কোন শক্তি বিশ্ব অর্থনীতির রাশ টেনে ধরছে? by জোসেফ ই স্টিগলিৎস ও হামিদ রশিদ
২০০৮
সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর ২০১৫ সালে এসেও বৈশ্বিক
অর্থনীতি হোঁচট খেয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন
অ্যান্ড প্রসপেক্টাস ২০১৬-তে দেখা গেল, সংকটের পর থেকে উন্নত দেশগুলোর গড়
প্রবৃদ্ধির হার ৫৪ শতাংশেরও বেশি কমেছে। উন্নত দেশগুলোতে বেকার মানুষের
সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ, যেটা ২০০৭ সালের তুলনায় ১ কোটি ২০ লাখ বেশি,
আর গত বছর সেখানকার মূল্যস্ফীতির হারও সংকটের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর, কারণ উন্নত দেশ হওয়ায় তাদের ক্যাপিটাল হিসাব সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, ফলে পুঁজির অবাধ প্রবাহ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ঝুঁকি ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগের কারণে তাদের লাভবান হওয়ার কথা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সামষ্টিক অর্থনীতি অতটা অস্থিতিশীল হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বেকার ভাতার মতো সামাজিক কর্মসূচির কারণে পরিবারের ভোগ চাহিদাও স্থিতিশীল থাকার কথা। কিন্তু সংকট-উত্তরকালে অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ব্যয়সংকোচ ও কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের নীতি (কিউই) গ্রহণ করায় পরিবারের ভোগ, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়ার তেমন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এসব ক্ষেত্রে প্রণোদনা না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা দেখলাম, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে ভোগ বা বিনিয়োগ কোনোটিই বাড়েনি, যার আংশিক কারণ হচ্ছে, দেশটিতে যে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে জমা হচ্ছে। সেখানে ২০০৬ সালে যে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেটরি রিলিফ অ্যাক্ট হয়েছিল, তার কারণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ প্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত রিজার্ভের ওপর সুদ দেওয়ার ক্ষমতা লাভ করে। এতে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের লক্ষ্য বিনষ্ট হয়। সে সময় মার্কিন আর্থিক খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে যে ইমার্জেন্সি ইকোনমিক স্ট্যাবিলাইজেশন অ্যাক্ট, ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়, তার বদৌলতে রিজার্ভের সুদ প্রদান করার কার্যকর সময় তিন বছর বাড়ানো হয়, নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর। এর ফলে দেখা গেল, ফেডে সঞ্চিত রিজার্ভের পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে গেল, ২০০০-০৮ সালে যেখানে গড় রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০,০০০ কোটি ডলার, সেখানে ২০০৯-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিয়ে ফেডে জমা রাখতে শুরু করে, ফলে গত পাঁচ বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত উপায়ে বছরে ৩,০০০ কোটি ডলার আয় করেছে। ফলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে ফেড আসলে আর্থিক খাতকে উদার ও মুক্তহস্তে ভর্তুকি দিল, যার চরিত্র অনেকটাই গোপন। আর গত মাসে ফেডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এ বছর ওই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে ১,৩০০ কোটি ডলার।
এ ধরনের বিকৃত প্রণোদনা দেওয়ার কারণে নিম্ন সুদের হারের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, যেটা আমরা আশা করেছিলাম। উল্লিখিত কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে প্রায় সাত বছর সুদের হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ছিল, যার কারণে উন্নত দেশগুলোর ধার করে হলেও অবকাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়া উচিত ছিল। সংকট-উত্তরকালে ক্রমবর্ধমান হারে যে সামাজিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তাতে সম্মিলিত চাহিদা বাড়ার এবং ভোগের ধরনও স্থিতিশীল হওয়ার কথা ছিল। আর জাতিসংঘের প্রতিবেদনে তো দেখাই গেল, উন্নত দেশগুলোতে সুদের হার একদম কমে গেলেও সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। ২০টি উন্নত দেশের মধ্যে ১৭টিতে দেখা যায়, সংকটের আগের সময়ের চেয়ে পরের সময়ে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে, তার মধ্যে আবার ২০১০-১৫ সালের মধ্যে পাঁচটি দেশের বিনিয়োগই কমে গেছে। বৈশ্বিক পরিসরে দেখা গেল, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের যে নিরাপত্তা দিত, এই সময়ে তার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেল, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করার কথা। অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে এটা থেকে বোঝা যায়, নিম্ন সুদের হারের সুযোগ নিয়ে অ-আর্থিক করপোরেশনগুলো ঋণ নিয়েছে। কিন্তু তারা এই টাকা বিনিয়োগ না করে সেটা দিয়ে নিজেদের ইকু্যইটি অথবা অন্যান্য আর্থিক সম্পদ কিনেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে লিভারেজ, মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও আর্থিক খাতের মুনাফা বেড়েছে।
কিন্তু এগুলোর কারণে প্রকৃত অর্থনীতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। ফলে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি রাখলেই বিনিয়োগ বা ঋণ নেওয়ার হার বেড়ে যাবে, এমন কথা নেই। ব্যাংকগুলোকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হলে তারা ঋণ না দিয়ে ঝুঁকিহীন মুনাফা লাভ ও আর্থিক ফাটকাবাজির পথ বেছে নেয়।
কিন্তু বৈপরীত্যমূলক ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যখন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ দেয়, তখন তারা শর্ত জুড়ে দেয়, এই টাকা দিয়ে কী করা যাবে আর কী যাবে না। কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে হলে শুধু ঋণ প্রদানের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির সংস্কার করলেই চলবে না, ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দিতে হবে। ব্যাংককে ঋণ প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহিত না করে ফেডের উচিত, অতিরিক্ত রিজার্ভ রাখার জন্য ব্যাংককে শাস্তি দেওয়া।
সুদের হার একদম কমে যাওয়াটা উন্নত দেশের জন্য সুবিধাজনক হলেও উন্নয়নশীল দেশ ও উদীয়মান বাজারের জন্য তা লাভজনক নয়। উদ্দেশ্যমূলক না হলেও এ ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত নয়, সেটা হলো মুদ্রানীতি সহজীকরণের ফলে আন্তর্দেশীয় পুঁজির প্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুঁজি প্রবাহের হার ২০০৮ সালে যেখানে ২,০০০ কোটি ডলার ছিল, সেখানে ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৬০,০০০ কোটি ডলার।
সে সময় অনেক উদীয়মান বাজারই এই পুঁজির প্রবাহ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে। এর খুব সামান্যই নির্ধারিত বিনিয়োগে ব্যয় হয়েছে। বস্তুত সংকট-উত্তরকালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল। ২০০৬ সালের পর এবারই প্রথম তারা পুঁজি রপ্তানি করতে যাচ্ছে, যার সম্মিলিত পরিমাণ হবে ৬১,৫০০ কোটি ডলার।
মুদ্রানীতি বা আর্থিক খাত—কেউই তাদের যা করার সেটা করছে না। দেখা যাচ্ছে, তারল্যের জোয়ারের কারণে বেসদৃশভাবে আর্থিক সম্পদ বাড়ছে, সম্পদের বুদ্বুদ সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু সে কারণে কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থনীতি তেজি হচ্ছে না। বিশ্বজুড়ে ইকু্যইটির মূল্য ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক জিডিপির অংশ হিসেবে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের হার অনেক বেশি। ফলে আরেকটি আর্থিক সংকটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নীতির আরও কিছু শাখা-প্রশাখা আছে, যার মাধ্যমে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শুরু করতে হবে বৃহত্তর সমতা অর্জনে বাজার অর্থনীতির নিয়ম পুনর্লিখন করে, কার্যকর বিধিবিধানের মাধ্যমে আর্থিক খাতের রাশ টেনে ধরে, সঙ্গে থাকবে প্রণোদনা দেওয়ার কার্যকর কাঠামো, চিন্তা করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। কিন্তু সরকারকে অবকাঠামো, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। এই টাকার অন্তত কিছুটা আসতে হবে পরিবেশ কর, যেমন: কার্বন কর এবং একচেটিয়া ব্যবসা ও ভাড়ার ওপর আরোপিত কর থেকে, যেটা বাজার অর্থনীতিতে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, আর যার কারণে অসমতা বাড়ছে, প্রবৃদ্ধির গতি কমছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
হামিদ রশিদ: জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের গ্লোবাল ইকোনমিক মনিটরিংয়ের প্রধান।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর, কারণ উন্নত দেশ হওয়ায় তাদের ক্যাপিটাল হিসাব সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, ফলে পুঁজির অবাধ প্রবাহ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ঝুঁকি ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগের কারণে তাদের লাভবান হওয়ার কথা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সামষ্টিক অর্থনীতি অতটা অস্থিতিশীল হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বেকার ভাতার মতো সামাজিক কর্মসূচির কারণে পরিবারের ভোগ চাহিদাও স্থিতিশীল থাকার কথা। কিন্তু সংকট-উত্তরকালে অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ব্যয়সংকোচ ও কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের নীতি (কিউই) গ্রহণ করায় পরিবারের ভোগ, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়ার তেমন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এসব ক্ষেত্রে প্রণোদনা না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা দেখলাম, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে ভোগ বা বিনিয়োগ কোনোটিই বাড়েনি, যার আংশিক কারণ হচ্ছে, দেশটিতে যে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে জমা হচ্ছে। সেখানে ২০০৬ সালে যে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেটরি রিলিফ অ্যাক্ট হয়েছিল, তার কারণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ প্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত রিজার্ভের ওপর সুদ দেওয়ার ক্ষমতা লাভ করে। এতে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের লক্ষ্য বিনষ্ট হয়। সে সময় মার্কিন আর্থিক খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে যে ইমার্জেন্সি ইকোনমিক স্ট্যাবিলাইজেশন অ্যাক্ট, ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়, তার বদৌলতে রিজার্ভের সুদ প্রদান করার কার্যকর সময় তিন বছর বাড়ানো হয়, নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর। এর ফলে দেখা গেল, ফেডে সঞ্চিত রিজার্ভের পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে গেল, ২০০০-০৮ সালে যেখানে গড় রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০,০০০ কোটি ডলার, সেখানে ২০০৯-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিয়ে ফেডে জমা রাখতে শুরু করে, ফলে গত পাঁচ বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত উপায়ে বছরে ৩,০০০ কোটি ডলার আয় করেছে। ফলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে ফেড আসলে আর্থিক খাতকে উদার ও মুক্তহস্তে ভর্তুকি দিল, যার চরিত্র অনেকটাই গোপন। আর গত মাসে ফেডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এ বছর ওই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে ১,৩০০ কোটি ডলার।
এ ধরনের বিকৃত প্রণোদনা দেওয়ার কারণে নিম্ন সুদের হারের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, যেটা আমরা আশা করেছিলাম। উল্লিখিত কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে প্রায় সাত বছর সুদের হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ছিল, যার কারণে উন্নত দেশগুলোর ধার করে হলেও অবকাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়া উচিত ছিল। সংকট-উত্তরকালে ক্রমবর্ধমান হারে যে সামাজিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তাতে সম্মিলিত চাহিদা বাড়ার এবং ভোগের ধরনও স্থিতিশীল হওয়ার কথা ছিল। আর জাতিসংঘের প্রতিবেদনে তো দেখাই গেল, উন্নত দেশগুলোতে সুদের হার একদম কমে গেলেও সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। ২০টি উন্নত দেশের মধ্যে ১৭টিতে দেখা যায়, সংকটের আগের সময়ের চেয়ে পরের সময়ে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে, তার মধ্যে আবার ২০১০-১৫ সালের মধ্যে পাঁচটি দেশের বিনিয়োগই কমে গেছে। বৈশ্বিক পরিসরে দেখা গেল, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের যে নিরাপত্তা দিত, এই সময়ে তার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেল, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করার কথা। অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে এটা থেকে বোঝা যায়, নিম্ন সুদের হারের সুযোগ নিয়ে অ-আর্থিক করপোরেশনগুলো ঋণ নিয়েছে। কিন্তু তারা এই টাকা বিনিয়োগ না করে সেটা দিয়ে নিজেদের ইকু্যইটি অথবা অন্যান্য আর্থিক সম্পদ কিনেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কারণে লিভারেজ, মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও আর্থিক খাতের মুনাফা বেড়েছে।
কিন্তু এগুলোর কারণে প্রকৃত অর্থনীতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। ফলে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি রাখলেই বিনিয়োগ বা ঋণ নেওয়ার হার বেড়ে যাবে, এমন কথা নেই। ব্যাংকগুলোকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হলে তারা ঋণ না দিয়ে ঝুঁকিহীন মুনাফা লাভ ও আর্থিক ফাটকাবাজির পথ বেছে নেয়।
কিন্তু বৈপরীত্যমূলক ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যখন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ দেয়, তখন তারা শর্ত জুড়ে দেয়, এই টাকা দিয়ে কী করা যাবে আর কী যাবে না। কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে হলে শুধু ঋণ প্রদানের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির সংস্কার করলেই চলবে না, ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দিতে হবে। ব্যাংককে ঋণ প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহিত না করে ফেডের উচিত, অতিরিক্ত রিজার্ভ রাখার জন্য ব্যাংককে শাস্তি দেওয়া।
সুদের হার একদম কমে যাওয়াটা উন্নত দেশের জন্য সুবিধাজনক হলেও উন্নয়নশীল দেশ ও উদীয়মান বাজারের জন্য তা লাভজনক নয়। উদ্দেশ্যমূলক না হলেও এ ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত নয়, সেটা হলো মুদ্রানীতি সহজীকরণের ফলে আন্তর্দেশীয় পুঁজির প্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুঁজি প্রবাহের হার ২০০৮ সালে যেখানে ২,০০০ কোটি ডলার ছিল, সেখানে ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৬০,০০০ কোটি ডলার।
সে সময় অনেক উদীয়মান বাজারই এই পুঁজির প্রবাহ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে। এর খুব সামান্যই নির্ধারিত বিনিয়োগে ব্যয় হয়েছে। বস্তুত সংকট-উত্তরকালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল। ২০০৬ সালের পর এবারই প্রথম তারা পুঁজি রপ্তানি করতে যাচ্ছে, যার সম্মিলিত পরিমাণ হবে ৬১,৫০০ কোটি ডলার।
মুদ্রানীতি বা আর্থিক খাত—কেউই তাদের যা করার সেটা করছে না। দেখা যাচ্ছে, তারল্যের জোয়ারের কারণে বেসদৃশভাবে আর্থিক সম্পদ বাড়ছে, সম্পদের বুদ্বুদ সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু সে কারণে কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থনীতি তেজি হচ্ছে না। বিশ্বজুড়ে ইকু্যইটির মূল্য ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক জিডিপির অংশ হিসেবে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের হার অনেক বেশি। ফলে আরেকটি আর্থিক সংকটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নীতির আরও কিছু শাখা-প্রশাখা আছে, যার মাধ্যমে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শুরু করতে হবে বৃহত্তর সমতা অর্জনে বাজার অর্থনীতির নিয়ম পুনর্লিখন করে, কার্যকর বিধিবিধানের মাধ্যমে আর্থিক খাতের রাশ টেনে ধরে, সঙ্গে থাকবে প্রণোদনা দেওয়ার কার্যকর কাঠামো, চিন্তা করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। কিন্তু সরকারকে অবকাঠামো, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। এই টাকার অন্তত কিছুটা আসতে হবে পরিবেশ কর, যেমন: কার্বন কর এবং একচেটিয়া ব্যবসা ও ভাড়ার ওপর আরোপিত কর থেকে, যেটা বাজার অর্থনীতিতে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, আর যার কারণে অসমতা বাড়ছে, প্রবৃদ্ধির গতি কমছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
হামিদ রশিদ: জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের গ্লোবাল ইকোনমিক মনিটরিংয়ের প্রধান।
No comments