এদেশের এরা এবং ওদেশের ওরা by মশিউর রহমান তৌহিদ
রাজনীতির
বর্তমান জায়গাটায় মমতা ব্যানার্জি স্বামী বা বাবার হাত ধরে কিংবা স্বামী
বা বাবার উত্তরাধিকার হয়ে আসেননি। এসেছেন নিজের চেষ্টায়; তৃণমূল থেকে
রাজনীতি করে; প্রতিনিয়ত আন্দোলন-প্রতিবাদ করে এবং যথেষ্ট পরিশ্রম করে।
সবসময় সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন। তাই তিনি সাধারণ মানুষের মনের এবং
হাঁড়ির ভাষা যতটা বোঝেন এপারের নেত্রীরা কিংবা দিল্লির সোনিয়া ও চেন্নাইয়ের
ললিতারাও ততটা বোঝেন না। যদি ২০১৪ সালে সোনিয়া ষড়যন্ত্র কিংবা বোকামি না
করতেন তাহলে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে গুজরাটি মোদি নন, হয়তো
বাংলার মেয়ে মমতাই বসতেন। প্রণব বাবুর মতো অন্যের হুকুম তামিল করে নয় বরং
মেজাজি, সাহসী ও স্বাধীন রাজনীতিবিদ হিসেবে।
অনেক বছর ভারতে ছিলাম, তাই ভারতের রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিকনীতি অনেকটা বুঝি। ফলে বিভিন্ন ক্যালকুলেশনে ২০১৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আমার মনে হয়েছিল- বিজেপি এবং মোদি ঠেকানোর একমাত্র সহজ উপায় হলো- একটি মাত্র স্পষ্ট ঘোষণা, ‘নির্বাচনে জিতে অকংগ্রেসি নেতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার। যে অকংগ্রেসি ও আঞ্চলিক দল লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, সে দলের এবং তার নেতার নেতৃত্বেই গঠিত হবে ভারত সরকার।’ এতেই হয়তো টনিকের মতো কাজ হতো সে সময়। তাহলে মোদি ও হিন্দুত্ববাদীরা উড়ে যেত, পাত্তাই পেত না বেশির ভাগ রাজ্যগুলোতে।
আশ্চর্য হয়েছিলাম কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণকারী বামদের থেকেও ওই রকম কোনো প্রস্তাব সে সময় না ওঠায়। হিন্দুত্ব ঠেকাতে অতীতে বামেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। এতে বামেরা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি তাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। আসলে কট্টর হিন্দুত্ববিরোধী ইস্যুতে বাম-কংগ্রেসের সর্বভারতীয় পরস্পর নির্ভরশীলতার কারণেই মমতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অথবা বলা যায়, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। মমতা হিন্দুত্ববাদে সমর্থক ছিলেন না। বরং সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেস প্রধান মমতার অভিযোগ ছিল- সর্বভারতীয় ইস্যুতে কংগ্রেস-বামদের ঐকমত্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামদের বিভিন্ন ইস্যুতে শুধুই ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ কারণে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে কংগ্রেস যেমন বামদের ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে, তেমনি রাজ্য রাজনীতিতে বামেরা হয়ে পড়েছে বেপরোয়া ও উদ্ধত।’
মমতার কথা ছিল- এসব চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে এবং তিনি প্রতিরোধে নেমে পড়েন তরুণ সমর্থকদের সাথে নিয়ে। মমতার ওই প্রতিরোধের রাজনীতি শুরু হয় আমার কলকাতায় উপস্থিতিতে এবং চোখের সামনে। ১৯৯৩ সালের ২৫ মে কলকাতা যাওয়ার পর, দিন কয়েকের মধ্যে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে- কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে কলকাতায় মমতার বাম ফ্রন্টবিরোধী ধারণা, অন্যটি হচ্ছে- তৎকালীন ভারতের লোকসভার বিরোধী দলের নেতা, বিজেপির এল কে আদভানির নেতৃত্বে বাংলাদেশের চাকমাদের জন্য ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের’ দাবিতে কলকাতার রবীন্দ্রসদন থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল।
যদ্দূর জানি, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবু রাজনীতিবিদ মমতাকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। সে রকম না হলে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি ও অন্য মৌলবাদীরা থাবা বসিয়ে দিতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কিছু না হওয়ার মূল কৃতিত্ব যার তিনি হচ্ছেন ঝাঁঝালো রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি। মমতা কোনো মতেই জায়গা ছেড়ে দেননি বরং যে জায়গা অধিকার করার পণ করেছিলেন তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানেই তার কৃতিত্ব। একটি কথা বলে রাখি- ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার প্রধান কারণ ছিল ভারতের মুসলিমদের একচেটিয়া ভোট। বাবরি মসজিদ রক্ষায় ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা; সেই সাথে অবিরলভাবে চলতে থাকা বঞ্চনা ও সীমাহীন বৈষম্যের কারণে ভারতের মুসলিম ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সোনিয়ার ভুলে এবারে ক্ষমতায় এসে গো-রক্ষার নামে বিজেপির কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তাই গো-মাংস খাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে মুসলিম নির্যাতন বিজেপি সরকারের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহসী নেতৃত্ব অনেকটাই দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
‘এদেশের এরা’ কোনো দিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারত সরকারের গণহত্যার প্রতিবাদ করেননি; অসংখ্য গরিব সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাননি। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিদেশ সফরকালে কৌশলে ভারত সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কাশ্মিরের সেনাঘাঁটিতে হামলার নিন্দা জানিয়ে। সে দিনই লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে প্রায়ই। কিন্তু ভারতে গো-মাংস নিয়ে মুসলিমদের ওপর চলমান অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদ এ দেশে দেখা যায় না। তা করেন মমতা ব্যানার্জি।
অথচ মমতা ব্যানার্জি এশিয়ার আদর্শ মহিলা রাজনীতিবিদ কিংবা বিশ্বের ক্ষমতাশালী মহিলা রাজনীতিবিদ হিসেবে কারো লিস্টে আসেননি। পাননি কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর কারণ অনেকের মতে, ওই সব বিষয়ে মমতা পশ্চিমা কোনো সংস্থা কিংবা কোনো বিখ্যাত ম্যাগাজিনকে গোপনে লাখ লাখ ডলার ঘুষ-ডোনেশন দেন না। দেয়ার দরকার মনে করেন না। তার মনোযোগ তার জনগণের দিকে। লন্ডন, কানাডা এবং নিউ ইয়র্কের চার দিনের সফরকে অযথা ১৭ দিন বানিয়ে ফেলার কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাই তার পুরস্কার ও স্বীকৃতি জনগণ দেন। ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়। গত নির্বাচনে মমতার বিজয় এরই প্রমাণ। অন্য দিকে, ‘এদেশের এরা’ সব সময় জনবিচ্ছিন্ন ও নির্বাচন চুরিতে ওস্তাদ। ওস্তাদ জনগণের অধিকার হরণ করতে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মমতা তার রাজ্যের সাত কোটির বেশি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকদের দুই টাকা কেজি দরে চাল-আটা দিচ্ছেন। কল্পনা করতে পারেন? সে হিসাবে বাংলাদেশে ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়টি- ‘শৈবাল দীঘিরে বলে ঊর্ধ্ব করে শির, লিখে রাখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির’, এ রকমই মনে হয়। আবার এর বাস্তবায়ন হতে কত সময় লাগে এবং কারা কারা পাবেন সে অনিশ্চয়তা তো আছেই।
কিছু লোককে ১০ টাকা সের দরে চাল দেয়া হবে এ ঘোষণা দেয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সারা বছরের ঊর্ধ্বগামী বাজারের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? গত কয়েক মাসে সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ৩০ টাকা থেকে দাম বেড়ে আজ প্রায় ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর দাম আগেও বাড়তি ছিল, আজো বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু ‘এদেশের এরা’ তার খোঁজ রাখেন না। নিজেদের খাওয়া-পাওয়ার সব কিছু ভালো চললেই মনে করেন, দেশের মানুষ অনেক সুখে আছে।
এখানেই ওপারের মমতার সাথে এপারের ফারাক। এদেশের ‘এরা’ যতটুকু না রাজনীতিবিদ, তার চেয়ে যেন অনেক বেশি ব্যবসায়ী ও ধান্দাবাজ। শুধুই তেলা মাথায় তেল দিয়ে যান। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধার ধারেন না। পুলিশ দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন করান। আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দিয়ে নির্যাতন করান জনগণকে। কারণ দেশে কার্যত গণতন্ত্র নেই। নেই জনগণের ভোটাধিকার।রাজনীতির বর্তমান জায়গাটায় মমতা ব্যানার্জি স্বামী বা বাবার হাত ধরে কিংবা স্বামী বা বাবার উত্তরাধিকার হয়ে আসেননি। এসেছেন নিজের চেষ্টায়; তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে; প্রতিনিয়ত আন্দোলন-প্রতিবাদ করে এবং যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সবসময় সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন। তাই তিনি সাধারণ মানুষের মনের এবং হাঁড়ির ভাষা যতটা বোঝেন এপারের নেত্রীরা কিংবা দিল্লির সোনিয়া ও চেন্নাইয়ের ললিতারাও ততটা বোঝেন না। যদি ২০১৪ সালে সোনিয়া ষড়যন্ত্র কিংবা বোকামি না করতেন তাহলে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে গুজরাটি মোদি নন, হয়তো বাংলার মেয়ে মমতাই বসতেন। প্রণব বাবুর মতো অন্যের হুকুম তামিল করে নয় বরং মেজাজি, সাহসী ও স্বাধীন রাজনীতিবিদ হিসেবে। অনেক বছর ভারতে ছিলাম, তাই ভারতের রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিকনীতি অনেকটা বুঝি। ফলে বিভিন্ন ক্যালকুলেশনে ২০১৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আমার মনে হয়েছিল- বিজেপি এবং মোদি ঠেকানোর একমাত্র সহজ উপায় হলো- একটি মাত্র স্পষ্ট ঘোষণা, ‘নির্বাচনে জিতে অকংগ্রেসি নেতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার। যে অকংগ্রেসি ও আঞ্চলিক দল লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, সে দলের এবং তার নেতার নেতৃত্বেই গঠিত হবে ভারত সরকার।’ এতেই হয়তো টনিকের মতো কাজ হতো সে সময়। তাহলে মোদি ও হিন্দুত্ববাদীরা উড়ে যেত, পাত্তাই পেত না বেশির ভাগ রাজ্যগুলোতে। আশ্চর্য হয়েছিলাম কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণকারী বামদের থেকেও ওই রকম কোনো প্রস্তাব সে সময় না ওঠায়। হিন্দুত্ব ঠেকাতে অতীতে বামেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। এতে বামেরা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি তাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। আসলে কট্টর হিন্দুত্ববিরোধী ইস্যুতে বাম-কংগ্রেসের সর্বভারতীয় পরস্পর নির্ভরশীলতার কারণেই মমতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অথবা বলা যায়, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। মমতা হিন্দুত্ববাদে সমর্থক ছিলেন না। বরং সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেস প্রধান মমতার অভিযোগ ছিল- সর্বভারতীয় ইস্যুতে কংগ্রেস-বামদের ঐকমত্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামদের বিভিন্ন ইস্যুতে শুধুই ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ কারণে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে কংগ্রেস যেমন বামদের ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে, তেমনি রাজ্য রাজনীতিতে বামেরা হয়ে পড়েছে বেপরোয়া ও উদ্ধত।’ মমতার কথা ছিল- এসব চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে এবং তিনি প্রতিরোধে নেমে পড়েন তরুণ সমর্থকদের সাথে নিয়ে। মমতার ওই প্রতিরোধের রাজনীতি শুরু হয় আমার কলকাতায় উপস্থিতিতে এবং চোখের সামনে। ১৯৯৩ সালের ২৫ মে কলকাতা যাওয়ার পর, দিন কয়েকের মধ্যে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে- কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে কলকাতায় মমতার বাম ফ্রন্টবিরোধী ধারণা, অন্যটি হচ্ছে- তৎকালীন ভারতের লোকসভার বিরোধী দলের নেতা, বিজেপির এল কে আদভানির নেতৃত্বে বাংলাদেশের চাকমাদের জন্য ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের’ দাবিতে কলকাতার রবীন্দ্রসদন থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল। যদ্দূর জানি, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবু রাজনীতিবিদ মমতাকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। সে রকম না হলে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি ও অন্য মৌলবাদীরা থাবা বসিয়ে দিতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কিছু না হওয়ার মূল কৃতিত্ব যার তিনি হচ্ছেন ঝাঁঝালো রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি। মমতা কোনো মতেই জায়গা ছেড়ে দেননি বরং যে জায়গা অধিকার করার পণ করেছিলেন তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানেই তার কৃতিত্ব। একটি কথা বলে রাখি- ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার প্রধান কারণ ছিল ভারতের মুসলিমদের একচেটিয়া ভোট। বাবরি মসজিদ রক্ষায় ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা; সেই সাথে অবিরলভাবে চলতে থাকা বঞ্চনা ও সীমাহীন বৈষম্যের কারণে ভারতের মুসলিম ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সোনিয়ার ভুলে এবারে ক্ষমতায় এসে গো-রক্ষার নামে বিজেপির কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তাই গো-মাংস খাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে মুসলিম নির্যাতন বিজেপি সরকারের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহসী নেতৃত্ব অনেকটাই দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ‘এদেশের এরা’ কোনো দিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারত সরকারের গণহত্যার প্রতিবাদ করেননি; অসংখ্য গরিব সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাননি। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিদেশ সফরকালে কৌশলে ভারত সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কাশ্মিরের সেনাঘাঁটিতে হামলার নিন্দা জানিয়ে। সে দিনই লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে প্রায়ই। কিন্তু ভারতে গো-মাংস নিয়ে মুসলিমদের ওপর চলমান অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদ এ দেশে দেখা যায় না। তা করেন মমতা ব্যানার্জি। অথচ মমতা ব্যানার্জি এশিয়ার আদর্শ মহিলা রাজনীতিবিদ কিংবা বিশ্বের ক্ষমতাশালী মহিলা রাজনীতিবিদ হিসেবে কারো লিস্টে আসেননি। পাননি কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর কারণ অনেকের মতে, ওই সব বিষয়ে মমতা পশ্চিমা কোনো সংস্থা কিংবা কোনো বিখ্যাত ম্যাগাজিনকে গোপনে লাখ লাখ ডলার ঘুষ-ডোনেশন দেন না। দেয়ার দরকার মনে করেন না। তার মনোযোগ তার জনগণের দিকে। লন্ডন, কানাডা এবং নিউ ইয়র্কের চার দিনের সফরকে অযথা ১৭ দিন বানিয়ে ফেলার কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাই তার পুরস্কার ও স্বীকৃতি জনগণ দেন। ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়। গত নির্বাচনে মমতার বিজয় এরই প্রমাণ। অন্য দিকে, ‘এদেশের এরা’ সব সময় জনবিচ্ছিন্ন ও নির্বাচন চুরিতে ওস্তাদ। ওস্তাদ জনগণের অধিকার হরণ করতে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মমতা তার রাজ্যের সাত কোটির বেশি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকদের দুই টাকা কেজি দরে চাল-আটা দিচ্ছেন। কল্পনা করতে পারেন? সে হিসাবে বাংলাদেশে ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়টি- ‘শৈবাল দীঘিরে বলে ঊর্ধ্ব করে শির, লিখে রাখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির’, এ রকমই মনে হয়। আবার এর বাস্তবায়ন হতে কত সময় লাগে এবং কারা কারা পাবেন সে অনিশ্চয়তা তো আছেই। কিছু লোককে ১০ টাকা সের দরে চাল দেয়া হবে এ ঘোষণা দেয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সারা বছরের ঊর্ধ্বগামী বাজারের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? গত কয়েক মাসে সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ৩০ টাকা থেকে দাম বেড়ে আজ প্রায় ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর দাম আগেও বাড়তি ছিল, আজো বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু ‘এদেশের এরা’ তার খোঁজ রাখেন না। নিজেদের খাওয়া-পাওয়ার সব কিছু ভালো চললেই মনে করেন, দেশের মানুষ অনেক সুখে আছে। এখানেই ওপারের মমতার সাথে এপারের ফারাক। এদেশের ‘এরা’ যতটুকু না রাজনীতিবিদ, তার চেয়ে যেন অনেক বেশি ব্যবসায়ী ও ধান্দাবাজ। শুধুই তেলা মাথায় তেল দিয়ে যান। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধার ধারেন না। পুলিশ দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন করান। আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দিয়ে নির্যাতন করান জনগণকে। কারণ দেশে কার্যত গণতন্ত্র নেই। নেই জনগণের ভোটাধিকার।
অনেক বছর ভারতে ছিলাম, তাই ভারতের রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিকনীতি অনেকটা বুঝি। ফলে বিভিন্ন ক্যালকুলেশনে ২০১৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আমার মনে হয়েছিল- বিজেপি এবং মোদি ঠেকানোর একমাত্র সহজ উপায় হলো- একটি মাত্র স্পষ্ট ঘোষণা, ‘নির্বাচনে জিতে অকংগ্রেসি নেতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার। যে অকংগ্রেসি ও আঞ্চলিক দল লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, সে দলের এবং তার নেতার নেতৃত্বেই গঠিত হবে ভারত সরকার।’ এতেই হয়তো টনিকের মতো কাজ হতো সে সময়। তাহলে মোদি ও হিন্দুত্ববাদীরা উড়ে যেত, পাত্তাই পেত না বেশির ভাগ রাজ্যগুলোতে।
আশ্চর্য হয়েছিলাম কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণকারী বামদের থেকেও ওই রকম কোনো প্রস্তাব সে সময় না ওঠায়। হিন্দুত্ব ঠেকাতে অতীতে বামেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। এতে বামেরা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি তাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। আসলে কট্টর হিন্দুত্ববিরোধী ইস্যুতে বাম-কংগ্রেসের সর্বভারতীয় পরস্পর নির্ভরশীলতার কারণেই মমতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অথবা বলা যায়, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। মমতা হিন্দুত্ববাদে সমর্থক ছিলেন না। বরং সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেস প্রধান মমতার অভিযোগ ছিল- সর্বভারতীয় ইস্যুতে কংগ্রেস-বামদের ঐকমত্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামদের বিভিন্ন ইস্যুতে শুধুই ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ কারণে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে কংগ্রেস যেমন বামদের ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে, তেমনি রাজ্য রাজনীতিতে বামেরা হয়ে পড়েছে বেপরোয়া ও উদ্ধত।’
মমতার কথা ছিল- এসব চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে এবং তিনি প্রতিরোধে নেমে পড়েন তরুণ সমর্থকদের সাথে নিয়ে। মমতার ওই প্রতিরোধের রাজনীতি শুরু হয় আমার কলকাতায় উপস্থিতিতে এবং চোখের সামনে। ১৯৯৩ সালের ২৫ মে কলকাতা যাওয়ার পর, দিন কয়েকের মধ্যে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে- কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে কলকাতায় মমতার বাম ফ্রন্টবিরোধী ধারণা, অন্যটি হচ্ছে- তৎকালীন ভারতের লোকসভার বিরোধী দলের নেতা, বিজেপির এল কে আদভানির নেতৃত্বে বাংলাদেশের চাকমাদের জন্য ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের’ দাবিতে কলকাতার রবীন্দ্রসদন থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল।
যদ্দূর জানি, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবু রাজনীতিবিদ মমতাকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। সে রকম না হলে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি ও অন্য মৌলবাদীরা থাবা বসিয়ে দিতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কিছু না হওয়ার মূল কৃতিত্ব যার তিনি হচ্ছেন ঝাঁঝালো রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি। মমতা কোনো মতেই জায়গা ছেড়ে দেননি বরং যে জায়গা অধিকার করার পণ করেছিলেন তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানেই তার কৃতিত্ব। একটি কথা বলে রাখি- ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার প্রধান কারণ ছিল ভারতের মুসলিমদের একচেটিয়া ভোট। বাবরি মসজিদ রক্ষায় ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা; সেই সাথে অবিরলভাবে চলতে থাকা বঞ্চনা ও সীমাহীন বৈষম্যের কারণে ভারতের মুসলিম ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সোনিয়ার ভুলে এবারে ক্ষমতায় এসে গো-রক্ষার নামে বিজেপির কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তাই গো-মাংস খাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে মুসলিম নির্যাতন বিজেপি সরকারের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহসী নেতৃত্ব অনেকটাই দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
‘এদেশের এরা’ কোনো দিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারত সরকারের গণহত্যার প্রতিবাদ করেননি; অসংখ্য গরিব সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাননি। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিদেশ সফরকালে কৌশলে ভারত সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কাশ্মিরের সেনাঘাঁটিতে হামলার নিন্দা জানিয়ে। সে দিনই লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে প্রায়ই। কিন্তু ভারতে গো-মাংস নিয়ে মুসলিমদের ওপর চলমান অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদ এ দেশে দেখা যায় না। তা করেন মমতা ব্যানার্জি।
অথচ মমতা ব্যানার্জি এশিয়ার আদর্শ মহিলা রাজনীতিবিদ কিংবা বিশ্বের ক্ষমতাশালী মহিলা রাজনীতিবিদ হিসেবে কারো লিস্টে আসেননি। পাননি কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর কারণ অনেকের মতে, ওই সব বিষয়ে মমতা পশ্চিমা কোনো সংস্থা কিংবা কোনো বিখ্যাত ম্যাগাজিনকে গোপনে লাখ লাখ ডলার ঘুষ-ডোনেশন দেন না। দেয়ার দরকার মনে করেন না। তার মনোযোগ তার জনগণের দিকে। লন্ডন, কানাডা এবং নিউ ইয়র্কের চার দিনের সফরকে অযথা ১৭ দিন বানিয়ে ফেলার কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাই তার পুরস্কার ও স্বীকৃতি জনগণ দেন। ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়। গত নির্বাচনে মমতার বিজয় এরই প্রমাণ। অন্য দিকে, ‘এদেশের এরা’ সব সময় জনবিচ্ছিন্ন ও নির্বাচন চুরিতে ওস্তাদ। ওস্তাদ জনগণের অধিকার হরণ করতে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মমতা তার রাজ্যের সাত কোটির বেশি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকদের দুই টাকা কেজি দরে চাল-আটা দিচ্ছেন। কল্পনা করতে পারেন? সে হিসাবে বাংলাদেশে ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়টি- ‘শৈবাল দীঘিরে বলে ঊর্ধ্ব করে শির, লিখে রাখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির’, এ রকমই মনে হয়। আবার এর বাস্তবায়ন হতে কত সময় লাগে এবং কারা কারা পাবেন সে অনিশ্চয়তা তো আছেই।
কিছু লোককে ১০ টাকা সের দরে চাল দেয়া হবে এ ঘোষণা দেয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সারা বছরের ঊর্ধ্বগামী বাজারের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? গত কয়েক মাসে সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ৩০ টাকা থেকে দাম বেড়ে আজ প্রায় ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর দাম আগেও বাড়তি ছিল, আজো বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু ‘এদেশের এরা’ তার খোঁজ রাখেন না। নিজেদের খাওয়া-পাওয়ার সব কিছু ভালো চললেই মনে করেন, দেশের মানুষ অনেক সুখে আছে।
এখানেই ওপারের মমতার সাথে এপারের ফারাক। এদেশের ‘এরা’ যতটুকু না রাজনীতিবিদ, তার চেয়ে যেন অনেক বেশি ব্যবসায়ী ও ধান্দাবাজ। শুধুই তেলা মাথায় তেল দিয়ে যান। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধার ধারেন না। পুলিশ দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন করান। আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দিয়ে নির্যাতন করান জনগণকে। কারণ দেশে কার্যত গণতন্ত্র নেই। নেই জনগণের ভোটাধিকার।রাজনীতির বর্তমান জায়গাটায় মমতা ব্যানার্জি স্বামী বা বাবার হাত ধরে কিংবা স্বামী বা বাবার উত্তরাধিকার হয়ে আসেননি। এসেছেন নিজের চেষ্টায়; তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে; প্রতিনিয়ত আন্দোলন-প্রতিবাদ করে এবং যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সবসময় সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন। তাই তিনি সাধারণ মানুষের মনের এবং হাঁড়ির ভাষা যতটা বোঝেন এপারের নেত্রীরা কিংবা দিল্লির সোনিয়া ও চেন্নাইয়ের ললিতারাও ততটা বোঝেন না। যদি ২০১৪ সালে সোনিয়া ষড়যন্ত্র কিংবা বোকামি না করতেন তাহলে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে গুজরাটি মোদি নন, হয়তো বাংলার মেয়ে মমতাই বসতেন। প্রণব বাবুর মতো অন্যের হুকুম তামিল করে নয় বরং মেজাজি, সাহসী ও স্বাধীন রাজনীতিবিদ হিসেবে। অনেক বছর ভারতে ছিলাম, তাই ভারতের রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিকনীতি অনেকটা বুঝি। ফলে বিভিন্ন ক্যালকুলেশনে ২০১৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আমার মনে হয়েছিল- বিজেপি এবং মোদি ঠেকানোর একমাত্র সহজ উপায় হলো- একটি মাত্র স্পষ্ট ঘোষণা, ‘নির্বাচনে জিতে অকংগ্রেসি নেতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার। যে অকংগ্রেসি ও আঞ্চলিক দল লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, সে দলের এবং তার নেতার নেতৃত্বেই গঠিত হবে ভারত সরকার।’ এতেই হয়তো টনিকের মতো কাজ হতো সে সময়। তাহলে মোদি ও হিন্দুত্ববাদীরা উড়ে যেত, পাত্তাই পেত না বেশির ভাগ রাজ্যগুলোতে। আশ্চর্য হয়েছিলাম কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণকারী বামদের থেকেও ওই রকম কোনো প্রস্তাব সে সময় না ওঠায়। হিন্দুত্ব ঠেকাতে অতীতে বামেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। এতে বামেরা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি তাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। আসলে কট্টর হিন্দুত্ববিরোধী ইস্যুতে বাম-কংগ্রেসের সর্বভারতীয় পরস্পর নির্ভরশীলতার কারণেই মমতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অথবা বলা যায়, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। মমতা হিন্দুত্ববাদে সমর্থক ছিলেন না। বরং সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেস প্রধান মমতার অভিযোগ ছিল- সর্বভারতীয় ইস্যুতে কংগ্রেস-বামদের ঐকমত্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামদের বিভিন্ন ইস্যুতে শুধুই ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ কারণে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে কংগ্রেস যেমন বামদের ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে, তেমনি রাজ্য রাজনীতিতে বামেরা হয়ে পড়েছে বেপরোয়া ও উদ্ধত।’ মমতার কথা ছিল- এসব চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে এবং তিনি প্রতিরোধে নেমে পড়েন তরুণ সমর্থকদের সাথে নিয়ে। মমতার ওই প্রতিরোধের রাজনীতি শুরু হয় আমার কলকাতায় উপস্থিতিতে এবং চোখের সামনে। ১৯৯৩ সালের ২৫ মে কলকাতা যাওয়ার পর, দিন কয়েকের মধ্যে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে- কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে কলকাতায় মমতার বাম ফ্রন্টবিরোধী ধারণা, অন্যটি হচ্ছে- তৎকালীন ভারতের লোকসভার বিরোধী দলের নেতা, বিজেপির এল কে আদভানির নেতৃত্বে বাংলাদেশের চাকমাদের জন্য ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের’ দাবিতে কলকাতার রবীন্দ্রসদন থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল। যদ্দূর জানি, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবু রাজনীতিবিদ মমতাকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। সে রকম না হলে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি ও অন্য মৌলবাদীরা থাবা বসিয়ে দিতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কিছু না হওয়ার মূল কৃতিত্ব যার তিনি হচ্ছেন ঝাঁঝালো রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি। মমতা কোনো মতেই জায়গা ছেড়ে দেননি বরং যে জায়গা অধিকার করার পণ করেছিলেন তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানেই তার কৃতিত্ব। একটি কথা বলে রাখি- ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার প্রধান কারণ ছিল ভারতের মুসলিমদের একচেটিয়া ভোট। বাবরি মসজিদ রক্ষায় ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা; সেই সাথে অবিরলভাবে চলতে থাকা বঞ্চনা ও সীমাহীন বৈষম্যের কারণে ভারতের মুসলিম ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সোনিয়ার ভুলে এবারে ক্ষমতায় এসে গো-রক্ষার নামে বিজেপির কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তাই গো-মাংস খাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে মুসলিম নির্যাতন বিজেপি সরকারের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহসী নেতৃত্ব অনেকটাই দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ‘এদেশের এরা’ কোনো দিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারত সরকারের গণহত্যার প্রতিবাদ করেননি; অসংখ্য গরিব সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাননি। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিদেশ সফরকালে কৌশলে ভারত সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কাশ্মিরের সেনাঘাঁটিতে হামলার নিন্দা জানিয়ে। সে দিনই লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে প্রায়ই। কিন্তু ভারতে গো-মাংস নিয়ে মুসলিমদের ওপর চলমান অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদ এ দেশে দেখা যায় না। তা করেন মমতা ব্যানার্জি। অথচ মমতা ব্যানার্জি এশিয়ার আদর্শ মহিলা রাজনীতিবিদ কিংবা বিশ্বের ক্ষমতাশালী মহিলা রাজনীতিবিদ হিসেবে কারো লিস্টে আসেননি। পাননি কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর কারণ অনেকের মতে, ওই সব বিষয়ে মমতা পশ্চিমা কোনো সংস্থা কিংবা কোনো বিখ্যাত ম্যাগাজিনকে গোপনে লাখ লাখ ডলার ঘুষ-ডোনেশন দেন না। দেয়ার দরকার মনে করেন না। তার মনোযোগ তার জনগণের দিকে। লন্ডন, কানাডা এবং নিউ ইয়র্কের চার দিনের সফরকে অযথা ১৭ দিন বানিয়ে ফেলার কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাই তার পুরস্কার ও স্বীকৃতি জনগণ দেন। ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়। গত নির্বাচনে মমতার বিজয় এরই প্রমাণ। অন্য দিকে, ‘এদেশের এরা’ সব সময় জনবিচ্ছিন্ন ও নির্বাচন চুরিতে ওস্তাদ। ওস্তাদ জনগণের অধিকার হরণ করতে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মমতা তার রাজ্যের সাত কোটির বেশি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকদের দুই টাকা কেজি দরে চাল-আটা দিচ্ছেন। কল্পনা করতে পারেন? সে হিসাবে বাংলাদেশে ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়টি- ‘শৈবাল দীঘিরে বলে ঊর্ধ্ব করে শির, লিখে রাখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির’, এ রকমই মনে হয়। আবার এর বাস্তবায়ন হতে কত সময় লাগে এবং কারা কারা পাবেন সে অনিশ্চয়তা তো আছেই। কিছু লোককে ১০ টাকা সের দরে চাল দেয়া হবে এ ঘোষণা দেয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সারা বছরের ঊর্ধ্বগামী বাজারের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? গত কয়েক মাসে সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ৩০ টাকা থেকে দাম বেড়ে আজ প্রায় ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর দাম আগেও বাড়তি ছিল, আজো বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু ‘এদেশের এরা’ তার খোঁজ রাখেন না। নিজেদের খাওয়া-পাওয়ার সব কিছু ভালো চললেই মনে করেন, দেশের মানুষ অনেক সুখে আছে। এখানেই ওপারের মমতার সাথে এপারের ফারাক। এদেশের ‘এরা’ যতটুকু না রাজনীতিবিদ, তার চেয়ে যেন অনেক বেশি ব্যবসায়ী ও ধান্দাবাজ। শুধুই তেলা মাথায় তেল দিয়ে যান। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধার ধারেন না। পুলিশ দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন করান। আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দিয়ে নির্যাতন করান জনগণকে। কারণ দেশে কার্যত গণতন্ত্র নেই। নেই জনগণের ভোটাধিকার।
No comments