বই পড়ার মাধ্যমে অসহনশীলতা দূর হতে পারে
১৩
জানুয়ারি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে দেশভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচির
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানস্থলের পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে ১৪
জানুয়ারির প্রথম আলো লিখেছে, ‘গতকালের বিকালটি ছিল সন্ধ্যার মতো। পৌষের
কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দগ দগ করে জ্বলছে শিখা চিরন্তন।
তার কোল ঘেঁষেই লাইন ধরে আসছে ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
উদ্দেশ্য একটাই- গতকাল ছিল দেশভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী।’
দেশভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হলেও এই
অনুষ্ঠানটিতে যোগ দিতে এসেছিল ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। বোঝাই
যাচ্ছে, এই অনুষ্ঠানে পুরো দেশের স্কুলের শিক্ষার্থীরা যোগদান করতে আসেনি।
ধারণা করি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এ রকম অনুষ্ঠান দেশের অন্যান্য জেলায়ও করে
থাকে। গোটা দেশের শিক্ষার্থীরা যদি একযোগে অনুষ্ঠানে আসত তাহলে অনুষ্ঠানের
ব্যবস্থাপনা সহজসাধ্য হতো না। শুধু ঢাকার স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম
নয়। প্রতি জেলায় যদি এ ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে একদিকে যেমন
বই পড়া আন্দোলনটি বিকেন্দ্রীকৃত হবে, অন্যদিকে মফস্বলের ছেলেমেয়েরা
সেখানকার অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে খুবই উৎসাহবোধ করবে। বই
পড়া আন্দোলনটি দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে এর সুফল হতাশা-নিরাশার এই
দেশকে করে তুলবে সম্ভাবনাময়। কারণ বই পড়ার সুফল বহুমাতৃক। বহুবিধ সুফল
একত্র হয়ে জাতির জন্য যে কল্যাণ বয়ে আনবে, তার পরিমাপ করা কঠিন। বিশেষ করে
বই পড়া থেকে যত রকমের গুণবাচক উপযোগ সৃষ্টি হয়, তাকে সংখ্যা কিংবা অঙ্ক
দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
প্রতিষ্ঠা করে যে রকম সফলভাবে বই পড়া আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন,
তা কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। আলোচ্য
অনুষ্ঠানটিতে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘বইয়ের মধ্যে আলো আছে,
তাই বই পড়লে আলোকিত হওয়া যায়। আলো আসে আগুন থেকে। কার আগুন? যিনি বই লেখেন,
তার আত্মার আগুন। এ আগুন দেয়াশলাইয়ের আগুনের মতো নয়। বইয়ের মধ্যে থাকে
ভালোবাসার আগুন, সৌন্দর্যের আগুন, পৃথিবীকে সুন্দর করার আগুন।’ অধ্যাপক
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একথাগুলো থেকে বই পড়ার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য ফুটে
উঠেছে। আমার পিতা একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি তার সন্তানদের বই পড়তে
উৎসাহিত করতেন। নিজেও প্রচুর বই পড়তেন। ডায়াবেটিস রোগে দৃষ্টিশক্তি হারানোর
আগ পর্যন্ত তাকে প্রতিদিনই নতুন কিছু পড়তে দেখেছি। তিনি অবশ্য
গল্প-উপন্যাস ও কবিতার বই পড়তেন। আত্মজীবনীও পড়তেন। পেশাগত জীবনে শিক্ষকদের
শিক্ষক হওয়ার ফলে তাকে শিশু-মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা-মনোবিজ্ঞান ও শিখন পদ্ধতির
বইপত্রও পড়তে হতো। তিনি শিক্ষানীতির ‘মণিকনিকা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা
করেছিলেন। এই গ্রন্থের ভাষা ছিল খুবই সমৃদ্ধ এবং উঁচু দরের। এ ভাষাশৈলী তার
পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়েছিল সাহিত্যের বই পড়ার ফলে। আমরা যখন স্কুলে
ওপরের ক্লাসে পড়তাম, তখন আমাদের উপন্যাস পড়তে নিষেধ করা হতো। যারা নিষেধ
করতেন তারা মনে করতেন উপন্যাসগুলো খারাপ বই। এগুলো পড়লে চরিত্র খারাপ হয়ে
যায়। কিন্তু আমার পিতার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারেই অন্যরকম। তিনি বলতেন,
বইয়ের মধ্যে খারাপ বই, ভালো বই বাছবিচার করা উচিত নয়। কারণ একটি বই পড়ার
আগে আমরা কি করে বুঝব বইটি খারাপ। উপন্যাস সাহিত্য মূলত মানব-মানবীর
সম্পর্ককে কেন্দ্র করে লেখা হয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এগুলো
প্রেম-ভালোবাসার গল্প। শুধু প্রেম বা ভালোবাসাই নয়, এর মধ্যে চলে আসে
প্রকৃতি ও প্রকৃতির আঁচলে ঠাঁই রেখে কিভাবে মানব-মানবী সম্পর্ক গড়ে তোলে
এবং তা পর্যায়ক্রমে একটি পরিণতির দিকে ধাবিত হয়, সেগুলোই উপন্যাসের
উপজীব্য। লৌকিক ঘটনাকে ছাপিয়ে ফুটে ওঠে একটি বাণী। এই বাণী লৌকিক পর্যায়
অতিক্রম করে অনেক সময় হয়ে ওঠে অলৌকিক। যে পাঠক এই অলৌকিক বাণীকে ধারণ করতে
পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন একজন সফল পাঠক ও সার্থক মানুষ। সুতরাং পড়া নিয়ে
বিধিনিষেধের শৃঙ্খল তৈরি না করাই শ্রেয়। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের
আকর্ষণ দুর্নিবার। সেজন্যই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বই নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী
নন। অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক কারণে বই নিষিদ্ধ করা হয়; কিন্তু এর ফলে
রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য সফল হয় না। দেখা গেছে, নিষিদ্ধ করার পর
নিষিদ্ধ বইটির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় অনেকগুণ। কারণ সবাই কৌতূহলী হয়ে ওঠে
বইটিতে কী আছে, তা জানার জন্য। বর্তমানকালের ফটোকপি প্রযুক্তির ফলে নিষিদ্ধ
বই ছাপাখানায় মুদ্রিত না হলেও এর হুবহু রূপ ফটোকপির দ্বারা পরিস্ফুট করা
সম্ভব।
বাংলাদেশেও যেসব বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
নজর এড়িয়ে ফটোকপি রূপে ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং বই নিষিদ্ধ না করাই ভালো। যারা
ক্ষমতায় থাকেন তাদের অনেক সময় বই নিষিদ্ধ করতে দেখা যায়। তারাও ভালো করে
জানেন বই নিষিদ্ধ করার পরিণতি কী? তবুও তারা করেন। এর উদ্দেশ্য স্রেফ
রাজনৈতিক। বইয়ের মধ্য দিয়ে অনেক সময় রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা বিশেষ কোন
দৃষ্টিভঙ্গি লেখক তুলে ধরেন। এ রকম বই যখন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নিষিদ্ধ
করার আদেশ জারি করা হয়, তখন ক্ষমতাধররা দু’রকম সুবিধা হাসিল করতে চান। এর
একটি হল বিরুদ্ধ মতকে স্তব্ধ করার প্রয়াস এবং তা দিয়ে নিজস্ব ক্ষমতা সংহত
করা। অন্যদিকে বইতে ব্যক্ত মত যদি ক্ষমতাধরদের প্রতিকূলে যায় তাহলে তারা
নিজ নিজ সমর্থকদের বাহ্বা কুড়াতে পারেন। পৃথিবীতে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে
বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলোতে বিবৃত ভাব ধারাকে ঠেকিয়ে
রাখা যায়নি। ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ‘মা’ উপন্যাসটি রাশিয়ার জার শাসকদের
পছন্দসই না হলেও রাশিয়ার বিপ্লবী যুগের অগণিত পাঠক বইটি পড়ে বিপ্লবের
মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছে। জারদের শাসনামলে মার্কসবাদী বইপত্র নিষিদ্ধ ছিল।
তদসত্ত্বেও মার্কসবাদের চর্চা থামিয়ে রাখা যায়নি। এসব বই পড়ার জন্য রাশিয়ায়
গড়ে উঠেছিল শত সহস্র পাঠচক্র। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ
ছিল। সেই সময় এই পার্টির গোপন মুখপত্র ‘শিক্ষা’ পড়ার জন্য অনেক বিপ্লবী
তরুণ উন্মুখ হয়ে থাকত। এছাড়া মার্কসবাদী বই পড়ার জন্য গোপন পাঠচক্র গঠিত
হয়েছিল। গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ হয়ে উঠেছিলেন
কিংবদন্তিতুল্য পুরুষ। দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি খুব বড় না হলেও একে
পাকিস্তানি শাসকরা শ্যেনদৃষ্টিতে রাখত। কারণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার বেশ
শক্তি ছিল এই দলটির। সংখ্যায় বড় না হলেও এর ভাবাদর্শগত বাণী অনেকের মধ্যেই
সংক্রমিত হয়েছিল। এখন আর এই পার্টি নিষিদ্ধ নয়। তাই একে ঘিরে রোমাঞ্চও তেমন
লক্ষ্য করা যায় না। একটি প্রকাশ্য দল হিসেবে এই দলকে জনগণের ব্যাপক অংশের
মধ্যে সাড়া জাগাতে অনেক দূর যেতে হবে, হয়তো অপেক্ষা করতে হবে অনেক সময়।
জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, ‘হে প্রভু
তুমি আমার হায়াত বাড়িয়ে দাও, যাতে আমি আরও বই পড়তে পারি।’ ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর উদ্ধৃতিযোগ্য অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমার পরিচিতি ঘটেছে; কিন্তু
তার এই বক্তব্যটি সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়েছে। মানুষ যদি নিছক দীর্ঘায়ু
লাভের জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করে, তাহলে ব্যাপারটি হবে খুবই নিরর্থক। কিন্তু
বই পড়ার মতো মহান ব্রত পালনের জন্য কেউ যদি দীর্ঘায়ু কামনা করে, তাহলে সে
শুধু নিজেকেই আলোকিত করবে না, আলোকিত করবে আরও হাজারও মানুষকে। জ্ঞানের
আলোর এই বিচ্ছুরণ একটি মহৎ সমাজ গড়ার পথে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দার্শনিক সক্রেটিস কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি; কিন্তু তিনি তার অনুসারীদের
কাছে অনেক মহৎ ও তাৎপর্যময় বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এগুলো তার শিষ্যরা সংরক্ষণ
করেছে। সেগুলো নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। সক্রেটিস
নিশ্চয়ই অনেক বই পড়তেন। সৃষ্টিকর্তা তাকে যে মেধা দিয়েছিল সে মেধা শত সহস্র
গুণ শানিত হয়েছে বই পড়ার ফলে। তিনি বলতেন, ‘An Unexamined life is not
worth living’ অর্থাৎ জিজ্ঞাসাহীন জীবনযাপনে কোনো সার্থকতা নেই। মানুষের
জীবন জিজ্ঞাসা যেমন একটি স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপক, তেমনি বই পড়ার মধ্য দিয়ে
জীবন-জিজ্ঞাসা আরও শানিত, আরও উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে শিক্ষিত
মানুষের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই তুলনায় বই পড়া মানুষের সংখ্যা তেমন
বাড়েনি। এ দারুণ হতাশাব্যঞ্জক। এদেশে জেলায় জেলায় গণগ্রন্থাগার রয়েছে। এসব
গণগ্রন্থাগারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একদিকে চুরি হওয়ার ফলে বইয়ের
সংখ্যা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে অনেক পুরনো মূল্যবান
বইও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আমরা হারাচ্ছি মণিমাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান
সম্পদ। আমার জানা মতে, দেশের পুরনো কলেজগুলোর গ্রন্থাগারেও অনেক পুরনো
মূল্যবান বই আছে; কিন্তু যত্নের অভাবে সেগুলো বিলুপ্তপ্রায়। জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি হিসেবে কাজ করার সময় আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত কলেজগুলোর লাইব্রেরিতে থাকা মূল্যবান বইগুলোর
একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রস্তাব ছিল, এই বইগুলো
ফটোকপি করে অন্তত একটি বা দুটি কপি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে,
গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করা হোক। বইপ্রেমী না হলে তো কাউকে দিয়ে এই কাজ করানো
সম্ভব নয়। মনে হতে পারে একজন প্রোভিসি হিসেবে আমি অনেক কিছু করতে পারতাম;
কিন্তু বাস্তব অবস্থা তেমন ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ভিসি সব
ক্ষমতার মালিক ছিলেন। তাই আমার পক্ষে আর বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না।
আমাদের দেশে সঙ্গীত, নাটক ও নৃত্যকলার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। হওয়া উচিতও।
কিন্তু বই পড়া যে, সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এটা আমরা অনেকেই বুঝতে
চাই না। বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো এবং ব্যবসা কোম্পানিগুলো যত উদারভাবে
নৃত্য-গীতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্পন্সর করে, সেই তুলনায় বই পড়াকে
উৎসাহিত করা এবং গ্রন্থাগারে বইয়ের সংগ্রহ যোগ করার ব্যাপারে তারা অনুমাত্র
উৎসাহী নয়। এ ধরনের সংকীর্ণ সংস্কৃতি চিন্তা পরিহার করতে হবে। সরকারের
গ্রন্থাগারগুলোকে সমৃদ্ধ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে।
বই সংগ্রহের নামে রাজনৈতিক স্তাবকদের লেখা বইগুলো সংগ্রহ করাই যথেষ্ট নয়।
দেশের বইপ্রেমীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার বই
সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে এদেশে যেন ইউএস
লাইব্রেরি অব কংগ্রেস অথবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মতো গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে।
উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো খাতে আমরা অনেক অর্থ বিনিয়োগ করছি। কিন্তু
রাস্তাঘাট, ব্রিজের মতো অবকাঠামোর চেয়েও জ্ঞানের অবকাঠামো সৃষ্টি কম
গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকারের লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেটে ১ হাজার কি ২ হাজার
কোটি টাকা গ্রন্থাগার সংরক্ষণে বরাদ্দ করা হলে দেশ অনেক বেশি এগিয়ে যেত।
রাজনীতিতে অসহনশীলতার যে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে বই পড়ার মাধ্যমে তা-ও স্তিমিত
হয়ে আসত। বই থাকাটাই যথেষ্ট নয়, বই পড়ার মতো মানুষও থাকা প্রয়োজন। এই কাজটি
শুরু হতে পারে স্কুলপর্যায় থেকে। আমি ও আমার সহপাঠীরা যখন কুমিল্লা জিলা
স্কুলে পড়তাম, তখন সেই স্কুলে বেশ কিছুসংখ্যক জ্ঞানপিপাসু শিক্ষকও ছিলেন।
ইতিহাসের শিক্ষক মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুর রহমান আমাদের সিন্ধু সভ্যতা
পড়াতে গিয়ে নেহেরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, স্যার মার্টিমোর হুইলার-এর বই
এবং রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি ইতিহাসের
আরও অনেক মূল্যবান গ্রন্থ পাঠ করতেও উৎসাহিত করেছিলেন। আমরাও পড়ার চেষ্টা
করেছি। ইংরেজিতে লেখা বইগুলো পড়তে ও বুঝতে কষ্ট হয়নি। একইভাবে সাহিত্য ও
ভূগলের শিক্ষকরাও পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য রেফারেন্স বই পড়তে উৎসাহিত
করেছেন। তাই আজ আমি বলতে পারি, এসব শিক্ষককে পেয়ে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে
আমি ও আমার সহপাঠীরা প্রভূতভাবে উপকৃত হয়েছি। শুধু রেফারেন্স বই-ই নয়,
সাহিত্যের বইও পড়তে তারা আমাদের উৎসাহিত করতেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু
সায়ীদের বই পড়া আন্দোলন আরও ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য,
প্রতিটি উপজেলায় সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, প্রতিটি বিদ্যালয়, কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, জাতীয় পর্যায়ে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের
মতো লাইব্রেরি গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এবং সর্বোপরি বই পড়ায় উৎসাহিত
করতে উন্নত জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকমণ্ডলী। গণচীনের এই সময়ের চোখ
ধাঁধানো উন্নয়নের পেছনে রয়েছে তাদের কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা।
চীনকে সিভিলাইজেশনাল স্টেট বলা হয়। প্রাচীন চীনের একজন জ্ঞানপিপাসুর সাধনা ও
অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে এই লেখাটির ইতি টানব। সুন জিং হান ডাইনেস্টির
সময় জীবিত ছিলেন। তিনি পড়ার সময় নিদ্রা নিবারণ করতে তার মাথার চুল রশি দিয়ে
ঘরের আড়ার সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। দীর্ঘক্ষণ পড়ার জন্য তিনি কি কষ্টই না সহ্য
করেছেন। একই ধরনের গল্প আছে কনফুসিয়াস, সু কিন, কুয়াং হেং, চে ইন এবং সুন
কাং সম্পর্কে। বই পড়া ও জ্ঞান চর্চার এমন দৃষ্টান্ত বিরল। গ্রিক দার্শনিক
ডায়জেনিস চষধরহ ষরারহম, ধহফ যরময ঃযরহশরহম- এ বিশ্বাস করতেন। জীবনযাত্রা
হবে সহজ সরল, চিন্তা হবে উঁচু। তিনি একটি মট্কার মধ্যে দিন যাপন করতেন। এরই
ভেতর মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতেন। সময়ে সময়ে মটকার মুখ দিয়ে মাথা উঁচু
করে তিনি জ্ঞান ও দর্শনের কথা সাধারণের মধ্যে প্রচার করতেন। এ রকম জ্ঞান
সাধকরা না থাকলে আমরা পেতাম না গ্রিক সভ্যতা। মহান জ্ঞান সাধকদের সম্পর্কে
গল্প বলে স্কুলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বই পড়া ও জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত
করতে পারেন। ডিজিটাল যুগে তথ্য আহরণ অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায়
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়নি। কাগজে মুদ্রিত বইয়ের
বিকল্প অন্য কিছু তেমন গভীর ছাপ রাখতে পারে না। কেউ কেউ ই-রিডারের কথা
বলবেন। কিন্তু এই যন্ত্রটি কতটা পাঠকবান্ধব, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন
করা যায়। তাই বলব বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments