ব্যাংকিং খাতের ১৬ হাজার কোটি টাকা হাওয়া
অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত। নামে বেনামে ঋণ যেমন বেড়েছে; তেমনি বেড়েছে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে বেড়ে গেছে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ। বলা চলে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে কুঋণ, এর পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে মোটা দাগে গত কয়েক বছরে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে আলোচিত ৯ ঘটনায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা হওয়া হয়ে গেছে। এ ঋণের বেশির ভাগই আদায় করা যাবে না, যা ব্যাংকগুলোর জন্য এখন বোঝা। এর বাইরে আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। এতে চুরি হয়ে যায় ৮০০ কোটি টাকা। এই টাকার কিছু অংশ পাওয়া গেলেও বেশির ভাগই এখনো পাওয়া যায়নি। আদৌ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। হলমার্ক গ্রুপ: ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সোনালী ব্যাংক থেকে অখ্যাত কোম্পানি হলমার্কের ঋণ অনিয়মের ঘটনা। সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে এ কোম্পানি হাতিয়ে নেয় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ভুয়া অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের (আইবিপি) মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নেয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের স্বীকৃত বিল কিনে বিপাকে পড়ে আরো ৪১ ব্যাংক। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ বর্তমানে আটক রয়েছেন। তবে চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম সোনালী ব্যাংকের অর্থ ফেরতের শর্তে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। যদিও তিনি মুক্তি পেয়ে কোনো অর্থই সোনালী ব্যাংককে ফেরত দেননি। এতে করে সোনালী ব্যাংক পুরো অর্থ খেলাপি হিসেবে দেখিয়েছে এবং অন্য ব্যাংকের স্বীকৃত বিলের দায় পরিশোধে বাধ্য হয়েছে। এত বড় আর্থিক জালিয়াতির নেপথ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তির নাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এলেও সে ব্যাপারে দুদক নিশ্চুপ রয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন চিহ্নিত সদস্য।
বেসিক ব্যাংক : হলমার্কের রেশ কাটতে-না-কাটতেই ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয় বেসিক ব্যাংকের ঘটনা। একসময় বেসিক ব্যাংককে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া হতো। সেই বেসিক ব্যাংক ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ফোকলা করে ফেলা হয়। এই সময়ে বেসিক ব্যাংক থেকে বের হয়ে যায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মহলে বেসিক ব্যাংকের এ ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর নাম উঠে এলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু চাপে পড়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও তার বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো আইনি পদক্ষেপ। ফলে অনেকটা নির্বিঘেœ বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। অথচ ঋণপ্রক্রিয়ায় যেসব কর্মকর্তা সহায়তা করেছিলেন, সেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনেকে বর্তমানে জেল খাটছেন। আর পুরো সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের ঘানি টানতে হচ্ছে বেসিক ব্যাংককে। ইতোমধ্যে ব্যাংকটিকে রক্ষার জন্য কয়েক দফা রাষ্ট্রের অর্থ দিয়েছে সরকার।
বিসমিল্লাহ গ্রুপ : হলমার্ক ও বেসিকের পর ব্যাংকিং খাতে অপর আলোচিত ঘটনা হলো বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম। টেরি টাওয়েলস রফতানির ভুয়া তথ্যে ব্যাংক খাত থেকে ওই টাকা হাতিয়ে নেয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী। জনতা, প্রাইম, প্রিমিয়ার, শাহজালাল, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন তিনি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উদঘাটিত হওয়ার পর থেকে খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরীন হাসিবসহ অন্যান্য পরিচালক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঘটনার মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হলেও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা জেলহাজতে আছেন।
আনন্দ শিপইয়ার্ড : জাহাজ রফতানির চুক্তিপত্র দেখিয়ে দেশের ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৬ শ’ কোটি টাকার ঋণ নেয় আনন্দ শিপইয়ার্ড। শুরুতে দু’টি জাহাজ রফতানি করতে পারলেও বাকি আটটি জাহাজের রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ক্রয়াদেশ দেয়া হয়েছিল, তাতেও আনন্দ শিপইয়ার্ডের মালিকানা। ভুয়া রফতানিকারক সেজে ক্রয়াদেশ দিয়েছিল আনন্দ শিপইয়ার্ড নিজেই। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রমাণও মেলে। তবে দুদকের অনুসন্ধানে ঋণ অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি। পরবর্তীকালে জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক বকেয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে। আর ইসলামী ব্যাংককে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণের সমপরিমাণ প্রভিশন রাখতে হয়েছে।
রানকা সোহেল : জনতা ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখা থেকে সুতা রফতানির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রানকা সোহেল লিমিটেডের ১১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বেরিয়ে আসে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে অনিয়ম উদঘাটন হয়। সব ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে রানকা সোহেল। বর্তমানে রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস্, রানকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস্সহ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ৩৫২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। তার পরও এই গ্রাহক জনতা ব্যাংক থেকে আরো ঋণসুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
এইচ আর গ্রুপ : চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টি ব্যাংকের শাখা থেকে এইচ আর গ্রুপ অভিনব কৌশলে ৯৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে। ব্যাংকগুলোও নিয়মকানুন ভঙ্গ করে গ্রুপকে বেআইনি ঋণ দিয়েছে। গ্রুপটিও ভুয়া বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে। গ্রুপের যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে সেগুলোও বর্তমানে বন্ধ। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেয়া হয় বাস্তবে বেশির ভাগের অস্তিত্ব নেই। এভাবে বন্ধ প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ, ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির নামে বিপুল অর্থ নেয়া হয়েছে। এসব কাজে সহায়তা করেছে ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তা। ব্যাংকের শাখাপর্যায় থেকে প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও এই জালিয়াতির সাথে জড়িত। গ্রুপের খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে বেআইনিভাবে নতুন ঋণ দেয়ার নজিরও রয়েছে। ব্যাংকের দুর্নাম ঘোচাতে খেলাপি হওয়ার এক বছরের মধ্যে নজিরবিহীনভাবে ঋণ অবলোপন করা হয়। ২০১৪ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব তথ্য উঠে আসে।
৮ ব্যাংক থেকে ৭৫০ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা : আর্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি ও বেসরকারি আটটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন দুই ভাই। মিজানুর রহমান শাহিন ও মজিবুর রহমান মিলন নামে এ দুই ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম মহানগর হালিশহরের বাসিন্দা। জানা গেছে, তারা গোপনে দেশ ছেড়েছেন। একজন আছেন কানাডায়। অন্যজন সিঙ্গাপুরে। তাদের নেয়া সব ঋণই এখন খেলাপি তালিকায়।
দুদকের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে চিহ্নিত দুই ভাইয়ের আটটি প্রতিষ্ঠান হলো- মিশম্যাপ শিপ ব্রেকিং, ফয়জুন শিপ ব্রেকিং, বিআর স্টিল মিলস, মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইকিং, এমআরএম এন্টারপ্রাইজ, এমআর শিপিং লাইনস, আহমেদ মোস্তফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানমার হোটেলস লিমিটেড। এসব সিলভিয়া গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তাদের সবচেয়ে বেশি ২৯৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এ ছাড়া ঋণ দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া ১৫১ কোটি ৩৭ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৮৫ কোটি ৫৭ লাখ, ইস্টার্ন ব্যাংক ৪৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৭০ কোটি ৫২ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৭ কোটি ২০ লাখ এবং যমুনা ব্যাংক ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। এসব ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি : সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মে ব্যাংকিং খাতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তখন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এতে খোদ ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফিলিপাইনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমে জুয়াড়িরা এ অর্থ নগদায়ন করে। এ পর্যন্ত দেড় কোটি ডলার উদ্ধার হয়েছে, বাকি অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থ ফেরতে নানান শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বেসিক ব্যাংক : হলমার্কের রেশ কাটতে-না-কাটতেই ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয় বেসিক ব্যাংকের ঘটনা। একসময় বেসিক ব্যাংককে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া হতো। সেই বেসিক ব্যাংক ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ফোকলা করে ফেলা হয়। এই সময়ে বেসিক ব্যাংক থেকে বের হয়ে যায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মহলে বেসিক ব্যাংকের এ ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর নাম উঠে এলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু চাপে পড়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও তার বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো আইনি পদক্ষেপ। ফলে অনেকটা নির্বিঘেœ বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। অথচ ঋণপ্রক্রিয়ায় যেসব কর্মকর্তা সহায়তা করেছিলেন, সেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনেকে বর্তমানে জেল খাটছেন। আর পুরো সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের ঘানি টানতে হচ্ছে বেসিক ব্যাংককে। ইতোমধ্যে ব্যাংকটিকে রক্ষার জন্য কয়েক দফা রাষ্ট্রের অর্থ দিয়েছে সরকার।
বিসমিল্লাহ গ্রুপ : হলমার্ক ও বেসিকের পর ব্যাংকিং খাতে অপর আলোচিত ঘটনা হলো বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম। টেরি টাওয়েলস রফতানির ভুয়া তথ্যে ব্যাংক খাত থেকে ওই টাকা হাতিয়ে নেয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী। জনতা, প্রাইম, প্রিমিয়ার, শাহজালাল, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন তিনি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উদঘাটিত হওয়ার পর থেকে খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরীন হাসিবসহ অন্যান্য পরিচালক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঘটনার মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হলেও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা জেলহাজতে আছেন।
আনন্দ শিপইয়ার্ড : জাহাজ রফতানির চুক্তিপত্র দেখিয়ে দেশের ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৬ শ’ কোটি টাকার ঋণ নেয় আনন্দ শিপইয়ার্ড। শুরুতে দু’টি জাহাজ রফতানি করতে পারলেও বাকি আটটি জাহাজের রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ক্রয়াদেশ দেয়া হয়েছিল, তাতেও আনন্দ শিপইয়ার্ডের মালিকানা। ভুয়া রফতানিকারক সেজে ক্রয়াদেশ দিয়েছিল আনন্দ শিপইয়ার্ড নিজেই। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রমাণও মেলে। তবে দুদকের অনুসন্ধানে ঋণ অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি। পরবর্তীকালে জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক বকেয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে। আর ইসলামী ব্যাংককে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণের সমপরিমাণ প্রভিশন রাখতে হয়েছে।
রানকা সোহেল : জনতা ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখা থেকে সুতা রফতানির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রানকা সোহেল লিমিটেডের ১১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বেরিয়ে আসে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে অনিয়ম উদঘাটন হয়। সব ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে রানকা সোহেল। বর্তমানে রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস্, রানকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস্সহ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ৩৫২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। তার পরও এই গ্রাহক জনতা ব্যাংক থেকে আরো ঋণসুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
এইচ আর গ্রুপ : চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টি ব্যাংকের শাখা থেকে এইচ আর গ্রুপ অভিনব কৌশলে ৯৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে। ব্যাংকগুলোও নিয়মকানুন ভঙ্গ করে গ্রুপকে বেআইনি ঋণ দিয়েছে। গ্রুপটিও ভুয়া বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে। গ্রুপের যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে সেগুলোও বর্তমানে বন্ধ। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেয়া হয় বাস্তবে বেশির ভাগের অস্তিত্ব নেই। এভাবে বন্ধ প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ, ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির নামে বিপুল অর্থ নেয়া হয়েছে। এসব কাজে সহায়তা করেছে ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তা। ব্যাংকের শাখাপর্যায় থেকে প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও এই জালিয়াতির সাথে জড়িত। গ্রুপের খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে বেআইনিভাবে নতুন ঋণ দেয়ার নজিরও রয়েছে। ব্যাংকের দুর্নাম ঘোচাতে খেলাপি হওয়ার এক বছরের মধ্যে নজিরবিহীনভাবে ঋণ অবলোপন করা হয়। ২০১৪ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব তথ্য উঠে আসে।
৮ ব্যাংক থেকে ৭৫০ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা : আর্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি ও বেসরকারি আটটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন দুই ভাই। মিজানুর রহমান শাহিন ও মজিবুর রহমান মিলন নামে এ দুই ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম মহানগর হালিশহরের বাসিন্দা। জানা গেছে, তারা গোপনে দেশ ছেড়েছেন। একজন আছেন কানাডায়। অন্যজন সিঙ্গাপুরে। তাদের নেয়া সব ঋণই এখন খেলাপি তালিকায়।
দুদকের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে চিহ্নিত দুই ভাইয়ের আটটি প্রতিষ্ঠান হলো- মিশম্যাপ শিপ ব্রেকিং, ফয়জুন শিপ ব্রেকিং, বিআর স্টিল মিলস, মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইকিং, এমআরএম এন্টারপ্রাইজ, এমআর শিপিং লাইনস, আহমেদ মোস্তফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানমার হোটেলস লিমিটেড। এসব সিলভিয়া গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তাদের সবচেয়ে বেশি ২৯৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এ ছাড়া ঋণ দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া ১৫১ কোটি ৩৭ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৮৫ কোটি ৫৭ লাখ, ইস্টার্ন ব্যাংক ৪৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৭০ কোটি ৫২ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৭ কোটি ২০ লাখ এবং যমুনা ব্যাংক ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। এসব ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি : সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মে ব্যাংকিং খাতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তখন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এতে খোদ ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফিলিপাইনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমে জুয়াড়িরা এ অর্থ নগদায়ন করে। এ পর্যন্ত দেড় কোটি ডলার উদ্ধার হয়েছে, বাকি অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থ ফেরতে নানান শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
No comments