একটি ‘ভাগ্যবান’ ব্যাংকের কাহিনী!
এটিকে ‘ভাগ্যবান’ ব্যাংক না বললে আর কী বলা যাবে? দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ করা হয়েছে এই ব্যাংক থেকে। এই লুটে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতারা। তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে তুলে নেয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এমনকি রাতের আঁধারে বস্তায় বস্তায় টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে কম করে হলেও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এর সবই জানত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে কিছুটা সতর্ক করা হয়েছিল। বিষয়টি জানতেন তৎকালীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। অর্থমন্ত্রীকেও বিষয়টি একসময় অবহিত করা হয়। কিন্তু সব কিছু জানানোর পরেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ততক্ষণে ব্যাংকটি থেকে লুটে নেয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু যারা এই অনিয়ম ও টাকা আত্মসাতে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। গত পাঁচ বছরে শুধু ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অথচ অনিয়মের বিষয়ে যার নাম সব সময়ই সামনে চলে এসেছে সেই ব্যাংকেরই সাবেক এমডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তার ‘খুঁটির’ জোর নাকি অ-নে-ক লম্বা। অনিয়ম ও আত্মসাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হলেও জনগণের কাছ থেকে আদায় করা করের টাকা প্রতি বছর এই ব্যাংকটিকে দেয়া হচ্ছে। মূলধন সংরক্ষণের নামে দেয়া এ টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দেখেশুনে মনে হয় ব্যাংকটি যেন সরকারের চোখের মণি! এই ব্যাংকটির নাম বেসিক ব্যাংক। পুুরোপুরি সরকারি মালিকানাধীন এই ব্যাংক কয়েক বছর ধরে খুব দুঃসময় অতিক্রম করছে। লুটপাটের কারণে এটি এখন বিপুল মূলধন ঘাটতির মুখে। আর খেলাপি ঋণও তো আকাশ ছোঁয়ার অতিক্রম। গত তিন বছরে এই মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে দুই হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এখন আবার নতুন করে ব্যাংকটিকে দেয়া হচ্ছে আরো এক হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে একটি সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এটি অনুমোদন পেতে পারে বলে জানা গেছে। অনুমোদন পেলে বেসিক ব্যাংককে এক হাজার কোটি টাকা চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে রক্ষিত মূলধন পুনর্গঠন খাতে রাখা ২০০০ কোটি টাকা থেকে এই অর্থ দেয়া হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো: ইউনুসুর রহমানের পাঠানো এই সারসংক্ষেপে বেসিক ব্যাংককে এক হাজার কোটি টাকা ছাড়াও অপর কয়েকটি সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে ১৬৪ কোটি টাকা রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসিতে রক্ষিত সরকারি শেয়ারের (রাইট শেয়ার ইস্যু) জন্য ১৮৫ কোটি এবং সরকারি গৃহঋণ দানকারী সংস্থা হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনকে ১৮৫ কোটি টাকা দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে অর্থ দেয়ার জন্য বরাবরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার অতি উৎসাহ লক্ষ করা গেছে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সামর্থ্য থাকলে এই বিভাগ তো আজই বেসিককে পুরো অর্থ দিয়ে দেয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকে যখন ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছিল তখন কিন্তু এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। এসব জালিয়াতি ঠেকানোর বিষয়ে তিনি কোনো ভূমিকা পালন করেছিলেন কি না তা আজ পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। তিনি এ ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এখন বেসিককে তারা টাকা দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এর আগেও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সঙ্কট কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিন দফায় দুই হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। প্রথমবার ২০১৪ সালে দুই দফায় যথাক্রমে ৭৯০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। পরে গত বছর দেয়া হয়েছিল আরো ১২ শ’ কোটি টাকা। এ সম্পর্কিত অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘অর্থ বিভাগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১২০০ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের অনুকূলে মূলধন পুনর্ভরণ খাতে প্রদান করা হলো। প্রসঙ্গত, সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত লাভজনক ছিল। কিন্তু এরপর যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত ঘটে। চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি। এতে আত্মসাৎ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকাÑ যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করে। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির েেত্রই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম পরিলতি হয় না। পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। যার অধিকাংশ ঋণই গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মতামত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
No comments