'সুখী মানুষ' ভান্টু দা'র গল্প
এক
নামেই সবাই চেনে ভান্টু দা বলে। ভান্টু নামটি এতটাই পরিচিত যে, বাবা-মায়ের
দেয়া নামটি আজ হারিয়ে গেছে। পুরো নাম অধির চন্দ্র কর্মকার। পিতা নিতাই
কর্মকার। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির মৌকুড়ি গ্রামে ( আমতলা)। জীবনের
বেশির ভাগ সময় পার করেছেন উপজেলা পরিষদের বারান্দায়। এখনও তার দিন কাটে
উপজেলা পরিষদ চত্বরে। বয়স ৭০ বছর হয়েছে। তরুণ বয়সে পাতার তৈরি বাঁশি বাজিয়ে
ও কথাবার্তায় অফিসের কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে রাখতেন। তবে বয়স
হওয়ার সাথে সাথে পাতার বাঁশির কাছে হার মেনেছেন সাদা মনের মানুষ ভান্টু
দা। সোমবার দুপুরে কথা হয় অধির চন্দ্র কর্মকার ওরফে ভান্টু দার সাথে। তার
কাছে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো শোনার চেষ্টা করলে তিনি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা
করেন। তারপরও মনের অজান্তেই বলতে থাকেন জীবনের হারিয়ে যাওয়া ৭০ বছরের কথা।
জন্ম প্রতিবন্ধী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাদশা কেরানির বাড়িতে ছোটবেলায় রাখালের
কাজ শুরু করেন। গরু চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন গাছের পাতা দিয়ে বাঁশি
বানিয়ে সুরের ঝড় তোলেন। ভালো বাসতেন আমতলা বাজারে যাত্রাদলের শিল্পীদের
অভিনয়। নিজেও অভিনয় করে মানুষকে হাসিয়ে মাতিয়ে রাখতেন।
গৃহকর্তা তাকে দিয়ে
সব কাজ করালেও সততার কোনো কমতি পাননি তার মধ্যে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় পাড়ি জমান ভারতে। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেই শিশু বয়সে বিয়ে করেন
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের গীতা রানীকে। বিয়ের পর সংসার চালানোর
জন্য কিছুদিন কাঠুরিয়ার কাজও করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাঠুরিয়ার কাজ
ছেড়ে দেন। এরপর আশ্রয় নেন উপজেলা চত্বরে। বিভিন্ন অফিসের বারান্দায় কাটতে
থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অফিসের বারান্দায় থাকলেও ভান্টুর সততা,
নিষ্ঠা ও তার গান, অভিনয়, পাতার বাঁশি ও ব্যবহারে মুগ্ধ হন
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একদিন ভান্টুকে না দেখলে মনে হয় কিছু হারিয়েছে। এরপর
তাকে দেওয়া হয় অফিস সহায়ক হিসেবে ঝাড়ুদার ও চা টানার কাজ। মাসিক বেতন না
থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় তার সংসার সুখেই চলতে থাকে। এরই
মধ্যে গীতা-ভান্টুর সংসারে একে একে ১০টি সন্তান জন্ম নেয়। এখন তার ৪ ছেলে ও
৩ মেয়ে জীবিত রয়েছেন। ছেলেরা বিয়ে করে তাদের মতো সংসার পেতেছে। ২ মেয়েকেও
বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। বয়সের ভারে এখন আর পাতার
বাঁশি বাজাতে পারেন না। তবে মনের জৌলুশ এখনও কমেনি। কর্মকর্তাদেরকে বিষন্ন
দেখলেই কৌতুকপূর্ণ কথা বা কোনো অভিনয় করেন। এতে পড়ে যায় হাসির ঝিলিক। কখনো
তার মন খারাপ দেখেছে কেউ -তা বলা দুষ্কর। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী
মানুষ দাবি করেন ভান্টু দা। ভান্টু দা বলেন, দাঁত পড়ে গেছে, শরীরও দুর্বল।
পাতা থাকলেও এখন আর বাঁশি বাজাতে পারি না। ইচ্ছা করে বাঁশি বাজাই। তবে
চেষ্টা করেও বাঁশি বাজাতে ব্যর্থ হই। দোয়া করবেন যেন বাকি জীবনটুকু
ভালোভাবে কেটে যায়। বালিয়াকান্দি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া
টগর বলেন, ভান্টু একজন সদালাপী, সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। তার সততার মূল্য
অনেক। তবে তাকে অনেকেই ঠকিয়েছে। সে কাউকে ঠকিয়েছে এমন নজির নেই। উপজেলা
সহকারী মৎস্য অফিসার মো. রবিউল হক জানান, আমি ২০০৭ সাল থেকে ভান্টু দাকে
চিনি। তিনি একজন সৎ ও ভালো মনের মানুষ। তাকে বিশ্বাস করে কেউ প্রতারিত
হয়নি। অফিস পাড়াকে হাস্যজ্জ্বল করে রাখেন। তার মতো লোক এ সমাজে পাওয়া বিরল।
No comments