তিউনিসিয়ার মানুষ বিক্ষোভ করছে কেন by ইউসেফ শরিফ
তিউনিসিয়ার
সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলীর পতনের সাত বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু তা উদ্যাপনের
বদলে তিউনিসিয়ার মানুষ আবার রাস্তায় নেমে এল। সমস্যাটা ঠিক কোথায়? ১৯৫০-এর
দশকে দেশটিতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটা পরবর্তীকালে পুলিশি রাষ্ট্র
হয়ে যায়। এরপর সেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। জনগণকে সরকারি কার্যক্রম থেকে
দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু তিউনিসিয়ার বিপ্লবের পর এই নিষেধাজ্ঞা দূরীভূত
হয় এবং সেখানকার মানুষ রাজনীতি করার সুযোগ পায়। সেই ২০১১ সালের জানুয়ারি
মাস থেকে তিউনিসিয়ার মানুষ ক্রমে রাজনীতিক হয়ে উঠেছে। দেশটির রাজনৈতিক
ব্যবস্থা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশটিতে স্বকীয়
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দেশটির অর্থনীতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। কিন্তু
রাজনৈতিক প্রক্রিয়া উন্মুক্ত হওয়ার সীমা আছে এবং অব্যবস্থাপনা যখন আর
সহ্যসীমার মধ্যে থাকল না, তখন মানুষ আবার ক্রোধে ফেটে পড়ল। বস্তুত, ২০১১
সালের পর থেকে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনমন ঘটেছে। ২০১০ সালে দেশটির
ঋণের বোঝা ছিল তার মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে যা
দাঁড়ায় ৬০ দশমিক ৬ শতাংশে। ডলারের সাপেক্ষে তিউনিসিয়ার মুদ্রা দিনারের ৪০
শতাংশ অবনমন হয়। আর তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব তো আছেই, যার হার বর্তমানে ৩৫
শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমে বাড়ছে। দেশটির সব শ্রেণি-পেশার
মানুষের অভিযোগ, তাঁদের জীবনমানের অবনমন ঘটেছে। প্রতি মাসেই তাঁরা খরচের
হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চলমান বিক্ষোভ শুরু হওয়ার এটাই মূল কারণ। আর
আরেকভাবে বললে, গত সাত বছরে দেশটিতে যত বিক্ষোভ হয়েছে, তার মূল কারণ হচ্ছে
এই অসন্তোষ। ১ জানুয়ারি দেশটিতে নতুন যে অর্থ আইন কার্যকর হয়েছে, তা যেন
স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছে। এই আইন গত বছর সংসদে পাস হয়েছে। গণমাধ্যমে এটি
আলোচিত হলেও মানুষ তখন ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। দ্রব্যের দাম যখন বেড়ে গেল,
তখনই কেবল মানুষ বুঝতে পারল। মূলত একদল তরুণ কর্মী এই প্রতিবাদ আন্দোলন
শুরু করেছেন, যার নাম ‘ফেক নেস্তানাউ’। প্রথমে অল্প কিছু মানুষ এই আন্দোলন
শুরু করে, যা তখন মূলত দেয়াললিখন ও লিফলেট বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু দেশটির পুলিশের এখনো সংস্কার হয়নি, বেন আলীর যুগে তারা যেভাবে কাজ
করত, এখনো তারা সেভাবেই কাজ করে। দেখা গেল, তারা আন্দোলনকারীদের নির্যাতন ও
নিপীড়ন করে জেলে পুরল। এরপর এই আন্দোলনের গায়ে কালিমা লেপণ শুরু হলো। তবে
মানুষের মনের গভীরে যে সুপ্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল, তার কারণে তারা ‘ফেক
নেস্তানাউ’র বাইরেও আন্দোলন করতে শুরু করে। এর সঙ্গে নৈরাজ্যিক প্রবণতার
কিছু বামপন্থী দলও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। রাজধানী তিউনিসসহ দেশটির বিভিন্ন
শহরে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
তখন অপরাধীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নানা
জায়গায় লুটপাট শুরু করে। তবে চলমান সংকটটি বেন আলীর পতনের পর আরও এক বড়
সংকটের মধ্যেই তৈরি হলো। দেশটিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দুটি দল বিজয়ী
হয়েছে। একদিকে ছিল মধ্যপন্থী দল নিদা টৌনস, অন্যদিকে ইসলামপন্থী দল
এনাহ্ধা। এনাহ্ধার ইসলামি রাজনীতির বিরোধিতা করেই প্রচারণা শুরু করেছিল
নিদা, যদিও শেষমেশ দলটি ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোট গড়তে রাজি হয়। এতে দলটির
তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। অনেক কর্মীই দল থেকে পদত্যাগ করেন।
আর দলের নেতা বেজি কাইদ এসেবসি দেশের প্রেসিডেন্ট হলে পরবর্তী নেতা
নির্বাচন নিয়ে আরেক সংকট সৃষ্টি হয় এবং দলটি ভেঙে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই
জোট শুরু থেকেই খুব দুর্বল ছিল। বলা যায়, একধরনের অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এটি
গড়ে উঠেছিল। দুই দলের নেতা কাইদ এসবেসি ও রাচেদ ঘানুচির মতৈক্যের ভিত্তিতে
যে ‘ঐকমত্য’ গড়ে উঠেছিল, তা দুই দলের ভেতরে শিকড় গাড়তে পারেনি। এই ঐক্য
খুবই অকিঞ্চিৎকর ছিল। মন্ত্রী ও সাংসদেরা তাঁদের ভিত্তি থেকে বিযুক্ত হয়ে
পড়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে অনেক আইন পাস ও পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার
পরিসরও ছিল খুব সীমিত। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে নিদা দুর্বল হলেও
প্রতীকীভাবে তারা এখনো শক্তিশালী। দেশটির বহু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষের কাছে
এই দল এনাহ্ধার ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প। তিউনিসিয়ার আমলাদের কাছে এটি পুরোনো
রাষ্ট্রীয় পার্টি। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি তিউনিসিয়ার
‘আধুনিকতাবাদী’ রূপ। আর এনাহ্ধা মনে করে, ইসলামপন্থার ব্যাপারে যে স্থানীয় ও
আন্তর্জাতিক বৈরিতা আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নিদা মুখ লুকানোর পর্দা হিসেবে
ভালো। এই ‘ঐকমত্য’ যতই অকার্যকর হোক না কেন, এ দুই বিধ্বস্ত শত্রুর কাছে
তা শ্রেষ্ঠ বিকল্প হতে পারে। সে কারণে সংসদ যখন সরকারের প্রণীত অর্থ আইন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তখন ‘ঐকমত্যের’ সাংসদদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন বিরোধিতা
দেখা যায়নি, যার পেছনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও ভূমিকা আছে। সাংসদেরা
আইনটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু জনসমক্ষে তাঁরা এর পক্ষে কথা
বলেননি, এমনকি নিজের নির্বাচনী এলাকায় তা নিয়েও যেতে পারেননি। এ ছাড়া
আরেকটি কারণেও এটি ঘটেনি। সেটা হলো দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইউসেফ চাহেদ ও
জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে এই অর্থ আইন নিয়ে
যেমন খুব একটা প্রচারণা চালানো হয়নি, তেমনি এর বাস্তবায়নও ছিল খুব সীমিত।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক একরকম অকার্যকর, যার
কারণে চলমান সংকটে আরও একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। এ রকম অচলাবস্থায়
একনায়কতন্ত্রের যুগের পুরোনো রীতি ফিরে আসতে পারে। রাষ্ট্রটি আবারও পুলিশি
রাষ্ট্র হতে পারে। জাতিসংঘের ওএইচসিএইচআর ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
সম্প্রতি তিউনিসিয়ার সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে।
সে কারণে সমাধান খোঁজার জরুরত আছে। সম্ভবত ২০১৪ সালের মতো টেকনোক্র্যাট
সরকার গঠন করে ২০১৮ সালের স্থানীয় এবং ২০১৯ সালের শেষ দিকের আইনসভা ও
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। দেশটির মানুষ আশা করে, এই নির্বাচনের
মাধ্যমে রাজনীতিতে নতুন মুখ আসবে এবং তারা নতুন, অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল ও
সক্ষম রাজনীতিক পাবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।
ইউসেফ শরিফ: তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।
ইউসেফ শরিফ: তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
No comments