ঘরে ঘরে এখন ‘মাগুরা’

মাগুরা
আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, প্রথম দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর মনে মনে আশা করেছিলাম এবং প্রকাশ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে সনির্বন্ধ প্রার্থনা জানিয়েছিলাম, দ্বিতীয় দফা নির্বাচনটি যেন ভালো হয়। নির্বাচন কমিশন জনগণের কাছে আশ্বাসও দিয়েছিল। কিন্তু ৩১ মার্চ অর্থাৎ, দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের দিন দেখা গেল পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর। প্রথম দফায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল, দ্বিতীয় দফায় তা ৩৮-এ উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-রাহাজানির সংখ্যাও বাড়ছে। দ্বিতীয় দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিন ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে কয়েকটি এলাকার ভোটচিত্র দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। সেখানে মোটামুটি ভোট হয়েছে। আবার যেসব কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল, সেসব কেন্দ্রে একতরফা ভোট হয়েছে। পোলিং এজেন্ট দূরের কথা, বিএনপির প্রার্থী কিংবা কর্মী-সমর্থকদেরও কেন্দ্রের আশপাশে দেখা যায়নি। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোট নিয়ে যেসব হাঙ্গামা, মারামারি, লাঠালাঠি হয়েছে, মূলত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে। নৌকাধারী ও নৌকাবঞ্চিত প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে। এটি ছিল ভোটের এক চিত্র। বিপরীত চিত্র হলো বিএনপির প্রার্থী ও সমর্থকদের পশ্চাদপসরণ। অনেক ইউনিয়নেই তাঁরা নামকাওয়াস্তে প্রার্থী দিয়েছেন। শ্রীনগরের একটি ইউনিয়নে অন্য কাউকে না পেয়ে বা না দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীকে—যাঁর সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের কোনো সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। নৌকার সমর্থকেরা সদলবলে ব্যালটে সিল মেরেছেন আর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচনী কর্মকর্তারা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন। বিবেকের তাড়নায় কেউ বাধা দিতে চাইলে ওপরের নির্দেশে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় দফা ভোটের পর বিভিন্ন কাগজে খবর বের হয়েছিল যে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা বলে বসলেন, ভরাডুবির লজ্জায় বিএনপি নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। তাঁর বক্তব্য সত্য হলে দেশবাসী যারপরনাই খুশি হতেন। একটি দলের পশ্চাদপসরণ নিশ্চয়ই গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। কিন্তু বাস্তবে বিপরীতটাই ঘটেছে।
গত এক বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো ক্রমাবনতিরই সাক্ষী হয়ে আছে। তিন সিটি করপোরেশনের চেয়ে পৌরসভা খারাপ হয়েছে। আর পৌরসভার চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিকৃষ্টতর। পৌরসভায় অন্তত প্রার্থী হতে তেমন বাধার মুখে পড়তে হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়ন নিয়েই গুলি-বোমা-অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এই নির্বাচনে সবচেয়ে অবমূল্যায়িত হয়েছেন নাগরিক বা ভোটার। অনেক ভোটার কেন্দ্রেই যেতে পারেননি বা যেতে উৎসাহ বোধ করেননি। আগে কালোটাকার মালিকেরা টাকা দিয়ে ভোট কিনতেন। এখন প্রার্থীরা মনোনয়ন কিনছেন। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের কাছ থেকে মনোনয়ন বাণিজ্যের যেসব অভিযোগ এসেছে, তার সবটা অমূলক নয়। নির্বাচনে নিবন্ধিত ১৮টি দল অংশ নিয়েছে, যদি ভরাডুবির লজ্জায় একটি দল সরেও দাঁড়ায়, বাকি ১৭টি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক ইউপিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। এসব দেখার বা প্রতিকারের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে সরকারি দলের যে বাকপটু নেতারা এত দিন সুন্দর নির্বাচন হয়েছে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন, তাঁরাই এখন বিব্রত হতে শুরু করেছেন এবং সংঘাত–সংঘর্ষের সব দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপাচ্ছেন।
নির্বাচনে দখলবাজি–জালিয়াতির অভিযোগগুলো কেবল ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক’ বিএনপির কাছ থেকেই আসেনি, এসেছে মনোনয়নবঞ্চিত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছ থেকেও। সরকারের অংশীদার ও অনুগত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও একই অভিযোগ করেছে। বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, নির্বাচনের নামে দখলবাজি চলছে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, তাঁরাও পরবর্তী নির্বাচনে থাকবেন কি না ভাবছেন। সরকারের শরিক ও সুহৃদেরা যে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা কি তাকেও ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেবেন? হ্যাঁ, ইউপি নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র যদি হয়েই থাকে, সেটি করেছেন আওয়ামী লীগ নামধারী সেই সব নেতা-কর্মী, যাঁরা কেন্দ্র দখল ও ব্যালটে সিল মারার মহড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। ভোটকেন্দ্রে যাঁরা নিহত হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ, নির্বাচনী লড়াইয়ের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মায়ের সঙ্গে ভোট দেখতে আসা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে জীবন হারিয়েছেন নিরীহ হকার। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এসব দেখেও না দেখার ভান করছে আর পরের ধাপ থেকে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে জনগণকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাচ্ছে।  বাংলাদেশে সামরিক বা দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার নজির খুবই কম। দু-চারটি উপনির্বাচন বা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন মোটামুটি ঠিকঠাক হলেও জাতীয় নির্বাচনে এসে তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হলেও ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। অনেক সময় তাদের ভাষাভঙ্গির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভাষাভঙ্গির আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায়। আবার এই মাজাভাঙা নির্বাচন কমিশনকেই দেখা যায় দলীয় সরকারের বাইরে নির্বাচন হলে অতি ন্যায়পরায়ণ হতে। আমরা বরাবরই তাদের দ্বিচারিতা দেখে এসেছি। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসনামলের নির্বাচনের উদাহরণ এখানে টানছি না। কেননা তাঁদের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই ছিল ক্ষমতায় থেকে দল করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সেই দলকে জয়ী করা। তাঁরা কখনো এমন নির্বাচন দেননি, যাতে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর কীভাবে এরশাদ মিডিয়া ক্যু করে ফল নিজের পক্ষে নিয়েছিলেন, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতারা ভুলে যাননি।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর আমলে দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু এরপর উপনির্বাচনগুলোতে দলীয় নেতা-কর্মী ও মাস্তানদের তিনি সামাল দিতে পারলেন না। যার প্রথম উপসর্গ দেখা দেয় মিরপুর উপনির্বাচনে এবং সর্বশেষ মাগুরা-২-এ। মাগুরা উপনির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ।  উপনির্বাচন উপলক্ষে মন্ত্রী-বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৮০ জন সাংসদ সেখানে গিয়েছিলেন বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল। নির্বাচনের পরদিন ২১ মার্চের পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়: মাগুরা-২ উপনির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে বেশ কিছু স্কুটারকে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় দেখা গেছে। এসব স্কুটারের নম্বর–প্লেট ঢাকা ছিল। এর পরিবর্তে লেখা ছিল সংবাদপত্র। স্কুটারের ভেতরে ছিল সশস্ত্র যুবকেরা। (সংবাদ, ২১ মার্চ)।
নির্বাচনের পরদিন মাগুরায় আয়োজিত জনসভায় তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচন না দিলে আমরা নতুন আন্দোলন করতে বাধ্য হব, যা সরকারের পতন ডেকে আনবে। ভোট ডাকাত এমপিদের সঙ্গে সংসদে বসা যায় কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। এ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি প্রমাণ করেছে এ সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। (সূত্র: ভোরের কাগজ, ২২ মার্চ ১৯৯৪)। একই পত্রিকায় বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে পড়ে থাকা প্রচুর ব্যালটের ছবি ছাপা হয়েছিল। বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার সংবাদপত্রে বিবৃতিতে বলেছিলেন, পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা নেই বলেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছে। সালাম তালুকদারের সেই বিবৃতির সঙ্গে আজকের আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি পরখ করে দেখলে খুব একটা অমিল পাওয়া যাবে না। ক্ষমতার ভাষা বরাবরই অহমিকায় আচ্ছন্ন থাকে। বিএনপি আমলে সেটাই ছিল সম্ভবত শেষ উপনির্বাচন। এরপর বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি। সংসদেও যোগ দেয়নি তারা। এই মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপি ও ভোট জালিয়াতিকে কেন্দ্র করেই বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলল এবং সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মানতে বাধ্য করল। মাগুরা উপনির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। ছাত্ররাজনীতিতে উজ্জ্বল অতীতের অধিকারী রউফ বলেছিলেন, কেউ ভোটকেন্দ্রে মাস্তানি করতে এলে কমিশন তিন গুণ মাস্তানি দিয়ে তা মোকাবিলা করবে। কিন্তু তিনি পারেননি বলেই অপনির্বাচনের দায় মাথায় নিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে। পরবর্তীকালে বিচারপতি এম এ সাদেকও দেশবাসীকে ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচন উপহার দিয়ে সটকে পড়েছিলেন। আর বিচারপতি এম এ আজিজ তো নির্বাচনই করতে পারেননি। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের এসব ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এক মাগুরার কারণে বিএনপি সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছিল। এবার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তো ঘরে ঘরে মাগুরা সৃষ্টি হয়েছে। সে সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছিলেন, মা–গুড়া। অর্থাৎ নির্বাচনটিই গুঁড়া হয়ে গেছে। এখন সারা দেশের ইউপি নির্বাচন গুঁড়া হওয়ার পথে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে সাবেক স্বৈরাচারী এরশাদও নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন ও বেশরম বলে গাল দিচ্ছেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাও নাকি মৃদু বিব্রত বোধ করছেন। কিন্তু বিব্রত বোধ করলেই দায়িত্ব চুকেবুকে যায় না। বিভিন্ন মহল থেকে যখন স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার কথা বলা হয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগ এর পক্ষে  যুক্তি দেখিয়েছিল যে নতুন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র আরও মজবুত হবে। গণতন্ত্র মজবুত না হলেও নির্বাচনের নামে ‘মাস্তানতন্ত্র’ মজবুত হয়েছে। মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির গোঁয়ার্তুমি ও কারচুপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিকে জায়েজ করেছিল। এখন ইউপি নির্বাচনে সেই মাগুরাকে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়ে কি আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় ‘পরিত্যক্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ ফিরিয়ে আনাকে অনিবার্য করে তুলছে না? ভবিষ্যতে হয়তো শুধু ইউপি নয়, পাড়ার ক্লাবের নির্বাচন করতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক। 
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.