সুখ কেবলই মরীচিকা
সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি কয়েক মাস আগে। বর্তমানে পিআরএলে আছি। সরকারের ঊর্ধ্বতন পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরও এই পিআরএল যা আগে এলপিআর হিসেবে সুপরিচিত ছিল- এই দু’য়ের সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বুঝতে পারিনি। এ দুটিই নাকি ছুটি। এলপিআর, যাকে বাংলায় বলা হতো অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি, এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর অবসরকাল শুরু হয়ে যেত। এ এলপিআরের পরিবর্তে কী কারণে পিআরএল করা হয়েছে এবং তা জনস্বার্থেই করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে সরকারি কর্মচারীরা বা জনগণ কতখানি জ্ঞাত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বর্তমানটি জনস্বার্থে করা হয়ে থাকলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আগেরটি কি জনস্বার্থবিরোধী ছিল, তাও আরেকটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন যাই থাক, পিআরএলকালে আমি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও ১ (এক) বছরের ছুটি ভোগ করছি এবং সরকারের কোনো কাজ না করেই যথারীতি বেতনভাতা পাচ্ছি। আমার প্রাপ্য ছুটি বাবদ ১৮ মাসের ছুটি নগদায়ন করে বেশ কিছু টাকাও পেয়েছি। এসব কথা লেখার প্রেক্ষাপট হল, অবসরে গিয়ে দীর্ঘদিনের হাজারো ব্যস্ততার দিনপঞ্জি থেকে নিজেকে ঘরে বন্দি করে কী যাতনা শুরু হয়ে যায় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে চাইবেন না। এ যাতনা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় আমার দীর্ঘদিনের শুভাকাক্সক্ষী এক স্যারের শরণাপন্ন হই।
স্যার শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিলেন, চা পানে আপ্যায়িত করলেন। বললেন, জীবনে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ সেগুলো লিপিবদ্ধ করো। দেখবে, তোমার এ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ লেখা দেশ ও জাতির উপকারে লাগবে। স্যার যত সহজে উপদেশটি দিলেন বিষয়টি যে কত কঠিন তা স্যারও হয়তো একসময় বুঝতে পারবেন। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা আর মুদ্রণযোগ্য এক পাতা লেখা কখনোই এক নয়। কাজেই স্যারের পরামর্শমতো কী নিয়ে লেখা শুরু করব সে ভাবনা থেকেই এ লেখা। সেই ছোটবেলার ‘ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ’ কেবল রঙিন স্মৃতি হয়ে আছে। সে স্মৃতিতে যেমন সুখ অনুভব হয়, তেমনি এতদিন পর সেই স্মৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক বেদনা, অনেক যন্ত্রণা। যাদের ঘিরে আমার সে সময়ের সুখের স্মৃতি তা রোমন্থনকালে তাদের প্রায় সবাই অনুপস্থিত। দীর্ঘ রোগভোগের পর নানার মৃত্যু; শিশু, তরুণ ও যুবক বয়সে ৬ জন মামার অকাল মৃত্যু, বেঁচে থাকা একমাত্র স্কুল শিক্ষক মধ্যবিয়সী মামার এক দিনের জ্বরে হঠাৎ মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে নানী ও সবশেষে আমার মায়ের অকাল মৃত্যুর ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। এসবের মধ্য থেকে কেবল আম কুড়োনোর স্মৃতিগুলোর মতো সুখ আলাদা করা খুবই কঠিন কাজ হলেও শুধু লেখার স্বার্থে সেগুলো সাজানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুঃখের স্মৃতিকে সাজাতে চাই না এ জন্য যে,
তাতে দুঃখ বেড়ে যাবে আর তা অবসর জীবনের বিড়ম্বনাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। সবাই যে সুখী হতে চায়, কেউ হয় আর কেউ হয় না। এ জগৎ সংসারে কোনো দুঃখবোধ নাই এমন একজন সুখী মানুষের সন্ধান লাভ কি সম্ভব? প্রকৃত সুখী হওয়া আদৌ সম্ভব কিনা এ নিয়ে সুখবাদী দার্শনিকরা নানারূপ তত্ত্ব, মতবাদ দিয়ে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করার নানামুখী যুক্তি প্রয়োগের অপচেষ্টা করেও মানুষকে ১০০ শতাংশ সুখী বানাতে সমর্থ হননি। সুখের জন্য কিছু চাইতে গেলে প্রায়ই তা পাওয়া যায় না বরং বিদ্যমান সুখও চলে যায়। এটা অনুধাবন করেই কবিগুরু গেয়েছেন, ‘তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, সুখ চলে যায়’। রাজা বিক্রমাদিত্যের বিদুষী কন্যা জ্ঞানী ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত বর কামনা করে পেয়েছেন এক মহা মূর্খকে। তাই কপালে কঙ্কনাঘাত হেনে বলেছেন ‘কিং ন করতি বিধি র্যদি রুষ্ট/কিং ন দদাতি স এবহি তুষ্ট/উষ্ট্রে লুম্পতি রং বা ষং বা/ তস্মৈ দত্তা নিবিড় নিতম্বা/। সে কারণেই কেউ কেউ এ তত্ত্ব প্রচার করতে বাধ্য হয়েছেন’ সুখী যদি হতে চাও, সুখের কথা ভুলে যাও। কাজেই সুখের পেছনে অহেতুক দৌড়ানোর চেয়ে সুখের কথা ভুলে যাওয়ার চর্চা বাড়াতে হবে। বর্তমান সমাজের উন্নয়ন বিষয়ে নানা মুনি নানা মত নিয়ে পত্রিকার পাতা এবং টেলিভিশনের পর্দা গরম করছেন। কিন্তু জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনা নেই তাতে। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম মানুষের মন থেকে দুঃখের স্মৃতিগুলো স্থায়ীভাবে মুছে দেয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে।
এটা সম্ভব হলে তো এ জগৎ সুখময় হয়ে যাবে। আমরা কি সে যন্ত্র আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকব, না সুখের কথা ভুলে থেকে ‘যখন যেমন তখন তেমন’কে মেনে নিয়ে দুঃখবোধকে বশে রাখার অভ্যাস তৈরি করব তা নিয়ে যত শিগগিরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে, ততই মঙ্গল বলে মনে করি। কীভাবে এ অভ্যাস তৈরি করা যায় তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখা যায় ‘প্রত্যাশার জন্ম এবং তা পূরণের ফলাফল’ থেকেই সুখ এবং দুঃখবোধ তৈরি হয়। প্রত্যাশার প্রাপ্তি থেকে সুখ এবং অপ্রাপ্তি থেকে দুঃখ- এ দু’য়ের মাঝামাঝি কোনো তৃপ্তিবোধ না থাকায় মানুষ নিজেকে কেবল সুখী বা দুঃখী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুখ আর দুঃখের মাঝামাঝি একটি অবস্থান তৈরি করা সম্ভব। জ্যামিতিক হারে মানুষবৃদ্ধি রোধকল্পে যেভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের স্লোগান উঠেছিল, তেমনিভাবে মানুষের প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধির কারণে জগৎ-সংসারে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার জন্য যে অস্থিরতা তা রোধ কল্পে নিয়ন্ত্রণহীন প্রত্যাশাকে নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ব্যতিরেকে এ অস্থিরতা দূর করা সম্ভব হবে না। বরং তা মহীরুহ হয়ে ম্যালথাসের বর্ণিত নিয়মে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। আর তা হবে খুবই দুঃখজনক। ক্লাসের ফার্স্ট বয় যখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কোনো রকম ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছেন এবং একই ক্লাসের মধ্যম সারির এমনকি পেছনের সারির ছাত্র হয়েও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর আরও প্রাপ্তির প্রত্যাশায় ন্যক্কারজনক অনৈতিক কোনো কাজ করেন,
তখন তো প্রকৃতি তাকে ক্ষমা করবে না। এ ধরনের অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অহরহই ঘটতে দেখা যায। যে কোনো প্রত্যাশার নিয়ন্ত্রণে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। কোনো ব্যক্তি স্বাধীনভাবে কোনো কিছুর প্রত্যাশা করতেই পারে। এ ক্ষেত্রে সমাজ বা রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তার এ প্রত্যাশা পূরণে যখনই কোনো অনৈতিক পন্থা গ্রহণ করা হবে, তখন রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভালো অভ্যাস গঠনের চর্চা করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা তা দৃশ্যমান নয়। সমাজও কি এ ধরনের বিবেকহীন মানুষকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে? রাষ্ট্র এবং সমাজ এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনই যেখানে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত, সেখানে দু-চারজন ব্যক্তি ওই মানুষটিকে ঘৃণা করলেই কী আর না করলেই কী। সুখের স্মৃতিগুলো মালাবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় সুখের অস্তিত্ব যেখানে সংকটাপন্ন ভাবি, সেখানে কীভাবে তৈরি হবে মালাটি। একটা চাকরি পাওয়ার পর যে সুখ অনুভূত হয়, বেতনের টাকায় চলতে না পারায় সে সুখ উবে যায়,
ঊর্ধ্বতনদের দাপুটে আচরণে নিজেকে অসহায় মনে হয়, পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার পর জীবন বিষাদময় হয়। এভাবে প্রতিটা সুখকেই কেবল সম্পূর্ণ ক্ষণস্থায়ী একটি অনুভূতি ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয় না। এভাবে সব সুখই এক সময় অসুখী হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। কাজেই ধার করে ঘি কিনে খেয়ে সুখী হওয়ার চেয়ে প্রকৃত সুখ অন্বেষণের পথ খুঁজে বের করাই উত্তম। সদা পরিবর্তনশীল জগতে বর্তমান খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। বর্তমান প্রতি মুহূর্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এভাবে ভবিষ্যতও ক্রমাগতভাবে বর্তমান এবং পর মুহূর্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। আমরা এগিয়ে চলেছি এমন এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে, যার সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এরূপ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই আমি, আমার প্রত্যাশা এবং আমার ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে, যার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় প্রত্যাশার জন্ম নিয়ন্ত্রিত হয়ে সীমিত প্রত্যাশা মানব সমাজকে সুখী হতে সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
মো. আনছার আলী খান : সাবেক অতিরিক্ত সচিব; সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন
মো. আনছার আলী খান : সাবেক অতিরিক্ত সচিব; সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন
No comments