কারাগারে আদালত স্থানান্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, চ্যালেঞ্জ করবেন আইনজীবীরা
জিয়া
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার
বিচারকাজ চলবে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগারে। সেখানে একটি কক্ষে
এজলাস স্থাপন করা হয়েছে। মামলার নির্ধারিত শুনানি হবে এ এজলাসে।
নিরাপত্তার কারণে আদালতের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে বলে গতকাল আইন
মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সংবিধান
পরিপন্থি দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল
সন্ধ্যায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে কারাগারে এজলাস স্থাপনকে ক্যামেরা
ট্রায়াল বলে উল্লেখ করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্তের
বিরুদ্ধে তারা আইনি চ্যালেঞ্জে যাবেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে এই বিশেষ মামলার বিচারকাজ পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নম্বর-৭ এ অনুষ্ঠিত হবে। তবে, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের আগেই বিকালে এ তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি জানান, আজ বুধবার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় অসমাপ্ত যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য আজ দিন ধার্য রয়েছে। এর আগে এই মামলার কার্যক্রম চলতো বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে।
এই মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আরো ৩ আসামি রয়েছেন। বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার আরো কিছু মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর এবং অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায়ের পর থেকেই খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি এখন যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় বেশ কয়েকটি ধার্য দিনে খালেদা জিয়াকে বকশীবাজারের আদালতে হাজির করা হয়নি। শুনানির দিনে আদালতকে এই বলে অবহিত করা হয়েছে যে, অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না।
এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া নির্ধারিত তারিখে হাজিরা না দেয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। গতকাল নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার এই মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা) গত ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাস হয়ে গেলেও কোনো কার্যক্রম করতে পারছি না। এই মামলায় খালেদা জিয়া উপস্থিত হচ্ছেন না। এ কারণে আমরা বলেছি, খালেদা জিয়া যেখানে আছেন সেখানেই আদালত বসানো প্রয়োজন।
এক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ কিনা, তা আমি জানি না। যে রেকর্ড আছে সেখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ, তা উল্লেখ নেই। আমরা জানি তিনি আসার জন্য অনুপযুক্ত ছিলেন।’ মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, কারাগারের ভেতরে আদালত হলেও এটি প্রকাশ্য আদালত। এখানে আদালতের কার্যক্রমের সময় জনগণ, আইনজীবী, সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানমতে এ আদালত হচ্ছে বলে জানান তিনি। এর আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ ভিডিও কনফারেন্সের ক্যামেরা ট্রায়ালে করার প্রস্তাব করেছিলেন দুদকের এই আইনজীবী। গতকাল তিনি বলেন, আমরা আদালতকে বলেছিলাম, সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার করার জন্য। আমরা আদালতে এও বলেছিলাম, এটি একটা পরিত্যক্ত জেলখানা। এখানে অনেক জায়গা আছে। জনগণের উপস্থিতিতে এখানে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।’
এদিকে কারাগারের ভেতরে আদালতের কার্যক্রম চলার এই সিদ্ধান্তকে সংবিধান, আইনবহির্র্ভূত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী নওশাদ জমির। খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান মানবজমিনকে বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। কেন না সংবিধানে বলা আছে যে, প্রকাশ্য আদালতে (পাবলিক ট্রায়াল) বিচারকাজ হতে হবে। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।’ তিনি বলেন, ‘জেলখানা কখনো পাবলিক ট্রায়াল হতে পারে না। জেলখানায় কখনো আদালত বসতে পারে না।’ খালেদা জিয়ার অন্য আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, যেনতেন কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়ার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকার এই পন্থা অবলম্বন করেছে। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এটি আরো একটি নীল নকশা। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই এসব করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কারাগার হচ্ছে কারাগার। এখানে বিচারকাজ চলতে পারে না। আমরা মনে করি এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের পরিপন্থি। সানাউল্লাহ মিয়া আরো বলেন, বাংলাদেশের জুডিশিয়ারির ইতিহাসে এ ধরনের নজির নেই। অতীতে জেলখানার বাইরে বিচারকাজ হয়েছে। কিন্তু জেলাখানার ভেতরে-এটি হয় না। প্রসঙ্গত, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ই আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক পুলিশের সাবেক পরিচালক জিয়াউল ইসলাম ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাবেক একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
উল্লেখ্য, এর আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে সংসদ ভবন এলাকায় সাব-জেলে রাখা হয়েছিল। তাদের বিচারে সাব-জেলের পাশেই সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করে বিচারকাজ চালানো হতো।
কারাগারে আদালত স্থাপন সংবিধান বিরোধী: বিএনপি
পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আদালত বসিয়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম শুরু করার সরকারি সিদ্ধান্তকে সংবিধানের পরিপন্থি আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিগগিরই রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার কথা বলেছে তারা। গতরাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। মির্জা আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা এতদিন একটি বিশেষ আদালত তৈরি করে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে চলছিল। আমরা জানতে পেরেছি- সরকার একটা বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আদালতটি স্থানান্তর করে নেয়া হচ্ছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। সেটা কাল থেকে শুরু হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই- সরকারের এই সিদ্ধান্ত সংবিধান বিরোধী। সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের আর্টিক্যাল ৩৫(৩) ধারা মতে, এই ধরনের মামলার বিচার প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এখানে ক্যামেরা ট্রায়াল করার সুযোগ নেই। আমরা তাদের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং অসুস্থ দেশনেত্রীর খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা মনে করি- এটি ক্যামেরা ট্রায়াল। আমরা রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা সর্বোপরি তিনি একজন প্রবীণ নাগরিক।
এখন সংবিধান লঙ্ঘন করে তার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে! এটাকে কোনোভাবেই হালকা করে নেয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, অন্যায় ও বেআইনিভাবে উচ্চতর আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন হওয়ার পরও বিভিন্ন কারসাজির মধ্য দিয়ে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই গণবিরোধী সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারবিভাগকে নিজেদের লোক দিয়ে প্রভাবিত করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে দেশনেত্রীকে হয়রানি ও নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মির্জা আলমগীর বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং একদলীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার হীন উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করবো। পরবর্তী কার্যক্রম কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবো। সিআরপি’র ধারা ব্যাখ্যা করে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, একটি দেশ চলে সংবিধানের অধীনে।
সংবিধানের অধীনে অন্য কোনো আইন নেই বাংলাদেশে। অনেকেই মৌলিক অধিকারের কথা বলেন, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের কথা বলেন। দেশের মূল সংবিধান এখন পর্যন্ত যতবারই সংশোধন করা হয়েছে, ৩৫ ধারা কোনদিন সংশোধন হয়নি। ৩৫(৩)-এ স্পষ্ট করে বলা আছে যেকোনো ফৌজদারি মামলার বিচার প্রকাশ্যে হতে হবে। তিনি বলেন, আজকে জেলখানার অভ্যন্তরে বিচার করার অর্থ হলো ক্যামেরা ট্রায়াল। এটা আমাদের দেশে সংবিধান সম্মত নয়। সিআরপিসি তো প্রায় দেড়শ’ দুইশ’ বছর আগের। সেখানে দেখবেন ৩৫২ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে এই ধরনের বিচার প্রকাশ্যে হতে হবে। এখন যেটা সরকার করছে এটা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান পরিপন্থি। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, আমরা এই ব্যাপারে কথা-বার্তা বলবো। পর্যালোচনা করবো। কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা করবো। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আইন সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে এই বিশেষ মামলার বিচারকাজ পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নম্বর-৭ এ অনুষ্ঠিত হবে। তবে, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের আগেই বিকালে এ তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি জানান, আজ বুধবার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় অসমাপ্ত যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য আজ দিন ধার্য রয়েছে। এর আগে এই মামলার কার্যক্রম চলতো বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে।
এই মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আরো ৩ আসামি রয়েছেন। বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার আরো কিছু মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর এবং অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায়ের পর থেকেই খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি এখন যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় বেশ কয়েকটি ধার্য দিনে খালেদা জিয়াকে বকশীবাজারের আদালতে হাজির করা হয়নি। শুনানির দিনে আদালতকে এই বলে অবহিত করা হয়েছে যে, অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না।
এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া নির্ধারিত তারিখে হাজিরা না দেয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। গতকাল নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার এই মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা) গত ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাস হয়ে গেলেও কোনো কার্যক্রম করতে পারছি না। এই মামলায় খালেদা জিয়া উপস্থিত হচ্ছেন না। এ কারণে আমরা বলেছি, খালেদা জিয়া যেখানে আছেন সেখানেই আদালত বসানো প্রয়োজন।
এক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ কিনা, তা আমি জানি না। যে রেকর্ড আছে সেখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ, তা উল্লেখ নেই। আমরা জানি তিনি আসার জন্য অনুপযুক্ত ছিলেন।’ মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, কারাগারের ভেতরে আদালত হলেও এটি প্রকাশ্য আদালত। এখানে আদালতের কার্যক্রমের সময় জনগণ, আইনজীবী, সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানমতে এ আদালত হচ্ছে বলে জানান তিনি। এর আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ ভিডিও কনফারেন্সের ক্যামেরা ট্রায়ালে করার প্রস্তাব করেছিলেন দুদকের এই আইনজীবী। গতকাল তিনি বলেন, আমরা আদালতকে বলেছিলাম, সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার করার জন্য। আমরা আদালতে এও বলেছিলাম, এটি একটা পরিত্যক্ত জেলখানা। এখানে অনেক জায়গা আছে। জনগণের উপস্থিতিতে এখানে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।’
এদিকে কারাগারের ভেতরে আদালতের কার্যক্রম চলার এই সিদ্ধান্তকে সংবিধান, আইনবহির্র্ভূত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী নওশাদ জমির। খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান মানবজমিনকে বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। কেন না সংবিধানে বলা আছে যে, প্রকাশ্য আদালতে (পাবলিক ট্রায়াল) বিচারকাজ হতে হবে। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।’ তিনি বলেন, ‘জেলখানা কখনো পাবলিক ট্রায়াল হতে পারে না। জেলখানায় কখনো আদালত বসতে পারে না।’ খালেদা জিয়ার অন্য আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, যেনতেন কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়ার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকার এই পন্থা অবলম্বন করেছে। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এটি আরো একটি নীল নকশা। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই এসব করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কারাগার হচ্ছে কারাগার। এখানে বিচারকাজ চলতে পারে না। আমরা মনে করি এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের পরিপন্থি। সানাউল্লাহ মিয়া আরো বলেন, বাংলাদেশের জুডিশিয়ারির ইতিহাসে এ ধরনের নজির নেই। অতীতে জেলখানার বাইরে বিচারকাজ হয়েছে। কিন্তু জেলাখানার ভেতরে-এটি হয় না। প্রসঙ্গত, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ই আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক পুলিশের সাবেক পরিচালক জিয়াউল ইসলাম ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাবেক একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
উল্লেখ্য, এর আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে সংসদ ভবন এলাকায় সাব-জেলে রাখা হয়েছিল। তাদের বিচারে সাব-জেলের পাশেই সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করে বিচারকাজ চালানো হতো।
কারাগারে আদালত স্থাপন সংবিধান বিরোধী: বিএনপি
পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আদালত বসিয়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম শুরু করার সরকারি সিদ্ধান্তকে সংবিধানের পরিপন্থি আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিগগিরই রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার কথা বলেছে তারা। গতরাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। মির্জা আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা এতদিন একটি বিশেষ আদালত তৈরি করে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে চলছিল। আমরা জানতে পেরেছি- সরকার একটা বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আদালতটি স্থানান্তর করে নেয়া হচ্ছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। সেটা কাল থেকে শুরু হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই- সরকারের এই সিদ্ধান্ত সংবিধান বিরোধী। সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের আর্টিক্যাল ৩৫(৩) ধারা মতে, এই ধরনের মামলার বিচার প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এখানে ক্যামেরা ট্রায়াল করার সুযোগ নেই। আমরা তাদের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং অসুস্থ দেশনেত্রীর খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা মনে করি- এটি ক্যামেরা ট্রায়াল। আমরা রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা সর্বোপরি তিনি একজন প্রবীণ নাগরিক।
এখন সংবিধান লঙ্ঘন করে তার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে! এটাকে কোনোভাবেই হালকা করে নেয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, অন্যায় ও বেআইনিভাবে উচ্চতর আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন হওয়ার পরও বিভিন্ন কারসাজির মধ্য দিয়ে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই গণবিরোধী সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারবিভাগকে নিজেদের লোক দিয়ে প্রভাবিত করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে দেশনেত্রীকে হয়রানি ও নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মির্জা আলমগীর বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং একদলীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার হীন উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করবো। পরবর্তী কার্যক্রম কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবো। সিআরপি’র ধারা ব্যাখ্যা করে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, একটি দেশ চলে সংবিধানের অধীনে।
সংবিধানের অধীনে অন্য কোনো আইন নেই বাংলাদেশে। অনেকেই মৌলিক অধিকারের কথা বলেন, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের কথা বলেন। দেশের মূল সংবিধান এখন পর্যন্ত যতবারই সংশোধন করা হয়েছে, ৩৫ ধারা কোনদিন সংশোধন হয়নি। ৩৫(৩)-এ স্পষ্ট করে বলা আছে যেকোনো ফৌজদারি মামলার বিচার প্রকাশ্যে হতে হবে। তিনি বলেন, আজকে জেলখানার অভ্যন্তরে বিচার করার অর্থ হলো ক্যামেরা ট্রায়াল। এটা আমাদের দেশে সংবিধান সম্মত নয়। সিআরপিসি তো প্রায় দেড়শ’ দুইশ’ বছর আগের। সেখানে দেখবেন ৩৫২ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে এই ধরনের বিচার প্রকাশ্যে হতে হবে। এখন যেটা সরকার করছে এটা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান পরিপন্থি। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, আমরা এই ব্যাপারে কথা-বার্তা বলবো। পর্যালোচনা করবো। কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা করবো। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আইন সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
No comments