হঠাৎ আলোচনায় কাদের খান!
খুনের দায়ে দশম সংসদের একজন সাংসদ এবং নবম সংসদের একজন সাবেক সাংসদ অভিযুক্ত। টাঙ্গাইল-৪ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা আমানুর রহমান কারাগারে আছেন তাঁর দলের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যার দায়ে। তাঁর অপর তিন ভাইও এই মামলার আসামি। তাঁরা কেউ বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর লোক নন, ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের সাবেক ও বর্তমান সাংসদ।
দুজনের বিরুদ্ধে আরও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আছে। আর গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন সেই আসনের সাবেক সাংসদ ও জাতীয় পার্টির নেতা আবদুল কাদের খান। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার বলেছেন, ‘রিমান্ডে থাকা কাদের খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার রাতে সুন্দরগঞ্জের ছাপারহাটিতে তাঁর গ্রামের বাড়ির উঠানের মাটি খুঁড়ে একটি পিস্তল, ছয়টি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্রটি সাংসদ হত্যায় ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। এটা পরীক্ষা করে দেখা হবে।’ (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) ‘গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় কাদের খানের গ্রামের বাড়ির উঠান খুঁড়ে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। গত বুধবার ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয় আনারুল ইসলাম ওরফে রানা (২৭) নামের আরেক সন্দেহভাজনকে। তাঁর বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ভেলারার কাজীরভিটা গ্রামে। রানা বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ নিয়ে সাংসদ মনজুরুল হত্যার ঘটনায় চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন কাদের খানের গাড়ির চালক।’ গত ৩১ ডিসেম্বর সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
আওয়ামী লীগের নেতারা তখন জামায়াতে ইসলামীকেই অভিযুক্ত করে আসছিলেন। সন্দেহভাজন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের ১১০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এ কথার অর্থ এই নয় যে তারা নির্দোষ, কালিমামুক্ত। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে যে জামায়াত-শিবির দেশজুড়ে সন্ত্রাস চালিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে, তাও সবার জানা। যেসব অপরাধ তারা করেছে বা করছে আমরা নিশ্চয়ই তা বলব। কিন্তু তথ্য–প্রমাণ ছাড়া সব ঘটনায় জামায়াত-শিবিরকে টানলে তারাই সুবিধা পেয়ে যাবে। সম্প্রতি কানাডার আদালত বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ দিলেও জামায়াত সম্পর্কে কিছু বলেননি। ঘটনার এক মাস ২০ দিনের মাথায় মামলার তদন্তে ঘটনার নাটকীয় মোড় নেয়। হঠাৎ আলোচনায় আসেন সাবেক সাংসদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আবদুল কাদের খান। গত মঙ্গলবার বগুড়া শহরের বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মনজুরুল ইসলাম যে আসনের সাংসদ ছিলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ওই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মনজুরুলের একসময়ের একান্ত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, জেলা পরিষদের এক কোটি টাকার একটি বরাদ্দ নিয়ে মনজুরুলের সঙ্গে কাদের খানের বিরোধ তৈরি হয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর। নির্বাচনের আগে ওই এক কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। কাদের খানের দাবি, এই টাকা তিনি সাংসদ থাকাকালে বরাদ্দ এনেছেন, তিনিই এর দাবিদার। তিনি ১৭ লাখ টাকা উত্তোলনও করেন, কিন্তু কোনো কাজ করেননি। তখন এ নিয়ে জেলা পরিষদে আপত্তি দেন সাংসদ মনজুরুল। এরপর প্রকল্পের বাকি টাকা তোলার জন্য আবেদন করেন কাদের খান; কিন্তু আপত্তির কারণে তুলতে পারেননি। তখন এ নিয়ে একটি প্রকল্পের সভাপতিকে দিয়ে আদালতে মামলা করান কাদের খান। ওই সভাপতি হলেন কাদেরের আত্মীয়। শেষ পর্যন্ত বাকি টাকা আর কেউ তুলতে পারেননি। (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ নিয়ে সাবেক ও বর্তমান সাংসদের বিরোধ থাকতে পারে। এ নিয়ে কেউ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।
তাই বলে খুনখারাবি কেন ঘটবে? কেন ভাড়াটে খুনিদের হাতে জীবন দিতে হবে একজন জনপ্রতিনিধিকে? কাদের খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর মনজুরুল হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কুৎসিত দিকটিও উন্মোচিত হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দাবি করেছেন কাদের খান জাতীয় পার্টি করেন না বা সম্পর্ক নেই। কাদের খান জাতীয় পার্টি না করলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন কীভাবে? কীভাবে তিনি দলের মনোনয়ন পেলেন? এসব কথা তিনি কাদের খান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে কেন বললেন না? পুলিশের দাবি অনুযায়ী, কাদের খান এক বছর ধরে সাংসদ মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আগামী নির্বাচনে নিজের পথ পরিষ্কার করতেই নাকি তিনি এটি করেছিলেন। ইতিমধ্যে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তাতে পুলিশের দাবিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যায় না। পত্রিকার প্রতিবেদন মতে, সাংসদ মনজুরুল হত্যার পর টেলিফোনে আড়ি পেতে আরও একজনকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। সেই সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে জাতীয় পার্টির নেতা কাদের খানের নাম। পুলিশের মহাপরিদর্শক গত বুধবার চট্টগ্রামে বলেছেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যার পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খান। তাঁর ইচ্ছে ছিল মনজুরুলকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করে পরবর্তী সময়ে সাংসদ হবেন। গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কাদের খান তাঁর নামে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি শটগান লোক মারফত থানায় জমা দেন। এর মধ্যে পিস্তলের ম্যাগাজিন খোয়া গেছে বলে জানান।
পুলিশ জানতে পারে, তাঁর নামে ৫০টি গুলি ইস্যু করা থাকলেও ৪০টির হদিস নেই। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি কাদেরের গাড়িতে করে যাওয়ার পথে সুন্দরগঞ্জ থেকে মেহেদী হাসান, শাহিন মিয়া ও কাদেরের গাড়িচালক হান্নানকে আটক করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তারা বলেন, মনজুরুল হত্যার ছয়-সাত মাস আগে থেকে, অর্থাৎ মে মাসের দিকে কাদের খান তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেন, ‘পথের কাঁটা লিটনকে সরিয়ে দিতে হবে।’ মেহেদী জবানবন্দিতে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন আগে তাঁরা মনজুরুলের গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ছাপারহাটির একটি ধানের চাতালে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি, শাহিন ও রানা থাকতেন। কাদের খানের গাড়িচালক হান্নান তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ওই চাতালে থাকার সময় তাঁরা নিয়মিত অস্ত্র চালানোর চর্চা করতেন। মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে তাঁরা কয়েক দিন ওই এলাকায় রেকি করেন। একদিন কাদের খানও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। শাহিন জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন তিনি ও মেহেদী গাইবান্ধা শহরে ছিলেন। কাদের খান তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গাড়িতে করে শহর থেকে তুলে নেন আর রানাকে নেন কদমতলা থেকে। বিকেল চারটার দিকে তাঁরা কাদেরের দেওয়া মোটরসাইকেলে করে মনজুরুলের গ্রামের বাড়িতে যান। তিনজনের হাতে তিনটি অস্ত্র ছিল। প্রথমে রানা ও তিনি মনজুরুলের বাড়িতে ঢোকেন। এরপর মেহেদী ঢুকেই গুলি শুরু করেন। খুনের পর তাঁরা কাদেরের বাড়িতে যান। শাহিনের ভাষ্যমতে, খুনের জন্য তাঁদের সাত লাখ টাকা দেওয়া হয়। তিনি ও রানা দুই লাখ করে ও মেহেদী তিন লাখ টাকা নেন। কথা ছিল, কাদের সাংসদ হলে তাঁদের একটি পেট্রলপাম্প করে দেবেন। আসামিদের এই জবানবন্দি গোয়েন্দা উপন্যাসকে হার মানায়। একজন সাবেক সাংসদ, যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি কীভাবে আরেকজন সাংসদকে হত্যা করতে ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করতে পারেন? পুলিশের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যারা সাংসদ মনজুরুলকে হত্যা করেছে, কাদের খান তাদের ওই আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া ব্যারিস্টার শামিম হোসেন পাটোয়ারিকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যার বিচার চলছে। সেখানে আসামি সাংসদ আমানুরের পক্ষে আওয়ামী লীগের কোনো আইনজীবী না দাঁড়ালেও বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক আইনজীবীরা তাঁর পক্ষে লড়ছেন। যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। এটি যেমন সত্য, তেমনি কেন সেখানকার আওয়ামী লীগ-সমর্থক আইনজীবীরা আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদের মামলা পরিচালনা করছেন না, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আইনজীবীদের মাঝেমধ্যে এ রকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সাত খুনের ঘটনায়ও প্রথমে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তাদের কোনো সদস্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে দাঁড়াবেন না। সেই হত্যার অন্যতম শিকার চন্দন সরকার ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সদস্য।
পরে সমিতির নেতৃত্বে পরিবর্তন এলে আইনজীবীরা তাঁদের ওয়াদা রাখতে পারেননি। ফারুক হত্যার আসামি সাংসদ আমানুর জেলখানায় বসে ছাত্রলীগ নেতা আবু শহীদ রুবেলকে হত্যার জন্য সমর্থকদের লেলিয়ে দেন বলেও পত্রিকায় খবর এসেছে। তাঁর ‘অপরাধ’ তিনি ফারুক হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। রুবেলেরও ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয় এবং তিনি বেঁচে থাকলেও পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। মনজুরুল হত্যার রহস্য উন্মোচিত হওয়ায় হয়তো উপনির্বাচনের প্রার্থী শামিমও বেঁচে গেলেন। কিন্তু নির্বাচন ও রাজনীতির নামে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে কী? বিচারাধীন বা তদন্তাধীন মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ও সাংসদ মনজুরুলের খুনি কে বা কারা, সেটি আদালতই নির্ধারণ করবেন। বহু বছর আগে প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন। দেশে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি যে নেই তা আমরা হরহামেশাই দেখতে পারছি। তুচ্ছ কারণে কেউ সন্ত্রাসীদের, কেউ ক্ষমতাধরদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছেন। আবার অনেক নিরীহ মানুষ কথিত বন্দুকযুদ্ধের কবলে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। কিন্তু হালে দেখা যাচ্ছে, একজন সাংসদ কিংবা মুক্তিযোদ্ধার জীবনও নিরাপদ নয়। এর প্রতিকার কী। এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনুন। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মদদ দেওয়া বন্ধ করুক। অন্যথায় সাধারণ মানুষ কিংবা ভিআইপি—সবাইকে খুনির বুলেট তাড়িবে বেড়াবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments