ডিজিটাল যুগেও ভরসা ঝাড়ফুঁকে by মরিয়ম চম্পা
পৃথিবী
এগিয়েছে। এনালগ থেকে এখন ডিজিটাল যুগ। হাতের মুঠোয় বিশ্ব। কিন্তু দেশের
বেশির ভাগ মানুষ এখনো ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী। সামান্য পেটে ব্যথা থেকে
ক্যানসারের চিকিৎসাও হচ্ছে ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে। ফল না পেলেও মানুষ ছুটছে
কবিরাজের বাড়ি। কেউবা ছুটছেন পীর-ফকিরের কাছে। কিন্তু কেন? উত্তর একটাই-
‘বিশ্বাস’।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষ থেকে শহরের চাকচিক্যে বেড়ে ওঠা লোকজনও ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী। শুধু তাই নয়, সন্তান হারিয়ে গেছে। কিংবা অপহরণ হয়েছে। সেক্ষেত্রেও মানুষ দ্বারস্থ হয় পীর-ফকিরের কাছে। জিনের বশ আছে এমন লোকের কাছে। গত কোরবানি ঈদের আগের কথা।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার ধর্মঘর থেকে নিখোঁজ হয় প্রবাসী মসিউর রহমানের আট বছরের একমাত্র পুত্র নিলয়। মামার সঙ্গে গরু বাজারে গিয়েছিল গরু কিনতে। সেখান থেকেই হারিয়ে যায় নিলয়। খবর শুনে সৌদি আরব থেকে ছুটে আসেন মসিউর। কিন্তু থানা-পুলিশের বদলে তিনি দৌঁড়াতে থাকেন ফকিরের বাড়ি। কোনো ফকির এক সপ্তাহ, কোনো ফকির এক মাস সময় দিয়েছেন নিলয় ফিরে আসার। কেউ কেউ আবার বলে দিয়েছেন অমুকের বাড়ি আছে। সেখানেও খোঁজা হয়েছে। কিন্তু নিলয়ের সন্ধান আজও মেলেনি। এক সময় অবশ্য র্যাব ও পুলিশকে জানানো হয়। এ পর্যন্তই। নিলয়ের জন্য পিতা-মাতার ঘুম হারাম। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের পানি এখন শুকিয়ে গেছে।
র্যাব, পুলিশ রেখে কেন ফকিরের কাছে গিয়েছেন? এ প্রশ্নে মসিউর রহমান বলেন, বিভিন্নজনের পরামর্শেই গিয়েছি। কেউ কেউ বলেছে, থানা-পুলিশ করলে ছেলেকে মেরে ফেলবে। ফকির আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দেয়া সময় পেরিয়ে গেছে। আজও আমার সন্তানকে ফিরে পাইনি। মসিউর বলেন, এক ফকির জিনের মাধ্যমে আমার সন্তানকে উদ্ধার করে দেবে বলে জানান। এজন্য তাবিজ-কবজ দেয়া হয়। নানা নিয়মের মধ্যে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। তার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তিন লাখ টাকা। আমি শর্ত দিয়েছি, ছেলেকে পেলে তিন লাখের বেশি দেবো। নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানকে ফিরে পাইনি। ওই কবিরাজ আরো সময় চায়। গ্রামে দেখা যায়, নামধারী এমন অনেক পীর ফকিরের বাড়ি শনি ও মঙ্গলবার ভিড় লেগে থাকে। কারণ, ওই দুই দিন পীর পানি পড়া থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক করেন। সব রোগের চিকিৎসা করেন।
রহিমা বিবির বিয়ে হয়েছে ২০১০ সালে। স্বামী পেশায় গাড়িচালক। স্বামীর স্বল্প আয়ের কথা চিন্তা করে গ্রামের বাড়িতেই থাকেন রহিমা। স্বামী তার কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেননি। তবে রহিমার মনে দুঃখ একটাই, তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। নয় বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানের আশায় বড় বড় ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়েছেন এই দম্পতি। হোমিওপ্যাথিক, হার্বাল কী করেননি? যার কাছে যখন যা শুনেছেন তাই করেছেন। অবশেষে ডাক্তার জানালেন রহিমা বিবিকে ঢাকায় তার স্বামীর কাছাকাছি থাকতে হবে। একটু সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। কিন্তু না এবারও ভাগ্য তার বিপক্ষে। বাচ্চা কনসিভ করলেও দুই থেকে তিন মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন। হুজুর বলেছে, তার সঙ্গে খারাপ জিন আছে। ওই জিন তার বাচ্চা মেরে ফেলে। শেষমেশ তার এক প্রতিবেশীর পরামর্শে এখন প্রতি বৃহস্পতিবার মিরপুরে শাহ আলীর মাজারে যান। মোমবাতি জ্বালান। ওখানে গিয়ে নামাজ পড়েন। দোয়া দুরুদ পড়েন। দান সাদকা করেন। রহিমা বিবির বিশ্বাস এবার তার সন্তান হবে।
সরজমিন মিরপুর-১, হাইকোর্ট মাজার, গোলাপশাহ মাজার, ঘোড়াশাহর মাজারে দেখা গেছে অনেকেই এসেছেন মানত পূরণ করতে। তাই কেউ মাজারে লাল সুতা বাঁধছেন। মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। পয়সা ফেলছেন মুট ভরে। দুই হাত কড়জোর করে মাজারের সামনে থেকে পেছনের দিকে উল্টো পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সিজদা করছেন। বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে শরীর দুলিয়ে অনেকেই নাচছেন। গান গাইছেন। এসব জায়গার আশপাশে সন্ধ্যার পরে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবনকারীদের মজমা বসে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, এখানে দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে। যুগটা ডিজিটাল। আর ডিজিটাল হওয়ার মানে এই নয় যে, আগের সব বাতিল হয়ে যাবে। যেটা সত্য এবং সঠিক বিষয় সেটার অস্তিত্ব এনালগ যুগেও যেরকম ছিল ডিজিটাল যুগেও সেরকমই থাকবে। তখন প্রচার-প্রচারণা যা ছিল, এখন সেটায় ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে মাজার যতটা ব্যাপকভাবে আছে, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এতটা নেই। আর কবিরাজ, পীর-ফকিরের নামে ব্যবসা এখন বেড়ে গেছে। দেশের মানুষ সহজ-সরল হওয়ায় তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা যায়। কিন্তু মানুষ সচেতন হলে প্রতারকের সংখ্যা কমে যাবে।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষ থেকে শহরের চাকচিক্যে বেড়ে ওঠা লোকজনও ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী। শুধু তাই নয়, সন্তান হারিয়ে গেছে। কিংবা অপহরণ হয়েছে। সেক্ষেত্রেও মানুষ দ্বারস্থ হয় পীর-ফকিরের কাছে। জিনের বশ আছে এমন লোকের কাছে। গত কোরবানি ঈদের আগের কথা।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার ধর্মঘর থেকে নিখোঁজ হয় প্রবাসী মসিউর রহমানের আট বছরের একমাত্র পুত্র নিলয়। মামার সঙ্গে গরু বাজারে গিয়েছিল গরু কিনতে। সেখান থেকেই হারিয়ে যায় নিলয়। খবর শুনে সৌদি আরব থেকে ছুটে আসেন মসিউর। কিন্তু থানা-পুলিশের বদলে তিনি দৌঁড়াতে থাকেন ফকিরের বাড়ি। কোনো ফকির এক সপ্তাহ, কোনো ফকির এক মাস সময় দিয়েছেন নিলয় ফিরে আসার। কেউ কেউ আবার বলে দিয়েছেন অমুকের বাড়ি আছে। সেখানেও খোঁজা হয়েছে। কিন্তু নিলয়ের সন্ধান আজও মেলেনি। এক সময় অবশ্য র্যাব ও পুলিশকে জানানো হয়। এ পর্যন্তই। নিলয়ের জন্য পিতা-মাতার ঘুম হারাম। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের পানি এখন শুকিয়ে গেছে।
র্যাব, পুলিশ রেখে কেন ফকিরের কাছে গিয়েছেন? এ প্রশ্নে মসিউর রহমান বলেন, বিভিন্নজনের পরামর্শেই গিয়েছি। কেউ কেউ বলেছে, থানা-পুলিশ করলে ছেলেকে মেরে ফেলবে। ফকির আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দেয়া সময় পেরিয়ে গেছে। আজও আমার সন্তানকে ফিরে পাইনি। মসিউর বলেন, এক ফকির জিনের মাধ্যমে আমার সন্তানকে উদ্ধার করে দেবে বলে জানান। এজন্য তাবিজ-কবজ দেয়া হয়। নানা নিয়মের মধ্যে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। তার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তিন লাখ টাকা। আমি শর্ত দিয়েছি, ছেলেকে পেলে তিন লাখের বেশি দেবো। নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানকে ফিরে পাইনি। ওই কবিরাজ আরো সময় চায়। গ্রামে দেখা যায়, নামধারী এমন অনেক পীর ফকিরের বাড়ি শনি ও মঙ্গলবার ভিড় লেগে থাকে। কারণ, ওই দুই দিন পীর পানি পড়া থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক করেন। সব রোগের চিকিৎসা করেন।
রহিমা বিবির বিয়ে হয়েছে ২০১০ সালে। স্বামী পেশায় গাড়িচালক। স্বামীর স্বল্প আয়ের কথা চিন্তা করে গ্রামের বাড়িতেই থাকেন রহিমা। স্বামী তার কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেননি। তবে রহিমার মনে দুঃখ একটাই, তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। নয় বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানের আশায় বড় বড় ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়েছেন এই দম্পতি। হোমিওপ্যাথিক, হার্বাল কী করেননি? যার কাছে যখন যা শুনেছেন তাই করেছেন। অবশেষে ডাক্তার জানালেন রহিমা বিবিকে ঢাকায় তার স্বামীর কাছাকাছি থাকতে হবে। একটু সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। কিন্তু না এবারও ভাগ্য তার বিপক্ষে। বাচ্চা কনসিভ করলেও দুই থেকে তিন মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন। হুজুর বলেছে, তার সঙ্গে খারাপ জিন আছে। ওই জিন তার বাচ্চা মেরে ফেলে। শেষমেশ তার এক প্রতিবেশীর পরামর্শে এখন প্রতি বৃহস্পতিবার মিরপুরে শাহ আলীর মাজারে যান। মোমবাতি জ্বালান। ওখানে গিয়ে নামাজ পড়েন। দোয়া দুরুদ পড়েন। দান সাদকা করেন। রহিমা বিবির বিশ্বাস এবার তার সন্তান হবে।
সরজমিন মিরপুর-১, হাইকোর্ট মাজার, গোলাপশাহ মাজার, ঘোড়াশাহর মাজারে দেখা গেছে অনেকেই এসেছেন মানত পূরণ করতে। তাই কেউ মাজারে লাল সুতা বাঁধছেন। মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। পয়সা ফেলছেন মুট ভরে। দুই হাত কড়জোর করে মাজারের সামনে থেকে পেছনের দিকে উল্টো পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সিজদা করছেন। বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে শরীর দুলিয়ে অনেকেই নাচছেন। গান গাইছেন। এসব জায়গার আশপাশে সন্ধ্যার পরে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবনকারীদের মজমা বসে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, এখানে দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে। যুগটা ডিজিটাল। আর ডিজিটাল হওয়ার মানে এই নয় যে, আগের সব বাতিল হয়ে যাবে। যেটা সত্য এবং সঠিক বিষয় সেটার অস্তিত্ব এনালগ যুগেও যেরকম ছিল ডিজিটাল যুগেও সেরকমই থাকবে। তখন প্রচার-প্রচারণা যা ছিল, এখন সেটায় ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে মাজার যতটা ব্যাপকভাবে আছে, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এতটা নেই। আর কবিরাজ, পীর-ফকিরের নামে ব্যবসা এখন বেড়ে গেছে। দেশের মানুষ সহজ-সরল হওয়ায় তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা যায়। কিন্তু মানুষ সচেতন হলে প্রতারকের সংখ্যা কমে যাবে।
No comments