আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ মানা বাধ্যতামূলক
রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ কিংবা দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়াসংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আপিল বিভাগের দেয়া পর্যবেক্ষণ মানা বাধ্যতামূলক বলে মত দিয়েছেন হাইকোর্ট। সুপ্রিমকোর্টের আসন্ন অবকাশের পর রিটের পরবর্তী শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন আদালত। মঙ্গলবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দের করা রিটের শুনানিতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও জেবিএম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মত দেন। এর আগে রিটটি জনস্বার্থে নয় এমন দাবি করে তা খারিজ চেয়ে আর্জি জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। এ সময় আদালত বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল সর্বোচ্চ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা মানা হাইকোর্টের জন্য বাধ্যতামূলক। আর সে জন্যই এ সংক্রান্ত রিটটির ওপর শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পরে সুপ্রিমকোর্টের আসন্ন অবকাশের পর রিটের পরবর্তী শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন আদালত। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, রিটটি জনস্বার্থে করা হয়নি উল্লেখ করে তা খারিজের আবেদন জানানো হয়। পরে আদালত সুপ্রিমকোর্টের আসন্ন অবকাশের পর রিটের পরবর্তী শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন। ড. ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু জরিমানাসহ রিট খারিজের আবেদন জানালে সে আবেদন গ্রহণ না করে আদালত সুপ্রিমকোর্টের আসন্ন অবকাশের পর পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। উল্লেখ্য, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্যপদ থাকবে না। এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদের স্থায়িত্ব ও দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য একটা ব্যবস্থা মাত্র। একজন সংসদ সদস্য যদি দর কষাকষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বা সন্দেহ হয় যে, তিনি দর কষাকষির সঙ্গে যুক্ত- তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান সংবিধানে নেই। এ অবস্থায় তারা বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কিভাবে নিতে চান? দল যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা দেয় তার বিরুদ্ধে ভোট বা মতামত দেয়ার সুযোগ সংসদ সদস্যদের নেই। তারা দলের নীতিনির্ধারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। ৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকাবস্থায় বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে একজন বিচারককে দলীয় নীতিনির্ধারকের করুণা অনুযায়ী চলতে হবে। বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে গেলে তার প্রভাব বিচার বিভাগে পড়বে। ১৭ এপ্রিল সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে সংসদ সদস্য পদ শূন্য হওয়াসংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ। রিট আবেদনে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব ও আইন সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ রিট আবেদনে বলা হয়েছে, এ ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ৭, ১১, ২৬ ও ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর কারণ ব্যাখ্যা করে রিটকারীর আইনজীবী ইউনুস আলী বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। অথচ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, এমপিরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। এখানে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন। তারা নিজ দলের কাছে পরাধীন। তারা স্বাধীনভাবে কোনো মতামত দিতে পারেন না। সংসদে কোনো গণবিরোধী আইন পাস হলেও সেখানে তারা নিজ দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য। কিন্তু সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। দল যা বলবে এমপিরা তাই করবেন- এমন কোনো কারণে জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দেননি। জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছেন যাতে স্বাধীনভাবে তাদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন, জনস্বার্থে কাজ করেন। এখানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সব ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে রাজনৈতিক দল, জনগণ নন। এসব কারণে এটা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক দাবি করে এ আইনজীবী বলেন, গণতন্ত্র সংবিধানের মূল ভিত্তি (বেসিক স্ট্রাকচার)। গণতন্ত্র অর্থ স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বৈরাচারী ধারা এটি। এ ধারার কারণে আমাদের সরকার প্রধান একনায়ক। এ অনুচ্ছেদ বাতিল হলে সরকার প্রধানের ক্ষমতা কমে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাকিস্তানে তখন সকালে এক সরকার, বিকালে আরেক সরকার। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে তখন সংসদ সদস্যরা বেচাকেনা হতেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে এ অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অনুচ্ছেদের আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করেন রিটকারী আইনজীবী। সংসদকে কার্যকর করতে, গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ ঘটাতে এবং জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে এ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ।
No comments