গুলশান বিভীষিকা
অবশেষে বাংলাদেশকেও এক বিভীষিকাময় জঙ্গি হামলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো। শুক্রবার রাত পৌনে নয়টা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার অভিজাত ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানের কূটনীতিক পাড়ার এক রেস্তোরাঁয় যে সশস্ত্র হামলা হয়েছে, তা নৃশংস পৈশাচিকতার ভয়ংকর প্রদর্শনী। নিরীহ লোকজনকে যারা এভাবে হত্যা করেছে, তারা মানবতার শত্রু; তাদের প্রতি ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ হামলার ঘটনায় নিহত দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিক ও ২ পুলিশ কর্মকর্তার জন্য আমরা গভীরভাবে শোকাহত। স্বজনহারা পরিবারগুলোর প্রতি আমরা আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। পুলিশের ২০ সদস্যসহ যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত সম্মিলিত অভিযানের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা এবং ছয় হামলাকারীর মৃত্যু ও একজনকে জীবিত গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু এই বিরাট বিয়োগান্ত ও বিভীষিকাময় ঘটনার প্রভাব ও পরিণতি সুদূরপ্রসারী। এটা বাংলাদেশে ইতিমধ্যে চলমান জঙ্গি তৎপরতার মাত্রাগত উল্লম্ফনের ইঙ্গিতবাহী: বেছে বেছে একজন বা দুজন মানুষকে হত্যা করা থেকে গণহারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পর্যায়ে পদার্পণ। এটা বাড়তি শঙ্কা ও উদ্বেগ জাগায়; ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের ভয়াবহ গণহত্যাযজ্ঞগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমরা এতকাল এই ভেবে স্বস্তিতে ছিলাম যে ওই সব দেশের মতো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে আমাদের দেশ মুক্ত রয়েছে। কিন্তু গুলশানের এই ঘটনার পর আমাদের আর সেই স্বস্তিতে থাকার উপায় রইল না। হামলাটি যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই হামলাকারীরা ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিল, এবং পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে তারা দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা ও ২০ জনকে আহত করেছে। আর রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া নিরীহ-নিরপরাধ মানুষগুলোকে তারা হত্যা করেছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। রোমহর্ষক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের এমন ঝোঁক লক্ষ করা গেছে ইরাক ও সিরিয়ায় তৎপর ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের মধ্যে। এর উদ্দেশ্য স্পষ্টতই সুস্থ-স্বাভাবিক মানবসমাজকে তীব্র মানসিক আঘাতে বিহ্বল করে দেওয়া, প্রচণ্ড ভীতি সঞ্চার করা। আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, হামলাকারীরা বেছে নিয়েছে দেশের এমন একটি রেস্তোরাঁ যেখানে প্রচুর বিদেশি নাগরিক নিয়মিত যান এবং সেটি কূটনীতিক পাড়ার ভেতরেই। অর্থাৎ তারা এই হামলার মাধ্যমে বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে। মানুষকে জিম্মি করে তারা সরকারের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছায়নি, তাদের কোনো দাবিদাওয়া ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের চরম নৃশংসতা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে চরম ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা আর আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আইএসের পক্ষ থেকে এই হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত-অনুসন্ধান প্রয়োজন; যে একমাত্র হামলাকারীকে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে, তার কাছে এ বিষয়ে নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের ভেতরে ও বাইরে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে; উদ্বেগ ক্রমশ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শুক্রবারে হামলার যেসব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে, তাতে দেখা যায় যে বাংলাদেশে এ ধরনের বড় আকারের জঙ্গি হামলার আশঙ্কা বিদেশি পর্যবেক্ষক মহলে ছিল। বলা হচ্ছে, এ রকম হামলা ছিল ‘প্রেডিক্টেবল’ বা পূর্বেই অনুমেয়। কিন্তু আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এমন সব বার্তা দেওয়া হয়েছে যে জঙ্গি সমস্যা গুরুতর নয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। এখন, গুলশানের এই গণহত্যাযজ্ঞ বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে কিংবা যাচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জানা-বোঝা যথেষ্ট কি না, জঙ্গিদের কার্যকরভাবে দমন ও নিষ্ক্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, দক্ষতা, দায়িত্ববোধ কতটুকু আছে—এসব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদী সমস্যা আরও অনেক দেশকে আক্রান্ত করেছে, তারা তা মোকাবিলার চেষ্টা করছে। আমাদেরও তা করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সক্রিয় উদ্যোগ। সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে যে জঙ্গিবাদী সহিংসতা অত্যন্ত গুরুতর এক জাতীয় সমস্যা হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে, পুরো জাতিই আজ জঙ্গিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি। তাই একে রুখতে সরকারের জোরালো উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন রাজনৈতিক পক্ষ-নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত সক্রিয়তা।
No comments