ট্রাম্পের মন কী জানি কেমন
আধুনিক কালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আর কোনো প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এত বিচার-বিশ্লেষণ হতে দেখা যায়নি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ঔৎসুক্য-কৌতূহলের শেষ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতারা ট্রাম্পকে বলতে গেলে চেনেন না। তাঁরা তাঁকে পড়তে পারেন না। তাঁর মতিগতি বোঝেন না। ট্রাম্প কখন কী বলেন, কখন কী করেন, তা অনুমান করা কঠিন।
কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ভাবভঙ্গি, চিন্তাভাবনায় ট্রাম্প যেন এক ‘দুর্বোধ্য’ প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পকে নিয়ে বিশ্বনেতারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে উদ্বিগ্ন। কূটনীতিবিদেরা বিভ্রান্ত। এ কারণে সবাই ট্রাম্পের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের দিকে সূক্ষ্ম নজর রাখছেন। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করছেন। গত ২০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসে রাজনীতি-কূটনীতির চিরচেনা নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করছেন ট্রাম্প। ওলট-পালট করা সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হচ্ছে। কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার, এমনকি সাধারণ মানুষের আলোচনায়ও থাকছেন ট্রাম্প। তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। বিশ্লেষণ থেকে ট্রাম্পের মনও বাদ পড়ছে না। মার্কিন রাজনীতিতে রুশবিরোধী মনোভাব প্রবল। অথচ নির্বাচনী প্রচারপর্ব থেকেই ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। ক্ষমতায় বসার আগেই গত বছরের ডিসেম্বরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলে চীনকে চটিয়ে দেন ট্রাম্প। এই ঘটনার পর ট্রাম্পের আমলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ তুঙ্গে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সেই ট্রাম্পই আবার সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখেছেন। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। ‘এক চীন’ নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র অটল থাকবে বলে তাঁকে জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প এমন সব কাণ্ডকীর্তি করছেন, যা আগের কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে করতে দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো মিত্রদের হুমকি, বড় বড় করপোরেশনকে ধমকি, সরকারি কর্মকর্তাদের চোখরাঙানির মতো কাজ ট্রাম্পকে করতে দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলের সঙ্গে ফোনালাপের সময় এক হাস্যকর কাণ্ড ঘটান ট্রাম্প। তিনি রেগে ফোন কেটে দেন। আবার মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েতোর সঙ্গে ফোনালাপেও ট্রাম্প রূঢ় আচরণ করেন। ইরানের সঙ্গে পাঁচ বিশ্বশক্তির সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি নাকচ করার কথা নির্বাচনী প্রচারের সময়ই বলেছিলেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসার পর ইরানের সঙ্গে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেছে। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জেরে দেশটির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তিনি। নির্বাহী আদেশে মুসলিমপ্রধান যে সাত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেন তিনি, তার মধ্যে ইরান অন্যতম।
ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বিচারকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর আরোপ করা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ায় সিয়াটলের এক বিচারককে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট বিচারককে ‘তথাকথিত বিচারপতি’ আখ্যা দিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তকে ‘হাস্যকর’ বলে বর্ণনা করেন ট্রাম্প। বিচারককে নিয়ে এমন মন্তব্যের পর সংবিধান ও বিচারপতিদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সানফ্রান্সিসকোর আপিল আদালতও ট্রাম্পের অভিবাসনসংক্রান্ত নির্বাহী আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ বহাল রাখেন। আপিল আদালতের রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেন ট্রাম্প। ঘোষণা করেন, ‘আদালতেই দেখা হবে।’ পরে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, ট্রাম্প নতুন নির্বাহী আদেশ জারি করবেন। এই ঘোষণার পরক্ষণই বলা হয়, ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। আবার আরেক ঘোষণায় জানানো হয়, ট্রাম্প নতুন আদেশ জারি করবেন, সুপ্রিম কোর্টেও যাবেন। ট্রাম্পের সঙ্গে গণমাধ্যমের ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক। তাঁকে নিয়ে বিপদেই আছে মার্কিন গণমাধ্যম। তিনি সাংবাদিকদের ‘অসৎ’ বলে গাল দিয়েছেন। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে বলেও জানিয়েছেন। তাঁর প্রধান উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন গণমাধ্যমকে ‘বিরোধী দল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের খবর লেখার কৌশল নিয়ে গণমাধ্যমকে ভাবতে হচ্ছে। নিন্দুকেরা ট্রাম্পকে ‘আত্মকামী’ বা ‘আত্মম্ভরি’ প্রেসিডেন্ট বলেন। তিনি সব সময় আলোচনায় থাকতে চান। থাকতে চান ‘এক নম্বরে’। অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন না। ট্রাম্পের আত্মবিনাশ দেখতেও অনেকে উন্মুখ। যে যেমনই ভাবুক বা বলুক না কেন, ট্রাম্প চলছেন ‘ট্রাম্পের মতো’। ‘আমেরিকা প্রথম’ স্লোগান ঢাল করে নানান সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। ট্রাম্পের মন বদলাতে সময় লাগে না। তাই তাঁর জামানায় ঠিক কী কী ঘটবে, এখনই তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি ও দ্য ইনডিপেনডেন্ট অবলম্বনে।
No comments