পিকাসো-ভ্যানগগ চিত্রকর্মের ‘কালোবাজার’ ফনসেকা
নন্দনশিল্পের ক্রেতা এবং বিক্রেতারাও রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতোই সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে এবং মুদ্রা পাচার করে বাড়িয়েই চলেছেন ব্যক্তিগত সম্পদ। পানামা পেপারসের ঘটনায় বেড়িয়ে পড়েছে দুনিয়া কাঁপানো শতাব্দীর সেরা চিত্রকর্ম নিলামের আসল ঘটনা। শুধু তাই নয়, চিত্রকর্ম পরিবহনে বন্দরগুলোতে করমুক্ত সুবিধা পরিবহনের সুযোগ থাকায় সবার নাকের ডগায় বসেই এসব চিত্রকর্ম কেনাবেচা এবং স্থানান্তরের মাধ্যমেই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে বিনিয়োগ। কালোবাজারিদের নিরাপদ অর্থ স্থানান্তরের একটা নিরাপদ মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানামা পেপারস। অর্থ গোপনের উদ্দেশ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নানাবিধ উপায়ের মধ্যে চিত্রকর্ম ব্যবসাকেই সবচেয়ে নির্জনতম এবং নিরাপদ বিনিয়োগ বলে মনে করছে বলে মন্তব্য করেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে। কেন এবং কিভাবে জমে উঠেছে নন্দন ব্যবসা : সহজেই পরিবহনযোগ্য, করমুক্ত সুবিধা, নান্দনিকতার গুণে সব ধরনের সন্দেহহীনতার কারণেই গত দুই দশক ধরে মালিকানা গোপন করেই কর ফাঁকি দিয়ে চলছে হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা। এটি এখন আর শুধু শখের মাঝে সীমিত নেই বরং বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়ছে এই এই নন্দন ব্যবসা। ট্রেড পাবলিকেশন অব আর্ট মার্কেটের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী চিত্রকর্ম কেনাবেচা হয়েছে ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। বিলিওনিয়াররা তাদের অলস অর্থ থেকে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল ২০১৩ সালের চিত্রকর্ম বেচাকেনায়।
নিরাপদে অর্থের হিসাব লুকানোর জন্যই মূলত এই সেক্টরে বিনিয়োগ করছে ব্যবসায়ীরা। আর্ট মার্কেটের রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ লেনদেনই গোপনে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংঘটিত হয়। তবে মাঝে মাঝে প্রকাশ্য নিলামের ব্যবস্থা থাকলেও সেটা আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যেই সম্পন্ন হয় বলেই জানা যায়। বিশ্বের অন্যতম বড় এবং ফ্রি-পোর্ট, সবচেয়ে বেশি আর্টওয়ার্ক জমা আছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। জেনেভার সেই জাদুঘর সম্পর্কে বলা হয় যে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান জাদুঘরকেও আর্থিক মূল্যে হার মানাতে পারে এটি। এটির সংগ্রহে থাকা অধিকাংশ জিনিসই বিশ্বের বড় বড় শিল্পীদের তৈরি সেরা চিত্রকর্মগুলো। ২০০৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের সংবাদে বলা হয়, এই জাদুঘরে ৫ হাজারের বেশি চিত্রকর্ম সংরক্ষণ করা আছে যার মূল্য প্রায় চার বিলিয়ন ডলার এবং এর মধ্যে পিকাসোর ৩০০টির মতো চিত্রকর্মের মূল্যই প্রায় ১ বিলিয়ন । চিত্রকর্ম ব্যবসার বিলিয়ন ডলারের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতে ব্যবসায়ীরা : চিত্রকর্ম ব্যবসার জন্য বিখ্যাত দুই ব্যবসায়ীর স্বার্থিক দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে আলোর দুনিয়ার আদালতে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে আদালতে গেলেও সম্প্রতি পানামা পেপারসের নথি ফাঁস করে দিয়েছে উভয়ের আসল চেহারা। বিলিয়র ডলারের ব্যবসা আর আভিজাত্যের মোড়কে ঢাকা আর্টওয়ার্ক সংগ্রাহকের পরিচয়ের পেছনে থেকে বের হয়ে এসেছে কর ফাঁকি এবং মুদ্রা পাচারের মতো ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা। বিশ্বব্যাপী ‘কিং অব দ্য ফ্রি-পোর্ট’ খ্যাত ধনাঢ্য চিত্রকর্ম ব্যবসায়ী ইভেজ বউভিয়ার জেনেভার ফ্রি-পোর্টে বিশাল একটা জায়গা নিজেই ভাড়া নিয়ে রেখেছেন। লুক্সেমবার্গ এবং সিঙ্গাপুরের ফ্রি-পোর্টেও তার মালিকানা আছে।
অন্যদিকে রাশিয়ান বিলিওনিয়ার দিমিত্রি রাইবোলোলেভ তার বিরুদ্ধে চিত্রকর্ম বিক্রির আগে সিন্ডিকেট করে মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগে এনে প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন মোনাকো এবং প্যারিসে। আদালতের রায়ে দোষী প্রমাণিত হয়ে বউভিয়ারের সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সম্প্রতি ফনসেকার নথি থেকে দেখা যায় বউভিয়া পাঁচটি এবং রাইবোলোলেভ নিজেও দুটি অফসোর কোম্পানির মালিক। এছাড়াও তারা চিত্রকর্ম কেনাবেচার অনেক বড় সমঝদারও বটে। বেরিয়ে পড়েছে শতাব্দীসেরা চিত্রকর্ম নিলামের আসল ঘটনা : ২ মিলিয়ন ডলারে সংগ্রহ করা চিত্রকর্ম ৫০ বছর পর ২০৭ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছে আমেরিকার গাঞ্জ পরিবার। এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চিত্রকর্ম নিলামের ঘটনা যা সেসময় দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পাবলো পিকাসোর ১৫টি আর্টওয়ার্কও ছিল এর মধ্যে যা প্রকাশ্য নিলাম দিয়ে কিনে নিয়ে যায় সিমসবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন। ১৯৯৭ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পরেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্টওয়ার্ক বিক্রির নিলামটি কিনে নেয় তারা। মোসাক ফনসেকা থেকে রেজিস্ট্রেশন করা এই অফসোর কোম্পানির মালিক ব্রিটিশ মুদ্রা ব্যবসায়ী জোশেফ লুইস গোপন চুক্তির মাধ্যমে আগেই সব ছবি কিনে নিয়েছিলেন বলে দাবি পানামা পেপারসের নথিগুলো। এই কোম্পানির মালিকানার শেয়ারগুলো ছিল সব ‘বিয়ারার শেয়ার’। এই শেয়ার যার হাতে থাকবে তার মালিকানাতেই লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু থাকে, কালো টাকার ব্যবসা এবং মুদ্রা পাচারের খনি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এ ধরনেই শেয়ার নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চুরি যাওয়া চিত্রকর্ম কালোবাজারিতে জড়িত ফনসেকা : ইতালিয়ান চিত্রকর অ্যামেডিও মডিগ্লিয়ানি’র বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘সিটেড ম্যান উইথ অ্যা কেন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান আগ্রাসনের মুখে প্যারিস থেকে চুরি হয়ে যায়। চুরি যাওয়া এই শিল্পকর্মের মালিক ছিলেন তখন ইহুদি চিত্রকর্ম সংগ্রাহক ওস্কার স্টেটিনার। পরে ১৯৪৬ সালে প্যারিসের আদালতের স্মরণাপন্ন হলেও চিত্রকর্মটির আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে পুরাতন মামলার কাগজসহ এর বৈধ মালিকানা দাবি করে স্টেনারের নাতি ম্যাইট্রেসিস সেটা ফিরে পাওয়ার জন্য চার বছর ধরে মার্কিন আদালতে লড়াই করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক লন্ডন, প্যারিস এবং নিউইয়র্কে একাধিকবার ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করেছেন আর্টওয়ার্ক সংগ্রহের জন্য কয়েক প্রজন্ম ধরে খ্যাত নাহমেদ পরিবার। ইন্টারন্যাশনাল আর্ট সেন্টারের (আইএসি) মাধ্যমে তারা ছবিটি কিনেছিল বলে দাবি তাদের। তবে পানামা পেপারসের নথিতে দেখা যায় মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে একটি সেল কোম্পানি হিসেবে আইএসিকে ব্যবহার করে গোপনে চিত্রকর্মের ব্যবসা করতো নাহমেদ পরিবার। পানামা পেপারস থেকে দেখা যায়, ইন্টারন্যাশনাল আর্ট সেন্টার (আইএসি) নামক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৯৬ সালে লন্ডন থেকে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩২ লাখ ডলারে বিতর্কিত চিত্রকর্ম ক্রয় করে তারা। এই কোম্পানিকে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ভ্যানগগ, রেমব্যানডথ, চাগার, ওয়ারহোল প্রভুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূল্যবান সব ছবি সংগ্রহ করেছে তারা। সঠিক নিলামের মাধ্যমেই চিত্রকর্ম কেনা হয়েছিল দাবি করলেও গত বছর তারা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল যে আইএসি’র পক্ষ থেকে কে নিলাম চুক্তিতে সই করেছিল। পানামা পেপারসে ফনসেকা এবং নাহমেদ পরিবারের দুই আইনজীবীর ই-মেইল চালাচালির নাথি প্রকাশ হয়ে পড়ে সম্প্রতি। এসব ব্যাপারে তাদের আইনজীবী কোনো বক্তব্য না দিলেও আদালতকে জানিয়েছে, ছবিগুলো নিউইয়র্কে নেই। সেগুলো সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংরক্ষণ করা আছে। এদিকে আইএসি একটি পানামা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, সুতরাং মার্কিন আদালতে এর বিচার চলতে পারে না বলেই দাবি ঐতিহ্যবাহী আর্টওয়ার্ক ব্যবসায়ী নাহমেদ পরিবারের। পিকাসোর নাতনি জড়িত : মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে অন্যান্য চিত্রকর্ম সংগ্রাহকদের পাশাপাশি কিংবদন্তি চিত্রকর পাবলো পিকাসোর এক নাতনি মারিনা রুইজ পিকাসো, স্কেনের অভিজাত চিত্রসংগ্রাহক পরিবার থাইসসেন বর্নেমিসজা পরিবার, চীনের ওয়াং ঝং জুং গং রাও মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে গোপন প্রতিষ্ঠান খুলে গোপন লেনদেনের মাধ্যমে চিত্রকর্ম ব্যবসায় জড়িত বলে নথি প্রকাশ করে দিয়েছে পানামা পেপারস।
No comments