পাচার হওয়া নারী নিজেই যেভাবে হয়ে গেলেন পাচারকারী
"আমি
কান্নায় ফেটে পড়লাম। এটা ছিল খুবই অন্যায্য। পুরুষদের কাছে আমাকে 'তুলে'
দেয়া হতো যেখানে উত্তর কোরিয়াতে আমার স্বামী এবং সন্তান আছে। আমার মনে
হতো ভুল দেশে জন্ম হওয়ার কারণে আমাকে এই নোংরা জগতে আসতে হয়েছে।"
কথাগুলো বলছিলেন 'মিসেস বি'।
২০০৩ সালে তাকে যখন চীনের কিছু লোকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তখন তার বয়স ছিল ৩৬ বছর।
উত্তর কোরিয়া থেকে পলায়ন
ওই নারী উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পার হয়ে চীনে পৌঁছান। ভেবেছিলেন কোনও বাড়িতে বয়স্কদের দেখাশোনার লোক হিসেবে কাজ জুটবে তার।
তাকে একজন দালাল অন্তত তেমনটাই বলেছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ডাহা মিথ্যা কথা।
মিসেস বি'র পরিকল্পনা ছিল তিনি এক বছর সেখানে কাজ করে টাকা জমাবেন এবং তারপর উত্তর কোরিয়াতে ফিরে যাবেন।
সেই টাকা-পয়সা দিয়ে দেশে থাকা তার স্বামী এবং দুই সন্তানের খাওয়া-পড়া চলে যাবে।
নতুন করে বিয়ে বা স্বামী পাওয়ার কোন ধরনের চিন্তাই ছিলনা তার মাথায়।
চীনাদের কাছে বিক্রি
চীনের জিলিন প্রদেশের চাংচুনে তাকে এবং উত্তর কোরিয়ান আরেকজন পাঁচজন নারীকে এক চীনা পুরুষের কাছে "তুলে দেয়া" হয়।
দালালটি তাকে তখন বলে "একজন চীনা লোকের সাথে কেবল এক বছর থাকো তারপর পালিয়ে যেও।"
মিসেস বি'র জীবনের নানান কাহিনীকে উপজীব্য করে পরিচালক জিরো ইউন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
নাম 'মিসেস বি, এ নর্থ কোরিয়ান উম্যান' অর্থাৎ 'মিসেস বি, একজন উত্তর কোরীয় নারী' ।
সিনেমাটিতে তার জীবনের বিপরীত অনেক বিষয় উঠে এসেছে।
সিনেমাতে যেমন দেখানো হয়েছে- ওই নারীকে যার কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল কিভাবে সেই চীনা লোকের প্রতি তার ভেতরে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল।
দশবছর ধরে ওই লোকটির সাথে একসাথে থাকেন এই নারী।
কীভাবে হয়ে উঠলেন একজন মানব পাচারকারী
যদিও এই নারী নিজেই পাচারের শিকার হওয়া একজন ভুক্তভোগী, তবু একটা সময় তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন মানব পাচারকারী এবং উত্তর কোরিয়ার মেয়েদের তিনি চীনা পুরুষদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেন।
বিবিসি কোরিয়ান সার্ভিসকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, তিনি অর্ধশত নারীকে বিক্রি করেছেন।
চীন-উত্তর কোরিয়া সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে পরে চীন-লাওস সীমান্ত পেরিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়াতে পৌঁছাতেন।
এই নারী জানান এসব তিনি করেন তার উত্তর কোরিয়ান পরিবারকে একত্রিত রাখার জন্য।
কিন্তু তার স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের ফাটল ধরতে থাকে।
মুক্ত অবাধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া তাকে সুখী করার চেয়েও বেশি 'বিতৃষ্ণা' দিয়েছে।
বাস্তব জীবন থেকে সিনেমা
দুর্ভাগ্যবশত তার জীবনের ঘটনা খুব বিচিত্র কিছু নয়।
কমিউনিস্ট দেশ উত্তর কোরিয়া ছেড়ে পালাতে গেলে দেশটির অনেক নারীকেই পাচারের অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়।
অনেক নারী চীনা লোকদের কাছে বিক্রি হওয়ার পর তাদের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে শেষপর্যন্ত সেখানেই স্থায়ী হয়ে যায়।
অনেক উত্তর কোরীয় পরে দক্ষিণ কোরিয়াতে পালিয়ে এলেও পরে এই দক্ষিণ কোরিয়াতে আসার জন্য তারা আক্ষেপ প্রকাশ করে এবং তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ অন্য কোন দেশে পাড়ি জমায়।
অপ্রত্যাশিত রোমান্স
তাকে যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল সেই চীনা লোকটির সাথে তার সম্পর্কের ধরণ কি ছিল? সেটি কি "ভালবাসা"?
এমন প্রশ্ন করা হলে 'মিসেস বি' বলেন, "আমি মনে করি এটা মায়া, দুজন মানুষের একে অপরের প্রতি মায়া।
আমার কখনোই মনে হয়নি এটা 'ভালবাসা' ছিল।"
তিনি জানান তাকে কিনে নেয়া লোকটি ছিলেন অত্যন্ত সমঝদার এবং চমৎকার মানুষ।
তিনি লোকটির সাথে চীনের প্রত্যন্ত যে এলাকায় বাস করতেন সেখানে খুব অল্প মানুষই ভালোবাসা নিয়ে কথাবার্তা বলতেন।
ভালোবাসা বিষয়ক আলোচনা উত্তর কোরিয়াতেও সমানভাবে অনুপস্থিত ছিল।
যে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে সেখানে মূলত চীনা লোকটির সাথে এই নারীটির সম্পর্ককে ফোকাস করা হয়েছে।
তার কাছে বিক্রিত হলেও তকে একজন প্রেমময় স্বামী বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
সিনেমায় দেখা যায় নারীটি যখন রেগে যায় তখন তাকে হাসানোর জন্য লোকটি নানারকম চেষ্টা চালাতো।
মিসেস বি, চীন-লাওস সীমান্ত পেরুনোর প্রচেষ্টা শুরু করলে ওই ব্যক্তিও তাকে সাহায্য করেন এবং বিশ্বাস করেন যে দক্ষিণ কোরিয়ায় মিসেস বি একটু সেটেল হলে তাকেও সেখানে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
মানব পাচারের ঘটনার দ্বারা অপ্রত্যাশিত রোমান্সের ঘটনা দেখে দর্শকরাও বিরক্তি প্রকাশ করেছে।
মিসেস বি বলেন,"আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি সন্তান ধারণে সক্ষম কিন্তু যেহেতু আমার সন্তানদের কাছে উত্তর কোরিয়াতে আমার ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাই আমি আবার বাচ্চা নিতে চাইলাম না। এটা শুনে সে(চীনা নাগরিক) বলেছিল 'ঠিক আছে'। এজন্য তার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম।"
যেহেতু আমার জন্য সে সন্তানের মুখ দেখতে পেলো না, তাই দায়িত্ববোধ থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে তার মৃত্যু পর্যন্ত তার পাশে থাকবো আমি।"
চলচ্চিত্রে যা উঠে আসেনি
মিসেস বি প্রকৃতপক্ষে তার সন্তানদের এবং উত্তর কোরীয় স্বামীকে চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
যদিও সিনেমা থেকে সেইসব অংশ বাদ দেয়া হয়েছে।
মিসেস বি তার বড় ছেলেকে ২০০৯ সালে চীনে আনার পর সে মা ও সৎ বাবার সাথে তিন বছর কাটানোর পর খাপ খাওয়াতে পারছিলনা।
তখন তার মা তাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে চলে যেতে সহায়তা করেন।
২০১৩ সালে মিসেস বি তার ছোট ছেলে এবং উত্তর কোরীয় স্বামীকে দক্ষিণ কোরিয়াতে চলে যেতে সাহায্য করেন, তবে তারা সেখানে যাওয়ার আগে চীনে আসেন এবং তাদের সাথে এক মাসের বেশি থাকেন।
"আমরা সবাই একই কক্ষের ভেতর ঘুমাতাম, আমি, আমার চীনা স্বামী, আমার উত্তর কোরিয়ান স্বামী এবং আমার ছোট ছেলেটি" -বলেন মিসেস বি।
"আরও অনেকের মধ্যে একজন"
মিসেস বি বলেন, উত্তর কোরিয়া থেকৈ পালানোর সময় ৮০% নারী পাচারের অভিজ্ঞতার স্বীকার হয় এবং তিনি কেবল সেইসব নারীদের মধ্যে একজন"।
যদিও এ বিষয়ে কোন অফিশিয়াল পরিসংখ্যান দুই কোরিয়া কিংবা চীনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
মিসেস বি রাতারাতি একজন পাচারকারী হয়ে উঠেছিলেন-বিষয়টি তেমন নয়।
প্রাথমিকভাবে একটি গরুর খামারে চাকরি করতেন তিনি। মাসে নয় মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রোজগার করতেন।
তিনি ওই ফার্মে কাজ করার সময় একজন দালালের সহায়তায় নিজের সন্তান আর উত্তর কোরিয়ান স্বামীকে একবার দেখার সুযোগ পান চীন-উত্তর কোরিয়া সীমান্তে।
সেখানে স্বামীকে অসহায় ও দরিদ্র অবস্থায় দেখে হতবাক হয়ে যান তিনি। এরপরই অর্থের জন্য তিনি অবতীর্ণ হন পাচারকারীর ভূমিকায়।
"পরিবারের জন্য কিছু একটা করতে হবে -এটাই তখন আমার মাথার ভেতর ছিল। আমাকে প্রচুর টাকা-পয়সা রোজগার করতে হবে। কিন্তু আমার কোন জাতীয়তা ছিলনা, পরিচয় ছিল না সেসময় , এবং ভালো কিছু রোজগারের মত অনেক কাজই আমি কখনো করতে পারতাম না।"
এরপর ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন উত্তর কোরীয় নারীকে চীনা পুরুষদের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি।
তিনি স্বীকার করেন এটা মানব-পাচার ছিল কিন্তু জোর দিয়ে বলেন তিনি তাদের সাথে প্রতারণা করেননি যেটা তার সাথে করা হয়েছিল।
কিন্তু এইসব মহিলাদের চুক্তি করেই আনা হতো" জানান মিসেস বি।
এক অর্থে এইসব নারীদের নিজেদের পথ খুঁজে নিতে তিনি সাহায্য করেছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, একজন নারীকে বিক্রি করে যে টাকা পেতেনে সেটা ওই বিক্রিত নারীর সাথে ভাগাভাগি করে নিতেন তিনি।
কিন্তু তার ভেতর কি অপরাধ-বোধ কাজ করে?
আমার কাছে মনে হতো মানব-পাচারের বিষয়টি এমন কিছু যার মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়ার নারীদের যাওয়া দরকার।
আমি প্রতারিত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এইসব মহিলারা জানতো তারা কি চাইছে। তাই তাদের হয়তো মনে যন্ত্রণা থাকলেও সেটি আমার মতো ছিল না ।"
উত্তর কোরিয়ার নারীদের চীনা নাগরিকদের কাছে বিক্রি ছাড়াও মিসেস বি দালাল হিসেবে উত্তর কোরীয়দের দক্ষিণ কোরিয়াতে পাঠানোর কাজও করতো।
এমন প্রায় ৫০ জনকে তিনি পাঠিয়েছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা জেরো ইয়ুন বলেন, এই সিনেমাটি নির্মাণের যে যাত্রা, তা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। এটা তাকে সারাজীবনের জন্য বিশাল অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
শেষটা সবসময়ই মধুর নয়
মিসেস বি তার চীনা স্বামীকে কথা দিয়েছিলেন যে একবার দক্ষিণ কোরিয়াতে জায়গা করে নিতে পারলেই তার কাছে আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু সেটা আর ঘটেনি।
২০১৪ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া পৌঁছান এবং সেদেশের গোয়েন্দাদের দ্বারা জেরার মুখে পড়েন। তাকে সন্দেহ করা হয় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে।
এই সন্দেহের কারণ তিনি একটা সময় চীনে আইস নামে একটি মাদক বিক্রি করতেন।
দক্ষিণ কোরীয় গোয়েন্দাদের ভাষ্য ছিল যেহেতু সেই অর্থ উত্তর কোরিয়াতে গিয়েছে সেহেতু তার স্পাই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন মিসেস বি।
তবে তাকে এবং তার স্বামীকে 'নন-প্রটেক্টেড' স্ট্যাটাস দেয়া হয় যার মানে তারা নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবেন না।
মানে হল যাদের অতীতের অপরাধের রেকর্ড আছে, যারা অন্তত ১০ বছর চীনে বসবাস করেছে এমন ব্যক্তিদের এই স্ট্যাটাস দেয়া হয়।
দক্ষিণ কোরীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেন তিনি। আর এতকিছু যখন ঘটছে তার মধ্যে মিসেস বি'র চীনা স্বামী আরেকজন নারীকে বিয়ে করে ফেলেছেন।
যদিও এরপরও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, যাকে তারা বলেন "কেবলই বন্ধুত্ব"। এখনো মেসেজ আদান-প্রদান হয় তাদের মধ্যে।
তবে চীনা সেই লোকটি তার সঙ্গে প্রতারণার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন বলে জানান মিসেস বি।
সিউলে এখন তার সময় কাটে কফি বিক্রি করে।
"একটা সময় টাকা-পয়সাই ছিল আমার জন্য সবকিছু। কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয়না। আমার বাচ্চাদের জন্য আমি সব ত্যাগ করেছি। এখন আমার ৫০ বছর বয়স। এবার আমি নিজের জন্য বাঁচতে চাই। নিজের খুশির জন্য।"
এখন পাচার কিংবা চোরাচালান কোনটির সাথেই আর আমার কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানান মিসেস বি।
সুত্রঃবিবিসি
কথাগুলো বলছিলেন 'মিসেস বি'।
২০০৩ সালে তাকে যখন চীনের কিছু লোকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তখন তার বয়স ছিল ৩৬ বছর।
উত্তর কোরিয়া থেকে পলায়ন
ওই নারী উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পার হয়ে চীনে পৌঁছান। ভেবেছিলেন কোনও বাড়িতে বয়স্কদের দেখাশোনার লোক হিসেবে কাজ জুটবে তার।
তাকে একজন দালাল অন্তত তেমনটাই বলেছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ডাহা মিথ্যা কথা।
মিসেস বি'র পরিকল্পনা ছিল তিনি এক বছর সেখানে কাজ করে টাকা জমাবেন এবং তারপর উত্তর কোরিয়াতে ফিরে যাবেন।
সেই টাকা-পয়সা দিয়ে দেশে থাকা তার স্বামী এবং দুই সন্তানের খাওয়া-পড়া চলে যাবে।
নতুন করে বিয়ে বা স্বামী পাওয়ার কোন ধরনের চিন্তাই ছিলনা তার মাথায়।
চীনাদের কাছে বিক্রি
চীনের জিলিন প্রদেশের চাংচুনে তাকে এবং উত্তর কোরিয়ান আরেকজন পাঁচজন নারীকে এক চীনা পুরুষের কাছে "তুলে দেয়া" হয়।
দালালটি তাকে তখন বলে "একজন চীনা লোকের সাথে কেবল এক বছর থাকো তারপর পালিয়ে যেও।"
মিসেস বি'র জীবনের নানান কাহিনীকে উপজীব্য করে পরিচালক জিরো ইউন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
নাম 'মিসেস বি, এ নর্থ কোরিয়ান উম্যান' অর্থাৎ 'মিসেস বি, একজন উত্তর কোরীয় নারী' ।
সিনেমাটিতে তার জীবনের বিপরীত অনেক বিষয় উঠে এসেছে।
সিনেমাতে যেমন দেখানো হয়েছে- ওই নারীকে যার কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল কিভাবে সেই চীনা লোকের প্রতি তার ভেতরে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল।
দশবছর ধরে ওই লোকটির সাথে একসাথে থাকেন এই নারী।
কীভাবে হয়ে উঠলেন একজন মানব পাচারকারী
যদিও এই নারী নিজেই পাচারের শিকার হওয়া একজন ভুক্তভোগী, তবু একটা সময় তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন মানব পাচারকারী এবং উত্তর কোরিয়ার মেয়েদের তিনি চীনা পুরুষদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেন।
বিবিসি কোরিয়ান সার্ভিসকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, তিনি অর্ধশত নারীকে বিক্রি করেছেন।
চীন-উত্তর কোরিয়া সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে পরে চীন-লাওস সীমান্ত পেরিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়াতে পৌঁছাতেন।
এই নারী জানান এসব তিনি করেন তার উত্তর কোরিয়ান পরিবারকে একত্রিত রাখার জন্য।
কিন্তু তার স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের ফাটল ধরতে থাকে।
মুক্ত অবাধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া তাকে সুখী করার চেয়েও বেশি 'বিতৃষ্ণা' দিয়েছে।
বাস্তব জীবন থেকে সিনেমা
দুর্ভাগ্যবশত তার জীবনের ঘটনা খুব বিচিত্র কিছু নয়।
কমিউনিস্ট দেশ উত্তর কোরিয়া ছেড়ে পালাতে গেলে দেশটির অনেক নারীকেই পাচারের অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়।
অনেক নারী চীনা লোকদের কাছে বিক্রি হওয়ার পর তাদের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে শেষপর্যন্ত সেখানেই স্থায়ী হয়ে যায়।
অনেক উত্তর কোরীয় পরে দক্ষিণ কোরিয়াতে পালিয়ে এলেও পরে এই দক্ষিণ কোরিয়াতে আসার জন্য তারা আক্ষেপ প্রকাশ করে এবং তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ অন্য কোন দেশে পাড়ি জমায়।
অপ্রত্যাশিত রোমান্স
তাকে যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল সেই চীনা লোকটির সাথে তার সম্পর্কের ধরণ কি ছিল? সেটি কি "ভালবাসা"?
এমন প্রশ্ন করা হলে 'মিসেস বি' বলেন, "আমি মনে করি এটা মায়া, দুজন মানুষের একে অপরের প্রতি মায়া।
আমার কখনোই মনে হয়নি এটা 'ভালবাসা' ছিল।"
তিনি জানান তাকে কিনে নেয়া লোকটি ছিলেন অত্যন্ত সমঝদার এবং চমৎকার মানুষ।
তিনি লোকটির সাথে চীনের প্রত্যন্ত যে এলাকায় বাস করতেন সেখানে খুব অল্প মানুষই ভালোবাসা নিয়ে কথাবার্তা বলতেন।
ভালোবাসা বিষয়ক আলোচনা উত্তর কোরিয়াতেও সমানভাবে অনুপস্থিত ছিল।
যে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে সেখানে মূলত চীনা লোকটির সাথে এই নারীটির সম্পর্ককে ফোকাস করা হয়েছে।
তার কাছে বিক্রিত হলেও তকে একজন প্রেমময় স্বামী বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
সিনেমায় দেখা যায় নারীটি যখন রেগে যায় তখন তাকে হাসানোর জন্য লোকটি নানারকম চেষ্টা চালাতো।
মিসেস বি, চীন-লাওস সীমান্ত পেরুনোর প্রচেষ্টা শুরু করলে ওই ব্যক্তিও তাকে সাহায্য করেন এবং বিশ্বাস করেন যে দক্ষিণ কোরিয়ায় মিসেস বি একটু সেটেল হলে তাকেও সেখানে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
মানব পাচারের ঘটনার দ্বারা অপ্রত্যাশিত রোমান্সের ঘটনা দেখে দর্শকরাও বিরক্তি প্রকাশ করেছে।
মিসেস বি বলেন,"আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি সন্তান ধারণে সক্ষম কিন্তু যেহেতু আমার সন্তানদের কাছে উত্তর কোরিয়াতে আমার ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাই আমি আবার বাচ্চা নিতে চাইলাম না। এটা শুনে সে(চীনা নাগরিক) বলেছিল 'ঠিক আছে'। এজন্য তার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম।"
যেহেতু আমার জন্য সে সন্তানের মুখ দেখতে পেলো না, তাই দায়িত্ববোধ থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে তার মৃত্যু পর্যন্ত তার পাশে থাকবো আমি।"
চলচ্চিত্রে যা উঠে আসেনি
মিসেস বি প্রকৃতপক্ষে তার সন্তানদের এবং উত্তর কোরীয় স্বামীকে চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
যদিও সিনেমা থেকে সেইসব অংশ বাদ দেয়া হয়েছে।
মিসেস বি তার বড় ছেলেকে ২০০৯ সালে চীনে আনার পর সে মা ও সৎ বাবার সাথে তিন বছর কাটানোর পর খাপ খাওয়াতে পারছিলনা।
তখন তার মা তাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে চলে যেতে সহায়তা করেন।
২০১৩ সালে মিসেস বি তার ছোট ছেলে এবং উত্তর কোরীয় স্বামীকে দক্ষিণ কোরিয়াতে চলে যেতে সাহায্য করেন, তবে তারা সেখানে যাওয়ার আগে চীনে আসেন এবং তাদের সাথে এক মাসের বেশি থাকেন।
"আমরা সবাই একই কক্ষের ভেতর ঘুমাতাম, আমি, আমার চীনা স্বামী, আমার উত্তর কোরিয়ান স্বামী এবং আমার ছোট ছেলেটি" -বলেন মিসেস বি।
"আরও অনেকের মধ্যে একজন"
মিসেস বি বলেন, উত্তর কোরিয়া থেকৈ পালানোর সময় ৮০% নারী পাচারের অভিজ্ঞতার স্বীকার হয় এবং তিনি কেবল সেইসব নারীদের মধ্যে একজন"।
যদিও এ বিষয়ে কোন অফিশিয়াল পরিসংখ্যান দুই কোরিয়া কিংবা চীনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
মিসেস বি রাতারাতি একজন পাচারকারী হয়ে উঠেছিলেন-বিষয়টি তেমন নয়।
প্রাথমিকভাবে একটি গরুর খামারে চাকরি করতেন তিনি। মাসে নয় মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রোজগার করতেন।
তিনি ওই ফার্মে কাজ করার সময় একজন দালালের সহায়তায় নিজের সন্তান আর উত্তর কোরিয়ান স্বামীকে একবার দেখার সুযোগ পান চীন-উত্তর কোরিয়া সীমান্তে।
সেখানে স্বামীকে অসহায় ও দরিদ্র অবস্থায় দেখে হতবাক হয়ে যান তিনি। এরপরই অর্থের জন্য তিনি অবতীর্ণ হন পাচারকারীর ভূমিকায়।
"পরিবারের জন্য কিছু একটা করতে হবে -এটাই তখন আমার মাথার ভেতর ছিল। আমাকে প্রচুর টাকা-পয়সা রোজগার করতে হবে। কিন্তু আমার কোন জাতীয়তা ছিলনা, পরিচয় ছিল না সেসময় , এবং ভালো কিছু রোজগারের মত অনেক কাজই আমি কখনো করতে পারতাম না।"
এরপর ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন উত্তর কোরীয় নারীকে চীনা পুরুষদের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি।
তিনি স্বীকার করেন এটা মানব-পাচার ছিল কিন্তু জোর দিয়ে বলেন তিনি তাদের সাথে প্রতারণা করেননি যেটা তার সাথে করা হয়েছিল।
কিন্তু এইসব মহিলাদের চুক্তি করেই আনা হতো" জানান মিসেস বি।
এক অর্থে এইসব নারীদের নিজেদের পথ খুঁজে নিতে তিনি সাহায্য করেছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, একজন নারীকে বিক্রি করে যে টাকা পেতেনে সেটা ওই বিক্রিত নারীর সাথে ভাগাভাগি করে নিতেন তিনি।
কিন্তু তার ভেতর কি অপরাধ-বোধ কাজ করে?
আমার কাছে মনে হতো মানব-পাচারের বিষয়টি এমন কিছু যার মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়ার নারীদের যাওয়া দরকার।
আমি প্রতারিত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এইসব মহিলারা জানতো তারা কি চাইছে। তাই তাদের হয়তো মনে যন্ত্রণা থাকলেও সেটি আমার মতো ছিল না ।"
উত্তর কোরিয়ার নারীদের চীনা নাগরিকদের কাছে বিক্রি ছাড়াও মিসেস বি দালাল হিসেবে উত্তর কোরীয়দের দক্ষিণ কোরিয়াতে পাঠানোর কাজও করতো।
এমন প্রায় ৫০ জনকে তিনি পাঠিয়েছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা জেরো ইয়ুন বলেন, এই সিনেমাটি নির্মাণের যে যাত্রা, তা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। এটা তাকে সারাজীবনের জন্য বিশাল অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
শেষটা সবসময়ই মধুর নয়
মিসেস বি তার চীনা স্বামীকে কথা দিয়েছিলেন যে একবার দক্ষিণ কোরিয়াতে জায়গা করে নিতে পারলেই তার কাছে আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু সেটা আর ঘটেনি।
২০১৪ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া পৌঁছান এবং সেদেশের গোয়েন্দাদের দ্বারা জেরার মুখে পড়েন। তাকে সন্দেহ করা হয় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে।
এই সন্দেহের কারণ তিনি একটা সময় চীনে আইস নামে একটি মাদক বিক্রি করতেন।
দক্ষিণ কোরীয় গোয়েন্দাদের ভাষ্য ছিল যেহেতু সেই অর্থ উত্তর কোরিয়াতে গিয়েছে সেহেতু তার স্পাই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন মিসেস বি।
তবে তাকে এবং তার স্বামীকে 'নন-প্রটেক্টেড' স্ট্যাটাস দেয়া হয় যার মানে তারা নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবেন না।
মানে হল যাদের অতীতের অপরাধের রেকর্ড আছে, যারা অন্তত ১০ বছর চীনে বসবাস করেছে এমন ব্যক্তিদের এই স্ট্যাটাস দেয়া হয়।
দক্ষিণ কোরীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেন তিনি। আর এতকিছু যখন ঘটছে তার মধ্যে মিসেস বি'র চীনা স্বামী আরেকজন নারীকে বিয়ে করে ফেলেছেন।
যদিও এরপরও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, যাকে তারা বলেন "কেবলই বন্ধুত্ব"। এখনো মেসেজ আদান-প্রদান হয় তাদের মধ্যে।
তবে চীনা সেই লোকটি তার সঙ্গে প্রতারণার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন বলে জানান মিসেস বি।
সিউলে এখন তার সময় কাটে কফি বিক্রি করে।
"একটা সময় টাকা-পয়সাই ছিল আমার জন্য সবকিছু। কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয়না। আমার বাচ্চাদের জন্য আমি সব ত্যাগ করেছি। এখন আমার ৫০ বছর বয়স। এবার আমি নিজের জন্য বাঁচতে চাই। নিজের খুশির জন্য।"
এখন পাচার কিংবা চোরাচালান কোনটির সাথেই আর আমার কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানান মিসেস বি।
সুত্রঃবিবিসি
No comments