তিস্তা থেকে গঙ্গা
তিস্তার পানি নিয়ে পাঁচ বছর ধরে চলছে অপেক্ষা আর আহাজারি। তিস্তার বুক চিরে যে বাঁধ একদা তৈরি হয়েছিল, আজ তা অকেজো হতে বসেছে। এই বাঁধ এখন পানি ধরে রাখবে কি, উজান থেকে পানিই আসছে না। ব্যারাজ এখন শুধুই ব্রিজ। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশ সরকার তিস্তা ব্যারাজ তৈরির কাজ শুরু করেছিল ১৯৭৯ সালে। উত্তরাঞ্চলে তিস্তার আশপাশের পাঁচটি জেলার ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি এই প্রকল্পের আওতায় সেচসুবিধা পাবে, এমনটি আশা করা গিয়েছিল। জেনারেল এরশাদের জমানায় বাঁধ তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে যায়। জায়গাটি তাঁর এলাকায়। তিনি ওই এলাকার ছাওয়াল হিসেবে আদৃত। যেখানে তাঁর জন্য আলিশান একটা বিশ্রামাগারও বানানো হয়েছিল। সেখানে তিনি মাঝেমধ্যে রিট্রিটে যেতেন। প্রকল্পটি চালু হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। এখন শুকনো মৌসুমে উজান থেকে পানি আর আসে না বা যেটুকু আসে, তা খুবই কম।
ব্যারাজ থেকে ৯৭ কিলোমিটার ভাটিতে ডালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে এক ফোঁটা পানিও পৌঁছায় না। তিস্তার সঙ্গে লতায়-পাতায় জড়িয়ে থাকা করতোয়া, কাটাখালী, ঘাঘট, দুধকুমার, যমুনেশ্বরী আর বুড়িতিস্তায় মরুকরণ-প্রক্রিয়া বেশ স্পষ্ট। ভূ–ওপরস্থ পানির অভাবে জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। গেরস্তরা নলকূপ বসিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলছেন। ফলে একদিকে বাড়ছে চাষের খরচ, অন্যদিকে পরিবেশের বারোটা বাজছে। শুধু কি খেতের ফসল, মাছেরও আকাল দেখা দিয়েছে। গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় তিস্তা অববাহিকার জন্য ‘সমন্বিত কৃষি কৌশল পরিকল্পনা’ নামে একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এই সমীক্ষায় ওই অঞ্চলে নেমে আসা দুর্ভোগের ভয়াবহ ছবি ফুটে উঠেছে। তিস্তা বাঁধের ‘সুবিধাভোগী’ এলাকায় মাছের বসতি ধ্বংস হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪২৩ হেক্টর। ৫ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে এবং ৩৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তিস্তার দুঃখ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা এলাকায় তিস্তায় বহুমুখী ব্যারাজ তৈরির পর থেকেই ভাটি এলাকার মানুষ সমস্যায় পড়ে যায়। গজলডোবায় একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণে পানি বাংলাদেশের ভেতরে কম ঢুকছে। জলের ধারা কমতে কমতে ২০১৫ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ২৫০ কিউসেকে। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো সমঝোতা হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সরকার ব্যারাজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এত বছরেও কোনো সমঝোতা হয়নি। শুনেছি এ নিয়ে দিল্লি আর কলকাতার মধ্যে রশি টানাটানি হচ্ছে। বুঝতে পারছি না এটা পাতানো খেলা, নাকি অন্য কিছু। ইতিমধ্যে তিস্তা ব্যারাজ এক অতিকায় সাদা হাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারিং মনুমেন্টের এই দশা দেখে দুঃখ হয়।
আন্তর্জাতিক বলয়ে কিছু সাধারণ নিয়ম আছে। কোনো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর অবকাঠামো তৈরি করতে হলে এবং তার ফলে পানিপ্রবাহে যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি থাকা দরকার। তা না হলে কোনো তৃতীয় দেশ বা সংস্থা অর্থায়ন করে না। বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে তাই বিদেশি অর্থায়ন ছিল না। শেষ দিকে এসে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল। সরকারের কর্তারা বেশ গর্ব করেই বলে থাকেন, আমাদের সরকারের টাকায় আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। তাঁরা বলেন, জিওবির টাকা। সরকারের লোকদের কোনো রকমেই বোঝানো গেল না যে সরকারের কোনো টাকা নেই। এটা হলো জনগণের টাকা, পাবলিক মানি। গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকা এ দেশে যেভাবে নয়ছয় হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। সেনাপতিরা যখন এই প্রকল্পের পেছনে জনগণের কষ্টে আয় করা টাকা ঢালতে শুরু করেন, তখন সরকারের কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল না। না হলে প্রশ্ন তোলা যেত, ভারতের সঙ্গে স্থায়ী চুক্তি ছাড়া এ ধরনের ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়ার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? প্রশ্ন উঠতে পারে, কবে চুক্তি হবে, তার আশায় আমরা বসে থাকব, নাকি আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে কিছু করব। উত্তম কথা। তাহলে ধরে নিতে হবে, চুক্তি না হলেও আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পাব এবং তার ওপর নির্ভর করে আমরা অবকাঠামো তৈরি করব। কিন্তু এই অনুমানও মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। গজলডোবার পর ভারতের সিকিমে একাধিক প্রকল্প তৈরি হয়েছে এবং ওখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে পানির প্রবাহ কমে গেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গ গোঁ ধরেছে, আমরাই জল পাই না,
তোমাদের দেব কোথা থেকে। এ রকম যখন পরিস্থিতি, তখন আমরা নিজেদেরই প্রশ্ন করতে পারি, কার ভরসায় আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঢাললাম তিস্তার জলে? টাকাটা কি তবে জলেই গেল? বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারও নড়েচড়ে বসেছে। অনেক দিন থেকেই বোর্ডের প্রকৌশলীরা গঙ্গা ব্যারাজের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। তাঁদেরই বা দোষ দিয়ে লাভ কী? পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁরা যে প্রযুক্তিজ্ঞান লাভ করেছেন, তা তো প্রয়োগ করার ক্ষেত্র চাই! পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু করার পর থেকেই বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মা নদীতে ব্যারাজ করার কথা বলে আসছেন আমাদের প্রকৌশলীরা। কাগজে-কলমে গঙ্গা নদী বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মা নামে প্রবাহিত হলেও প্রস্তাবিত ব্যারাজটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঙ্গা ব্যারাজ নামেই উল্লেখ করে থাকে। এখানে ব্যারাজ হলে তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গেও পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় ভারত এত দিন প্রস্তাবিত গঙ্গা বাঁধের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, ভারত কিছুটা নরম হয়েছে এবং এই বাঁধের ব্যাপারে বাংলা-ভারত সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। তিস্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গঙ্গা ব্যারাজের ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার। ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটা চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর। মেয়াদ শেষ হতে বাকি আছে আর মাত্র ৯ বছর।
বাঁধ তো শুধু বাঁধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধরনের অবকাঠামো। সবকিছু তৈরি হতে সময় নেবে ১৫ থেকে ২০ বছর, কিংবা তারও বেশি। তত দিনে গঙ্গার কী হাল হবে, তা কি আমরা জানি? গঙ্গার অবস্থা তিস্তার মতোই। উজানে বিহার আর উত্তর প্রদেশে গঙ্গাজল দেদার তোলা হচ্ছে সেচ ও অন্যান্য কাজে। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ আগের মতো নেই। ভারতের অনেক রাজ্যে পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার। ভারত সরকার গঙ্গার জল অন্যান্য রাজ্যে চালান করতে চাইছে। সে জন্য গঙ্গার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে হিমালয় থেকে নেমে আসা অনেকগুলো নদীর পানি গঙ্গায় চালান করার একটা চেষ্টা চলছে। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নামে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। ভারতের এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ নেই। একই অববাহিকার দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চলে পানি নিয়ে কোনো বহুপক্ষীয় সমঝোতার ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়নি। ‘জল জাতীয়তাবাদ’ ভারতে বেশ জোরদার। বাংলাদেশকে দুয়োরানির চেয়ে অমর্যাদাকর অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। এই যখন অবস্থা, তখন চার বিলিয়ন ডলারের গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে আমরা কেন মাতামাতি করছি?
আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী এ নিয়ে বেশ উৎসাহী এবং উচ্চকিত। কিন্তু টাকার জোগান দেবে জনগণ। সুতরাং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু জানানো দরকার। পদ্মায় পানিপ্রবাহ না বাড়াতে পারলে আমাদের কৃষি, মৎস্য চাষ, পশুপালন, নৌ-যোগাযোগ—সবই হুমকির মধ্যে পড়বে। নৌ-যোগাযোগ বেহাল তো অনেক বছর ধরেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে সুন্দরবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পানি ও জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে চলেছে। সুতরাং পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য গঙ্গা ব্যারাজের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পানি কতটুকু পাওয়া যাবে? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি ২০ বছর লাগে, তাহলে প্রকল্পের প্রাক্কলিত খরচ যে শেষমেশ নিদেনপক্ষে ৩০০ শতাংশ বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধরনের প্রকল্প থেকে সুবিধা পেতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০ বছর। অর্থাৎ এই প্রকল্প শুরু করার আগে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫০ থেকে ১০০ বছরের একটা চুক্তি থাকতে হবে পানি ভাগাভাগির। তার আগে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গঙ্গা ব্যারাজের সম্ভাব্যতা জরিপ করার কী দরকার? বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এখন দীনহীন দশা। নতুন নিয়োগ নেই, বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই, ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া অবকাঠামো দেখভাল করার জন্য যথেষ্ট তহবিলের জোগান দেওয়া হয় না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাঁচাতে দরকার বড় বড় প্রকল্প। তাই গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে বোর্ডের অনেক উৎসাহ এবং আশা। কিন্তু এটা যে আরেকটা সাদা হাতি হবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? এ ধরনের মেগা প্রকল্প একধরনের কামধেনু। এটাকে দোহন করে অনেকের ভাগ্য বদলে যায়। এসব প্রকল্প নিয়ে আমলা, রাজনীতিবিদ আর ঠিকাদারের আঁতাত বেশ লক্ষণীয়। কিন্তু খরচের বোঝাটা গিয়ে পড়ে আমজনতার ওপর। বড় বড় সড়ক, সেতু আর বাঁধ উন্নয়নের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু কোনটা কখন ও কোন জায়গায় দরকার, তা জানতে হবে। আদৌ দরকার আছে কি না, নাকি অন্য বিকল্প আছে, তা–ও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে হাজারো সমস্যা। কোনটা অগ্রাধিকার পাবে, তা-ও বিবেচনা করা দরকার। তিস্তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গঙ্গা প্রসঙ্গে কথা বললাম। আমাদের দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা খোলামেলা জন-আলোচনা হওয়া দরকার। উন্নয়নের নামে এ দেশে অনেক বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়, সেসবের যে হাজারো রকমের উপকার, তার ফিরিস্তি সম্ভাব্যতা জরিপের রিপোর্টে মলাটবন্দী হয়ে থাকে। সরকার কিংবা ঋণদাতা সংস্থা ইন্টারনাল রেট অব রিটার্নের হিসাবটা দেখেই প্রকল্পে হ্যাঁ বা না বলে দেয়। যাদের টাকায় প্রকল্প, সেই আমজনতা থাকে অন্ধকারে। একটা গণতান্ত্রিক সমাজে এ রকম চলতে দেওয়া যায় না। জবাবদিহির জায়গাটা আরও শক্ত ও সুনির্দিষ্ট করা দরকার।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments