গুলিস্তানের সেকাল-একাল by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
জিরো
পয়েন্ট। সারা দেশের সড়ক পথের দূরত্বের শুরুর প্রান্ত। আবার সব সড়কের শেষ
প্রান্তও বলা যায় এটিকে। দিনভর ব্যস্ততা। হরেক রকম মানুষ। হরেক রকম পেশা।
কেউ কাছের, কেউ দূরের। গিজগিজ করা মানুষের ভিড় যেন জনবহুল বাংলাদেশেরই
প্রতিচ্ছবি।
‘ঢাকার রাজধানী’ খ্যাত ‘গুলিস্তান’ এলাকা এটি। ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোয় এ নামের কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও আদি আর আধুনিক এই দুই ঢাকারই কেন্দ্রে আছে এই গুলিস্তান। এক সময় ঢাকায় আসা মানেই ছিল গুলিস্তানে নামা। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে। যে যেভাবেই আসুক প্রথম গন্তব্য এই গুলিস্তান। আর এখনো রাজধানীর সব রাজপথের শেষ ঠিকানা ওই গুলিস্তানই। তিল ধারণের জায়গা নেই, একদিকে ফুটপাথে হরেক রকম পণ্যের পসরা, আরেক দিকে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসা মানুষের ভিড়, আন্তঃবাসের কন্ডাক্টররা ডাকছেন মীরপুর, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেইট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ।
ঢাকা শহরে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলা ছাড়াও ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ভৈরব, সাভার, মুন্সীগঞ্জে লোকাল গাড়িতে চলাচলের অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড গুলিস্তান। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের আসা যাওয়া এখানে। নানা পেশার নানা মানুষ কেউ কাজ করছেন, কেউ করাচ্ছেন। কেউ ক্রেতা কেউ বিক্রেতা। আজকের ব্যস্ত এই গুলিস্তান আগেও এমনই ছিল। এখন যেমন রূপ পাল্টেছে। দৃশ্য বদলে গেছে। আকাশ ছোঁয়া ইমারতের পাশে গড়িয়ে গেছে কনক্রিটের উড়াল সেতু। গুলিস্তানের একাল আর সেকালের বিস্তর তফাত থাকলেও আদিকালে ব্যস্ত গুলিস্তান আধুনিক ঢাকারও ব্যস্ততম স্থান হয়েই আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় গুলিস্তান নামের কোনো জায়গা নেই। যা আছে তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। পাকিস্তান আমলে জিন্নাহ এভিনিউ নামে পরিচিত ছিল এটি।
কাগজপত্রে গুলিস্তান নামে কোনো জায়গার নাম না থাকলেও গুলিস্তান নামে একটি সিনেমা হল থেকেই এর নাম হয় গুলিস্তান। হলটির প্রতিষ্ঠার সময় ‘লিবার্টি সিনেমা হল’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেলেও গুলিস্তান নামটির সঙ্গে দেশের সবাই পরিচিত। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে ফজলে দোসানি নামের এক পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী গুলিস্তান সিনেমা হলটি নির্মাণ করেন। এর আগে তিনি কলকাতায় একই ব্যবসা করতেন। ৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে কলকাতার চেয়ে ঢাকায় চলচ্চিত্র ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। সেই সূত্রে ফজলে দোসানি তার ব্যবসা ঢাকায় স্থানান্তর করেন। শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে, গুলিস্তান সিনেমা হলের নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয়ে যায় গুলিস্তান। রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রমনার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন এবং পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে গুলিস্তান নামের এই সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়।
গুলিস্তান সিনেমা হল নির্মাণ সম্পর্কে মনোয়ার আহমদ তার ঢাকার পুরোনো কথা গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৫২ সালের শেষের দিকে রমনা এলাকায় ফজলে দোসানি নির্মাণ করেন গুলিস্তান সিনেমা হল। পরে এই সিনেমা হলের উপরে অল্প আসনের একটি ছোট হল নির্মাণ করে এর নাম দেন নাজ সিনেমা হল। এই হলে প্রথম দিকে শুধু ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো। বর্তমানে দুটি সিনেমা হলই বিলুপ্ত। পুরান ঢাকার স্মৃতি নিয়ে লেখা ঢাকা পুরানগ্রন্থ-এ মিজানুর রহমান লিখেছেন, ‘গুলিস্তান সিনেমার উল্টোদিকে, ওই যেখানে সাধারণ বীমা সদন, সেখানে ছিল ব্রিটানিয়া হল। তখন তো পুরো এলাকাটাই ছিল ন্যাড়া। ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছু ছিল না। কিছু ক্লাবঘর, এসএ গ্রাউন্ড আর বাকিটা সবুজ। এই সবুজের পটে ওই একরত্তি সিনেমা হল।’
চলচ্চিত্রবিষয়ক খ্যাতিমান সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ লিখেছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতার চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজলে দোসানি ঢাকায় চলে আসেন এবং এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। ১৯৫৩ সালে আগা খান এই হলের উদ্বোধন করেন। এটি ছিল ঢাকার প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ। প্রথমে হলটির নাম ছিল লিবার্টি। পরে গুলিস্তান করা হয়। এখানে দেশি-বিদেশি সব সিনেমা দেখানো হতো। গুলিস্তান শব্দের অর্থ ফুলের বাগান। সিনেমা হল ছাড়াও মোগল আমলের একটি কামানের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত ছিল। ১৯৫৫ সালে গুলিস্তান হলের উপর তলায় নাজ নামে আরেকটি সিনেমা হল চালু হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চলচ্চিত্র এবং শিল্প-সংস্কৃতির জন্য গুলিস্তান খুব বিখ্যাত ছিল। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গুলিস্তানের মালিক পাকিস্থানে চলে যাওয়ায় এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং ১৯৭২ সালে তা দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে।
২০০৫ সালে তারা পুরোনো ভবনটি ভেঙে একটি নতুন শপিং কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করে। শাব্দিক দিক থেকে ‘গুলসিতান’ শব্দটির অর্থ ফুলের বাগান। গুলসিতান লোকমুখে কালক্রমে আজকের গুলিস্তান হিসেবে খ্যাত হয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এ এলাকায় একটি ফুলের বাগান ছিল। সেই ফুলের বাগানকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিপ্রেমীরা আড্ডা দিতেন। সে আড্ডা কখনো কখনো চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। মাঝে মাঝে সিনেমা হলটির দক্ষিণ পাশের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনের হুইসেলে তাদের ধ্যান ভাঙতো। মোঘল আমলের একটি কামান রাখা ছিল হলের পূর্ব দিকে। সে কামানের গায়ে ঠেস দিয়ে চলতো অবিরাম আড্ডা। তবে এখন সেই সিনেমা হল বা রেলস্টেশন কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০ তলা শপিং কমপ্লেক্সটির উপরের তলায় একটি সিনেমা হল নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু মার্কেটের কাজই সম্পূর্ণ না হওয়ায় হল স্থাপনের পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন নূর হোসেন।
গণমিছিলের একপর্যায়ে গুলিস্তানে জিরো পয়েন্ট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নূর হোসেনের আত্মত্যাগে আন্দোলন আরো জোরালো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে। জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন স্কয়ার।
একসময় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান ছিল ব্যস্ততম জায়গা। যানজটও লেগে থাকতো রাত দিন। কেনাকাটা, সিনেমা দেখা, ভালো রেস্তরাঁয় খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা মানেই আসতে হতো এখানে। এই শহরের প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল চৌ চিন চাও. যেখানে আদি ঢাকার মানুষজন চাইনিজ খেতে আসতেন। ছিল বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট লা সানি, রেক্স রেস্তরাঁ। শুধু তাই নয় ঢাকার প্রথম আইসক্রিম পার্লারটিও ছিল এখানে, যার নাম ছিল বেবী আইসক্রিম।
এখন যেমন গুলিস্তান: আদিকালের ব্যস্ত গুলিস্তানের ব্যস্ততা আজও আছে। গুলিস্তান এখন আগের চেয়েও ব্যস্ত। নানা পেশা, নানা ব্যবসার মানুষজন এখানে ভিড় করেন। আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত। সব সময় মানুষ আর যানবাহনের ভিড়ে লাখ লাখ মানুষ কেউ নিজের জীবিকা উপার্জন আবার কেউ প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নেন এখান থেকে। আধুনিক গুলিস্তানে আদির সেই রূপের কিছুই নেই। চওড়া সড়কের দুই পাশে এখন সারি সারি ইমারত। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পল্টন এখন ইট পাথরে ঢাকা। বাণিজ্যের ঘরবসতি গুলিস্তানে আদির চিহ্ন বলতে আছে সেই ঘোড়ার গাড়ির টম টম, টক্কর শব্দ। গুলিস্তানে আচার বিক্রি করেন ওবায়েদ হোসেন।
গত পাঁচ বছর ধরে তিনি এখানে ফেরি করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রচুর মানুষ আসে। তাই বিক্রিও হয় বেশি। নিয়মিত হাজার দুয়েক বিক্রি করতে পারি। ফুটপাতে নতুন পুরনো টাকা কেনাবেচা করেন নোয়াখালীর জহির মিয়া। প্রায় পনেরো বছর ধরে তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন গুলিস্তানে টাকা ব্যবসা হয় প্রায় বিশ পঁচিশ বছর ধরে। এখান থেকে সব ধরনের মানুষ টাকা নিয়ে যায়। বিশেষ করে ঈদ, পুজো, নববর্ষের সময় টাকার কাটতি বেশি থাকে। এর বাইরেও নিয়মিত ছেঁড়াফাটা টাকা কিনি আমরা। তবে তিনি অভিযোগ করেন ব্যাংক থেকে তাদেরকে সরাসরি টাকা দেয়া হয় না। দালালের মাধ্যমে তাদেরকে টাকা কিনতে হয়। শুধু তাই নয় এখানে ব্যবসা করতে গেলেও গুনতে হয় চাঁদার টাকা।
গুলিস্তানের রমনা ভবনটি সুপরিচিত এখানকার দর্জি দোকানের জন্য। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থেকেও এখনও লোকজন এখানে আসেন জামা কাপড় বানাতে।ু পীর ইয়ামেনী মার্কেটে এখনও মানুষ যান পাঞ্জাবি, টুপিসহ জামা কাপড় কিনতে। এ এলাকাতে আছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, বাংলাদেশ সচিবালয়, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, হকি স্টেডিয়াম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, জিপিও, জাতীয় মসজিদ, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, হলমার্কেট, হোটেল রমনা, টিএনটির প্রধান কার্যালয়, বিটিসিএল এর প্রধান কর্মাধক্ষ্যের কার্যালয়, মহানগর নাঠ্যমঞ্চসহ নানা গুরত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পীর ইয়ামেনী মার্কেট, খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সসহ বেশ কিছু শপিং মল আছে এখানে। খুব পরিচিত গোলাপশাহর মাজারটিও গুলিস্তানে। এসব কিছুকে কেন্দ্র করে এখানে প্রতিনিয়ত জমজমাট নানা ব্যবসা। নানা পেশা। এখানে নানান কিসিমের হকাররা তাদের ব্যবসা করছে। কেউ ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করছে, কেউ পারফিউম, মোবাইলের এক্সেসরিস, সিডি, কেউ খাদ্যদ্রব্য নানান পণ্যের সমাহার এখানে।
হকারদের পাশাপাশি শপিংমল গুলোতে আছে নামিদামি ব্রান্ডের দোকান। রিকশা, বাস, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি, লেগুনা, সিএনজিসহ পাবলিক যানবাহন চালকরা নিয়মিত ভিড় জমায় গুলিস্তানে। ঘোড়ার গাড়ি চালক পনেরো বছর বয়সী আবিদ জানান, তিনি প্রায় দুই বছর ধরে টমটম চালান। তার বাবা এই টমটমটির মালিক। বাবার অসুস্থতার কারণে এই টমটমের ভার তার ওপরে। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে তার নিয়মিত আয় হয় হাজার তিনেক টাকা।
সেই টাকার একটি বড় অংশ চলে যায় ঘোড়ার খাবার বাবদ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বিপরীত পাশে ফুটপাতে আছে ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের দোকান। দোকানদার আজগর মিয়া বলেন, এখানে বেশির ভাগই বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর, হকাররা খায়। এর বাইরেও আছে বেশ কয়েকটি দোকান। তবে অনেক সময় ঢাকার বাইরে থেকে আসা নানান মানুষও এখানে খেয়ে থাকে। কথা হয় এমন একজনের সঙ্গে, বরিশাল থেকে মুক্তিযোদ্ধ মন্ত্রণালয়ে কাজে আসা রহিম আলী বলেন, সকালে কাজ ছিল, দুপুরের মধ্যেই কাজ শেষ। ঢাকার কিছু তেমন তার চেনা জানা নেই। তাই এখানে তিনি খেতে বসেছেন। এই তো গেলো দিনের চিত্র। বিকালে দিনের আলো যখন নিভতে শুরু করে তখন পুরো গুলিস্তানের চিত্রও বদলাতে থাকে। ভিড় বাড়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের। কাজ আর জীবিকার তাগিদে এখানে আসা মানুষজন খুব নির্বিগ্নে যে কাজ করতে পারেন তা নয়। মানুষের প্রয়োজনকে ঘিরে এখানে আছে প্রতারণা আর শঠতার নানা ফন্দি ফিকির। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পকেটমার, ভেজাল পণ্য দিয়ে ঠকানোর মতো ঠিকাদারি কারবারও হয় এখানে অহরহ।
দোকানগুলোর পরিসর বড় নয়। ছোট ছোট কাঠের চকি কিংবা কংক্রিটের মেঝেতে প্লাস্টিকের ছালা-চটি বিছিয়ে বসানো হয়েছে পসরা। এসব দোকানে মিলে সব কিছু। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ক্যামেরা, মোবাইল, ঘড়ি, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, জুতা, কাপড়-চোপড়, কেমিক্যাল সামগ্রী সবই আছে। সব জিনিস দামি, কিন্তু এখানে দাম একেবেরই কম।
যাকে বলে পানির দাম। ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ঘিরে রেখেছে চোরাই মোবাইল ফোন আর ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর দোকান। হেন কোনো জিনিস নেই, যা এখানে পাওয়া যায় না। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি-ভিসিডি, মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, দেশি-বিদেশি লাইটার থেকে সবই পাওয়া যায় এখানে। দু’চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কারও দামি কোনো জিনিস হারালে এ মার্কেটে এসে খোঁজ নিলে পাওয়া যায় এমন ঘটনাও আছে শ’ শ’। হকি স্টেডিয়াম থেকে একটু সামনে এলেই মিলে গুলিস্তান পাতাল মার্কেট, এই মার্কেটে প্রায় ১শ’ ২০টির মতো মোবাইল ফোন মেরামতের দোকান রয়েছে। মূলত এ সবই বিক্রি হয় নতুন-পুরান নানা কিসিমের মোবাইল ফোন।
এখানেওে হয় চুরি হওয়া মোবাইল বেচাকেনা। এখানে নেই রাত দিন। সবসময়ই বিক্রি হয় চোরাই পণ্য। বিভিন্নভাবে জানা যায়, গুলিস্তান এলাকায় মোবাইল ফোনসেট মেরামতকারী এ ধরনের এক হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে চোরাই ও ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনসেট বিক্রি হয় এখানে আসা সবার এটা জানা। এজন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিজস্ব শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা মোবাইল ফোন সেট চুরি বা ছিনতাই করে আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ দোকানে বিক্রি করে। শুধু তাই নয় গোলাপশাহ মাজারের অপরপাশে গুলিস্তানের মসজিদের পাশে বসে মোবাইল ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দোকান। এসব দোকান গুলোতেও রয়েছে চোরাই পণ্যের আধিপত্য।
গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজারের পাশের গলিতেই বসে জুতার দোকান। এখানে নতুন জুতার পাশাপাশি পুরনো জুতাও বিক্রি করা হয়। আর এ সব জুতা মানুষ কিনে নিয়ে যায় খুব সুলভ মূল্যে। রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মার্কেট থেকে চুরি যাওয়া জুতার একটি অংশ এখানে আসে বলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভাষ্য।
‘ঢাকার রাজধানী’ খ্যাত ‘গুলিস্তান’ এলাকা এটি। ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোয় এ নামের কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও আদি আর আধুনিক এই দুই ঢাকারই কেন্দ্রে আছে এই গুলিস্তান। এক সময় ঢাকায় আসা মানেই ছিল গুলিস্তানে নামা। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে। যে যেভাবেই আসুক প্রথম গন্তব্য এই গুলিস্তান। আর এখনো রাজধানীর সব রাজপথের শেষ ঠিকানা ওই গুলিস্তানই। তিল ধারণের জায়গা নেই, একদিকে ফুটপাথে হরেক রকম পণ্যের পসরা, আরেক দিকে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসা মানুষের ভিড়, আন্তঃবাসের কন্ডাক্টররা ডাকছেন মীরপুর, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেইট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ।
ঢাকা শহরে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলা ছাড়াও ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ভৈরব, সাভার, মুন্সীগঞ্জে লোকাল গাড়িতে চলাচলের অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড গুলিস্তান। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের আসা যাওয়া এখানে। নানা পেশার নানা মানুষ কেউ কাজ করছেন, কেউ করাচ্ছেন। কেউ ক্রেতা কেউ বিক্রেতা। আজকের ব্যস্ত এই গুলিস্তান আগেও এমনই ছিল। এখন যেমন রূপ পাল্টেছে। দৃশ্য বদলে গেছে। আকাশ ছোঁয়া ইমারতের পাশে গড়িয়ে গেছে কনক্রিটের উড়াল সেতু। গুলিস্তানের একাল আর সেকালের বিস্তর তফাত থাকলেও আদিকালে ব্যস্ত গুলিস্তান আধুনিক ঢাকারও ব্যস্ততম স্থান হয়েই আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় গুলিস্তান নামের কোনো জায়গা নেই। যা আছে তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। পাকিস্তান আমলে জিন্নাহ এভিনিউ নামে পরিচিত ছিল এটি।
কাগজপত্রে গুলিস্তান নামে কোনো জায়গার নাম না থাকলেও গুলিস্তান নামে একটি সিনেমা হল থেকেই এর নাম হয় গুলিস্তান। হলটির প্রতিষ্ঠার সময় ‘লিবার্টি সিনেমা হল’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেলেও গুলিস্তান নামটির সঙ্গে দেশের সবাই পরিচিত। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে ফজলে দোসানি নামের এক পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী গুলিস্তান সিনেমা হলটি নির্মাণ করেন। এর আগে তিনি কলকাতায় একই ব্যবসা করতেন। ৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে কলকাতার চেয়ে ঢাকায় চলচ্চিত্র ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। সেই সূত্রে ফজলে দোসানি তার ব্যবসা ঢাকায় স্থানান্তর করেন। শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে, গুলিস্তান সিনেমা হলের নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয়ে যায় গুলিস্তান। রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রমনার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন এবং পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে গুলিস্তান নামের এই সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়।
গুলিস্তান সিনেমা হল নির্মাণ সম্পর্কে মনোয়ার আহমদ তার ঢাকার পুরোনো কথা গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৫২ সালের শেষের দিকে রমনা এলাকায় ফজলে দোসানি নির্মাণ করেন গুলিস্তান সিনেমা হল। পরে এই সিনেমা হলের উপরে অল্প আসনের একটি ছোট হল নির্মাণ করে এর নাম দেন নাজ সিনেমা হল। এই হলে প্রথম দিকে শুধু ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো। বর্তমানে দুটি সিনেমা হলই বিলুপ্ত। পুরান ঢাকার স্মৃতি নিয়ে লেখা ঢাকা পুরানগ্রন্থ-এ মিজানুর রহমান লিখেছেন, ‘গুলিস্তান সিনেমার উল্টোদিকে, ওই যেখানে সাধারণ বীমা সদন, সেখানে ছিল ব্রিটানিয়া হল। তখন তো পুরো এলাকাটাই ছিল ন্যাড়া। ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছু ছিল না। কিছু ক্লাবঘর, এসএ গ্রাউন্ড আর বাকিটা সবুজ। এই সবুজের পটে ওই একরত্তি সিনেমা হল।’
চলচ্চিত্রবিষয়ক খ্যাতিমান সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ লিখেছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতার চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজলে দোসানি ঢাকায় চলে আসেন এবং এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। ১৯৫৩ সালে আগা খান এই হলের উদ্বোধন করেন। এটি ছিল ঢাকার প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ। প্রথমে হলটির নাম ছিল লিবার্টি। পরে গুলিস্তান করা হয়। এখানে দেশি-বিদেশি সব সিনেমা দেখানো হতো। গুলিস্তান শব্দের অর্থ ফুলের বাগান। সিনেমা হল ছাড়াও মোগল আমলের একটি কামানের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত ছিল। ১৯৫৫ সালে গুলিস্তান হলের উপর তলায় নাজ নামে আরেকটি সিনেমা হল চালু হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চলচ্চিত্র এবং শিল্প-সংস্কৃতির জন্য গুলিস্তান খুব বিখ্যাত ছিল। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গুলিস্তানের মালিক পাকিস্থানে চলে যাওয়ায় এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং ১৯৭২ সালে তা দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে।
২০০৫ সালে তারা পুরোনো ভবনটি ভেঙে একটি নতুন শপিং কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করে। শাব্দিক দিক থেকে ‘গুলসিতান’ শব্দটির অর্থ ফুলের বাগান। গুলসিতান লোকমুখে কালক্রমে আজকের গুলিস্তান হিসেবে খ্যাত হয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এ এলাকায় একটি ফুলের বাগান ছিল। সেই ফুলের বাগানকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিপ্রেমীরা আড্ডা দিতেন। সে আড্ডা কখনো কখনো চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। মাঝে মাঝে সিনেমা হলটির দক্ষিণ পাশের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনের হুইসেলে তাদের ধ্যান ভাঙতো। মোঘল আমলের একটি কামান রাখা ছিল হলের পূর্ব দিকে। সে কামানের গায়ে ঠেস দিয়ে চলতো অবিরাম আড্ডা। তবে এখন সেই সিনেমা হল বা রেলস্টেশন কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০ তলা শপিং কমপ্লেক্সটির উপরের তলায় একটি সিনেমা হল নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু মার্কেটের কাজই সম্পূর্ণ না হওয়ায় হল স্থাপনের পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন নূর হোসেন।
গণমিছিলের একপর্যায়ে গুলিস্তানে জিরো পয়েন্ট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নূর হোসেনের আত্মত্যাগে আন্দোলন আরো জোরালো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে। জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন স্কয়ার।
একসময় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান ছিল ব্যস্ততম জায়গা। যানজটও লেগে থাকতো রাত দিন। কেনাকাটা, সিনেমা দেখা, ভালো রেস্তরাঁয় খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা মানেই আসতে হতো এখানে। এই শহরের প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল চৌ চিন চাও. যেখানে আদি ঢাকার মানুষজন চাইনিজ খেতে আসতেন। ছিল বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট লা সানি, রেক্স রেস্তরাঁ। শুধু তাই নয় ঢাকার প্রথম আইসক্রিম পার্লারটিও ছিল এখানে, যার নাম ছিল বেবী আইসক্রিম।
এখন যেমন গুলিস্তান: আদিকালের ব্যস্ত গুলিস্তানের ব্যস্ততা আজও আছে। গুলিস্তান এখন আগের চেয়েও ব্যস্ত। নানা পেশা, নানা ব্যবসার মানুষজন এখানে ভিড় করেন। আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত। সব সময় মানুষ আর যানবাহনের ভিড়ে লাখ লাখ মানুষ কেউ নিজের জীবিকা উপার্জন আবার কেউ প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নেন এখান থেকে। আধুনিক গুলিস্তানে আদির সেই রূপের কিছুই নেই। চওড়া সড়কের দুই পাশে এখন সারি সারি ইমারত। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পল্টন এখন ইট পাথরে ঢাকা। বাণিজ্যের ঘরবসতি গুলিস্তানে আদির চিহ্ন বলতে আছে সেই ঘোড়ার গাড়ির টম টম, টক্কর শব্দ। গুলিস্তানে আচার বিক্রি করেন ওবায়েদ হোসেন।
গত পাঁচ বছর ধরে তিনি এখানে ফেরি করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রচুর মানুষ আসে। তাই বিক্রিও হয় বেশি। নিয়মিত হাজার দুয়েক বিক্রি করতে পারি। ফুটপাতে নতুন পুরনো টাকা কেনাবেচা করেন নোয়াখালীর জহির মিয়া। প্রায় পনেরো বছর ধরে তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন গুলিস্তানে টাকা ব্যবসা হয় প্রায় বিশ পঁচিশ বছর ধরে। এখান থেকে সব ধরনের মানুষ টাকা নিয়ে যায়। বিশেষ করে ঈদ, পুজো, নববর্ষের সময় টাকার কাটতি বেশি থাকে। এর বাইরেও নিয়মিত ছেঁড়াফাটা টাকা কিনি আমরা। তবে তিনি অভিযোগ করেন ব্যাংক থেকে তাদেরকে সরাসরি টাকা দেয়া হয় না। দালালের মাধ্যমে তাদেরকে টাকা কিনতে হয়। শুধু তাই নয় এখানে ব্যবসা করতে গেলেও গুনতে হয় চাঁদার টাকা।
গুলিস্তানের রমনা ভবনটি সুপরিচিত এখানকার দর্জি দোকানের জন্য। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থেকেও এখনও লোকজন এখানে আসেন জামা কাপড় বানাতে।ু পীর ইয়ামেনী মার্কেটে এখনও মানুষ যান পাঞ্জাবি, টুপিসহ জামা কাপড় কিনতে। এ এলাকাতে আছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, বাংলাদেশ সচিবালয়, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, হকি স্টেডিয়াম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, জিপিও, জাতীয় মসজিদ, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, হলমার্কেট, হোটেল রমনা, টিএনটির প্রধান কার্যালয়, বিটিসিএল এর প্রধান কর্মাধক্ষ্যের কার্যালয়, মহানগর নাঠ্যমঞ্চসহ নানা গুরত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পীর ইয়ামেনী মার্কেট, খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সসহ বেশ কিছু শপিং মল আছে এখানে। খুব পরিচিত গোলাপশাহর মাজারটিও গুলিস্তানে। এসব কিছুকে কেন্দ্র করে এখানে প্রতিনিয়ত জমজমাট নানা ব্যবসা। নানা পেশা। এখানে নানান কিসিমের হকাররা তাদের ব্যবসা করছে। কেউ ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করছে, কেউ পারফিউম, মোবাইলের এক্সেসরিস, সিডি, কেউ খাদ্যদ্রব্য নানান পণ্যের সমাহার এখানে।
হকারদের পাশাপাশি শপিংমল গুলোতে আছে নামিদামি ব্রান্ডের দোকান। রিকশা, বাস, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি, লেগুনা, সিএনজিসহ পাবলিক যানবাহন চালকরা নিয়মিত ভিড় জমায় গুলিস্তানে। ঘোড়ার গাড়ি চালক পনেরো বছর বয়সী আবিদ জানান, তিনি প্রায় দুই বছর ধরে টমটম চালান। তার বাবা এই টমটমটির মালিক। বাবার অসুস্থতার কারণে এই টমটমের ভার তার ওপরে। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে তার নিয়মিত আয় হয় হাজার তিনেক টাকা।
সেই টাকার একটি বড় অংশ চলে যায় ঘোড়ার খাবার বাবদ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বিপরীত পাশে ফুটপাতে আছে ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের দোকান। দোকানদার আজগর মিয়া বলেন, এখানে বেশির ভাগই বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর, হকাররা খায়। এর বাইরেও আছে বেশ কয়েকটি দোকান। তবে অনেক সময় ঢাকার বাইরে থেকে আসা নানান মানুষও এখানে খেয়ে থাকে। কথা হয় এমন একজনের সঙ্গে, বরিশাল থেকে মুক্তিযোদ্ধ মন্ত্রণালয়ে কাজে আসা রহিম আলী বলেন, সকালে কাজ ছিল, দুপুরের মধ্যেই কাজ শেষ। ঢাকার কিছু তেমন তার চেনা জানা নেই। তাই এখানে তিনি খেতে বসেছেন। এই তো গেলো দিনের চিত্র। বিকালে দিনের আলো যখন নিভতে শুরু করে তখন পুরো গুলিস্তানের চিত্রও বদলাতে থাকে। ভিড় বাড়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের। কাজ আর জীবিকার তাগিদে এখানে আসা মানুষজন খুব নির্বিগ্নে যে কাজ করতে পারেন তা নয়। মানুষের প্রয়োজনকে ঘিরে এখানে আছে প্রতারণা আর শঠতার নানা ফন্দি ফিকির। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পকেটমার, ভেজাল পণ্য দিয়ে ঠকানোর মতো ঠিকাদারি কারবারও হয় এখানে অহরহ।
দোকানগুলোর পরিসর বড় নয়। ছোট ছোট কাঠের চকি কিংবা কংক্রিটের মেঝেতে প্লাস্টিকের ছালা-চটি বিছিয়ে বসানো হয়েছে পসরা। এসব দোকানে মিলে সব কিছু। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ক্যামেরা, মোবাইল, ঘড়ি, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, জুতা, কাপড়-চোপড়, কেমিক্যাল সামগ্রী সবই আছে। সব জিনিস দামি, কিন্তু এখানে দাম একেবেরই কম।
যাকে বলে পানির দাম। ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ঘিরে রেখেছে চোরাই মোবাইল ফোন আর ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর দোকান। হেন কোনো জিনিস নেই, যা এখানে পাওয়া যায় না। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি-ভিসিডি, মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, দেশি-বিদেশি লাইটার থেকে সবই পাওয়া যায় এখানে। দু’চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কারও দামি কোনো জিনিস হারালে এ মার্কেটে এসে খোঁজ নিলে পাওয়া যায় এমন ঘটনাও আছে শ’ শ’। হকি স্টেডিয়াম থেকে একটু সামনে এলেই মিলে গুলিস্তান পাতাল মার্কেট, এই মার্কেটে প্রায় ১শ’ ২০টির মতো মোবাইল ফোন মেরামতের দোকান রয়েছে। মূলত এ সবই বিক্রি হয় নতুন-পুরান নানা কিসিমের মোবাইল ফোন।
এখানেওে হয় চুরি হওয়া মোবাইল বেচাকেনা। এখানে নেই রাত দিন। সবসময়ই বিক্রি হয় চোরাই পণ্য। বিভিন্নভাবে জানা যায়, গুলিস্তান এলাকায় মোবাইল ফোনসেট মেরামতকারী এ ধরনের এক হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে চোরাই ও ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনসেট বিক্রি হয় এখানে আসা সবার এটা জানা। এজন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিজস্ব শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা মোবাইল ফোন সেট চুরি বা ছিনতাই করে আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ দোকানে বিক্রি করে। শুধু তাই নয় গোলাপশাহ মাজারের অপরপাশে গুলিস্তানের মসজিদের পাশে বসে মোবাইল ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দোকান। এসব দোকান গুলোতেও রয়েছে চোরাই পণ্যের আধিপত্য।
গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজারের পাশের গলিতেই বসে জুতার দোকান। এখানে নতুন জুতার পাশাপাশি পুরনো জুতাও বিক্রি করা হয়। আর এ সব জুতা মানুষ কিনে নিয়ে যায় খুব সুলভ মূল্যে। রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মার্কেট থেকে চুরি যাওয়া জুতার একটি অংশ এখানে আসে বলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভাষ্য।
No comments