লোকবল কম, তদন্ত–বিচারে ধীরগতি
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও বিচার চলছে ধীরগতিতে। ছয় বছরে ৯৬১টি মামলা হলেও তদন্তকাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪৫টির। রায় হয়েছে ২৭টি মামলার। এর মধ্যে ছয়জন শীর্ষ অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২৮। বিচারাধীন আছে ৮টি। এ ছাড়া আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ১৬টি, আসামি পলাতক থাকায় ৫টি মামলায় আপিল হয়নি, ২টিতে আপিল চলাকালে আসামির মৃত্যু ঘটেছে। তদন্তের এই ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কারী এম এ হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, লোকবলের অভাবের কারণে মামলার তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে সংস্থায় ২৩ জন তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এঁদের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তা ১৭ জন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হলেও তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়। এরপর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে উচ্চ আদালত কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিলে উচ্চ আদালত দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। উচ্চ আদালত আরও যে পাঁচ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেন, তাঁরা হলেন জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
বর্তমানে বিচারাধীন মামলার আসামিরা হলেন সৈয়দ মো. হুমাউন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নিয়ামত হোসেন (হবিগঞ্জ), আবু ছালেহ মো. আজিজ মিয়া (গাইবান্ধা), আলবদর কমান্ডার সরকার শামসুল হক (মৌলভীবাজার), আকমল আলী তালুকদার (মৌলভীবাজার), আমির আহমেদ (নোয়াখালী), এম এ হান্নান (ময়মনসিংহ) ও রিয়াজ উদ্দিন ফকির (ময়মনসিংহ)। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ও পঞ্চম মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। একটি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ ছিল ৩১ জানুয়ারি এবং আরেকটির পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাংসদ মোসলেমউদ্দিনের (ময়মনসিংহ) বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে একটি মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কোনো সাংসদের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম মামলা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে, কিন্তু বিচারকাজ শুরু হয়নি এমন মামলার সংখ্যা ১০। এর মধ্যে ব্যক্তি বাদে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীও রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করলেও রাষ্ট্রপক্ষ এখন পর্যন্ত আদালতে তা দাখিল করেনি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সরকার আইনের মাধ্যমে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে এ রকম ঘোষণা দেওয়ায় মামলাটি ঝুলে আছে। অন্যদিকে তদন্তাধীন পাঁচটি মামলার আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় আদালতে বিচারকাজ চলছে। তদন্তাধীন মামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন গিয়াস কাদের চৌধুরী, মেজর (অব.) মোহাম্মদ ওবায়দুল হক। রাজনগরের আলবদর কমান্ডার শামসুল হকের তদন্ত প্রতিবেদন গত ২০ অক্টোবর দাখিল করা হলেও তিনি পলাতক আছেন। জাতীয় পার্টির সাংসদ এম এ হান্নান ও তাঁর ছেলে মো. কবির সাজ্জাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে গত বছরের ১৭ জুলাই। তদন্ত সংস্থা যেসব মামলা আমলে নিয়েছে,
তার মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২০১টি এবং রংপুর বিভাগে সর্বনিম্ন ৩৩টি মামলা রয়েছে। অন্যান্য বিভাগে মামলার সংখ্যা যথাক্রমে ঢাকায় ৬৯, চট্টগ্রামে ১০২, রাজশাহীতে ৭৩, সিলেটে ৬৬, বরিশালে ৬৪, ময়মনসিংহে ৮৩। এসব মামলায় মোট আসামি ৩ হাজার ৬৬৩ জন। এত বিপুলসংখ্যক মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, জানতে চাইলে প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা এম এ হান্নান বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেলে প্রথমেই অপরাধের মাত্রা বিচার করি। আমরা এমন কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিইনি, যাতে আসামিরা খালাস পেতে পারেন।’ আওয়ামী লীগের সাংসদ মোসলেমউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে করা এই মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতের কাছ থেকে তদন্তের নির্দেশ পেলে তদন্তকাজ শুরু হবে। মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির মনে করেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে অবিলম্বে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালটি চালু হওয়া প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ড. তুরিন আফরোজ বলেছেন, কেবল ট্রাইব্যুনাল বাড়ালে হবে না, সেই সঙ্গে আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাও বাড়াতে হবে।
No comments