গুলিস্তানে ফুটপাতের চাঁদা দৈনিক ২০–২৫ লাখ টাকা!
রাজধানীর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে হকার ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। দুই পক্ষের নেতা-কর্মী, হকার, পুলিশ ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে হকার উচ্ছেদ, দখল, পাল্টা দখল এবং এসব নিয়ে মামলা-হামলার নেপথ্যে রয়েছে এই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ।
তবে কোনো পক্ষই চাঁদাবাজির সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেনি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় ৪৫টির মতো ফুটপাতে ভাসমান হকার বসেন। এর মধ্যে ৩০টি ফুটপাত পড়েছে পল্টন থানায়, ১২টি মতিঝিল থানায় ও ৩টি শাহবাগ থানা এলাকায়। এসব ফুটপাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তালিকাভুক্ত হকার আছেন প্রায় আড়াই হাজার। তালিকার বাইরে কত হকার আছেন, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। হকারদের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫টি ফুটপাতে অন্তত ১০-১২ হাজার ভাসমান দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। চাঁদার হার গড়ে ২০০ টাকা করে হলে ৪৫টি ফুটপাত থেকে দিনে ২০ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদার এই টাকা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশ ও চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত লাইনম্যান এবং তাঁদের সহযোগীরা ভাগ করে নেন। জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক নেতা নামধারী কিছু চাঁদাবাজ ও সংশ্লিষ্ট থানার কিছু পুলিশ সদস্য ফুটপাতের চাঁদার টাকার ভাগ নেন৷ তাঁদের নির্ধারিত লাইনম্যানরা মাঠপর্যায় থেকে চাঁদা আদায় করেন। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬: ঢাকা মহানগরের যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ নামের এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৩০ কিলোমিটার। এসব ফুটপাতে প্রায় আড়াই লাখ হকার আছেন। তাঁদের কাছ থেকে বছরে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
এই অর্থ দুই সিটি করপোরেশনের বাজেটের প্রায় সমান। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত ৩০ জানুয়ারি। রাজধানীর ফুটপাতগুলোতে ইচ্ছেমতো কোনো হকার বসতে পারেন না। এ জন্য স্থানীয় রাজনীতিক, প্রশাসন ও প্রয়োজনে সিটি করপোরেশনের লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। এই অনুমতির একমাত্র মাধ্যম হলো ‘লাইনম্যান’। ফুটপাতের দোকানিদের নিয়ন্ত্রণ করা, চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের যোগাযোগে লাইনম্যান হলেন মাঠপর্যায়ের লোক। সাধারণত প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে চাঁদা তোলা হয়। হকার উচ্ছেদ নিয়ে দ্বন্দ্ব ডিএসসিসি এলাকায় হকার উচ্ছেদের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনের সূচনা হয় হাইকোর্টের একটি আদেশকে কেন্দ্র করে। ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই আদেশে জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত এলাকার ফুটপাত এবং রাস্তার ওপর থেকে দোকান তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে তা এত দিন কার্যকর হয়নি। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকের সভায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এলাকাভিত্তিক সাপ্তাহিক বাজার এবং হকারদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রকৃত হকার শনাক্ত করতে তাঁদের ছবি ও ভিডিও রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসসিসি গুলিস্তান এলাকার ২ হাজার ৫০৬ জন হকারের তালিকা করে। এই তালিকা নিয়েও হকারদের একটি বড় অংশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা। এতে করে হকাররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক পক্ষ বেশি সুবিধার আশায় ডিএসসিসির মেয়রের পক্ষ নেয়, আরেক পক্ষ কর্মহীন হয়ে পড়ার ভয়ে বিরোধিতা শুরু করে। এই পক্ষের সঙ্গে যোগ দেন লাইনম্যান ও চাঁদার টাকার সুবিধাভোগীরা। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ার ভয়ে এবং চাঁদাবাজদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলনের নামে হকারদের বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে। গত ২৬ অক্টোবর গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযান চালায় ডিএসসিসি। পরদিন আবার অভিযানে গেলে হকার ও লাইনম্যানদের সঙ্গে ডিএসসিসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় স্থানীয় ছাত্রলীগের একটি অংশ উচ্ছেদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করে। এরপর ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ১৫ জানুয়ারি থেকে গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় কর্মদিবসে সড়ক ও ফুটপাতে হকার বসা যাবে না। তবে কর্মদিবসে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর থেকে এবং সরকারি ছুটির দিনে সারা দিন হকাররা বসতে পারবেন। কিন্তু হকাররা তা না মেনে আন্দোলন করতে থাকেন। এর মধ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসির পক্ষ থেকে পল্টন, শাহবাগ ও মতিঝিল থানায় ৭২ জনকে আসামি করে তিনটি মামলা করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ মামলার ৭২ আসামির অধিকাংশই সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ২৫ জন বিএনপি, ছয়জন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত,
কজন গোয়েন্দা পুলিশের সোর্স হিসেবে নিজের পরিচয় দেন। জানতে চাইলে মামলা তিনটির তদন্ত কর্মকর্তারা (পল্টন থানার এসআই সুমেন কুমার বড়ুয়া, মতিঝিলের এসআই শফিকুল ইসলাম আকন্দ, শাহবাগের এসআই মাহবুবুল আলম) জানিয়েছেন, গত রোববার পর্যন্ত পল্টন থানায় দেলোয়ার হোসেন ভোলা নামের একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আন্দোলন ও মামলা এখন উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে বাংলাদেশ হকার্স সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে। হকারদের নিবন্ধিত আটটি সংগঠনের মধ্যে দুটি সংগঠনসহ ১৬টি সংগঠনের সমন্বয়ে এই পরিষদ গঠন করা হয়েছে। নিবন্ধিত অন্য সংগঠনগুলো বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে মেয়র সাঈদ খোকনের পক্ষ নিয়েছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, নিজেদের পছন্দমতো লোক নিয়ে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করতেই মেয়র এই পথ বেছে নিয়েছেন। আন্দোলনরত হকার্স ইউনিয়নের আহ্বায়ক আবদুল হাশেম অভিযোগ করেন, আন্দোলন বন্ধ করতেই ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। তিনি নিজেও এই মামলার আসামি। তবে মেয়র সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা ফুটপাত ও সড়কে দোকানপাট বসিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন৷ এর বাইরে আরও লাইনম্যান নামের চাঁদাবাজ রয়েছেন৷ পুলিশ তদন্ত করে মামলায় তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেও হকার ও লাইনম্যান সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি হকারদের হাত থেকে চাঁদা নেন না। তবে লাইনম্যানদের সংগ্রহ করা চাঁদার ভাগ পায় পুলিশ।
এক সপ্তাহ পর পর সাত দিনের ভাগের টাকা লাইনম্যানদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে দিয়ে আসা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তারা বিশ্বস্ত ব্যক্তির মাধ্যমে ভাগের টাকা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে হকার্স লীগের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এক অভিযোগে বলা হয়, লাইনম্যানের মাধ্যমে ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ২০০ টাকা দৈনিক চাঁদা আদায় করা হয়। যার একটি অংশ কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা নেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযোগের তদন্ত করা হয়। কিন্তু ঘটনা সত্য নয় বলে তারা প্রতিবেদন দেয়। এদিকে গত বছরের এপ্রিলে নিউমার্কেট হকারদের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে অভিযোগ করে বলা হয়, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, সায়েন্সল্যাব ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটসহ ছয়টি এলাকার ফুটপাত থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পরিচয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদার একটি অংশ নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার, নিউমার্কেট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনারসহ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন। জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিযোগ সম্পর্কে তিনি জানেন না। তবে পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে তদন্ত করা হয়।
তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, জিপিও, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, দিলকুশা, মতিঝিল এলাকার মূল ফুটপাতগুলো পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯, ১৩ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডে। অভিযোগ রয়েছে, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা কে এম মমিনুল হক ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কর্মীরা চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত। জানতে চাইলে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি বা তাঁর কোনো কর্মী চাঁদার টাকা নেন না। তবে মাঠপর্যায়ে কাজ করা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা দৈনিক ৪ হাজার ২০০ টাকা করে ভাগ পান। এ কারণেই অন্যদের নামে বদনাম হয়। আরেক কাউন্সিলর কে এম মমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিজ উদ্যোগে তিনি উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদার ভাগ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। একসময় স্থানীয় কিছু অসাধু নেতা-কর্মী চাঁদার ভাগ নিতেন। এখন লাইনম্যানরাই বড় রাজনীতিবিদ, তাঁদের সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে কাউকে ভাগ দিতে হয় না।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের শিক্ষক ও ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক গবেষণা দলের প্রধান শাহনেওয়াজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো চক্রের মদদ ছাড়া ফুটপাতে হকার বসতে পারেন না, এটাই বাস্তবতা। হকাররা এই চক্রকে যে চাঁদা দেন, তা গুলশান-বনানীর ভাড়ার চেয়েও বেশি। কাজেই মেয়র চাইলেও হকার উচ্ছেদ করতে পারবেন না। তবে এ পরিস্থিতিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে, যানজটের সৃষ্টি হবে এমন জায়গায় হকারদের বসতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে হকারেরা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে বৈধভাবে নির্ধারিত জায়গার বরাদ্দ নেবেন। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি হকারদের নিয়ন্ত্রণে লাইনম্যান বা পুলিশ সদস্যদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে। ফুটপাত থেকে আয়ের একটি অংশ করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাঁরাও পেতে পারেন।
No comments