জিনের স্থানে দাঁড়িয়ে (আল্লাহু আকবার বলে) উচ্চস্বরে আজান
দিলেন। সেখান থেকে নামার সময় সুবহে সাদেকের সাদা আভাকে বিদায় জানালেন। তিনি
বললেন, ‘হে সাদা আভা! হে শুভ্র ভোর! হে প্রভাত! যেদিন থেকে আলী এ
পৃথিবীতে চোখ খুলেছিল তার পর এমন কোন ফজর কি আসবে যে, তোমার উদয় হবে আর আলী
ঘুমিয়ে থাকবে? অর্থাৎ এবার আলীর চোখ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে।’ যখন তিনি নেমে
এলেন তখন বললেন,
خلّوا سبیلَ المومنِ المجاهدِ فی الله ذی الکتبِ و ذی المشاهدِ
فی الله لا یعبدُ غیرَ الواحدِ و یوقظُ النّاسَ الى المساجدِ
‘এই মুমিন ও মুজাহিদের (আলীর) জন্য রাস্তা
খুলে দাও যে গ্রন্থ ও শাহাদাতের অধিকারী, যে একক খোদা ছাড়া আর কারো ইবাদত
করেনি এবং মানুষকে মসজিদে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে জাগাতো।’
পরিবারের কাউকে অনুমতি দেননি বাইরে যাওয়ার।
আলী (আ.) বলেছিলেন, ‘পাখিদের কান্নার পর মানুষের আহাজারি শুনতে পাবে।’
স্বাভাবিকভাবেই হযরত যয়নাব কোবরা (সা.), উম্মে কুলসুম (সা.) ও পরিবারের
বাকী সদস্যরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় ছিলেন, আজ রাতে কি ঘটতে যাচ্ছে? হঠাৎ এক
প্রচণ্ড চিৎকারে সবাই ঘটনা বুঝতে পারলেন। একটি আওয়াজ চারিদিকে ধ্বনিত
প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল-
تهدّمت واللهِ ارکان الهدى وانطمست اعلام التّقى و انفصمتِ العروةُ قتلَ ابنُ عمِّ المصطفى قُتِلَ الوصىُّ المجتبى قُتِلَ علىُّ المرتضى قَتَلَهُ اشقى الاشقیاء
“ধর্ম বা দীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে,
তাকওয়ার ধ্বজা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে পড়েছে, মুস্তাফা
(সাঃ)’র চাচাতো ভাই ও ওয়াসীকে হত্যা করা হয়েছে, আলী মোর্তজা(আ.) নিহত
হয়েছেন, তাঁকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হত্যা করেছে।”
জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে ইমাম আলী (আ.)
আলী (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও
আশ্চর্যজনক সময় তাঁর জীবনের শেষ দু’দিন। তাঁর জীবনের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে-
তাঁর জন্ম থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত, রাসূলুল্লাহ
(সা.)’র নবুওয়াত থেকে হিজরত পর্যন্ত, হিজরত থেকে রাসূলের (সা.) ইন্তেকাল
পর্যন্ত, রাসূলুল্লাহ(সা.)’র ইন্তেকাল থেকে নিজের খেলাফত প্রাপ্তির আগের ২৫
বছর এবং খেলাফত প্রাপ্তির পর সাড়ে চার বছর। এর বাইরেও তাঁর জীবনের আরেকটি
পর্যায় রয়েছে যা তিন দিনেরও কম সময়ের, কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্তগুলো
এখানে দেখা যায়। সেটা হলো আলী (আ.) যখন তরবারীর আঘাতে শয্যাশায়ী হলেন তখন
থেকে শাহাদত পর্যন্ত। তিনি যে এক পূর্ণ মানুষ তা এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি
যখন মৃত্যুর মুখোমুখি তখন মৃত্যুর প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ছিল? যখন
তরবারী তাঁর কপালে আঘাত হানলো তখন তিনি দু’টি বাক্য বলেছেন। একটি ‘এ
ব্যক্তিকে ধর’, অপরটি فُزْتُ وَ رَبّ الْکَعْبَة ‘কাবার প্রভুর শপথ! আমি সফলকাম হয়েছি- শাহাদাত আমার জন্য সফলতা’।
আলী (আ.)-কে এনে বিছানায় শোয়ানো হলো।
চিকিৎসক আসির ইবনে আমর যিনি কুফায় আঘাত বিষয়ক খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ছিলেন
তিনি আমীরুল মুমিনীনের চিকিৎসার জন্য আসলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে
পারলেন, তরবারীতে বিষ মেশানো ছিল এবং বিষ তাঁর রক্তে প্রবেশ করেছে। তাই
চিকিৎসায় লাভ হবে না এটা নিশ্চিত হয়ে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। সাধারণত
যে রোগীর আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই তাকে এ কথা বলা হয় না। কিন্তু আসির জানতেন,
আলী (আ.) অন্য দশজনের মতো নন। তাই তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ আমীরুল
মুমিনীন, যদি কোন অসিয়ত থেকে থাকে তাহলে তা ঘোষণা করুন।”
আলী(আ.)’র কন্যা হযরত উম্মে
কুলসুম এ কথা শুনে ইবনে মুলজিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমার পিতা তোর কি
ক্ষতি করেছিল যে, তাঁর প্রতি এ আচরণ করেছিস? আল্লাহ চাইলে আমার পিতা যদি
সুস্থ হয়ে উঠেন, তোর চেহারা কলঙ্কিত করে দেবেন।” যখন উম্মে কুলসুম এ কথা
বললেন তখন ইবনে মুলজিম (আল্লাহ তাঁর রহমত থেকে ইবনে মুলজিমকে বঞ্চিত করুন)
জবাব দিল, “ আমি তরবারীটা এক হাজার দিরহাম দিয়ে কিনেছি, আর এক হাজার
দিরহামের বিষ ওটাতে মাখিয়েছি। যে পরিমাণ বিষ ওটাতে মাখিয়েছি যদি কুফার সব
মানুষের মাথায় আঘাত করি তাহলে তারা মৃত্যুবরণ করবে। তাই তোর বাবার বেঁচে
থাকার কোন সম্ভাবনা নেই তা জেনে রাখ।”
আলী (আ.)-এর অলৌকিকত্ব এখানেই প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর অসিয়তে বলেন, বন্দির প্রতি সঠিক আচরণ কর।
یَا بَنِى عَبْدُ الْمُطَّلِب لا الفِیَنَّکُمْ تَخُوْضُوْنَ دِمَاءَ الْمُسْلِمِیْنَ خَوْضًا, تَقُوْلُوْنَ قُتِلَ امِیْرُ الْمُؤْمِنِیْنَ أَ لا لا تَقْتُلُنَّ بْنَ الا قَاتلى
“আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা তোমরা এমন
যেন না কর, যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা করবে এ
অজুহাতে যে, আমীরুল মুমিনীনকে শহীদ করা হয়েছে। অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল,
অমুক এ কাজে উৎসাহিত করেছে। এসব কথা বলে বেড়াবে না, বরং আমার হত্যাকারী এ
ব্যক্তি।” ইমাম হাসান (আ.)-কে বললেন, “বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর এ
বিষয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে
তাহলে মুক্তি দিও, যদি চাও কেসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে, সে তোমার
পিতাকে একটি আঘাত করেছে, তাকেও একটি আঘাত করবে। যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো
করল, নতুবা ছেড়ে দেবে।” (নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ৪৭)
তারপর আবার বন্দির চিন্তায় মগ্ন। বন্দিকে
ঠিক মতো খেতে দিয়েছ তো? পানি দিয়েছ খেতে? ঠিক মতো দেখাশোনা কর ওর। কিছু দুধ
তাঁর জন্য আনা হলে কিছুটা খেয়ে বললেন, বাকীটা বন্দিকে দাও। এটাই আলী
(আ.)-এর আচরণ তাঁর শত্রুর সাথে। এ জন্যই মাওলানা রুমী বলেছেন,
“সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি
পৌরুষত্বে কি তুমি, জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”
এখানেই আলীর পৌরুষত্ব ও মানসিকতার
সর্বোচ্চ স্তরের প্রকাশ ঘটেছে। আলী(আ.) মৃত্যুশয্যায় শায়িত, প্রতি
মুহূর্তে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটছে, বিষ তাঁর পবিত্র শরীরে প্রতিক্রিয়া
করছে। তাঁর সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সবাই কাঁদছে, চারিদিকে ক্রন্দনের
শব্দ, কিন্তু আলী (আ.)-এর মুখ হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন,
وَ اللَّهِ ما فَجَأنِى مِن الْمَوْتِ وَارِدٌ کَرِهْتُه وَ لا طَالِعٌ انْکَرْتُه وَ مَا کُنْتُ إِلا کَقَارِبٍ وَرَدَ, وَ طَالِبٍ وَجَد
“আল্লাহর শপথ! যা আমার কাছে এসেছে (মৃত্যু)
এমন কিছু নয় যে, আমি তা অপছন্দ করি। আল্লাহর পথে শাহাদাত সব সময়ই আমার
কাছে সবচেয়ে কাম্য সাধ ছিল, আমার জন্য শাহাদাত এমন বস্তু যেন কোন ব্যক্তি
যার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিল তা পেয়েছে। আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?” (নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ২৩)
وَ مَا کُنْتُ إِلا کَقَارِبٍ وَرَدَ, وَ طَالِبٍ وَجَد
এরপর এমন এক উদাহরণ এনেছেন যে উদাহরণের
সঙ্গে আরবরা খুবই পরিচিত। আরবরা বেদুইনদের মতো যাযাবর জীবন যাপন করত। যতদিন
কোন স্থানে পানি ও তাদের মেষ, উট ইত্যাদির জন্য ঘাস ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ
পেত ততদিন সেখানে থাকত; তারপর অন্য স্থানে পানি ও ঘাস পেলে সেখানে চলে যেত।
যেহেতু মরুভূমিতে প্রচণ্ড গরম সেহেতু রাত্রিতে পানির সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। قَارِب
পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তিকে বলা হয়। আলী তাঁর সহযোগীদের বলছেন, “ আমার
সঙ্গীরা! গভীর রাতে পানির অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি আকস্মিকভাবে পানির সন্ধান
পেয়ে যেমন উল্লসিত হয় আমিও শাহাদাতের সুযোগ পেয়ে সে রকম আনন্দিত। আমার
উদাহরণ সেই প্রেমিকের মত যে তার ভালবাসার বস্তুটি লাভ করেছে।”
আলী (আ.)-এর সবচেয়ে উষ্ণ উক্তিগুলো যেন
তাঁর জীবনের শেষ দু’দিনে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি ১৯ রমযানের ফজরের ওয়াক্তের
কিছু পরেই আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ২১ তারিখের রাত্রির দ্বিপ্রহরে স্রষ্টার কাছে
তাঁর পবিত্র আত্মার প্রত্যাবর্তন ঘটে।
শেষ মুহূর্তগুলোতে সবাই তাঁর চারপাশে সমবেত
হয়েছে। বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু যখনই
জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন তখনই তাঁর কণ্ঠে হেকমতপূর্ণ উপদেশ ও নসিহত উচ্চারিত
হচ্ছে। তাঁর শেষ উপদেশ যা অত্যন্ত উষ্ণতাপূর্ণ ও গুরুত্ববহুল তা তিনি বিশটি
বাক্যে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে ইমাম হাসান (আ.), এরপর ইমাম হুসাইন (আ.),
তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের লক্ষ্য করে বলেছেন। ইমাম হাসান, ইমাম
হুসাইন (আ.), আলী (আ.)-এর অন্যান্য সন্তানসহ আমরা সকলেই, এমনকি কিয়ামত
পর্যন্ত যারা আসবে আলী(আ.) তাদের উদ্দেশ্যে এ বক্তব্য দিয়েছেন। এ
বাক্যগুলোতে তিনি ইসলামকে যেন পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন- সামগ্রিকভাবে
উপস্থাপন করেছেন।
اَللَّه اَللَّه فِى الایتَام, اَللَّه اَللَّه فِى الْقُرْآن, اَللَّه اَللَّه فِى جیرانکُمْ, اَللَّه اَللَّه فِى بَیْتِ رَبِّکُمْ, اَللَّه اَللَّه فِى الصَّلَوةِ, اَللَّه اَللَّه فِى الزَّکَوةِ
(বিহারুল আনওয়ার, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৭৪৬ ও নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ৪৭)
তিনি একে একে সব বর্ণনা করছেন। “ আল্লাহ,
আল্লাহ, ইয়াতীমদের ব্যাপারে সতর্ক থেক; আল্লাহ, আল্লাহ, কোরআনকে আঁকড়ে ধর;
আল্লাহ, আল্লাহ, প্রতিবেশীদের ব্যাপারে দায়িত্বের কথা মনে রেখ; নামায,
রোযা, হজ্ব, যাকাত... (এখানে “আল্লাহ আল্লাহ” শব্দগুলো বার বার ব্যবহার
করেছেন কসম বা শপথ হিসেবে ও ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার জন্য)।” সবাই আলী (আ.)-এর
মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে
গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সবাই কান পেতে আছে তিনি আর কি বলেন।
সবাই দেখছেন আলী (আ.) উচ্চস্বরে পড়ছেন, “ আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু ওয়া
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ্।”
No comments