হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে বিস্ফোরকের বিচার চলছে
আট বছর পেরিয়ে গেল বিডিআর বিদ্রোহের। দেশের ইতিহাসে কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীতে এমন মর্মন্তুদ রক্তস্নাত বিদ্রোহের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটেছিল এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। সেদিন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। এত দিনে পিলখানার দরবার হল থেকে মুছে গেছে গুলির চিহ্ন। শোকের কোনো চিহ্নও সেখানে নেই। কিন্তু স্বজনহারাদের হৃদয়ের যে ক্ষত, তা এখনো শুকায়নি। আট বছর পেরিয়ে গেলেও এই বিদ্রোহ নিয়ে মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন রয়েছে তার পরিষ্কার কোনো জবাব এখনো মেলেনি। বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে জওয়ানদের নানা ক্ষোভের কথা বলা হলেও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট হয়নি সাধারণ মানুষের কাছে। বিডিআর বিদ্রোহের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছিল। দুটি কমিটিই বলেছিল, তারা এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এ দুটি কমিটি এ ঘটনার তদন্ত ও ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুই কমিটির অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাহিনীর নিজস্ব আইনের পাশাপাশি ফৌজদারি আইনে দুটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি এখন শেষ পর্যায়ে আছে। তবে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে করা মামলাটির বিচার এখনো শেষ হয়নি, মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়েই রয়ে গেছে। বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ মোড় নিয়েছে নানা দিকে। পুরো বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়েছে, নামও বদলেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি নামে নতুন আইনে চলছে বাহিনীর কার্যক্রম। বিদ্রোহের ঘটনায় গত আট বছরে ১০ হাজার ৮৭৮ জওয়ানের শাস্তি হয়েছে।
তাঁদের মধ্যে ৬ হাজার জওয়ানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অভিযুক্ত জওয়ানদের ৮৫০ জনের বিচার হয়েছে ফৌজদারি আদালতে। বিদ্রোহের পর যে ২১ জন জওয়ান পলাতক ছিলেন, তাঁদের মাত্র ১ জন ধরা পড়েছেন। বাকি ২০ জন এখনো পলাতক আছেন। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিচারিক আদালতে ১ হাজার ৩০২ জন সাক্ষীর মধ্যে বিগত বছরে ৫০ জনের সাক্ষ্য জেরা শেষ হয়েছে, বাকি রয়েছে ১ হাজার ২৫২ জন। আর দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় এই মামলায় (হত্যা) তিন সদস্যের হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর আইনি যুক্তি উপস্থাপন চলছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৫৯ দিনের (কার্যদিবস) মতো শুনানি হয়। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি হয়। চলতি বছর এই মামলার বিচার শেষ হবে বলে আশা করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্র ও বিস্ফোরক মামলার বিচার নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই হত্যা মামলার বিচার আগে নিষ্পত্তি হয়েছে। এই মামলার বিচার পরে শুরু হয়েছে। এ মামলায় ৮৩৪ জন আসামি রয়েছে। এদের অধিকাংশই হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলায় মোট সাক্ষী ১ হাজার ৩০২ জন। এর মধ্যে ৫০ জনের সাক্ষ্য জেরা শেষ হয়েছে। আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য আছে। বাকি ১ হাজার ২৫২ জনের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে কমিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। বিচার হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে। বিচার শেষে ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দীন আহাম্মেদ পিন্টু (প্রয়াত), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়। রায়ের পর ১৫২ জনের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, রায়ের পর বিভিন্ন সময়ে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা পৃথক ১১৯টি আপিল করেন। জেল আপিল করেন ১৪১ জন। আর ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। বিশেষ ব্যবস্থায় এই মামলার পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) ৩৬ খণ্ডে ৩৬ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক তৈরি করা হয়।
পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। এরপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে হাইকোর্টে এ মামলার শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, এ মামলার আসামিদের মধ্যে ইতিমধ্যে ১৫ জন আসামি মারা গেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ের আগে চারজন আসামি মারা যান। বিচারিক আদালতের রায়ের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ১১ আসামি মারা যান। এদিকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলার বিচার চলছে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লার আদালতে। এই মামলায় আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। সূত্র জানায়, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের সাজা হয় অধিনায়কদের সামারি ট্রায়ালে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রত্যেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন।
কর্মসূচি: বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এই দিনটি শাহাদতবার্ষিকী হিসেবে পালন করবে। এ দিন বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর কোরআন খতম এবং বিজিবির সব মসজিদে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করা হবে। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল নয়টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্রসচিব, বিজিবির মহাপরিচালক স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কাল (২৬ ফেব্রুয়ারি) বাদ আসর পিলখানায় বীর উত্তম ফজলুর রহমান মিলনায়তনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এতে উপস্থিত থাকবেন। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সকাল সাড়ে ১০টায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।
No comments