একটি ইশতেহার ও একটি ধর্মঘট
একুশের প্রস্তুতি পর্বে ১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলনের উত্তাপ বহন করে পরবর্তী প্রতিটি বছর, অর্থাৎ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১। সেসব ঘটনার কোনোটি বড় (যেমন মূলনীতিবেরাধী আন্দোলন), কোনোটি একেবারে সাদামাটা কিন্তু তাৎপর্য ছোট নয়। আবার কোনোটির চরিত্র সাংগঠনিক—যেমন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠন (১৯৫১ মার্চ)। এই সংগঠন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
তেমনি একটি ইশতেহার ও একটি স্মারকলিপির গুরুত্বও অগ্রাহ্য করার মতো ছিল না। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও নানান পেশাজীবী, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের তরফ থেকে ‘অবিলম্বে পূর্ববঙ্গে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের’ দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. কাজী মোতাহার হোসেনসহ দেশের বিশিষ্টজনের স্বাক্ষর ছিল এই স্মারকলিপিতে। এর পাশাপাশি ১৯৫১ সালে ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন কর্মসূচি হিসেবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ সব শিক্ষায়তনে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। এই ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য, ‘বন্ধুগণ,...আসুন ১১ই মার্চ নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে পুনরায় লৌহদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করি।’ এই আহ্বানে ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে দিবসটি ব্যাপক প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে পালিত হয়। নারায়ণগঞ্জ এদিক থেকে ঢাকার পরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্রদের হরতাল-মিছিলের পর ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ঢাকা থেকে একাধিক ছাত্র-যুব নেতা যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেখ মুজিবুর রহমান ও মোহাম্মদ তোয়াহা। মূলত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের আগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় উর্দুবাদীদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা, প্রচার ও চাপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার পক্ষে কর্মতৎপরতা সমাজে যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। মধ্যপন্থী বা নিরপেক্ষ শিক্ষিত বিশিষ্টজন অনেকে বাংলার পক্ষে সোচ্চার হতে থাকেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৬ মার্চ (১৯৫১) কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত অধ্যাপকদের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে কোনো ধরনে রাখঢাক না করে বলেন, ‘বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতো পণ্ডিতপ্রবরের এমন বলিষ্ঠ উক্তির গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাংলাদেশে ‘মীরজাফরি বদরক্তের’ ধারকদের তো অভাব ছিল না। তাই ১৯৫১ সাল যখন প্রতিবাদে অগ্নিঝরা হয়ে ওঠে, তখনো কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট বাঙালি উর্দুর পক্ষে তদবির করতে থাকেন। যেমন ১৫ এপ্রিল (১৯৫১) করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান উর্দু সম্মেলনে মওলানা আকরম খাঁ সভাপতির ভাষণে উর্দুর পক্ষে এতটা জবরদস্ত ওকালতি করেন যে এর প্রতিবাদ ছিল তাৎক্ষণিক। পাকিস্তান অবজারভার ১৮ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে কড়া ভাষায় মওলানার ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে এই বলে যে ‘রিপোর্ট অনুযায়ী মওলানা আকরম খাঁ উর্দু সম্মেলনে বলেছেন যে পূর্ব বাংলায় যারা উর্দুর বিরোধিতা করে, তারা ইসলামের শত্রু। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে তিনি এই শত্রুদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতো (ব্যক্তিকেও) অন্তর্ভুক্ত করবেন।’ রাষ্ট্রভাষাকে ঘিরে এমন এক বাদ-প্রতিবাদমূলক পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৫১ সাল শেষ হয়। আগেই বলা হয়েছে, বছরটি একুশের বিস্ফোরক প্রকাশে, অর্থাৎ এর প্রস্তুতি পূর্বে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছিল। এ বছর অনুঘটক শক্তিসম্পন্ন ঘটনার সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। এভাবে তৈরি হয় একুশের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ এবং আন্দোলন দানা বাঁধার ক্ষেত্র।
No comments