গণতন্ত্র: সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দুর্বোধ্য শব্দ

এই সময়ে আমাদের রাজনীতির উঠোনে সবচেয়ে ব্যবহৃত, জনপ্রিয় ও দুর্বোধ্য শব্দ হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, খবরের কাগজের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের আলোচনায় প্রতিদিন ‘গণতন্ত্র’ লেখা ও বলা হয় হাজার বার। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আছে নানা মত ও বিরোধ। আছে তর্ক ও ঝগড়া। এর মীমাংসা কীভাবে হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না, জানি না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়তো এর চটজলদি উত্তর খুঁজবেন পশ্চিমের কোনো পণ্ডিত অথবা রাজনীতিকের কাছে। হয়তো জাঁ জাক রুশো, আব্রাহাম লিংকন কিংবা উইড্রো উইলসনের উদ্ধৃতি দিয়ে জবাব দেবেন। তাতে কতটুকুই-বা বোঝা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ শব্দ দুটো বেশ চাউর হয়েছিল। বিশ শতকের মধ্যভাগে ‘সমাজতন্ত্রের’ জনপ্রিয়তার গ্রাফ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তখন বলা হতো, সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের উচ্চতর রূপ। কোনো কোনো দেশ তার নামের সঙ্গে বাহারি সব শব্দ জুড়ে দিত, যাতে নামেই বোঝা যায় দেশে কোন ধরনের তন্ত্র আছে। উদাহরণ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার কথা বলা যায়। দেশটির কাগুজে নাম হলো ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া। ওই দেশে কয় ছটাক ডেমোক্রেসি আছে বা কয় ডজন পিপল নীতিনির্ধারণে অংশ নেয়, তা এত দিনে আমাদের জানা হয়ে গেছে। গালভরা বুলি কপচে যতই তন্ত্রমন্ত্রের গুণগান করা হোক না কেন, তা যে আসলেই কত ঠুনকো, অন্তঃসারশূন্য, তা এ ধরনের দেশের হালচাল দেখলেই বোঝা যায়। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের কাছের দেশ শ্রীলঙ্কা। পোশাকি নাম হলো ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলঙ্কা। বাইরে থেকে আমরা অনেকেই ওই দেশের ভেতরের খবর জানি না বা রাখি না।
ওই দেশের অনেক নাগরিক মনে করেন ওখানে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সমাজতন্ত্র তো নির্বাসনে গেছে অনেক আগেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মানবাধিকারের রেকর্ড তলানিতে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাই সবার আগে বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। ঋণের ভারে দেশটি অনেকটাই নুইয়ে পড়েছে। একসময় অনেক দেশেই রাজা-রানিদের শাসন ছিল। এখন অবস্থা বদলেছে। অবশ্য আরব দেশগুলোতে এখনো রাজা-বাদশাহরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে রাজা-রানিরা অলংকারমাত্র। প্রজাতন্ত্র হলেই যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেখানেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন জারি থাকতে পারে, যেমনটি  আমাদের দেশেও দেখেছি। তারপরও আমরা শব্দ-অনুগত প্রাণ। সংবিধানে কোন শব্দটি আছে বা নেই, কোনটা ঢুকল বা বাদ পড়ল, তা নিয়ে আমরা তুলকালাম করি। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরম পবিত্র শব্দরাজির ব্যবহার দেখলাম। ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’ হিসেবে পেলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই শব্দগুলোর অর্থ বোঝেন কি না বা ব্যাখ্যা জানেন কি না, তা নিয়ে আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। তারপরও আমরা এই শব্দগুলো নিয়ে কতই-না হইচই করি, হাঙ্গামা বাধাই। কথা হচ্ছিল ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে। আমার মতে, ‘গণতন্ত্র’ থাকলে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা জাতীয়তাবাদ শব্দগুলো বাহুল্য মনে হয়। গণতন্ত্র যদি সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে, তাহলে সামাজিক ন্যায্যতা বা ন্যায়বিচার আপনাআপনি চলে আসে। গণতন্ত্র থাকলে ধর্মের ভিত্তিতে পক্ষপাত কিংবা বৈষম্য থাকার কথা নয়। জাতীয়তাবাদ তো যেকোনো জাতি-রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ।
মানুষ বলতে এর সঙ্গে দুই কানওয়ালা বা দুপেয়ে মানুষ বলার দরকার হয় না। তেমনি গণতন্ত্র বোঝাতে অন্য বিশেষণগুলো টেনে আনার দরকার কী? তারপরও আমরা এই চারটি শব্দকে রাষ্ট্রের স্তম্ভ হিসেবে ধরে নিই, কাগজে-কলমে। বাস্তবে তা আছে কি নেই, থাকলে কতটুকু আছে, তার হিসাব করি না। রাষ্ট্রের জন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সরকার তার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করে। দেশের দেখভালের ঠিকাদারিটা কালপরম্পরায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বর্তায়। ঠিকাদারি পেলে তারা মহা গণতান্ত্রিক। না পেলে তারা গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও দেখে না। এই পরস্পরবিরোধী দাবির মধ্যে পড়ে আমজনতা চিড়ে-চ্যাপ্টা হচ্ছে। গণতন্ত্র একটি ধারণা এবং একই সঙ্গে একটি জীবনব্যবস্থা। ধারণাটি যেকোনো দেশের সংবিধান থেকে ধার করে নিয়ে আসা যায়। তখন আমরা বলতেই পারি, আমাদের দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে। কে বলেছে গণতন্ত্র নেই? ওই যে সংবিধানের অমুক ধারায় স্পষ্ট বলা আছে? বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর লগ্নে সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ ছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী সেনাশাসনের সময় সেনাপতি এটা বাদ দিয়েছিলেন। এখন শব্দটা আবার সংবিধানে ঢোকানো হয়েছে। তাতে করে আমাদের দেশে কি সমাজতন্ত্র এসে গেছে? নাকি সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও অঙ্গীকার বেড়েছে? আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি, যাঁরা নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। এটা পরিবারে, শিক্ষায়তনে, অফিসে, রাজনৈতিক দলে এমনকি হাল আমলের ফেসবুকে—সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে। আমরা হাতে ক্ষমতা পেলে হয়ে যাই ‘হিটলার’, ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ঝরে পড়লে হই মহা গণতন্ত্রী। একই অঙ্গে দুই রূপ। গণতন্ত্রের অবয়ব নিয়ে মতভিন্নতা আছে। কতটুকু হলে গণতন্ত্র বলব, আর কী না থাকলে বলব যে গণতন্ত্র নেই? কখনো মনে হয়, নির্বাচনই হলো গণতন্ত্রের চরম পরীক্ষা এবং পরম লক্ষ্য।
সে জন্য আমাদের জন-আলোচনার বেশির ভাগটাই জুড়ে থাকে নির্বাচন-প্রসঙ্গ। নির্বাচন এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী বছরের শেষ দিকেই নির্বাচন হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরগুলোয় যুযুধান অবস্থা তৈরি হচ্ছে। জিতলে পাঁচ বছরের জন্য ঠিকাদারি, হারলে ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’। শিগগিরই শুরু হবে ভোটারদের মনোরঞ্জনের পালা। প্রতিশ্রুতির ডালা সাজিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘরে ঘরে হাজির হবেন। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা বলবেন, তাঁরা গণতন্ত্র দিয়েছেন। যাঁরা ক্ষমতার বাইরে আছেন, তাঁরা বলবেন, ক্ষমতাসীনরা গণতন্ত্রকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন, তাঁরা নিজেরা নির্বাচিত হলে দেশে গণতন্ত্রের বান ডাকবে। সময় ও অবস্থার সঙ্গে মানুষের মতিগতিও পাল্টায়। পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেলে তত্ত্বও বদলে যায়। মনে আছে, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কয়েকটি আসনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল। অভিযোগকারীদের অন্যতম ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি সেবার বরিশালে দুটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে বাবুগঞ্জের একটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কারচুপি করে তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগের পরম মিত্র, মহাজোটের অংশীদার। আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে উতরে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তো তাঁর বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ানোর সাহসই পাননি। বিএনপির নেতারা ২০১৪ সালের নির্বাচনকে নির্বাচনই মনে করেন না। কারণ, ওই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। ভোটারবিহীন নির্বাচনকে যদি নির্বাচন বলা না যায়, তাহলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে কী বলা যায়? বিএনপি অবশ্য ওই নির্বাচনটির আয়োজন করে সরকার টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ পেরেছে। এই যা পার্থক্য। দেশে গণতন্ত্র আছে বা আসবে, তার মাপকাঠি হলো সরকার তৈরি হচ্ছে বা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ নাগরিকেরা ভোট দিয়ে সরকারের বৈধতা দিচ্ছেন বা দেবেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় কি? কোথাও হয়, কোথাও হয় না। এখানে নির্বাচন কমিশনের তেমন কিছু করার নেই।
ভোটকেন্দ্র যদি দুর্বৃত্তদের দখলে চলে যায়, তাহলে জনপ্রিয় প্রার্থীর নির্বাচনে জেতার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। বলা চলে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থায় নোংরা কাদা লেগেছে। এই মুহূর্তে ভালো গণতন্ত্রের অর্থ হলো অবাধে ভোট দিতে পারার অনুকূল পরিবেশের নিশ্চয়তা। ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসবে, আমরা ততই ভাবতে থাকব, আমার ভোটটা আমি আমার পছন্দের দল বা প্রার্থীকে দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারব কি না। দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা আছে কি নেই, ক্ষমতায় গেলে দলটি ভালো থাকবে নাকি দানবে পরিণত হবে। এসব সম্ভাবনা বা আশঙ্কা থাকলেও, এই মুহূর্তের চিন্তা হলো একটা সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ও পরিবেশ তৈরি করা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, যদি ভালো মানুষেরা নির্বাচনে প্রার্থী হন, তাহলে তাঁরা ভালো নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারেন। নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচন এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ। ভালো মানুষেরা গুন্ডাপান্ডা লেলিয়ে বুথ দখলের চেষ্টা করবেন না বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মাস্তানদের প্রার্থী বানায়, তাহলে ফেরেশতাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন বানালেও কোনো লাভ হবে না। আমরা কি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ভালো মানুষ আশা করতে পারি না?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.