বাংলাদেশের নির্বাচন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে
শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, এই বছরের
৩১শে অক্টোবর থেকে ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু
বাংলাদেশ বা দেশটির প্রধান প্রতিবেশী ভারত কারো জন্যই এটি সহজ কোনো
প্রেক্ষাপট নয়। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সহিংসতার কারণে বিতর্কিত ছিল।
পাশাপাশি, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচনে ভোটার
উপস্থিতি ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা, এবারের
নির্বাচন হবে আরো বিশ্বাসযোগ্য এবং এ নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
স্থিতিশীল করার পক্ষে সহায়ক হবে বলেও সবার আশা। দেশটিতে আবার ইসলামি
চরমপন্থা শক্তিশালী হচ্ছে।
এ মাসে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভাল বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের এক বৈঠকে ঢাকায় গেছেন। তার সফরের পর ঢাকায় যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় গোখালে। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে এ সম্পর্ক।
বিএনপিকে নিয়ে সংশয়ী ভারত: বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬ সালে বিএনপির দুই দফার শাসনামলের অভিজ্ঞতা থেকে। দলটির দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের শেকড় বিস্তার করে। তখন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ দৃষ্টিপাত না করায় ভারতের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানের গোপন সমর্থন পেয়েছে।
রাজনৈতিক, জাতীয় নিরাপত্তা ও ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিবেচনায় থাকতে হবে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। দেশটি বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের কাছেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, এখানে বিপুল সংখ্যক মুসলিমের বাস, যারা উগ্রপন্থার ছোঁয়ায় আসছেন।
জামায়াতে ইসলামি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ, জমিয়াতুল মুজাহিদিনসহ ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো অনেকদিন হলো দেশটিতে আছে। এখন ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদার মতো গোষ্ঠীরও দাবি দেশটিতে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আত্মঘাতী হামলাও প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। এ কারণে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতীত অন্য যে কারো নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে- এমন প্রেক্ষাপটকে উদ্বেগের চোখে দেখে ভারত। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে, ভারত জোর দিয়েই বলে থাকে যে, দুই দলের বিষয়ে তারা নিরপেক্ষ। গত অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। আলোচনা করেছেন দলটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। কয়েকজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা ও তৃতীয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকাণ্ড সীমিত করার মতো ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক। তারা আরো বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইসলামিস্ট চরমপন্থা দূরীকরণে শেখ হাসিনা খুবই সক্রিয়। অপরদিকে বিএনপি সরকার কিছু ইসলামিস্ট গোষ্ঠীকে যদি উৎসাহ নাও দিয়ে থাকে, অন্তত তাদেরকে সহ্য করেছে বলে, এমনটা দাবি ভারতীয় কর্তাদের।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন: স্পষ্টতই, যেকোনো নতুন নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত বিএনপি বলছে, আগামী নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে দলটির অবস্থান হলো, ভালো হয় যদি তা নির্দলীয় একটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে হয়। যারা নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের দায়িত্ব নেবে। এমনকি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে প্রচারণা জোরদার করেছে।
ক্ষমতাসীন-বিরোধিতা ফ্যাক্টরের ওপর ভর করছে বিএনপি। দলটি নিজেই নির্বাচনে লড়ার জন্য সাংগঠিনকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ৩৭টি মামলা দায়ের করা আছে। লন্ডন থেকে পরোক্ষভাবে দল পরিচালিত হচ্ছে তার ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে।
ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলেকে একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা দেয়া হয়। একটি তহবিল থেকে অর্থ তছরুফের অভিযোগে তারা সাজা পান। খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়। তার দল দাবি করছে, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত। তবে, বাংলাদেশের সরকারগুলোর বাজে পারফরম্যান্সের পেছনে একটি বড় কারণ হলো লাগামহীন দুর্নীতি।
খালেদার একসময়কার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামির স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন কার্যকলাপের বিচার হয়েছে। দলটি রীতিমত ধ্বংস হয়ে গেছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। নির্বাচনে অংশও নিতে পারবে না জামায়াতে ইসলামি। যদিও নিজেদের ছাত্র শাখা বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের মাধ্যমে এখনো রাজপথে উল্লেখযোগ্য শক্তি রয়েছে দলটির।
শেখ হাসিনার সমস্যা হলো ক্ষমতাসীন থাকার সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হলো তার মিত্র সাবেক স্বৈরশাসক হসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি বলছে তারা একাই নির্বাচন লড়বে।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোই করেছে। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭ শতাংশ। ভারতের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে দেশটির অর্থনীতির কলেবর। তারপরও সরকার কাঠামোয় কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে যা সহজে দূর করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত অরাজনৈতিক ভূমিকায় আছে। তবে, ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দুই বছরব্যাপী মেয়াদে টিকিয়ে রেখেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ওই অবস্থা বিরাজ ছিল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থাকলে, এমনো সম্ভাবনা আছে যে, গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ফের সেনাবাহিনীকে ডাকা হবে। তবে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে ঘনিষ্ঠ করে রেখেছেন। আকার দ্বিগুণ করেছেন। অস্ত্রসজ্জিত করার পাশাপাশি নতুন ঘাঁটি নির্মাণে উদারহস্তে বাজেট দিয়েছেন।
ভূরাজনৈতিক হটস্পট: ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন নিয়ে কিছু পশ্চিমা দেশ অসন্তুষ্ট ছিল। এ কারণেই বেইজিং ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের প্রভাব কমিয়ে আনতে ও বঙ্গোপসাগরের মাথায় দেশটির কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ বাড়ছে। মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের নিকটেই বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে চীনের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। এই রাজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইনও রয়েছে চীনের। এই পাইপলাইনের ফলে মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে চীন সরাসরি নিজের স্থলবেষ্টিত প্রদেশ ইউনানে তেল সরবরাহ করতে পারছে।
ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাতা ও বাণিজ্য আংশীদার। তবে, চীন এখন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। ২০০৭ সাল থেকে দেশটি বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে সেতু, সড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনের সংশ্লিষ্টতা আছে। এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ।
২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে দুই হাজার কোটি ডলার সমমূল্যের বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। একটি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, এই বিনিয়োগ বেড়ে তিন হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। বিনিয়োগের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলে সবাইকে বহুদূর ছাড়িয়ে চীন হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ। ভারত এখানে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তবে, ভারত বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৪৫০ কোটি ডলার করেছে, যা যেকোনো দেশকে দেয়া ভারতের সর্বোচ্চ ঋণের প্রস্তাব।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারত উভয়ের সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চীন একদিকে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার নেপথ্যে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার নিন্দা জানায়নি। অপরদিকে ভারতের কেউ কেউ উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশ থেকে বড় আকারে রোহিঙ্গারা ভারতে অনুপ্রবেশ করতে পারে। হয়ে উঠতে পারে নিরাপত্তা হুমকি।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যৎ কেমন দেখাবে বাংলাদেশে? এই প্রশ্ন পুরো বিশ্বের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারতের।
সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যকল্প হলো এই যে, বাংলাদেশের সংসদীয় দলগুলো দুর্বল হবে। শক্তিশালী হবে হেফাজতে ইসলামের মতো গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান। ইসলামি আদর্শবাদীরা ইতিমধ্যেই পাঠ্যবই পরিবর্তনের মাধ্যমে অমুসলিম লেখক ও তাদের ধ্যানধারণা বাতিল করিয়ে জাতীয় ন্যারেটিভ পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে, ব্লগার, শিক্ষাবিদ ও হিন্দুদের ওপর জঙ্গিরা হামলা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এসব দমন করা শুরু করে কেবলমাত্র ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হওয়ার পর।
আরেকটি বিকল্প হলো সামরিক সরকার, যেমনটা দেশটি অতীতে বেশ কয়েকবার দেখেছে। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে বেশ উপযুক্ত অবস্থানে (সুইট স্পট) আছে, তবে এখানে বড় এক ‘কিন্তু’ আছে। বাংলাদেশের ইসলামিস্ট উগ্রপন্থার পুরোনো ইতিহাস আছে। তবে নতুন ও আরো উৎকট ঘরানার ইসলামিজম দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিতে পারে।
(মনোজ যোশী নয়াদিল্লি-ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফেলো। এশিয়া টাইমস থেকে তার এই নিবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছে।)
এ মাসে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভাল বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের এক বৈঠকে ঢাকায় গেছেন। তার সফরের পর ঢাকায় যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় গোখালে। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে এ সম্পর্ক।
বিএনপিকে নিয়ে সংশয়ী ভারত: বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬ সালে বিএনপির দুই দফার শাসনামলের অভিজ্ঞতা থেকে। দলটির দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের শেকড় বিস্তার করে। তখন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ দৃষ্টিপাত না করায় ভারতের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানের গোপন সমর্থন পেয়েছে।
রাজনৈতিক, জাতীয় নিরাপত্তা ও ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিবেচনায় থাকতে হবে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। দেশটি বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের কাছেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, এখানে বিপুল সংখ্যক মুসলিমের বাস, যারা উগ্রপন্থার ছোঁয়ায় আসছেন।
জামায়াতে ইসলামি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ, জমিয়াতুল মুজাহিদিনসহ ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো অনেকদিন হলো দেশটিতে আছে। এখন ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদার মতো গোষ্ঠীরও দাবি দেশটিতে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আত্মঘাতী হামলাও প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। এ কারণে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতীত অন্য যে কারো নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে- এমন প্রেক্ষাপটকে উদ্বেগের চোখে দেখে ভারত। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে, ভারত জোর দিয়েই বলে থাকে যে, দুই দলের বিষয়ে তারা নিরপেক্ষ। গত অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। আলোচনা করেছেন দলটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। কয়েকজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা ও তৃতীয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকাণ্ড সীমিত করার মতো ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক। তারা আরো বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইসলামিস্ট চরমপন্থা দূরীকরণে শেখ হাসিনা খুবই সক্রিয়। অপরদিকে বিএনপি সরকার কিছু ইসলামিস্ট গোষ্ঠীকে যদি উৎসাহ নাও দিয়ে থাকে, অন্তত তাদেরকে সহ্য করেছে বলে, এমনটা দাবি ভারতীয় কর্তাদের।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন: স্পষ্টতই, যেকোনো নতুন নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত বিএনপি বলছে, আগামী নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে দলটির অবস্থান হলো, ভালো হয় যদি তা নির্দলীয় একটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে হয়। যারা নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের দায়িত্ব নেবে। এমনকি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে প্রচারণা জোরদার করেছে।
ক্ষমতাসীন-বিরোধিতা ফ্যাক্টরের ওপর ভর করছে বিএনপি। দলটি নিজেই নির্বাচনে লড়ার জন্য সাংগঠিনকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ৩৭টি মামলা দায়ের করা আছে। লন্ডন থেকে পরোক্ষভাবে দল পরিচালিত হচ্ছে তার ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে।
ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলেকে একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা দেয়া হয়। একটি তহবিল থেকে অর্থ তছরুফের অভিযোগে তারা সাজা পান। খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়। তার দল দাবি করছে, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত। তবে, বাংলাদেশের সরকারগুলোর বাজে পারফরম্যান্সের পেছনে একটি বড় কারণ হলো লাগামহীন দুর্নীতি।
খালেদার একসময়কার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামির স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন কার্যকলাপের বিচার হয়েছে। দলটি রীতিমত ধ্বংস হয়ে গেছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। নির্বাচনে অংশও নিতে পারবে না জামায়াতে ইসলামি। যদিও নিজেদের ছাত্র শাখা বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের মাধ্যমে এখনো রাজপথে উল্লেখযোগ্য শক্তি রয়েছে দলটির।
শেখ হাসিনার সমস্যা হলো ক্ষমতাসীন থাকার সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হলো তার মিত্র সাবেক স্বৈরশাসক হসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি বলছে তারা একাই নির্বাচন লড়বে।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোই করেছে। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭ শতাংশ। ভারতের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে দেশটির অর্থনীতির কলেবর। তারপরও সরকার কাঠামোয় কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে যা সহজে দূর করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত অরাজনৈতিক ভূমিকায় আছে। তবে, ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দুই বছরব্যাপী মেয়াদে টিকিয়ে রেখেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ওই অবস্থা বিরাজ ছিল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থাকলে, এমনো সম্ভাবনা আছে যে, গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ফের সেনাবাহিনীকে ডাকা হবে। তবে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে ঘনিষ্ঠ করে রেখেছেন। আকার দ্বিগুণ করেছেন। অস্ত্রসজ্জিত করার পাশাপাশি নতুন ঘাঁটি নির্মাণে উদারহস্তে বাজেট দিয়েছেন।
ভূরাজনৈতিক হটস্পট: ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন নিয়ে কিছু পশ্চিমা দেশ অসন্তুষ্ট ছিল। এ কারণেই বেইজিং ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের প্রভাব কমিয়ে আনতে ও বঙ্গোপসাগরের মাথায় দেশটির কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ বাড়ছে। মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের নিকটেই বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে চীনের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। এই রাজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইনও রয়েছে চীনের। এই পাইপলাইনের ফলে মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে চীন সরাসরি নিজের স্থলবেষ্টিত প্রদেশ ইউনানে তেল সরবরাহ করতে পারছে।
ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাতা ও বাণিজ্য আংশীদার। তবে, চীন এখন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। ২০০৭ সাল থেকে দেশটি বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে সেতু, সড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনের সংশ্লিষ্টতা আছে। এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ।
২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে দুই হাজার কোটি ডলার সমমূল্যের বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। একটি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, এই বিনিয়োগ বেড়ে তিন হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। বিনিয়োগের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলে সবাইকে বহুদূর ছাড়িয়ে চীন হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ। ভারত এখানে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তবে, ভারত বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৪৫০ কোটি ডলার করেছে, যা যেকোনো দেশকে দেয়া ভারতের সর্বোচ্চ ঋণের প্রস্তাব।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারত উভয়ের সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চীন একদিকে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার নেপথ্যে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার নিন্দা জানায়নি। অপরদিকে ভারতের কেউ কেউ উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশ থেকে বড় আকারে রোহিঙ্গারা ভারতে অনুপ্রবেশ করতে পারে। হয়ে উঠতে পারে নিরাপত্তা হুমকি।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যৎ কেমন দেখাবে বাংলাদেশে? এই প্রশ্ন পুরো বিশ্বের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারতের।
সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যকল্প হলো এই যে, বাংলাদেশের সংসদীয় দলগুলো দুর্বল হবে। শক্তিশালী হবে হেফাজতে ইসলামের মতো গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান। ইসলামি আদর্শবাদীরা ইতিমধ্যেই পাঠ্যবই পরিবর্তনের মাধ্যমে অমুসলিম লেখক ও তাদের ধ্যানধারণা বাতিল করিয়ে জাতীয় ন্যারেটিভ পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালে, ব্লগার, শিক্ষাবিদ ও হিন্দুদের ওপর জঙ্গিরা হামলা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এসব দমন করা শুরু করে কেবলমাত্র ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হওয়ার পর।
আরেকটি বিকল্প হলো সামরিক সরকার, যেমনটা দেশটি অতীতে বেশ কয়েকবার দেখেছে। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে বেশ উপযুক্ত অবস্থানে (সুইট স্পট) আছে, তবে এখানে বড় এক ‘কিন্তু’ আছে। বাংলাদেশের ইসলামিস্ট উগ্রপন্থার পুরোনো ইতিহাস আছে। তবে নতুন ও আরো উৎকট ঘরানার ইসলামিজম দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিতে পারে।
(মনোজ যোশী নয়াদিল্লি-ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফেলো। এশিয়া টাইমস থেকে তার এই নিবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছে।)
No comments