সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কোনো বুদ্বুদ নয়
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী আমাদের তথ্যমন্ত্রীর মতে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বুদ্বুদের মতো স্থায়ী ১০ দিন কিংবা ১০ মাস থাকতে পারে। ভারতের দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের নিশ্চয়কারক মন্তব্য হয়তো কিছু লোককে তুষ্ট করতে পারে, তবে সাংবাদিকদের নয়, বিশেষ করে বিদেশি সাংবাদিকদের যাঁরা বাংলাদেশে সহিংস জঙ্গিবাদের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবর্ধমান বিকাশের সঙ্গে পরিচিত। বাংলাদেশ আজ যে উগ্রবাদী হুমকির সম্মুখে, তা যদি সত্যি সত্যি বুদ্বুদের মতো ক্ষণস্থায়ী হতো তাহলে এর চেয়ে বেশি খুশি শুধু দেশের জনগণই নয়, আমাদের প্রতিবেশীরাও আনন্দিত হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাস্তব একেবারে ভিন্ন, যা বোঝার জন্য শুধু বর্তমান পরিস্থিতি নয়, গত ১০-১৫ বছরের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই হয়। আরও বেশি দুঃখের বিষয়, বর্তমানের মতো অতীতেও যখন এ ধরনের জঙ্গিবাদী বা উগ্রবাদী সহিংস ঘটনা ঘটেছে, আমাদের সরকার এবং সরকারি নেতারা হয় রাজনৈতিক কারণে, না হয় অজ্ঞতার কারণে দেশে জঙ্গিশক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন বা তার মোকাবিলা করতে চাননি।
আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে বিখ্যাত সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে এক দীর্ঘ আলেখ্যে অ্যালেক্স পেরি নামে এক সাংবাদিক বাংলাদেশে জঙ্গি শক্তির উপস্থিতির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। বহু সূত্র থেকে আহরিত লেখায় তিনি বর্ণনা দেন কীভাবে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া আল-কায়েদা আর তালেবান অনুসারীরা সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছায় আর কীভাবে তারা সে উপকূলে অভয়াশ্রম তৈরির চেষ্টা করছে। পেরি তাঁর লেখায় এ-ও মন্তব্য করেন যে আল-কায়েদা অনুসারীরা যারা অনেকেই বাংলাদেশের, তাদের বাংলাদেশে নতুন ঘাঁটি বানানোর পেছনে তখনকার বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহায়তা করছে। পেরি আরও বলেছিলেন যে আল-কায়েদা অনুসারীরা বাংলাদেশে ঘাঁটি করতে সাহস পাচ্ছে এ কারণে যে তখনকার ক্ষমতাসীন সরকার (জাতীয়তাবাদী দল) জোট করেছে জামায়াতে ইসলামী আর ইসলামিক ঐক্যজোটের সঙ্গে, যারা ইসলামি জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
টাইম ম্যাগাজিনে এ আলেখ্য বের হওয়ার পর তৎকালীন সরকার কোনো জঙ্গিঘাঁটি খুঁজে বের করা কিংবা এ লেখার তথ্য অনুযায়ী কোনো অনুসন্ধান করা তো দূরে থাক, তারা ওই লেখাকে সর্বৈব মিথ্যা আখ্যা দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের সে সংখ্যাটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে। আল-কায়েদা বা তাদের মতাদর্শ উৎসাহিত কর্মকাণ্ড কক্সবাজার এলাকায় না হলেও হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। কিছুদিন পর উদয় হলেন সিদ্দিকুল ইসলাম নামে এক ইসলামি জঙ্গি, যিনি নিজেকে বাংলা ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি এবং তাঁর জামাআতুল মুজাহিদীন নামের জঙ্গি দল রাজশাহী ও নওগাঁ অঞ্চলে ধর্মের নামে এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব চালায় ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত। তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ভাইয়ের সন্ত্রাসীরা দুই বছরে ৩২ জন লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁকে পুলিশ ধরতে পারেনি বা ধরেনি অনেক দিন। কারণ বাংলা ভাই ছিল সেই অঞ্চলের তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায়। (পরে বৈদেশিক চাপে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কারণে তাঁকে সরকার গ্রেপ্তার করে, কিন্তু তাঁর বিচার এবং ফাঁসি হয় দুই বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।)
এ ছিল আমাদের দেশে গত দেড় দশকে সন্ত্রাস-সংক্রান্ত কিছু তথ্য। এবার আসা যাক গত কয়েক বছরের ইতিহাসে। গুলশানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগে গত দুই বছরে খুন হয়েছেন বেশ কিছু প্রগতিশীল লেখক, কয়েকজন বিদেশি নাগরিক আর কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি। এ হত্যাগুলোর দাবিদার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইএস, কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী। কিন্তু আমাদের তা বোঝার কোনো উপায় নেই, কারণ অধিকাংশ হত্যায় প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, তাদের শনাক্তই করা হয়নি। যেকোনো হত্যা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, তা জঙ্গি দ্বারা হোক বা ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য হোক। আর অপরাধ নিবারণের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সুচারু এবং ত্বরিত তদন্ত। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যেসব সন্ত্রাসমূলক হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার কয়েকটির ক্ষেত্রেও যদি প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত এবং অভিযুক্ত করা যেত, তাহলে দেশবাসী কিছুটা আশ্বাস পেত যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে বেশি দিন স্থায়ী হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান এবং ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব ব্যাপক এবং ভয়াবহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হয়েছে, সে তুলনায় এক গুলশানের ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়তো কম। কিন্তু তাই বলে এগুলোকে শুধু গৃহজাত বা বিরোধী দল অনুপ্রাণিত বলে আখ্যায়িত করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আজকের বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক নয়, এ বিশ্বায়ন উগ্রবাদ ভাবাদর্শ প্রচার এবং তার অনুসারী বিস্তারের জন্যও।
আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে বিখ্যাত সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে এক দীর্ঘ আলেখ্যে অ্যালেক্স পেরি নামে এক সাংবাদিক বাংলাদেশে জঙ্গি শক্তির উপস্থিতির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। বহু সূত্র থেকে আহরিত লেখায় তিনি বর্ণনা দেন কীভাবে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া আল-কায়েদা আর তালেবান অনুসারীরা সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছায় আর কীভাবে তারা সে উপকূলে অভয়াশ্রম তৈরির চেষ্টা করছে। পেরি তাঁর লেখায় এ-ও মন্তব্য করেন যে আল-কায়েদা অনুসারীরা যারা অনেকেই বাংলাদেশের, তাদের বাংলাদেশে নতুন ঘাঁটি বানানোর পেছনে তখনকার বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহায়তা করছে। পেরি আরও বলেছিলেন যে আল-কায়েদা অনুসারীরা বাংলাদেশে ঘাঁটি করতে সাহস পাচ্ছে এ কারণে যে তখনকার ক্ষমতাসীন সরকার (জাতীয়তাবাদী দল) জোট করেছে জামায়াতে ইসলামী আর ইসলামিক ঐক্যজোটের সঙ্গে, যারা ইসলামি জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
টাইম ম্যাগাজিনে এ আলেখ্য বের হওয়ার পর তৎকালীন সরকার কোনো জঙ্গিঘাঁটি খুঁজে বের করা কিংবা এ লেখার তথ্য অনুযায়ী কোনো অনুসন্ধান করা তো দূরে থাক, তারা ওই লেখাকে সর্বৈব মিথ্যা আখ্যা দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের সে সংখ্যাটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে। আল-কায়েদা বা তাদের মতাদর্শ উৎসাহিত কর্মকাণ্ড কক্সবাজার এলাকায় না হলেও হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। কিছুদিন পর উদয় হলেন সিদ্দিকুল ইসলাম নামে এক ইসলামি জঙ্গি, যিনি নিজেকে বাংলা ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি এবং তাঁর জামাআতুল মুজাহিদীন নামের জঙ্গি দল রাজশাহী ও নওগাঁ অঞ্চলে ধর্মের নামে এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব চালায় ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত। তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ভাইয়ের সন্ত্রাসীরা দুই বছরে ৩২ জন লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁকে পুলিশ ধরতে পারেনি বা ধরেনি অনেক দিন। কারণ বাংলা ভাই ছিল সেই অঞ্চলের তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায়। (পরে বৈদেশিক চাপে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কারণে তাঁকে সরকার গ্রেপ্তার করে, কিন্তু তাঁর বিচার এবং ফাঁসি হয় দুই বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।)
এ ছিল আমাদের দেশে গত দেড় দশকে সন্ত্রাস-সংক্রান্ত কিছু তথ্য। এবার আসা যাক গত কয়েক বছরের ইতিহাসে। গুলশানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগে গত দুই বছরে খুন হয়েছেন বেশ কিছু প্রগতিশীল লেখক, কয়েকজন বিদেশি নাগরিক আর কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি। এ হত্যাগুলোর দাবিদার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইএস, কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী। কিন্তু আমাদের তা বোঝার কোনো উপায় নেই, কারণ অধিকাংশ হত্যায় প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, তাদের শনাক্তই করা হয়নি। যেকোনো হত্যা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, তা জঙ্গি দ্বারা হোক বা ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য হোক। আর অপরাধ নিবারণের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সুচারু এবং ত্বরিত তদন্ত। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যেসব সন্ত্রাসমূলক হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার কয়েকটির ক্ষেত্রেও যদি প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত এবং অভিযুক্ত করা যেত, তাহলে দেশবাসী কিছুটা আশ্বাস পেত যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে বেশি দিন স্থায়ী হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান এবং ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব ব্যাপক এবং ভয়াবহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হয়েছে, সে তুলনায় এক গুলশানের ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়তো কম। কিন্তু তাই বলে এগুলোকে শুধু গৃহজাত বা বিরোধী দল অনুপ্রাণিত বলে আখ্যায়িত করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আজকের বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক নয়, এ বিশ্বায়ন উগ্রবাদ ভাবাদর্শ প্রচার এবং তার অনুসারী বিস্তারের জন্যও।
বাংলাদেশে এ ধরনের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য কোনো বিদেশির সেখানে উপস্থিত থাকা জরুরি নয়। শুধু প্রয়োজন একটি অনুকূল পরিবেশ। আর এ পরিবেশ সৃষ্টি হয় যখন মানুষ নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে ফেলে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বা মানুষ চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে না। কারণ সেসব দেশের লোকদের তাদের সরকার এবং নিয়মতান্ত্রিকতার ওপর আস্থা আছে। ওই সব দেশে মানুষের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা আছে যে বড় বা ছোট সব অপরাধের সমাধান তারা করতে পারবে। সাধারণ মানুষের চলাফেরার নিরাপত্তা থাকবে। পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে আমরা লোকজনকে তা দেখাতে পারছি না। আমরা মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না সাধারণ জীবনযাপনের ও চলাফেরার। আমরা দেখাতে পারছি না যে আমরা অপরাধ নিবারণে বা অপরাধীদের নিবৃত্ত করতে সক্ষম। তাই অনেকটা লঘু পাপে আমাদের গুরুদণ্ড হতে পারে যদি না আমরা কাজ দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারি যে আমরা সন্ত্রাস এবং অপরাধ দমনে আগ্রহী, আমরা আমাদের নাগরিকদের সুরক্ষায় সক্ষম। তা না হলে সন্ত্রাস বুদ্বুদের পরিবর্তে কালবৈশাখীর মতো আমাদের জীবনে হানা দিতে থাকবে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
No comments