কুলি থেকে কোটিপতি নাইটগার্ড সাইদুর
এক সময় তিনি ছিলেন কুলি। মাথায় মালামাল বহন করাই ছিল তার কাজ। কুলিগিরি করে যে আয় হতো তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলত। সাইদুর রহমানকে এলাকায় এখনও ‘কুলি সাইদুর’ নামেই চেনেন মুরব্বিরা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু পাল্টে গেছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডমালা পৌর এলাকার বাসিন্দা সাইদুর এখন কোটিপতি। শুধু তাই নয়, তিনি মুন্ডমালা পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। দলের কার্যালয় করার নাম করে সরকারি জমি লিজ নিয়ে তাতে নিজের নামেই নির্মাণ করছেন বহুতল মার্কেট। অবাক করার মতো বিষয় হল, এই সাইদুর কাগজে-কলমে এখনও একটি কলেজের নাইটগার্ড। তার বদলে ভাড়ায় এক লোককে খাটান তিনি। আর মাস শেষে কলেজ থেকে তুলে নেন বেতনের টাকা।
স্থানীয়রা জানান, সাইদুর রহমানের বাবা সাইনাল হকের জন্ম ভারতের মুর্শিদাবাদে। পাকিস্তান আমলে মুন্ডমালা এসে শ্যালক নোমান মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। সাইনাল ছিলেন মুন্ডমালা বাজারে পানের দোকানদার। সাইদুর প্রথমে মুন্ডমালায় কুলির কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে কুলির সর্দার হন। এরপর পেশা পরিবর্তন করে হন ভুটভুটির চেইন মাস্টার। ২০০১ সালে বিএনপির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মুন্ডমালা মহিলা কলেজে নাইটগার্ডের চাকরি পান। ওই সময় তানোর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শীশ মোহাম্মদের ছত্রছায়ায় সাইদুর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে প্রভাবশালী নেতা শীশের মৃত্যুর পর খানিকটা দমে যান তিনি। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভোল পাল্টে ফেলেন সাইদুর। এ সময় তানোর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানীর হাত ধরে যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন। ২০১২ সালে মুন্ডমালা পৌর যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। সাইদুর ২০১৫ সাল থেকে মুন্ডমালা পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদে আছেন। মুন্ডমালা পৌরসভার বর্তমান মেয়র গোলাম রাব্বানীর খুবই আস্থাভাজন সাইদুর। এর অন্যতম কারণ হিসেবে এলাকাবাসী যুগান্তরকে জানান, সাইদুরের আশ্রয়েই পাঁচন্দর ইউনিয়নের বাসিন্দা রাব্বানী মুন্ডমালা পৌরসভার ভোটার হয়েছিলেন। এরপর দলের সমর্থন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। রাব্বানী মেয়র হওয়ার পরই কপাল খুলে যায় সাইদুরের। পৌরসভার প্রায় সব কাজই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। বেনামেই করেন কনস্ট্রাকশনের কাজ। বর্তমানে সাগর এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার হয়ে মুন্ডমালা পৌরসভার প্রায় কোটি টাকার কাজ করছেন সাইদুর। পৌরসভায় ঠিকাদারির নামে অবৈধ কর্মকাণ্ডই তার আয়ের মূল উৎস বলে অভিযোগ রয়েছে। মুন্ডমালা মহিলা কলেজের নাইটগার্ড হয়েও অন্যের ঠিকাদারি লাইসেন্সে ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। এখনও তিনি ওই কলেজের কর্মচারী। তবে নিজে ডিউটি করেন না। স্থানীয় শাওন নামে এক ব্যক্তিকে কিছু টাকা দিয়ে পাহারাদার রেখেছেন। কলেজে নিয়মিত হাজিরা দেখিয়ে তুলে নিচ্ছেন বেতন-ভাতা। এ বিষয়ে মুন্ডমালা মহিলা কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও মুন্ডমালা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, সাইদুর রহমানের বাবা পাকিস্তান আমলে মুন্ডমালায় যে বাড়িতে থাকত, সেই পরিবারের দুই ভাই রাজাকার।
আর সেই রাজাকারদের ভাগ্নেই হল সাইদুর। শূন্য থেকে সে এখন কোটিপতি। পৌর মেয়র রাব্বানীর ডান হাত হিসেবে পরিচিত। আমি সভাপতি, কিন্তু সাইদুর আমার কথা শোনে না। একেবারেই বেপরোয়া। কলেজের পাহারাদারের কাজ না করেও বেতন-ভাতা তোলার বিষয়টিও স্বীকার করেন মোস্তফা। অভিযোগ উঠেছে, দলের কার্যালয় নির্মাণের কথা বলে জেলা পরিষদের কাছ থেকে দেড় শতক জমি নিজের নামে লিজ নেন সাইদুর। পরে ওই জমি সংলগ্ন সরকারি রাস্তা ও মাদ্রাসার জমি দখলে নেন। এরপর সেখানেই নির্মাণ করছেন বহুতল মার্কেট। এরই মধ্যে দুটি তলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। নিচতলায় দোকান ভাড়াও দিয়েছেন। এ বিষয়ে মুন্ডমালা কামিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য তাসির উদ্দিন জানান, সাইদুর স্থানীয় সরকারি দলের নেতা হওয়ায় যা ইচ্ছা তাই করছেন। মাদ্রাসার জমি দখলে নিয়ে তিনি ভবন নির্মাণ করছেন। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। এ ব্যাপারে মুন্ডুমালা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা (তহশিলদার) মিজানুর রহমান বলেন, লিজের শর্ত লংঘন করে সাইদুর রহমান পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মুন্ডমালা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, দলীয় কার্যালয় করার কথা ছিল। এ কারণে জেলা পরিষদ দেড় শতক জমি তাকে লিজ দেয়। কিন্তু ওই জমিসহ রাস্তা ও মাদ্রাসার জমি দখলে নিয়ে মার্কেট তৈরি করছে সাইদুর। এসব অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জেলা পরিষদের কাছ থেকে ৩-৪ বছর আগে দেড় শতক জমি লিজ নিয়ে দোকান করি। এখন বিল্ডিং করেছি। লিজ নেয়া সরকারি জমিতে পাকা ভবন নির্মাণের নিয়ম নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি। তবে মাদ্রাসার জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেন সাইদুর।
No comments