মুখ খুললে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায় ধর্ষক
ফেসবুকের
পরিচয়ে প্রেম। এরপর জন্মদিনের দাওয়াত ও মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা
বলে ডেকে নেয় বনানীর নিজ বাসায়। সেখানে ধর্ষণ করে প্রেমিকাকে। এরপর ঘটনা
ধামাচাপা দিতে শেষ রাতে জোর করে বাসা থেকে বের করে দেয়। চিৎকার চেচামেচি
শুরু করে তরুণী। পরিবারে ফোন দেয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত বনানী থানায়
গিয়ে মামলা করে।
ঘটনার পরপর পালিয়ে যায় ইভান। ঢাকা থেকে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর বাজারে তার খালা শান্তার বাসায় গিয়ে ওঠে। সেখান থেকেই তাকে গতকাল গ্রেপ্তার করে র্যাব-১।
এদিকে গতকাল সকালে বনানীর ২ নম্বর সড়কের ন্যাম ভিলেজের সেই ৫/এ নম্বর বাসা ছাড়েন তার বাবা ব্যবসায়ী মো. বোরহান উদ্দিন বেলাল ও মা ইতি। মামলার পর থেকে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে ওই তরুণী। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগে তার শারীরিক ও বয়স নির্ধারণী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তাকে নেশা করানো হয়েছিল কি না সে পরীক্ষাও হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ দিকে মঙ্গলবার দিবাগত শেষরাতে বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর গত বুধবার বনানী থানায় ইভানকে আসামি করে মামলা করেন তরুণী। মামলার এজাহারে ধর্ষিতা তরুণীর মুখ বন্ধ করার জন্য ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় বলে উল্লেখ করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ওই আসামি আমাকে ইতিপূর্বেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করেছে। আসামি আমাকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতো। আমি মুখ খুললে সে তার কাছে আছে এমন খারাপ ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে’ বলে হুমকি দিত।
গত মঙ্গলবার রাতে ওই তরুণী সে বাসায় যায়। ইভান তাকে ‘অতিথি’ বলে রিসিভ করে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর নেশা খাইয়ে তাকে ধর্ষণ করে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ইভান প্রথমে ওই তরুণীকে দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেয়। তখন তরুণী চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এ সময় ইভান দারোয়ান মাসুদকে তাকে ফটকের বাইরে বের করে দিতে বলে। ফোন করে বাসার ব্যবস্থাপক শওকত আকবরকেও একই কথা বলে। তারা কথা না রেখে ইভানকেই বের করে দিতে বললে সে নিজেই নিচে নেমে আসে। জোর করে তরুণীকে গেটের বাইরে বের করে দেয়। এরপর সকালে ওই তরুণী প্রথমে বনানী থানায় গিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করেন। বনানী থানা পুলিশের একটি টিম তাকে সঙ্গে নিয়ে সে বাসায় যান। তখন বাসায় ইভানের মা, ছোট ভাই ও কাজের মেয়েদের পেলেও ইভানকে পাওয়া যায়নি। তার আগেই পালায় ইভান। পরে বনানী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তরুণী। এরপর থেকে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে তরুণী।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় তরুণী উল্লেখ করেন, ‘ইভানের সঙ্গে ১১ মাস ধরে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়। এ বন্ধুত্বের সূত্র ধরে দুজনের ঘুরাঘুরি, দেখা সাক্ষাৎ হতো। এ বন্ধুত্ব থেকেই ৪ মাস আগে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়। এ সম্পর্কের সূত্র ধরে গত ৪ঠা জুলাই ওই আসামি আমাকে রাত ৯টার সময় ফোন করে জানায় যে, তার জন্ম দিন এবং ওই জন্মদিনে আমাকে তার বাসায় যেতে বলে এবং তার মায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি তার মাকে জানাবে বলে জানায়। এবং টেলিফোনে মায়ের পরিচয় দিয়ে এক মহিলা আমার সঙ্গে কথা বলে, আর আমি তাকে তার মা মনে করি। তার পর আমি আমার আপুর সঙ্গে কথা বলে ওই দিন রিকশা যোগে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তার বাসার সামনে পৌঁছলে সে আমাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে যায়। আমি যাওয়ার পর বাসায় কাউকে দেখতে পাইনি। সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। তার মার কথা জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, বাবা-মা অসুস্থ। ঘুমিয়ে আছে। জোরে কথা বলা যাবে না। সকাল বেলা পরিচয় করিয়ে দেবে। বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কোনো আলামত দেখি না। আমি ভয় পাই এবং বাসায় চলে আসতে চাই। কিন্তু সে বাসায় আসতে দেয় না। সে আমাকে রাতের খাবার খাওয়ায় এবং নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়। আমি তাকে নিষেধ করলে, সে একদিন খেলে কিছু হবে না বলে জানায়। এরপর ৫ই জুলাই (মঙ্গলবার দিবাগত রাত) ১টা ৩০ মিনিটে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আমি চিৎকার চেচামেচি করতে থাকলে সে রাত সাড়ে ৩টায় আমার ব্যাগ রেখে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ব্যাগের মধ্যে আমার ৩টা ড্রেস, ২টা জিনস, ১টা কুর্তা, ৩টি মোবাইল, চার্জার, সিমকার্ড, মেমোরিকার্ড, নগদ ১৫ হাজার টাকা ছিল। তারপর আমি পথচারী ভদ্রলোকের সহায়তায় থানায় আসি। আসামি আমাকে ইতিপূর্বেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করেছে...।’
ইভানের পিতা বোরহান উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, কথিত ঘটনার দিন আমি বাসায় ছিলাম। তার মাও ছিল। তিনজন কাজের মেয়েও ছিল। কিন্তু আমরা ওই রাতে কেউ কিছুই জানি নি। তাছাড়া সংসদ সদস্যদের জন্য তৈরি করা ওই বাসার কক্ষগুলো এমন যে, এক কক্ষের শব্দ অন্য কক্ষে শোনা যায় না। বুধবার সকালে আমি হাঁটতে বের হই। তখন ছেলের মায়ের ও পরে পুলিশের ফোন পেয়ে বাসায় আসি। এসেই দেখি এক মেয়েকে নিয়ে পুলিশ এমন ঘটনা বলছে। আমার ছেলে অপরাধ করলে তার বিচার হোক। অপরাধ না করলে সে মুক্তি পাক। আমি তা-ই চাই। এজন্য ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ছেলেকে দুটি স্থানে যেতে পারে ভেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে খোঁজতে রওনা দিই। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর এলাকা থেকে গতকাল বিকাল ৪টার দিকে ইভানের মা তাকে র্যাব-১ এর হাতে তুলে দিয়েছে।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের এক সংসদ সদস্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া ওই ফ্ল্যাটে বোরহান উদ্দিন ভাড়ায় ওঠেন কয়েক মাস আগে। সেই ভবন সংলগ্ন উত্তর পাশের প্লটটি বোরহান উদ্দিনের। টিনশেড প্লটটিতে তিনি ছোট ছোট বেশ কিছু পরিবার ও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছেন। বনানীতে তার একটি দোকানও রয়েছে। ইভান তার বাবার সঙ্গে সে ব্যবসা দেখেন। পাশাপাশি নিজেরও ব্যবসা আছে। বোরহান নিজ ও ছেলের পরিবার নিয়ে কয়েক মাস আগে ১০ নম্বর সড়কের অপর বাসা থেকে ওই বাসায় ওঠেন। ইভান দুই সন্তানের জনক। তার পাঁচ বছরের ছেলে আবরান (৫) একটি স্কুলে পড়ে। তার তিন বছরের কন্যা অলিভিয়া এখনও স্কুলে যায় না। দুই সন্তানকে নিয়ে গত ঈদের দু’দিন পর স্ত্রী টুম্পা পুরান ঢাকায় বাপের বাড়ি যান। তার অনুপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে বুধবার দুই সন্তানকে নানার বাড়ি রেখে ছুটে আসেন নিজ বাসায়। পরে আবার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বাসা ছাড়েন।
ওই বাসার দারোয়ান মাসুদ বলেন, মঙ্গলবার মধ্যরাতের দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন ওই মেয়ে রিকশা নিয়ে বাসার সামনে আসে। ইভান মামা তাকে রিসিভ করে। আমাদের বলেন ‘গেস্ট’ এসেছে। তারপর বাসায় নিয়ে যান। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওই মেয়ের চিৎকার-চেচামেচি শুনি। ইভান মামা বলে তাকে বের করে দিতে। তখন বলি, আমরা ওই মেয়েকে কীভাবে বের করে দেবো। আপনিই বের করে দেন। এরপর তিনি এসে ওই মেয়েকে ধরে জোর করে বাসা থেকে বের করে দেন।
ওই বাসার ব্যবস্থাপক শওকত আকবর বলেন, ইভান আমাকে ফোন করে সেই মেয়েকে গেটের বাইরে বের করে দিতে বলেন। তখন আমি তাকেই তা করতে বলি। শেষে তিনি এসে তাকে বের করে দেন।
বোরহানের বাসার দুই কাজের মেয়ে আসমা ও আয়েশা বলেন, ওই রাতে ১১টার দিকে খেয়ে শুয়ে পড়ি। বাসায় কোনো মেয়ে আসতে দেখিনি। সকালে পুলিশসহ ওই মেয়েকে এসে অভিযোগ করতে শুনি।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য গঠিত হয় ৫ সদস্যের কমিটি। কমিটি এবং ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহামুদ বলেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই তরুণী শর্ট টাইমের মধ্যে আমাদের কাছে এসেছেন। তিনি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ৩৬ ঘণ্টার মতো সময় পার হয়েছে। যেহেতু ৪৮ ঘণ্টা এখনও পার হয়নি, তাই এর মধ্যে কোনো কিছু ঘটে থাকলে আমরা পজিটিভ রিপোর্ট পাবো।’
ওই বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস, ডা. মমতাজ আরা, ডা. রেজোয়ানা শারমিন ও ডা. কবীর সোহেল। পরীক্ষার পর কমিটির প্রধান আরো বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর বেশ কয়েকটি শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বয়স নির্ধারণের জন্য এক্সরে এবং ধর্ষণের আগে তাকে নেশাজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল কি না তা জানতে ব্লাড ও ইউরিন সংগ্রহ করে মহাখালীতে অবস্থিত রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য হাইটেজোনাল সফট সংগ্রহ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মেয়েটি আমাদের ফিজিক্যাল অ্যাসল্টের কথা বলেনি। আমরা তার শরীরেও এমন কিছু পাইনি। তবে কেমিক্যাল রিপোর্ট, রেডিওলজি রিপোর্ট এবং মাইক্রো-বাইলোজির রিপোর্ট আসার পরে ওই তরুণীর ফিজিক্যাল ফাইন্ডিংস (শারীরিক আলামত) যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো মিলিয়ে আমরা চূড়ান্ত মতামত জানাবো। সে জন্য তিন-চার সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তিনি।
বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সুলতানা আক্তার বলেন, মামলার পর থেকে তদন্ত চলছে। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখন মামলার অন্যান্য দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর আগে গত ২৮শে মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদ, শাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকি তিন আসামি হলেন, শাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ, গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী ওরফে আজাদ। শাফাতসহ সব আসামি বর্তমানে কারাগারে। এ মামলায় ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
ঘটনার পরপর পালিয়ে যায় ইভান। ঢাকা থেকে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর বাজারে তার খালা শান্তার বাসায় গিয়ে ওঠে। সেখান থেকেই তাকে গতকাল গ্রেপ্তার করে র্যাব-১।
এদিকে গতকাল সকালে বনানীর ২ নম্বর সড়কের ন্যাম ভিলেজের সেই ৫/এ নম্বর বাসা ছাড়েন তার বাবা ব্যবসায়ী মো. বোরহান উদ্দিন বেলাল ও মা ইতি। মামলার পর থেকে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে ওই তরুণী। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগে তার শারীরিক ও বয়স নির্ধারণী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তাকে নেশা করানো হয়েছিল কি না সে পরীক্ষাও হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ দিকে মঙ্গলবার দিবাগত শেষরাতে বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর গত বুধবার বনানী থানায় ইভানকে আসামি করে মামলা করেন তরুণী। মামলার এজাহারে ধর্ষিতা তরুণীর মুখ বন্ধ করার জন্য ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় বলে উল্লেখ করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ওই আসামি আমাকে ইতিপূর্বেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করেছে। আসামি আমাকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতো। আমি মুখ খুললে সে তার কাছে আছে এমন খারাপ ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে’ বলে হুমকি দিত।
গত মঙ্গলবার রাতে ওই তরুণী সে বাসায় যায়। ইভান তাকে ‘অতিথি’ বলে রিসিভ করে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর নেশা খাইয়ে তাকে ধর্ষণ করে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ইভান প্রথমে ওই তরুণীকে দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেয়। তখন তরুণী চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এ সময় ইভান দারোয়ান মাসুদকে তাকে ফটকের বাইরে বের করে দিতে বলে। ফোন করে বাসার ব্যবস্থাপক শওকত আকবরকেও একই কথা বলে। তারা কথা না রেখে ইভানকেই বের করে দিতে বললে সে নিজেই নিচে নেমে আসে। জোর করে তরুণীকে গেটের বাইরে বের করে দেয়। এরপর সকালে ওই তরুণী প্রথমে বনানী থানায় গিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করেন। বনানী থানা পুলিশের একটি টিম তাকে সঙ্গে নিয়ে সে বাসায় যান। তখন বাসায় ইভানের মা, ছোট ভাই ও কাজের মেয়েদের পেলেও ইভানকে পাওয়া যায়নি। তার আগেই পালায় ইভান। পরে বনানী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তরুণী। এরপর থেকে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে তরুণী।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় তরুণী উল্লেখ করেন, ‘ইভানের সঙ্গে ১১ মাস ধরে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়। এ বন্ধুত্বের সূত্র ধরে দুজনের ঘুরাঘুরি, দেখা সাক্ষাৎ হতো। এ বন্ধুত্ব থেকেই ৪ মাস আগে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়। এ সম্পর্কের সূত্র ধরে গত ৪ঠা জুলাই ওই আসামি আমাকে রাত ৯টার সময় ফোন করে জানায় যে, তার জন্ম দিন এবং ওই জন্মদিনে আমাকে তার বাসায় যেতে বলে এবং তার মায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি তার মাকে জানাবে বলে জানায়। এবং টেলিফোনে মায়ের পরিচয় দিয়ে এক মহিলা আমার সঙ্গে কথা বলে, আর আমি তাকে তার মা মনে করি। তার পর আমি আমার আপুর সঙ্গে কথা বলে ওই দিন রিকশা যোগে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তার বাসার সামনে পৌঁছলে সে আমাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে যায়। আমি যাওয়ার পর বাসায় কাউকে দেখতে পাইনি। সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। তার মার কথা জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, বাবা-মা অসুস্থ। ঘুমিয়ে আছে। জোরে কথা বলা যাবে না। সকাল বেলা পরিচয় করিয়ে দেবে। বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কোনো আলামত দেখি না। আমি ভয় পাই এবং বাসায় চলে আসতে চাই। কিন্তু সে বাসায় আসতে দেয় না। সে আমাকে রাতের খাবার খাওয়ায় এবং নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়। আমি তাকে নিষেধ করলে, সে একদিন খেলে কিছু হবে না বলে জানায়। এরপর ৫ই জুলাই (মঙ্গলবার দিবাগত রাত) ১টা ৩০ মিনিটে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আমি চিৎকার চেচামেচি করতে থাকলে সে রাত সাড়ে ৩টায় আমার ব্যাগ রেখে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ব্যাগের মধ্যে আমার ৩টা ড্রেস, ২টা জিনস, ১টা কুর্তা, ৩টি মোবাইল, চার্জার, সিমকার্ড, মেমোরিকার্ড, নগদ ১৫ হাজার টাকা ছিল। তারপর আমি পথচারী ভদ্রলোকের সহায়তায় থানায় আসি। আসামি আমাকে ইতিপূর্বেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করেছে...।’
ইভানের পিতা বোরহান উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, কথিত ঘটনার দিন আমি বাসায় ছিলাম। তার মাও ছিল। তিনজন কাজের মেয়েও ছিল। কিন্তু আমরা ওই রাতে কেউ কিছুই জানি নি। তাছাড়া সংসদ সদস্যদের জন্য তৈরি করা ওই বাসার কক্ষগুলো এমন যে, এক কক্ষের শব্দ অন্য কক্ষে শোনা যায় না। বুধবার সকালে আমি হাঁটতে বের হই। তখন ছেলের মায়ের ও পরে পুলিশের ফোন পেয়ে বাসায় আসি। এসেই দেখি এক মেয়েকে নিয়ে পুলিশ এমন ঘটনা বলছে। আমার ছেলে অপরাধ করলে তার বিচার হোক। অপরাধ না করলে সে মুক্তি পাক। আমি তা-ই চাই। এজন্য ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ছেলেকে দুটি স্থানে যেতে পারে ভেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে খোঁজতে রওনা দিই। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর এলাকা থেকে গতকাল বিকাল ৪টার দিকে ইভানের মা তাকে র্যাব-১ এর হাতে তুলে দিয়েছে।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের এক সংসদ সদস্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া ওই ফ্ল্যাটে বোরহান উদ্দিন ভাড়ায় ওঠেন কয়েক মাস আগে। সেই ভবন সংলগ্ন উত্তর পাশের প্লটটি বোরহান উদ্দিনের। টিনশেড প্লটটিতে তিনি ছোট ছোট বেশ কিছু পরিবার ও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছেন। বনানীতে তার একটি দোকানও রয়েছে। ইভান তার বাবার সঙ্গে সে ব্যবসা দেখেন। পাশাপাশি নিজেরও ব্যবসা আছে। বোরহান নিজ ও ছেলের পরিবার নিয়ে কয়েক মাস আগে ১০ নম্বর সড়কের অপর বাসা থেকে ওই বাসায় ওঠেন। ইভান দুই সন্তানের জনক। তার পাঁচ বছরের ছেলে আবরান (৫) একটি স্কুলে পড়ে। তার তিন বছরের কন্যা অলিভিয়া এখনও স্কুলে যায় না। দুই সন্তানকে নিয়ে গত ঈদের দু’দিন পর স্ত্রী টুম্পা পুরান ঢাকায় বাপের বাড়ি যান। তার অনুপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে বুধবার দুই সন্তানকে নানার বাড়ি রেখে ছুটে আসেন নিজ বাসায়। পরে আবার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বাসা ছাড়েন।
ওই বাসার দারোয়ান মাসুদ বলেন, মঙ্গলবার মধ্যরাতের দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন ওই মেয়ে রিকশা নিয়ে বাসার সামনে আসে। ইভান মামা তাকে রিসিভ করে। আমাদের বলেন ‘গেস্ট’ এসেছে। তারপর বাসায় নিয়ে যান। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওই মেয়ের চিৎকার-চেচামেচি শুনি। ইভান মামা বলে তাকে বের করে দিতে। তখন বলি, আমরা ওই মেয়েকে কীভাবে বের করে দেবো। আপনিই বের করে দেন। এরপর তিনি এসে ওই মেয়েকে ধরে জোর করে বাসা থেকে বের করে দেন।
ওই বাসার ব্যবস্থাপক শওকত আকবর বলেন, ইভান আমাকে ফোন করে সেই মেয়েকে গেটের বাইরে বের করে দিতে বলেন। তখন আমি তাকেই তা করতে বলি। শেষে তিনি এসে তাকে বের করে দেন।
বোরহানের বাসার দুই কাজের মেয়ে আসমা ও আয়েশা বলেন, ওই রাতে ১১টার দিকে খেয়ে শুয়ে পড়ি। বাসায় কোনো মেয়ে আসতে দেখিনি। সকালে পুলিশসহ ওই মেয়েকে এসে অভিযোগ করতে শুনি।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য গঠিত হয় ৫ সদস্যের কমিটি। কমিটি এবং ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহামুদ বলেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই তরুণী শর্ট টাইমের মধ্যে আমাদের কাছে এসেছেন। তিনি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ৩৬ ঘণ্টার মতো সময় পার হয়েছে। যেহেতু ৪৮ ঘণ্টা এখনও পার হয়নি, তাই এর মধ্যে কোনো কিছু ঘটে থাকলে আমরা পজিটিভ রিপোর্ট পাবো।’
ওই বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস, ডা. মমতাজ আরা, ডা. রেজোয়ানা শারমিন ও ডা. কবীর সোহেল। পরীক্ষার পর কমিটির প্রধান আরো বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর বেশ কয়েকটি শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বয়স নির্ধারণের জন্য এক্সরে এবং ধর্ষণের আগে তাকে নেশাজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল কি না তা জানতে ব্লাড ও ইউরিন সংগ্রহ করে মহাখালীতে অবস্থিত রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য হাইটেজোনাল সফট সংগ্রহ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মেয়েটি আমাদের ফিজিক্যাল অ্যাসল্টের কথা বলেনি। আমরা তার শরীরেও এমন কিছু পাইনি। তবে কেমিক্যাল রিপোর্ট, রেডিওলজি রিপোর্ট এবং মাইক্রো-বাইলোজির রিপোর্ট আসার পরে ওই তরুণীর ফিজিক্যাল ফাইন্ডিংস (শারীরিক আলামত) যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো মিলিয়ে আমরা চূড়ান্ত মতামত জানাবো। সে জন্য তিন-চার সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তিনি।
বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সুলতানা আক্তার বলেন, মামলার পর থেকে তদন্ত চলছে। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখন মামলার অন্যান্য দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর আগে গত ২৮শে মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদ, শাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকি তিন আসামি হলেন, শাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ, গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী ওরফে আজাদ। শাফাতসহ সব আসামি বর্তমানে কারাগারে। এ মামলায় ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
No comments