জানতামই না আমার এত খুঁত! by শাহনাজ মুন্নী
ঘর
গোছানো বা রান্না করার সময় গুনগুন করে গান গাওয়ার অভ্যাস রুচিতার
(ছদ্মনাম)। বাড়িতে সবাই জানে ওর এই অভ্যাসের কথা। ওর গানের শব্দ শুনলেই মা
বলতেন, ‘ওই যে আমার মেয়ের কাজ শুরু হয়েছে।’ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসেও
রুচিতার গুনগুনানি থামল না। ‘বউমা, তুমি তো দেখি বিরাট শিল্পী...।’ শাশুড়ি
একদিন খাবার টেবিলে সবার সামনেই বলে বসলেন, ‘রাঁধতে রাঁধতে গান, ঘর গোছাতে
গোছাতে গান...।’ সবার মুখ টিপে হাসা দেখে রুচিতার বুঝতে বাকি রইল না যে ওর
গান নিয়ে এই বাড়িতে ঠাট্টা-তামাশা শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎই যেন দপ করে নিভে
গেল তার সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস। জোরে হাসে, খাবারের টেবিলে কেন কম
কথা বলে—নানা বিষয়ে তাঁর খুঁত ধরতে থাকে এই নতুন সংসারের মানুষজন। রুচিতার
মনে হতে থাকে—আমার এত খুঁত! এত দিন কিছুই জানতাম না। মিরা (ছদ্মনাম) বেড়ে
উঠেছে ব্যবসায়ী পরিবারে। বাবা-চাচারা সব সময় রাত করে বাড়ি ফেরেন, রাত করে
ঘুমান। সকালে সবারই ঘুম ভাঙে দেরি করে।
ওর শ্বশুরবাড়িতে আবার উল্টো নিয়ম।
এখানে সবাই ঘুমান তাড়াতাড়ি, ওঠেনও তাড়াতাড়ি, একদম ভোরে দিন শুরু হয়ে যায়
তাঁদের। প্রথম দিকে বাবার বাড়ির অভ্যাস নিয়ে খুব বিপদেই পড়েছিল মিরা। দেরি
করে ওঠার জন্য মুখে কেউ কিছু না বললেও শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের চেহারা দেখেই
বোঝা যেত, তাঁরা ব্যাপারটি ভালোভাবে দেখছেন না। লায়লার সমস্যা আবার অন্য
রকম। ওর বাবার বাড়িতে বরাবরই দেখেছে বড় মাছে আদা-রসুন দেওয়া হয়, শ্বশুরবাড়ি
এসে যখন সে নিজে রাঁধতে গেল, তখন সেই নিয়মেই রুই মাছের তরকারিতে সামান্য
আদা-রসুন বাটা দিয়ে দিল। শাশুড়ি তখন পুরোই বিপক্ষেÿঅবস্থান নিয়ে বললেন,
জীবনেও নাকি আদা-রসুন দেওয়া মাছের তরকারি খাননি তাঁরা। মুখে হাসি ধরে
রাখলেও এই কথায় মনের মধ্যে রান্না করার ইচ্ছাটাই হঠাৎ উবে গেল লায়লার।
এমনিতেই শাড়ি খুব একটা সহজে পরতে পারে না মিমি। পায়ে জড়িয়ে যায়। এর মধ্যে
একটা শাড়ি পায়ে লেগে ছিঁড়েই গেল। মিমির বড় ননাস মুখ কালো করে বললেন,
‘শাড়িতে ফলস লাগাও না কেন? ফলস ছাড়া আবার শাড়ি পরে নাকি মানুষ?’ মিমির মনে
হলো, বিরাট একটা অপরাধ করে বসেছে সে। অথচ এগুলো নিয়ে কোনো দিন যে কথা উঠতে
পারে বা এগুলো যে উল্লেখ করার মতো কিছু, তা কখনোই মনে হয়নি তার। অথচ বিয়ের
পর অনেক সময় দেখা যায় এ রকম ছোটখাটো ব্যাপারও বড় হয়ে ওঠে। এসব বিষয়ে
কথাবার্তা যেন অনেকটা পিনের খোঁচার মতো, যা সামান্য হলেও পীড়াদায়ক। ‘বিয়ের
পর জীবনটা আর আগের মতো থাকে না। বিশেষ করে মেয়েদের। “বিয়ের আগে ও পরে” এই
নামে আস্ত একটা বই লেখা সম্ভব।’ বলছিলেন অন্বেষা (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি বিয়ে
করেছেন তিনি। তাঁর মতে, বিয়ের পর মেয়েরা নতুন একটা পরিবেশে এসে পড়ে, সেই
পরিবেশে বিয়ের আগের অনেক আচরণই ঠিক খাপ খায় না।
এ ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির
মানুষদের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব
সেন্ট্রাল আরাকানসাসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রিফাত আকতার এ
প্রসঙ্গে বললেন, আমরা সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বিষয়কে নারীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ
করার একটা প্রচেষ্টা হিসেবে দেখি। কর্তৃত্বপরায়ণতা আর নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা
মানুষের স্বভাবজাত ব্যাপার। বাংলাদেশের মতো একটা কঠিন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে
প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে নারী ও শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কারণ,
তারা শারীরিকভাবে দুর্বল। একজন নারী যখন শাশুড়ি হন বা ননদ, ননাস—তখন তাঁরাও
সুযোগ পেলে ছেলের বউ বা ভাইয়ের বউকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সংসারে নতুন
আসা সদস্যকে সহজভাবে গ্রহণ করা বা কোনো কিছু তাঁকে বুঝিয়ে বলার চাইতে কঠিন
গলায় বা ধমক দিয়ে শোধরানোকেই তাঁরা নিয়ম মনে করেন। তার অবস্থানে রেখে তাকে
বোঝার চেষ্টা করেন না। যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন
করে, সেহেতু শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসব না করার জন্য সামাজিক কোনো চাপও অনুভব
করে না। অন্যদিকে একটা ছেলেরও কিন্তু নানা রকম আচরণগত সমস্যা থাকতে পারে,
যা তাদের বিবাহিত জীবনকে প্রভাবিত করে, যেমন দেরি করে বাড়ি ফেরা, সিগারেট
খাওয়া, গৃহস্থালির কাজে অংশ না নেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে,
ছেলেটিকে কেউই বিয়ের পর তার আচরণগুলো বদলানোর জন্য চাপ দেয় না। এই অবস্থা
খুব ধীরে ধীরে পাল্টায়, যখন যৌথ পরিবারের বদলে একক পরিবার নির্মিত হয়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাইরে কাজ করেন, কিন্তু তখন আবার স্ত্রীর ওপর স্বামীর
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্য গল্প শুরু হয়ে যেতে পারে। যাক, সেটা অন্য
প্রসঙ্গ। আপাতত এই খুঁত ধরাই সামলানো যাক!
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
No comments