নকল পুলিশ সরঞ্জামাদি পাচ্ছে আসল পুলিশের কাছ থেকে!
পুলিশের অসাধু সদস্যদের যোগসাজশে পুলিশি সরঞ্জামাদি যাচ্ছে অপরাধীদের কাছে। আর ওই সব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হচ্ছে অপরাধ তৎপরতায়। কখনও কখনও চিহ্নিত অপরাধীদের সঙ্গে ভুয়া অভিযানেও অংশ নিচ্ছে পুলিশের ওই সব অসাধু সদস্যরা। বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, অসাধু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৬ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার এএসআই আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। দ্রুতই আরও কয়েকজন অসাধু পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) একটি সূত্র জানিয়েছে, পৃথক দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে দুই দফা রিমান্ডে এএসআই আলমগীর স্বীকার করেছেন যে, অপরাধীদের হাতে অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায়ই তিনি পুলিশি সরঞ্জামাদি তুলে দিতেন। বিনিময়ে অপরাধীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন।
কখনও কখনও তিনি নিজে ভুয়া পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অভিযানে অংশ নিতেন। ৪ এপ্রিল উত্তরার রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সামনে এ ধরনের একটি অভিযানে অংশ নেন আলমগীর। ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়রা মাসুম বিল্লাহ নামে এক চাকরিচ্যুত সেনা সদস্যকে আটক করে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। মাসুম বিল্লাহর কাছ থেকেই এএসআই আলমগীরের নাম জানতে পারে ডিবি। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বৃহস্পতিবার মাসুম বিল্লাহ জানান, এএসআই আলমগীরের সহযোগিতায় ভুয়া পুলিশ পরিচয়ে তিনি এর আগে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছেন। ৪ এপ্রিল বিকালে উত্তরা পূর্ব থানাধীন রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সামনে থেকে এইচএস মানি এক্সচেঞ্জের মালিক ইলিয়াসকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে প্রাইভেটকারে তুলে নেন। পরে ইলিয়াসের চোখ বেঁধে তার কাছ থেকে ১৮ হাজার ৮০০ ইউএস ডলার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ইলিয়াস চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন গাড়ি থামিয়ে দেয়। তখন এএসআই আলমগীরসহ আরও চারজন গাড়িতে থাকলেও তারা কৌশলে পালিয়ে যান। ওই সময় অন্য যে তিনজন পালিয়ে যান তাদের নাম হাবিব ডলার, রাশেদ ও সুমন। ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এএসআই আলমগীরের কাছে থাকা অস্ত্র, ওয়াকিটকি এবং হ্যান্ডকাফ ব্যবহার করে ২৬ আগস্ট উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের আজমপুর পুলিশ ফাঁড়ির পাশ থেকে জেবিকো মানি এক্সচেঞ্জের সাইফুর রহমান সুজনের কাছ থেকে ১৮ হাজার ইউএস ডলার ছিনিয়ে নেয়া হয়। ডিএমপি সূত্র জানায়, আগে রাজধানীর পলওয়েলসহ বিভিন্ন মার্কেটে পুলিশের পোশাক, ওয়াকিটকি সেট, হ্যান্ডকাফ এবং সিগন্যাল লাইটসহ নানান সরঞ্জমাদি অবাধে বিক্রি হতো। অপরাধীরা এসব কিনে পুলিশ সেজে সহজেই নানান অপরাধ কর্মককাণ্ডে লিপ্ত হতো। এ কারণে পুলিশি সরঞ্জামাদি বিক্রির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা দোকানগুলোকে পুলিশ সদর দফতর থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এসব কেনা বা তৈরির অর্ডারের ক্ষেত্রে এখন পুলিশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া বাধ্যতামূলক।
প্রায় তিন বছর ধরে পলওয়েলসহ পুলিশের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা মার্কেটগুলো থেকে কেউ পুলিশি সামগ্রী কিনতে পারছে না। পরিচয়পত্র দেখিয়ে সরঞ্জমাদির অর্ডার দিতে হচ্ছে। তারপরই সরবরাহ করা হচ্ছে। এরপরও ভুয়া পুলিশের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। কড়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কিভাবে পুলিশের সরঞ্জামাদি অপরাধীদের হাতে আসছে- তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভুয়া পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আসল পুলিশের সংশ্লিষ্টতা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অসাধু সদস্যদের পাশপাশি নানান উপায়ে পুলিশের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে ভুয়া র্যাব-পুলিশের সদস্যরা। কোনো কোনো ভুয়া পুলিশ সদস্য অনেক আগেই বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে রেখেছিল। এসব এখন ব্যবহার করছে। আদালত এবং থানা থেকে অনেক সময় সরঞ্জামাদি চুরি হয় বা হারিয়ে যায়। পরে এসব সরঞ্জামাদি অপরাধ তৎপরতায় ব্যবহার করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী পুরাতন সরঞ্জামাদি ড্যামেজ (নষ্ট) করে ফেলার কথা। কখনও কখনও দেখা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যের মাধ্যমে সেগুলো অপরাধীদের হাতে চলে যায়। মাঝে মধ্যেই অকেজো সরঞ্জামাদি নিলামে তোলা হয়। সেখান থেকেও এসব চলে যায় অপরাধীদের হাতে। ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সবুজবাগে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে একটি চক্রের ১১ জনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাঁচ রাউন্ড গুলি, তিনটি ম্যাগাজিন, তিনটি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশীয় পাইপগান, একটি ওয়াকিটকি, পাঁচটি ডিবি পুলিশের জ্যাকেট, পাঁচটি হ্যান্ডকাফসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। এ চক্রের দলনেতা ইউসুফ কাজী রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ডিবিকে জানায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কর্মরত একাধিক সদস্যদের সহযোগিতায় তারা পুলিশের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে। পরে এসব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে তারা ডাকাতি করে। ২ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরা থানাধীন শেখের জায়গা এলাকা থেকে চার ভুয়া ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, দুই রাউন্ড গুলি, একটি পিস্তলের পোছ, একটি ওয়াকিটকি সেট, একটি হ্যান্ডকাফ, একটি সিগন্যাল লাইট এবং ছিনতাইকৃত নগদ ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকাসহ নানান সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের ডেমরা থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, গ্রেফতার আবুল কাশেম জীবন, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে রনি, মোস্তফা কামাল ওরফে লিঙ্কন এবং স্বপন আকন এখন জেলহাজতে। রিমান্ডে তারা স্বীকার করেছে- অস্ত্র, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ ও সিগন্যাল লাইট দেখিয়ে তারা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পুলিশের সরঞ্জামাদি কোথা থেকে কিভাবে সংগ্রহ করা হয়, সে বিষয়ে আসামিরা রিমান্ডে তেমন কোনো তথ্য দেয়নি। তার ধারণা, এসব সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে কোনো না কোনো পুলিশ সদস্যের হাত থাকতে পারে। যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক রাহাৎ খান যুগান্তরকে জানান, এসআই মো. আইয়ুবের নেতৃত্বাধীন পুলিশের একটি দল ২২ মার্চ মাতুয়াইল থেকে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় শাহীন নামের একজনকে গ্রেফতার করে। শাহীনের কাছ থেকে পুলিশের শার্ট, প্যান্ট এবং নেমপ্লেট ছাড়াও একটি চাপাতি এবং চারটি চাকু উদ্ধার করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শাহীন জানায়, নাননু নামের একজনের কাছ থেকে তারা পুলিশের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে থাকে। তবে নাননুর বিষয়ে সে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। নাননু কোনো অসাধু পুলিশ সদস্য কি-না, সে বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের পিএসআই শফিউল আজম গভীর রাতে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে মাঝে-মধ্যে ভুয়া অভিযানে নামেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নামধারী অভিযানের সময় সফিউল ও তার সহযোগীরা (পুলিশের ভুয়া সদস্য) পুলিশের পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, সিগন্যাল লাইট ব্যবহার করে। পুলিশ পরিচয়ে তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। শফিউলের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতর থেকে তদন্ত হচ্ছে উল্লেখ করে সূত্রটি জানায়, শফিউল এখন গোয়েন্দা নজরদারিতে। যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
No comments