দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
বাংলাদেশ
ও মিয়ানমারের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রমের চুক্তি ‘ফিজিক্যাল
অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষর হয়েছে। তবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে
ফেরত পাঠানো কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। মিয়ানমার প্রতিদিনে
মাত্র ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। বর্তমানে ১০ লাখের বেশি
রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছেন। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নির্ধারিত দুই
বছরের মধ্যে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার
দাবি করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার নানা অজুহাতে টালবাহানা করেছে। তারা
প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে।
মিয়ানমার বলেছে, তিন মাস পর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার সংখ্যা বাড়াবে।
দেশটির রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ৩০ দফা ফিজিক্যাল
অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়েছে। দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকের পর মঙ্গলবার এই
চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে মো. শহীদুল হক এবং মিয়ানমারের পক্ষে মিন্ট
থোয়ে স্বাক্ষর করেন। ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে
পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের আগামী দুই বছরের মধ্যে ফেরত নেয়া শেষ
হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প বসাবে বাংলাদেশ। আর
মিয়ানমারের দিকে তাদের গ্রহণ করতে দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করবে
দেশটি। যাচাই হবে পরিবারকে ইউনিট হিসেবে ধরে। বিবিসি জানায়, চুক্তি অনুযায়ী
প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে মিয়ানমার। অর্থাৎ সপ্তাহে ১৫০০
রোহিঙ্গা ফেরত যাবেন। তিন মাস পর এই সংখ্যা পুনরায় পর্যালোচনা করে বাড়ানো
হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলছে, যে কোনো প্রত্যাবাসন
স্বেচ্ছামূলক হতে হবে। ওই দেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়টি পুরোপুরি
নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার
আলম বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। যদিও ২৩
নভেম্বর সই হওয়া চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসন শুরু হবে। নেপিদো থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা
হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে গঠিত যৌথ
ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি নেপিদোতে অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির স্থায়ী সচিব মিন্ট থো।
আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা করে দু’পক্ষ ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চূড়ান্ত
করেছে। নতুন এই চুক্তিটি গত বছরের ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে সই হওয়া
‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসন ফ্রম রাখাইন স্টেট’র
পরবর্তী সময়ে ঢাকায় সই হওয়া কার্যপরিধির আলোকে স্বাক্ষর হয়েছে। বিবৃতিতে
আরও বলা হয়, ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট মোতাবেক, প্রত্যাবাসন শুরুর দুই
বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্পন্ন হবে। পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে
যাচাই ও প্রত্যাবাসন সম্পাদন হবে। বৈঠকে যাচাই সম্পাদনের লক্ষ্যে ‘ফরম’
চূড়ান্ত করা হয়েছে। অ্যারেঞ্জমেন্টে এতিম এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় জন্ম
নেয়া শিশুদের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের
মিয়ানমার অস্থায়ীভাবে হিলা ফো খুংয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে। এরপর তাদের
ঘরবাড়ি দ্রুত পুনরায় নির্মাণ করবে যাতে তারা সেখানে যেতে পারেন।
বিবৃতিতে
আরও উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমার শূন্য রেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার
ভিত্তিতে পুনরায় বসতি স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করবে। মিয়ানমার পুনরায়
অঙ্গীকার করেছে, বাংলাদেশে আসতে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রবাহ তারা বন্ধ করবে।
উভয়পক্ষ দুটি কারিগরি গ্রুপ গঠনে একমত হয়েছে। একটি গ্রুপ যাচাইয়ের বিষয়
দেখাশোনা করবে। অপর কারিগরি গ্রুপটি ফিরে যাওয়া তদারকি করবে। রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত কৌশলও ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা
হয়েছে। মিয়ানমারের সরকারি মুখপাত্রের বক্তব্যের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাচাই শেষে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের জন্য
আবেদন করতে পারবেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা চৌকিতে ২৫ আগস্ট
হামলা চালানোর পর রোহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি হয়। ওই হামলায় মিয়ানমারের ১১ জন
সীমান্তরক্ষী নিহত হওয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকদের
সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। তারা রোহিঙ্গাদের
হত্যা, বাড়িঘরে আগুন এবং রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাখাইনে হামলার প্রথম মাসেই প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা
হয়েছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে বলেছে চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক গ্রুপ ‘মেডিসিন
সান ফ্রন্টিয়ার্স’ (এমএসএফ)। রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুরতার
পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে রাজি হয়।
রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দুই দেশের মধ্যে
একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে বলা হয়, প্রথম দফায় শুধু এবার আসা
শরণার্থীদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। ওই সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের তিন সপ্তাহের
মধ্যে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসন শুরু হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব একটি সুনির্দিষ্ট চুক্তিতে সই
করবে দুই দেশ। তবে সেই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় তিন সপ্তাহ পর গত বছর
১৯ ডিসেম্বর। ঢাকায় ওই বৈঠকেই কার্যপরিধি ঠিক করা হয়। সম্মতিপত্র
স্বাক্ষরের ৫৪ দিনের মাথায় দু’পক্ষ মঙ্গলবার ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট
চূড়ান্ত করল। প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গা ফেরত যাবে : চুক্তি স্বাক্ষরের পর
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বিবিসিকে বলছেন,
‘চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে।’
তিনি জানান, বাংলাদেশ প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর দাবি
করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে রাজি হয়েছে। তিন
মাস পরে পর্যালোচনা করে এই সংখ্যা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, চুক্তিটিতে ফেরত
যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এবং রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর তাদের জীবন-জীবিকার
বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যায়
রোহিঙ্গারা এসেছে, এত কম সংখ্যায় তাদের ফেরত পাঠানো হলে সেটি তো দীর্ঘ সময়
নেবে। এটা স্বীকার করে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলছেন, ‘এ ধরনের অবস্থায়
প্রত্যাবাসন এভাবেই হয়। কারণ আমরা সবকিছু চাইতে পারি না। আমরা তাদের
নিরাপত্তার কথাও বলব, আবার আমরা চাইব যে, একসঙ্গে সবাইকে পাঠিয়ে দেব, ওরা
এখনই তা দিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হল, আমরা এখানে একটি ধারা রেখেছি,
যেখানে বলা আছে যেদিন থেকে (রোহিঙ্গাদের) যাওয়া শুরু হবে, সেদিন থেকে দুই
বছরের মধ্যে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে।’ তিনি বলছেন, ‘প্রথমে অল্প
করে যাওয়া শুরু হবে, পরে এই সংখ্যা বাড়বে।’
No comments