ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় সত্য বলেন নি: বুলবুল
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে
স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তবে বাংলাদেশে সম্প্রতি পাস
হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক, সাংবাদিক নেতা ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় সত্য কথা বলেন নি
এবং সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্তই বিতর্ক ও সমাচেনার জন্ম দিয়েছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় সত্য বলেন নি
- পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি
- সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্তই বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে
- এই আইনের অনেক ধারাই সাংবাদিকদের জন্য আতঙ্কের কারণ
- আইনে ১৪ টি জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে
- এই আইনে শাস্তির পরিমাণ অস্বাভাবিক
- দুটি আইনের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত আছে
রেডিও তেহরান:
জনাব মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, সম্প্রতি বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
নামে একটি আইন করা হয়েছে যা নিয়ে সাংবাদিক সমাজ ও সরকার বড় রকমের বিতর্কে
জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে আপনি একটি কলাম লিখেছেন যার শিরোনাম ছিল “এই বিতর্কের
প্রয়োজন ছিল না”। আপনার লেখা থেকে পরিষ্কার যে, সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এই
বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। কেন এই বিতর্ক সৃষ্টি করা হলো বলে আপনার মনে হয়?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অংশীজন হিসাবে সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হয়েছিল। সেই উদ্যোগটি অবশ্যই ভালো ছিল। তবে আমি " এই বিতর্কের প্রয়োজন ছিল না" এই জন্যে বলেছি যে যখন আলোচনা শেষে সংসদীয় কমিটিতে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা প্রথম ও দ্বিতীয় বৈঠক করার পর চূড়ান্ত বৈঠকটি আর করলেন না। আর চূড়ান্ত বৈঠকটি না করার ফলে অনেকগুলো জায়গা অনিস্পন্ন থেকে গেল। তৃতীয় বৈঠকটি করলে এমন অবস্থা হতো না। আর সেজন্যেই আমি বলেছি যে আসলে এই বিতর্কটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই বিতর্কটি তৈরি না করলেও পারত।
রেডিও তেহরান: জাতীয় সংসদে যখন আইনটি নিয়ে আলোচনার পর পাস করা হয়েছে তখন কী শুধু কয়েকজন মন্ত্রীকে সৃষ্ট বিতর্কের জন্য দায়ী করা যায়? এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নিজেও কিন্তু আইনটির পক্ষে কথা বলছেন।
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: হ্যাঁ, একথা ঠিক যে এর দায়িত্বটি পুরোপুরিভাবে সরকারের ওপর বর্তাবে। আমি বলতে চেয়েছি পদ্ধতিগত ক্রুটির কথা। যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তারা সঠিকভাবে পদ্ধতি অনুসরণ করেন নি সেকথাই বলতে চেয়েছি। তবে চূড়ান্ত বিচারে এ আইনটি তো সরকারের আইন, এটি রাষ্ট্রের আইন। সংসদে পাসের মাধ্যমে এটি রাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা আলোচনায় বলব রাষ্ট্র এমন একটি আইন পাস করল যেটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। এই সমালোচনাটি আমরা এখনও করছি। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার বক্তব্য দিয়েছেন- সেটি ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু এ বিতর্কে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বিতর্কটি নিষ্পন্ন করার জন্যই তো সংসদীয় কমিটি আমাদেরকে ডেকেছিল কিন্তু তারা বিষয়টি নিষ্পত্তি না করার ফলেই তো বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই বিতর্কটি রেখেই সংসদীয় কমিটি পার্লামেন্টে গেলেন। ফলে চূড়ান্ত বিচারে আমরা এর সমালোচনা করছি। আর সেই সমালোচনার জায়গাটি তৈরি করে দিলেন এই সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত। আর সেখানে ছিলেন মন্ত্রী মহোদয় ও এমপিরা।
রেডিও তেহরান: মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, আইনটি পাসের আগে সাংবদিকদের দেয়া সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আপনার লেখা থেকে পরিষ্কার যে, কয়েকজন মন্ত্রী অসত্য বলেছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, এটি খুবই দুঃখজনক। দুঃখজনক একারণে যেখানে পার্লামেন্টে আমাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই। মন্ত্রী মহোদয় একতরফাভাবে বললেন যে, সাংবাদিকদের সমস্ত দাবি মানা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা সত্য না। আর সেটি যে সত্য না সেকথা আমার লেখার মধ্যে বলেছি এবং চ্যালেঞ্জ করেছি। এ ব্যাপারে আমাদের হাতে চারটি ডকুমেন্ট আছে। একটি ডকুমেন্ট হচ্ছে প্রথম খসড়া। দ্বিতয়টি হচ্ছে-সম্পাদক পরিষদের লিখিত বক্তব্য। তৃতীয়টি হচ্ছে-বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়েনের লিখিত প্রস্তাবনা এবং চতুর্থটি হচ্ছে যেটি সংসদে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হলো। তো আমরা বলেছিলাম যে সবগুলো নিয়ে বসলেই বোঝা যাবে আমাদের কোন প্রস্তাব কতটুকু মানা হয়েছে। তবে হ্যাঁ একেবারে কোনো কিছু মানা হয় নি সেকথা বলব না। আর সেই মানার মধ্য দিয়ে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বড় একটি উদাহরণ দিতে চাই।
আমরা বলেছিলাম যে, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইন- এ দুটোকে মিলিয়ে করতে হবে। তারা আমাদের কথা শুনে তিন ধারায় তথ্য অধিকার আইনকে সংযুক্ত করল। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন তথ্য অধিকার আইন হয়েছিল তখন কীজন্য এ আইনটি হয়েছিল? হয়েছিল এই কারণে যে, তখন কাজ করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বাধা দেয়া হতো। আর সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্যই সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শুধু সাংবাদিক না গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তথ্য অধিকার আইন করা হয়।
ফলে ২০০৯ সালের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টটাকে একধরনের বাতিলই করে দেয়া হলো- এর কোনো কার্যকারীতা থাকল না। আর তথ্য অধিকার আইনে একই কথা বলা হয়েছিল। তথ্য অবারিত করার ক্ষেত্রে এই আইনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। তবে ৩ নং ধারায় ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনকে সংযোজন করা হলো আবার একই আইনের ৩২ ধারায় ২০০৯ সালের যে আইনকে একধরনের ভোতা করে দিলাম সেটাকেই আবার উজ্জীবিত করা হলো।
রেডিও তেহরান: ডিজিটাল আইন নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ উদ্বেগ জানাচ্ছে কেন? আসলে সংকটটা কোথায়?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, সংকটের জায়গাটি হচ্ছে একজন সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ যখন কথা বলবেন তখন তিনি তথ্য অধিকার আইনের রেফারেন্স করবেন। তিনি বলবেন তথ্য অধিকার আইনে আমাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেই আইনে আমি একথা বলছি বা একাজটি করছি। আবার পুলিশ বলবে আপনি যে কাজ করেছেন সেজন্য আপনার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হবে। তবে হয়তো কোর্টে গেলে তথ্য অধিকার আইন চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকরা গ্রেফতার হবে, জেলে যাবে, কোর্ট পর্যন্ত যেতে জামিন অযোগ্য ধারায় তাকে যেতে হবে। এই যে ভোগান্তি হবে সেটাই আমাদের আতঙ্কের কারণ।
আরেকটি বড় সংকট রয়েছে। মৌলিক যে বিষয়টি পরিবর্তন করার কথা মন্ত্রীরা বলেছিলেন যে ৪৩ ধারায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করবেন। মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে প্রস্তাব দিলেন। তখন আমরা বললাম এখানে তো কোনো প্রোটেকশন নেই। পুলিশের যাকে সন্দেহ হবে সে সাংবাদিক কিংবা সাধারণ মানুষ-তাকেই কোনো বাধা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারবে। আমরা এর প্রতিবাদ করে বলেছিলাম যে এখানে সেফটি নীতি থাকতে হবে যাতে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার না হয়। আমাদের বক্তব্য শুনে মন্ত্রীরা সংসদীয় কমিটিতে নিজেরাই প্রস্তাব দিলেন যে তাহলে সাংবাদিকদের প্রোটেকশন হিসেবে ডিজিটাল এজেন্সির যিনি মহাপরিচালক থাকে তাহলে তার অনুমতি নিয়ে কাউকে গ্রেফতার করতে হবে।
সংসদে চূড়ান্ত যে রিপোর্টটি পাবলিশ করা হয়েছে সেখানে কোন কোন ধারায় নতুন যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তা আন্ডারলাইন পড়ে দেয়া হয়। সেই কপিটির মধ্যে বিষয়গুলো লেখা আছে। কিন্তু উদ্বেগজনক এবং হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে মন্ত্রী যখন সংসদে এটি পাঠ করেন তখন বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আমাদের প্রোটেকশনটা থাকল কোথায়!
কাজেই দুটি আইনের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত আছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের অবারিত ক্ষমতা দেয়া হলো। তারা যা খুশি তাই করতে পারবেন। কারো কোনো অনুমতি না নিয়েই কাউকে গ্রেফতার করতে পারবেন। তারপরও বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে- এই আইনে ১৪ টি জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে। তাছাড়া শাস্তির পরিমাণ অস্বাভাবিক। কাজেই সব মিলিয়ে এই আইনে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো যথেস্ট উপাদান আছে। আর সেজন্যেই আমরা বলেছি যে, আইনের ধারাগুলো যদি দুর্বৃত্তদের ওপর প্রয়োগ করা হয় তাতে কোনো আপত্তি নেই। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে যারা অপরাধ করেন তাদের বিরুদ্ধে একটা আইনের মাধ্যমে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়া হোক এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আইনের কোনো ধারাতে যাতে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইন এই দুটো আইনের মধ্য দিয়ে তথ্য মুক্ত করার যে জায়গায় আমরা গিয়েছিলাম সেখান থেকে আমাদের আবার বিপরীতভাবে হাঁটতে হলো। আমরা গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই আইনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাথার ওপর একটা ভয়ের ছায়া ঝুলিয়ে রাখা হলো। যেটা মুক্ত স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
রেডিও তেহরান: সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে সর্বশেষ যে বৈঠক হয়েছে তার পরিণতি কী হতে পারে বলে আপনি মনে করছেন?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, তিনজন মন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আমাদের এই উদ্বেগগুলোকে নিয়ে তারা মন্ত্রিসভায় যাবেন। আর মন্ত্রিসভা আবার এটাকে দ্রুততম সময়ে একটা সংশোধনী আনতে পারেন। এটি একটি দিক হতে পারে। আর দ্বিতীয় যেটি হতে পারে সেটি হচ্ছে-মন্দের ভালো- এই আইনটি প্রয়োগের যে বিধিমালা রয়েছে তাতেও যদি কিছু সংশোধনী এনে নতুন কিছু সংযোজন করা যায়। তবে বিধিমালা কখনও মূল আইনকে সুপারসিড করতে পারবে না। কোনো অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার ও তল্লাশীর যে অধিকার পুলিশকে দেয়া হয়েছে সেটি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে বিধিমালা দিয়ে হয়তো কিছু বিষয়কে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব।
আরেকটি হচ্ছে আমরা অতীতে দেখেছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক কিছুতে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন এখানেও যদি তিনি তেমনটি দেখান তাহলে হয়তো শঙ্কার জায়গা থেকে সাংবাদিকরা বের হয়ে আসতে পারবেন।
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অংশীজন হিসাবে সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হয়েছিল। সেই উদ্যোগটি অবশ্যই ভালো ছিল। তবে আমি " এই বিতর্কের প্রয়োজন ছিল না" এই জন্যে বলেছি যে যখন আলোচনা শেষে সংসদীয় কমিটিতে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা প্রথম ও দ্বিতীয় বৈঠক করার পর চূড়ান্ত বৈঠকটি আর করলেন না। আর চূড়ান্ত বৈঠকটি না করার ফলে অনেকগুলো জায়গা অনিস্পন্ন থেকে গেল। তৃতীয় বৈঠকটি করলে এমন অবস্থা হতো না। আর সেজন্যেই আমি বলেছি যে আসলে এই বিতর্কটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই বিতর্কটি তৈরি না করলেও পারত।
রেডিও তেহরান: জাতীয় সংসদে যখন আইনটি নিয়ে আলোচনার পর পাস করা হয়েছে তখন কী শুধু কয়েকজন মন্ত্রীকে সৃষ্ট বিতর্কের জন্য দায়ী করা যায়? এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নিজেও কিন্তু আইনটির পক্ষে কথা বলছেন।
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: হ্যাঁ, একথা ঠিক যে এর দায়িত্বটি পুরোপুরিভাবে সরকারের ওপর বর্তাবে। আমি বলতে চেয়েছি পদ্ধতিগত ক্রুটির কথা। যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তারা সঠিকভাবে পদ্ধতি অনুসরণ করেন নি সেকথাই বলতে চেয়েছি। তবে চূড়ান্ত বিচারে এ আইনটি তো সরকারের আইন, এটি রাষ্ট্রের আইন। সংসদে পাসের মাধ্যমে এটি রাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা আলোচনায় বলব রাষ্ট্র এমন একটি আইন পাস করল যেটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। এই সমালোচনাটি আমরা এখনও করছি। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার বক্তব্য দিয়েছেন- সেটি ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু এ বিতর্কে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বিতর্কটি নিষ্পন্ন করার জন্যই তো সংসদীয় কমিটি আমাদেরকে ডেকেছিল কিন্তু তারা বিষয়টি নিষ্পত্তি না করার ফলেই তো বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই বিতর্কটি রেখেই সংসদীয় কমিটি পার্লামেন্টে গেলেন। ফলে চূড়ান্ত বিচারে আমরা এর সমালোচনা করছি। আর সেই সমালোচনার জায়গাটি তৈরি করে দিলেন এই সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত। আর সেখানে ছিলেন মন্ত্রী মহোদয় ও এমপিরা।
রেডিও তেহরান: মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, আইনটি পাসের আগে সাংবদিকদের দেয়া সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আপনার লেখা থেকে পরিষ্কার যে, কয়েকজন মন্ত্রী অসত্য বলেছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, এটি খুবই দুঃখজনক। দুঃখজনক একারণে যেখানে পার্লামেন্টে আমাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই। মন্ত্রী মহোদয় একতরফাভাবে বললেন যে, সাংবাদিকদের সমস্ত দাবি মানা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা সত্য না। আর সেটি যে সত্য না সেকথা আমার লেখার মধ্যে বলেছি এবং চ্যালেঞ্জ করেছি। এ ব্যাপারে আমাদের হাতে চারটি ডকুমেন্ট আছে। একটি ডকুমেন্ট হচ্ছে প্রথম খসড়া। দ্বিতয়টি হচ্ছে-সম্পাদক পরিষদের লিখিত বক্তব্য। তৃতীয়টি হচ্ছে-বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়েনের লিখিত প্রস্তাবনা এবং চতুর্থটি হচ্ছে যেটি সংসদে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হলো। তো আমরা বলেছিলাম যে সবগুলো নিয়ে বসলেই বোঝা যাবে আমাদের কোন প্রস্তাব কতটুকু মানা হয়েছে। তবে হ্যাঁ একেবারে কোনো কিছু মানা হয় নি সেকথা বলব না। আর সেই মানার মধ্য দিয়ে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বড় একটি উদাহরণ দিতে চাই।
আমরা বলেছিলাম যে, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইন- এ দুটোকে মিলিয়ে করতে হবে। তারা আমাদের কথা শুনে তিন ধারায় তথ্য অধিকার আইনকে সংযুক্ত করল। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন তথ্য অধিকার আইন হয়েছিল তখন কীজন্য এ আইনটি হয়েছিল? হয়েছিল এই কারণে যে, তখন কাজ করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বাধা দেয়া হতো। আর সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্যই সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শুধু সাংবাদিক না গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তথ্য অধিকার আইন করা হয়।
ফলে ২০০৯ সালের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টটাকে একধরনের বাতিলই করে দেয়া হলো- এর কোনো কার্যকারীতা থাকল না। আর তথ্য অধিকার আইনে একই কথা বলা হয়েছিল। তথ্য অবারিত করার ক্ষেত্রে এই আইনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। তবে ৩ নং ধারায় ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনকে সংযোজন করা হলো আবার একই আইনের ৩২ ধারায় ২০০৯ সালের যে আইনকে একধরনের ভোতা করে দিলাম সেটাকেই আবার উজ্জীবিত করা হলো।
রেডিও তেহরান: ডিজিটাল আইন নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ উদ্বেগ জানাচ্ছে কেন? আসলে সংকটটা কোথায়?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, সংকটের জায়গাটি হচ্ছে একজন সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ যখন কথা বলবেন তখন তিনি তথ্য অধিকার আইনের রেফারেন্স করবেন। তিনি বলবেন তথ্য অধিকার আইনে আমাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেই আইনে আমি একথা বলছি বা একাজটি করছি। আবার পুলিশ বলবে আপনি যে কাজ করেছেন সেজন্য আপনার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হবে। তবে হয়তো কোর্টে গেলে তথ্য অধিকার আইন চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকরা গ্রেফতার হবে, জেলে যাবে, কোর্ট পর্যন্ত যেতে জামিন অযোগ্য ধারায় তাকে যেতে হবে। এই যে ভোগান্তি হবে সেটাই আমাদের আতঙ্কের কারণ।
আরেকটি বড় সংকট রয়েছে। মৌলিক যে বিষয়টি পরিবর্তন করার কথা মন্ত্রীরা বলেছিলেন যে ৪৩ ধারায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করবেন। মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে প্রস্তাব দিলেন। তখন আমরা বললাম এখানে তো কোনো প্রোটেকশন নেই। পুলিশের যাকে সন্দেহ হবে সে সাংবাদিক কিংবা সাধারণ মানুষ-তাকেই কোনো বাধা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারবে। আমরা এর প্রতিবাদ করে বলেছিলাম যে এখানে সেফটি নীতি থাকতে হবে যাতে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার না হয়। আমাদের বক্তব্য শুনে মন্ত্রীরা সংসদীয় কমিটিতে নিজেরাই প্রস্তাব দিলেন যে তাহলে সাংবাদিকদের প্রোটেকশন হিসেবে ডিজিটাল এজেন্সির যিনি মহাপরিচালক থাকে তাহলে তার অনুমতি নিয়ে কাউকে গ্রেফতার করতে হবে।
সংসদে চূড়ান্ত যে রিপোর্টটি পাবলিশ করা হয়েছে সেখানে কোন কোন ধারায় নতুন যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তা আন্ডারলাইন পড়ে দেয়া হয়। সেই কপিটির মধ্যে বিষয়গুলো লেখা আছে। কিন্তু উদ্বেগজনক এবং হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে মন্ত্রী যখন সংসদে এটি পাঠ করেন তখন বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আমাদের প্রোটেকশনটা থাকল কোথায়!
কাজেই দুটি আইনের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত আছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের অবারিত ক্ষমতা দেয়া হলো। তারা যা খুশি তাই করতে পারবেন। কারো কোনো অনুমতি না নিয়েই কাউকে গ্রেফতার করতে পারবেন। তারপরও বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে- এই আইনে ১৪ টি জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে। তাছাড়া শাস্তির পরিমাণ অস্বাভাবিক। কাজেই সব মিলিয়ে এই আইনে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো যথেস্ট উপাদান আছে। আর সেজন্যেই আমরা বলেছি যে, আইনের ধারাগুলো যদি দুর্বৃত্তদের ওপর প্রয়োগ করা হয় তাতে কোনো আপত্তি নেই। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে যারা অপরাধ করেন তাদের বিরুদ্ধে একটা আইনের মাধ্যমে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়া হোক এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আইনের কোনো ধারাতে যাতে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আইন এই দুটো আইনের মধ্য দিয়ে তথ্য মুক্ত করার যে জায়গায় আমরা গিয়েছিলাম সেখান থেকে আমাদের আবার বিপরীতভাবে হাঁটতে হলো। আমরা গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই আইনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাথার ওপর একটা ভয়ের ছায়া ঝুলিয়ে রাখা হলো। যেটা মুক্ত স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
রেডিও তেহরান: সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে সর্বশেষ যে বৈঠক হয়েছে তার পরিণতি কী হতে পারে বলে আপনি মনে করছেন?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, তিনজন মন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আমাদের এই উদ্বেগগুলোকে নিয়ে তারা মন্ত্রিসভায় যাবেন। আর মন্ত্রিসভা আবার এটাকে দ্রুততম সময়ে একটা সংশোধনী আনতে পারেন। এটি একটি দিক হতে পারে। আর দ্বিতীয় যেটি হতে পারে সেটি হচ্ছে-মন্দের ভালো- এই আইনটি প্রয়োগের যে বিধিমালা রয়েছে তাতেও যদি কিছু সংশোধনী এনে নতুন কিছু সংযোজন করা যায়। তবে বিধিমালা কখনও মূল আইনকে সুপারসিড করতে পারবে না। কোনো অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার ও তল্লাশীর যে অধিকার পুলিশকে দেয়া হয়েছে সেটি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে বিধিমালা দিয়ে হয়তো কিছু বিষয়কে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব।
আরেকটি হচ্ছে আমরা অতীতে দেখেছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক কিছুতে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন এখানেও যদি তিনি তেমনটি দেখান তাহলে হয়তো শঙ্কার জায়গা থেকে সাংবাদিকরা বের হয়ে আসতে পারবেন।
No comments