উৎপাদনে নেই ৯০ ভাগ ট্যানারি
কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য এখনও প্রস্তুত হতে পারেনি সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরী। সবমিলে ২২৪টি ট্যানারির মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৩টি ট্যানারি ক্রাস্ট চামড়া উৎপাদন উপযোগী হয়েছে। আর ৪৪টি ওয়েট ব্লু উৎপাদনক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে ওয়েট ব্ল– চামড়ার ওপর রয়েছে রফতানি নিষেধাজ্ঞা। এ হিসেবে ৯০ ভাগ ট্যানারি এখনও উৎপাদনের বাইরে রয়েছে। এদিকে উচ্ছেদ হওয়ার কারণে রাজধানীর হাজারীবাগেও উৎপাদনে নেই কোনো ট্যানারি। এ পরিস্থিতিতে কোরবানির মৌসুমে ঢাকাসহ সারা দেশের সম্ভাব্য ১৯ কোটি বর্গফুট গবাদি পশুর চামড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারেন চামড়া সংশ্লিষ্ট তিনটি সংগঠনের ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়া কিনবেন না- এ কথা বলে দাম কমিয়ে দিতে পারেন। এতে ক্ষতির মুখে পড়বেন মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। আর ভালো দাম না পেলে তারা বেশি দামের লবণ চামড়ায় পরিমাণ মতো মেশাতে চাইবেন না। ফলে চামড়া সংরক্ষণেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। গত বছরও ট্যানারি সংকটের অজুহাত এবং লবণের সরবরাহ ঘাটতির কারণে ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। এবার আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো চামড়াই নষ্ট হবে না। সংগৃহীত চামড়া প্রাথমিক অবস্থায় লবণজাতের মাধ্যমে সংগ্রহ-সংরক্ষণ করা হবে। দেশে উৎপাদনের বাইরে আরও ৫ লাখ টন লবণ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া অনেক ট্যানারি মালিক এরই মধ্যে সাভারে গিয়ে উৎপাদন শুরু করেছেন। আরও অনেকেই কোরবানির আগে সেখানে উৎপাদনে যাবেন। এ স্থানান্তর প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত শেষ হয়, তার জন্য সরকার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে উৎপাদন ও পণ্য রফতানিতে উৎসাহ জোগাতে ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়ার পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা ঘোষণা করেছে। এটা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকেই কার্যকর হচ্ছে। সবমিলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ২৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে তাদের স্থানান্তর সক্ষমতা বাড়বে।’ এতদিন কোরবানিতে পাওয়া সারা দেশের চামড়া লবণজাতের মাধ্যমে ঢাকার পোস্তা আড়তসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হতো। কোরবানির দিনপনেরো পর থেকে চামড়ার দ্বিতীয় দফা কেনাবেচা ও হাতবদলের মাধ্যমে তা যেত হাজারীবাগের ট্যানারিতে। সেখানে প্রক্রিয়াজাত ও পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে তা রফতানি হতো বিদেশে। গত কোরবানির মৌসুমে একযোগে ২২৪টি ট্যানারি সচল থাকা সত্ত্বেও চামড়ার প্রকৃত দাম মেলেনি। এ বছর প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। ৮ এপ্রিল সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হাজারীবাগে সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর তোড়জোড় শুরু হয় সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার। তা সত্ত্বেও বেশিরভাগেরই স্থানান্তর কার্যক্রম শেষ হয়নি। নতুন শিল্পনগরীতে ১৫৪ মালিককে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫৩ জন সাভারে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করলেও মাত্র ২৪ ভাগ ট্যানারির অবকাঠামো নির্মাণকাজ চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি উৎপাদনও শুরু করা সম্ভব হয়েছে। তবে এ সক্ষমতা শুধু ওয়েট ব্ল– প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশ থেকে এই ওয়েট ব্ল– চামড়াও রফতানি হয় না। এ হিসেবে সাভার শিল্পনগরীতে প্রক্রিয়াজাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ক্রাস্ট চামড়ার উৎপাদন সক্ষমতা আছে মাত্র ১০ ভাগ ট্যানারির, যা সংখ্যায় মাত্র ২৩টি। এছাড়া ফিনিশড পণ্যের উৎপাদন শুরু করতে পারেনি কোনো কারখানাই। সরেজমিন সোমবার দিনভর বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শনে এসব চিত্র ওঠে এসেছে। জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে এখন পর্যন্ত ৬৭টি ট্যানারি উৎপাদনে গেছে। এটা শতাধিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে কোনো চামড়াই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। মূল্যবান চামড়া সম্পদের ক্ষতি এড়াতে কোরবানির আগে শতাধিক ট্যানারিকে উৎপাদনে আনার সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।’ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিসিক চামড়া শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষ নিজেই অক্ষমতায় ধুঁকছে। ফলে তারা ট্যানারি মালিকদের পুরোপুরি সাভারমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতে, বিসিকসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা সবাই জানেন, সামনে কোরবানির মৌসুম, তা সত্ত্বেও নতুন চামড়া শিল্পনগরীর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন না হওয়া এবং স্থানান্তর পরবর্তী উৎপাদনে নেয়ার মতো ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন যুগান্তরকে বলেন, নগদ প্রণোদনায় উদ্যোক্তার সক্ষমতা বাড়বে বৈকি। এতে অনেকেই সাভারে যাওয়ার কার্যক্রম আরও জোরেশোরে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তো একজন উদ্যোক্তাকে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ সব ধরনের সেবা সার্ভিসের নিরবচ্ছিন্ন নিশ্চয়তা পেতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ এসব উপকরণের নিশ্চয়তা এখনও মেলেনি। ফলে সক্ষমতা সত্ত্বেও এখনও অনেকে উৎপাদনে যেতে পারছেন না। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শুধু প্রণোদনা যথেষ্ট নয়। উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে দ্রুত উৎপাদনে যাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ হবে অবিলম্বে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে জমির মালিকানার দলিল হস্তান্তর করা। এই একটি উদ্যোগের অভাবেই নতুন চামড়া শিল্পনগরীর কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি পাচ্ছে না। দলিল বুঝিয়ে দেয়া হলে ট্যানারি মালিকরা ব্যাংকের কাছে দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ নিতে পারবেন। ফলে দ্রুত উৎপাদনে যাওয়ার পথ সহজ হবে। চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও পণ্য উৎপাদন সংগঠন বিএফএলএফইএ, বিটিএ এবং বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএস এমএ) বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে গরু, মহিষ, খাসি, ছাগল ও ভেড়া এসব গবাদি পশু থেকে ২০১৬ সালে গড়ে ৩০ কোটি বর্গফুট চামড়ার সরবরাহ মিলছে। আর এর আগের বছর ২০১৫ সালে চামড়া পাওয়া গেছে ২৮ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট। এর মধ্যে ওই বছর কোরবানির মৌসুমে চামড়া মিলেছে ১৭ কোটি ১০ লাখ বর্গফুট। ২০১৪ সালে চামড়া মিলেছে ২৭ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট। কোরবানিতে পাওয়া গেছে ১৬ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট। আর এ বছর ৩১ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে ১৯ কোটি বর্গফুট পাওয়া যাবে কোরবানির মৌসুমে। এদিকে বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়াউল হক জানিয়েছেন, কোরবানিকে সামনে রেখে চামড়া নিয়ে সংকট এড়াতে বিসিক কর্তৃপক্ষের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। শুধু সাভার চামড়া শিল্পনগরীর উন্নয়ন কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই বিসিক। কোরবানির চামড়ার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি সব চামড়া যাতে উৎপাদনের জন্য আনা যায়, তার করণীয় নির্ধারণে ২০ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন তারা। চামড়া শিল্প রক্ষা ঐক্য পরিষদের কার্যকরী সদস্য ও ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসাযী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রবিউল আলম দাবি করেন, সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়গুলো যদি এ ব্যাপারে আগাম পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে গতবারের চেয়েও বেশি পরিমাণ চামড়ার ক্ষতি অনিবার্য।
No comments