জাতীয় বীর মাখন অনাদৃত by নূরে আলম সিদ্দিকী
গভীর
বেদনাপ্লুত চিত্তে অবলোকন করলাম, কী নিষ্প্রভভাবে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয়
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য, জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখনের
মৃত্যুবার্ষিকীটা চলে গেল! আমরা অবশ্য ঘরোয়াভাবে দোয়া মাহফিলের আয়োজন
করেছিলাম। আরেকটু বৃহৎ পরিসরে করতে পারিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে। এটাও
আমাকে আত্মগ্লানিতে ভোগাচ্ছে। কিন্তু একজন জাতীয় বীরের এই মৃত্যুদিবসে
সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমগুলো দিনটিকে যতটা গুরুত্ব প্রদানের প্রয়োজন
ছিল তাও করেনি। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি
পর্যন্ত আসেনি। যতদূর মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার(!) ভুল করেও
এই বদান্যতা কখনো দেখান নি। অথচ ১৯৯৪ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি যেদিন তিনি মারা
যান, বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় থাকলেও তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদ অধিবেশন
মুলতবি করা হয়েছিল। তখনকার সংসদ সদস্য এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব শাজাহান সিরাজ সংসদে প্রত্যয়দৃঢ় বক্তৃতা করে
সংসদ মুলতবি করতে সরকারকে বাধ্য করেছিলেন। তবুও সংসদ মুলতবি করাটা স্বাধীন
বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে গুরুত্ব প্রদানের একটি ইতিবাচক দিক।
পুরো তিন দিন তার লাশ হিমাগারে ছিল। সমগ্র ছাত্রসমাজসহ মুক্তিযুদ্ধের
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের দাবি ছিল, সামরিক শকটে জাতীয় গোরস্তানে তাঁর
দাফন হবে। এই দাবি নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ
করেছিলাম। বিএনপির পক্ষে সর্বজনাব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার
মওদুদ আহমেদ, আমানউল্লাহ আমান ও খোকন এবং আমাদের তরফ থেকে মরহুম আবদুর
রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শাজাহান সিরাজ ও আমি। আমাদের দাবিটির যথার্থতা
স্বীকার করে স্বল্পভাষিণী খালেদা জিয়া বললেন, উনি একজন বেসামরিক
ব্যক্তিত্ব, তাই সামরিক শকট দিতে হলে একটা জাতীয় ঐক্যের ওপর ভিত্তি করেই
দিতে হবে। আপনারা বিরোধী দলের নেত্রীর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করান,
আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না। তিন দিন ধরে গ্রিন রোডে
বিরাট শামিয়ানা টাঙিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা খণ্ড খণ্ড বক্তৃতা চলতো এবং জাতীয়
উল্লেখযোগ্য সকল স্তরের নেতৃত্বের পদচারণায় এলিফ্যান্ট রোড উজ্জীবিত হয়ে
থাকত। বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিদিন অপরাহ্নে ওখানে যেতেন এবং
সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মহিলা নেতৃত্বের সঙ্গে অনেক সময় ব্যয় করতেন। তা
সত্ত্বেও তার বিবৃতিটি সংবাদপত্রে আসেনি। তার যুক্তি হলো- যেখানে সবুর খান,
শাহ আজিজুর রহমানরা শায়িত আছে, সেখানে আমাদের কেউই শায়িত হবে না। অবশ্য
তখন রমজানের সময়। অসংখ্য লোক দাবিতে এতই অনড় ছিল যে, তারা অনশন করবে এবং
দাবির স্বপক্ষে অনড় থাকবে। একে তো রমজান মাস, দ্বিতীয়ত- আমার হাতে কোনো
সংগঠন নেই, আমি রাজনীতির বাইরে; শাহজাহান সিরাজও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য।
উপরন্তু, মাখনের স্ত্রী মরহুমা হাসুসহ পরিবার থেকে চাপ আসতে লাগলো, রুহের
কষ্ট হবে, দাফনের ব্যবস্থা করুন। অনেক কষ্টে সকলকে শান্ত করে আমরা জাতীয়
ঈদগাহ ময়দানে জানাজার ব্যবস্থা করলাম। সেই জানাজা লক্ষ লোকে ভরপুর এবং
প্রায় সমগ্র জাতীয় নেতৃত্বই সেই জানাজায় অংশ নেন। মাইকে অশ্রুসিক্ত নয়নে
আবেগভরা বক্তৃতা করে উত্তেজিত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে লাশ
দাফন করা হলো। অবশ্যই সামরিক বাহিনীর বিউগল বেজেছে, কামানও গর্জে উঠেছিল।
আমি জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অশ্রুসিক্ত নয়নে সেদিন বলেছিলাম- মাখন, তোমার
সামরিক শকটের প্রয়োজন নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল তোমাকে গোরস্তানে নিয়ে
যাবে। আজও তার পুনরাবৃত্তি করেই বলতে চাই, আপাত দৃষ্টিতে আজকে যত অনাদৃতই
হও না কেন, মুক্তিযুদ্ধে তোমার গৌরবময় স্মৃতি ইতিহাস একদিন অকপটে তুলে
ধরবে।
No comments