আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ফের তদন্ত
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গঠিত সত্য ও জবাবদিহি কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) মার্জনা পাওয়া আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ফের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ করা হয়েছে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে দুদক থেকে ট্রু–থ কমিশনে পাঠানো ৩৯ জনের নাম। আর দ্বিতীয় ধাপে আছে কমিশন থেকে অনুকম্পা বা মার্জনা পাওয়া ৪৫২ জনের দুর্নীতির বিষয়। দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ট্রুথ কমিশনে মার্জনা পাওয়া আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু হয়েছে। কিছু কিছু মামলাও হচ্ছে। কত জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, যারা ট্রুথ কমিশন থেকে অনুকম্পা পেয়েছিল, তাদের সবার বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান বা তদন্তে আইনগত বাধা নেই। আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের কাউকে ছাড় দেয়ার জন্য নতুন করে তদন্ত হচ্ছে কিনা বা কাউকে দুদক অব্যাহতি দিয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্তের ফল কী, তা জেনে বলতে হবে। তবে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক থেকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। দুদকের লিগ্যাল শাখার মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, আইনের মারপ্যাঁচে অনুকম্পা পেয়েছে এমন কারও রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ট্রুথ কমিশন অবৈধ হয়ে যাওয়ার পর দায়মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজদের জন্য ট্রুথ কমিশনে মার্জনা নেয়ার আইন করা হয়েছিল, অনেকেই মার্জনা নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই মার্জনা বৈধ নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে তাদের আবার বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ওই সময় দুর্নীতিবিরোধী ট্রাস্কফোর্সের তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদসহ ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে ট্রু–থ কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। এ কমিশন থেকে ৪৫২ জনকে শর্তসাপেক্ষে মার্জনাপত্র দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ডেসা, নিবন্ধন পরিদফতর, ওয়াসা, টিঅ্যান্ডটি, এলজিইডি, পোস্টাল, তিতাস গ্যাস, বন বিভাগ, গৃহায়ন অধিদফতর, সওজ, বিটিসিএল, ঢাকা ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম আছে। অনুকম্পাপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৬৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২৮ জন তাদের স্ত্রী। তারা ৩৩ কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৬৬৮ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ওই ট্রুথ কমিশন গঠন ও অনুকম্পা পাওয়ার বিষয়টি অবৈধ হয়ে যায়। ফলে অনুকম্পাপ্রাপ্তদের দুর্নীতির বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে।
দুদক অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ট্রু–থ কমিশন থেকে অনুকম্পা পাওয়া গুলশানের একাধিক বাসিন্দা, একটি জেলার সাবরেজিস্ট্রার, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ শতাধিক ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ করেছে দুদক। তবে তাদের কয়েকজন দুদকের নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে তা গৃহীত হয়। তবে দুদক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই সঙ্গে ট্রুথ কমিশন থেকে অনুকম্পা পাওয়া অন্যদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিয়ে অনুসন্ধান কাজ করছে বলে জানা গেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা টিআইবির ট্রাস্টি এম. হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, যেসব সরকারি চাকরিজীবী ট্রু–থ কমিশনের কাছ থেকে অনুকম্পা নিয়েছেন তাদের অপরাধ মোচন হয়নি। অপরাধের বিচার হতে হবে। তিনি বলেন, ট্রু–থ কমিশন গঠন আইনসিদ্ধভাবে ছিল না। তাই সেটা বাতিল হয়ে গেছে। যারা দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন কমিশনের কাছে প্রমাণ রয়েছে। সেই প্রমাণ নিয়েই দুদক কাজ করতে পারে। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আইনানুগভাবেই আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম সচল করেছে দুদক। অভিযোগ তদন্তে যারা দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে প্রমাণিত হবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ২০০৮ সালের ৮ জুন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮’ জারি করে। দোষ স্বীকার করলে লঘু দণ্ড দিয়ে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য এর আলোকে গঠিত ট্রু–থ কমিশন ওই বছরের ৩ আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু করে। কমিশন থেকে ৪৫২ জন মার্জনার সনদ পান। ২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি কমিশন বিলুপ্ত হয়। তবে ওই অধ্যাদেশ ও কমিশন গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আদিলুর রহমান খান, বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার, দীপুমনি (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেত্রী) ও মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান যৌথভাবে হাইকোর্টে রিট করেন। তাদের রিটের ফলে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে (ট্রু–থ কমিশন) অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেন। পরে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
No comments