পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন হালদাপাড়ের জেলেরা
হালদা নদীর পাড়ে হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার জলদাশ পাড়া। এই জেলেপল্লিতে ৪২টি পরিবারের বসবাস। একটি পরিবারের প্রধান জহরলাল দাশ (৬৫)। হালদা নদীকে ঘিরেই তাঁর জীবনজীবিকা। তিন ছেলে তিন মেয়ের বাবা জহরলাল সাত বছর ধরে কার্যত বেকার। কখনো রিকশাভ্যান চালিয়ে কখনো বা দিনমজুরের কাজ করে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন তিনি।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পেশা পাল্টানোর আক্ষেপ তাঁর চোখে-মুখে। হালদা নদীতে মাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এতে জহরলালের মতো বেকার হয়ে পড়েছেন হালদার দুই পাড়ের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় দুই হাজার জেলে। ডিম সংগ্রহে বিধিনিষেধ না থাকলেও হালদায় মা মাছের সংখ্যা কমে গেছে। ফলে ডিমও আগের মতো মিলছে না। মাছ ধরতে না পেরে বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়েছেন তাঁরা। হালদা নদীতে মাছের প্রজনন ফিরিয়ে আনতে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জেলা মৎস্য কার্যালয়। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। এই প্রকল্প চলার সময়ে ২০০৭ সালে প্রথমে হালদা নদীর সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর ২০ কিলোমিটার, পরে ২০১০ সালে নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। মা মাছ রক্ষার জন্য হালদায় জাল ফেলা নিষিদ্ধ করা হলেও এ নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হয়নি—এ অভিযোগ জেলেদের। পেটের তাগিদে তাই অনেক জেলে রাতের আঁধারে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। গত সাত মাসেই হাটহাজারী মৎস্য কার্যালয় অভিযান চালিয়ে ৬০টি জাল ও ১টি নৌকা জব্দ করেছে।
জেলা মৎস্য কার্যালয় বলছে, প্রকল্পের আওতায় মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রায় দুই হাজার মৎস্যজীবীকে ঋণ হিসেবে দেড় বছরের জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে জনপ্রতি দুই মাসের জন্য ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। এই সহায়তা ২০১৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে ২০১৩ সাল থেকে চালের বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৬০ কেজি করে প্রতি পরিবারকে চাল দেওয়া হয়। এরপর চাল সহায়তাও বন্ধ হয়ে যায়। হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক ও বর্তমানে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপপরিচালক প্রভাতী দেব প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তারপরও জেলেদের ২০১৫ সালে চাল দেওয়া হয়েছে। আবারও তাঁদের চাল দেওয়া যায় কি না সে চেষ্টা করা হচ্ছে। হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাটহাজারীতে জেলেদের মোট ৬৬ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল তাঁরা দেড় বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ করে প্রয়োজনে পুনরায় ঋণ নেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।
গত মঙ্গলবার হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার জলদাসপাড়া ও গড়দুয়ারার সোনাইচরণ দাস পাড়ায় গিয়ে কথা হয় জেলেদের সঙ্গে। প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। জলদাশপাড়ার মৎস্যজীবী শ্রীধাম জলদাশ বলেন, কয়েক পুরুষ ধরে মাছ ধরাই ছিল তাঁদের একমাত্র পেশা। কিন্তু হালদায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তাঁর। রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম জেলেপাড়ার বাবুল জলদাশ আক্ষেপ করে বলেন, গত বছর ডিম ধরার মৌসুমে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা পেয়েছি। সারা বছর দিনমজুরি করে যে আয় হয় তাতে ছয়জনের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। ১০ হাজার টাকা ঋণ বা চাল বিতরণ জেলেদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনেনি বলে মনে করেন হালদা নদী রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে বরং জেলেদের ঋণের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এই টাকায় কিছুই করা সম্ভব নয়। জেলেদের তাঁদের পেশা থেকে পুরোপুরি সরিয়ে আনা উচিত নয়। হাটহাজারী এলাকায় সরকারের অনেকগুলো বড় বড় পুকুর আছে।
এগুলো জেলেদের লিজ দেওয়া যায়। তাঁরা সেখানে হালদার প্রকৃত পোনা চাষ করবেন। মাছ যখন পরিণত হবে, সরকার সেগুলো কিনে নিয়ে হালদায় ছাড়বে। এটা করা গেলে জেলেদের পুনর্বাসন ও হালদার মা মাছ বাড়ানো ও রক্ষা সবই সম্ভব। হালদার মাছের ডিম কমে যাওয়া যে শুধু জেলেদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে তা নয়, মৎস্যচাষিরাও ভুগছেন মন্দায়। হাটহাজারীর মধ্যম মাদার্শার আশু বড়ুয়া তিন পুরুষ ধরে মৎস্য চাষের সঙ্গে যুক্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর ৮টি নৌকা ও ১৬ জন জেলেকে নিয়ে রেণু সংগ্রহ করতে পেরেছি মাত্র ১ কেজি ৮০০ গ্রামের মতো। অথচ এর আগের বছরেও ৬ কেজির মতো রেণু পেয়েছিলাম। দিন দিন আমাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। দুই দশক আগেও বছরে ২২ থেকে ২৫ কেজি রেণু সংগ্রহ করতে পারতাম।’
No comments