চাঙ্গাভাব ফিরছে আবাসন খাতে

টানা কয়েক বছর সংকটে থাকা দেশের আবাসন খাতে চাঙ্গাভাব ফিরছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায়, ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে আসা, ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের স্বল্প সুদে গৃহঋণ পাওয়া এবং বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট কেনার  ক্ষেত্রে দেয়া ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দেশব্যাপী নগর দরিদ্রদের জন্য ৪০ লাখ পরিবারকে ফ্ল্যাট প্রদানের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব কারণে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও বিএইচবিএফসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালে নতুন আবাসিকে গ্যাস সংযোগ না দেয়ার ঘোষণার পর পরতে শুরু করে আবাসন খাতের বাজার। এরপর শেয়ারবাজারে ধস, ক্রেতাপর্যায়ে ঋণের অভাবসহ নানা কারণে আবাসন খাতের বিক্রি আরো কমে যায়। তবে ব্যাংকঋণের সুদহার হ্রাস ও ফ্ল্যাট কিনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ চালুর সুবাদে আবাসন খাতে আবার সুদিন ফিরছে। অ্যাপার্টমেন্টের বাজার ক্রমান্বয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালের পর থেকে আবাসন ইউনিট বিক্রি ২০ শতাংশ বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ২০১৭ সালে পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে এবং আগের কয়েক বছরের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে। চলতি বছর এ খাতের পরিস্থিতি আরো ভালো হবে বলে তারা আশা করছেন। তারা জানান, অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রিতে বেশ ছাড় দিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে জমির মূল্য একই রকম আছে। এদিকে অ্যাপার্টমেন্টের দামও বাড়েনি। এ কারণেই আবাসন খাতে বিক্রি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের তুলনায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতিষ্ঠানভেদে ৩০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। দাম সবচেয়ে বেশি কমেছে বারিধারা, বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি, লালমাটিয়ার মতো এলাকায়। রিহ্যাব জানিয়েছে, ২০০৮ সালে আবাসন খাতকে ঘিরে ২০ লাখের মতো কর্মসংস্থান ছিল। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ২৮ লাখের মতো। ২০২০ সাল নাগাদ এ খাতে প্রায় ৩৩ লাখ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান প্রায় ১৫ ভাগ। রিহ্যাবের হিসাব মতে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ২০৯টি প্রতিষ্ঠানের ১১ হাজার ১৬৫টি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। ২০১৪ সালে ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৪৯টি।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম এখনো যৌক্তিক। আবাসনে বিনিয়োগের এখন উপযুক্ত সময়। আমাদের ব্যবসাও এখন তুলনামূলক বেশ ভালো চলছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আবাসন খাত আবারো ঘুরে দাঁড়াবে।
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম সেরাজ বলেন, ২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ছিল খুবই কম। তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০১৭ সালে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় বিক্রি শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বেড়েছে। আশা করা যায়, আগামীতে পরিস্থিতি আরো ভালো হবে।
বিএইচবিএফসি সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে সরকারি কর্মচারীরা ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে গৃহঋণ পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট কেনার ঋণের সুদহারে এত দিন সামান্য যে পার্থক্য ছিল, তা তুলে দিচ্ছে সংস্থাটি। বিএইচবিএফসির এক কর্মকর্তা বলেন, ৯ই আগস্টের মধ্যে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেটি মানতেই সুদের হার কমানো হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন জারি হবে। স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের আবাসন স্বপ্ন পূরণে বিএইচবিএফসির নতুন গৃহঋণের সুদের হার কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সূত্র জানায়, ঋণ ছাড়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছে। দেশের ১২ লাখ কর্মচারীর হাতে এ ঋণের অর্থ তুলে দিতে সরকারের পক্ষ থেকে জোর তাগিদ রয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সরকার এ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
এদিকে গত ৩০শে জুলাই অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহ নির্মাণ ঋণ প্রদান নীতিমালা’ ২০১৮ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে অর্থ বিভাগ, যা ১লা জুলাই থেকে কার্যকরের কথা বলা হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী, গৃহনির্মাণে ৫ শতাংশ সরল সুদে ঋণ নেয়ার যোগ্যতা হিসেবে কর্মচারীদের বয়সসীমা করা হয় চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর সর্বনিম্ন ৫ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫৬ বছর। সে হিসেবে প্রায় ১২ লাখ কর্মচারী এ ঋণ সুবিধা পাবেন, যা বাস্তবায়নে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংক ও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন সরকারের এ ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করবে। নীতিমালার আওতায় জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড ভেদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ এবং সর্বনিম্ন ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেয়া যাবে।
সূত্র মতে, সরকারি চাকরিজীবীদের সহজ শর্তে গৃহঋণ দিতে চলতি মাসে দেশের চারটি সরকারি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গৃহ নির্মাণ ঋণ দেয়া হবে সেগুলো হচ্ছে- সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী এবং বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি)।
বাংলাদেশে ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি কর্মচারীদের গৃহঋণ প্রদান নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে এ উদ্যোগের আওতায় অন্যদেরও আনার চেষ্টা রাখতে হবে। আবার  ব্যাংকগুলোকেও এ ঋণ প্রদানে স্বচ্ছতার বিষয়টি গুরুত্বে রাখতে হবে।
রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নূরন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি বলেন, স্বল্প সুদে ঋণের এ পরিপত্রের কারণে এরই মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে গৃহনির্মাণ বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের আগ্রহ জন্মেছে। যা আবাসন শিল্পের জন্য খুবই সুখের খবর। এর মাধ্যমে আবাসন শিল্পে ১৩ লাখ নতুন বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, আবাসন খাত অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে। আগের তুলনায় এ খাতে বর্তমানে ক্রেতাদের আস্থার সংকট কেটেছে। ১৯৯২ সালে সাতটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিহ্যাব। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১১৫১টি।

No comments

Powered by Blogger.