গড়ে প্রতিদিন একটি শিশু খুন
এ বছরের প্রথম দেড় মাসে (১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সারা দেশে বিভিন্নভাবে ৪৫ শিশু খুন হয়েছে। গত বছরের প্রথম দুই মাসে শিশু হত্যার সংখ্যা ছিল ৪৮। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা বলছে, চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসে ৪২ শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অপর দুটি সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শিশুদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গত বছর (২০১৬) তিন শতাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ওই সময়ের মোট ধর্ষণের ঘটনার প্রায় অর্ধেক। ধর্ষণের শিকার শিশুদের অর্ধেকেরই বয়স ১২ বছরের নিচে। এদের মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশুও রয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও বাড়ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। চলতি মাসে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি অপহরণ চক্র ধরা পড়ার পর উদঘাটিত হয়, সাম্প্রতিক সময়ে তারা ১৭টি শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। শিশু ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে সাজা কার্যকর করতে পারলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। ২৬৯টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ১০টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে শিশু হত্যার পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। তাদের হিসাবমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২৭ শিশু এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ শিশু খুন হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন একটি করে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ শিশু খুন হয়। নিখোঁজের পর শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেশি ঘটছে। দেড় মাসে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১৭টিতে। আর গত বছর প্রথম দুই মাসে এই সংখ্যা ছিল ১০। এরপরই আছে বাবা-মায়ের হাতে শিশু খুনের ঘটনা। দেড় মাসে সংখ্যাটি ৭ জনে পৌঁছে গেছে। গত বছরের এই দুই মাসে তা ছিল ১০টি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বাবা-মায়ের কাছে শিশুরা সব থেকে নিরাপদ থাকবে, এটা স্বাভাবিক কথা। কিন্তু এখন বাবা-মায়ের হাতেও শিশুরা খুন হচ্ছে। এগুলো কোনো স্বাভাবিক বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। একক কোনো মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর বিষয়ে কোনো সমাধান দিতে পারে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রয়াস থাকাটা জরুরি। নাছিমা বেগম বলেন, শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছিল। আসামিদের দ্রুত ফাঁসির রায় হলো। রায় কার্যকর হয়ে গেলে মানুষ ভয় পেত। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৬ সালে মোট ধর্ষণের ঘটনা ৭২৪টি। এর মধ্যে ৩০৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫৭টি শিশুর বয়স ১২ বছরের কম। ৬ বছরের নিচে আছে ৪৬টি শিশু। আটটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে। শিশুবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যমতে, গত বছরের বছরের প্রথম ১১ মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা চার শতাধিক, যার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৪টি শিশু।
ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ শিশুর বয়স ৪ থেকে ৯। ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫২১টি। শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, অপহরণের পর হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, রাজনৈতিক বা পারিবারিক দ্বন্দ্ব, খেলা নিয়ে সংঘর্ষ, জমিসংক্রান্ত ও অন্যান্য বিরোধের জের, যৌতুকের কারণসহ বিভিন্ন কারণে শিশুরা খুন হচ্ছে। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত শিশু খুনের ঘটনা পর্যালোচনা করেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড়দের দ্বন্দ্বে পরিবারের শিশুটিকে হত্যার জন্য টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। জানুয়ারি মাসে কক্সবাজারের চকরিয়ার দরবেশকাটা এলাকায় রশিদুল ইসলাম নামের সাত বছরের এক শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুটির এক নিকটাত্মীয় রিদুয়ানুল হককে এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, পারিবারিক দ্বন্দ্বে তিনি কুপিয়ে শিশুটিকে আহত করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। অপরদিকে ১২ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জে সুমাইয়া খাতুন (৭) ও মেহজাবিন আক্তারকে (৬) হত্যা করা হলে অভিযোগ ওঠে প্রতিবেশী লাকী আক্তারের বিরুদ্ধে। ২১ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীতে তিন ভাইবোন খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন মেজ ভাই রুবেল মিয়া। বড়দের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সম্প্রতি শিশুদের হাতে শিশু হত্যা একটি নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবীর খুনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, তাদের একজনের বয়স ১৩ ও অন্যজনের ১৬ বছর। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সমাজে শিশু হত্যা চলছেই। দেড় মাসে প্রায় দিনে গড়ে একটি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। বছর শেষে এ চিত্র কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধের শিকার হওয়া পরিবারের মধ্যে আইনি সহায়তা নেওয়ার ব্যাপারে হতাশা দেখা দেয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা যেকোনো কারণে পরিবারের শিশুটিকে অপহরণ করা হচ্ছে। বাবা-মা সন্তানকে খুন করে ফেলছেন। সর্বত্র সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাবা, মা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে অবশ্যই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ইভ টিজিং বা অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ধরনের আন্দোলন হয়েছিল, সে ধরনের আন্দোলন প্রয়োজন।
No comments