আর নয় সাংঘর্ষিক রাজনীতি by তারেক শামসুর রেহমান
আগামী ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশের সিদ্ধান্তের পর একই স্থানে একই দিন সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সিদ্ধান্ত আবারও প্রমাণ করল এদেশে আস্থাহীনতার যে রাজনীতি এবং যে রাজনীতি বারবার সংকটের জন্ম দিচ্ছে, সেই রাজনীতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। ৫ জানুয়ারি এ দেশের ‘নির্বাচনী রাজনীতি’র জন্য একটি কলঙ্কময় দিন। ২০১৪ সালে এই দিনে এ দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি সেদিন লঙ্ঘিত হয়েছিল যখন আমরা দেখেছি ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। ১৫টি জেলায় মাত্র ১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আর শতকরা ৫২ ভাগ মানুষ সেখানে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে এদেশে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, তা এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। ২০১৫ সালে বিএনপি প্রায় তিন মাস অবরোধ অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ এই ‘অবরোধ’ আর সহিংস ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি। বরং শত শত মামলা-মোকদ্দমার দায়ভার বহন করে বিএনপির অনেক নেতা ও কর্মী এখনও জেলে।
৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বড় দলের মাঝে যে আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছিল, সেই আস্থাহীনতা আজও বজায় রয়েছে, যা মাঝে-মধ্যে সহিংসরূপ ধারণ করে। ৫ জানুয়ারির পর এ দেশে নতুন এক ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে, যেখানে ‘ভোট কেন্দ্র দখল’ আর ‘সিলমারা সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও, পরবর্তী সময়ে উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু যে প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তা হয়নি। এবং পরস্পরবিরোধী এক ঘৃণ্য রাজনীতির জন্ম হয়েছে। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ৫ জানুয়ারি (২০১৫) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একই স্থানে ও একই সময় সমাবেশের আহ্বানে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যে সম্ভাবনা, তাতে আসবে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। বিএনপি দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপি’ হলেও বিএনপি ‘কারচুপি’র প্রতিবাদে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপির এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে এবং গণতন্ত্র ক্রমেই হয়ে উঠবে একদলীয়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ‘শক্তিশালী বিরোধী দলের’ অভাব অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে উৎসাহ জোগাবে মাত্র। বাংলাদেশে বিএনপির আবির্ভাব একটি বাস্তবতা। এ দেশের জনগোষ্ঠীর ৩২ থেকে ৩৩ ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি। সুতরাং এ দলটিকে বাদ দেয়া যাবে না। বিএনপি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কতটুকু ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে কিংবা তাদের ‘নির্বাচন বয়কটের’ সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক ছিল, তা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিতে বিএনপি ফিরে আসায়, সরকারের উচিত ছিল বিএনপির এই ‘অবস্থান’কে সমর্থন করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে মাত্র। এই উত্তাপ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বড় দলের মাঝে যে আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছিল, সেই আস্থাহীনতা আজও বজায় রয়েছে, যা মাঝে-মধ্যে সহিংসরূপ ধারণ করে। ৫ জানুয়ারির পর এ দেশে নতুন এক ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে, যেখানে ‘ভোট কেন্দ্র দখল’ আর ‘সিলমারা সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও, পরবর্তী সময়ে উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু যে প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তা হয়নি। এবং পরস্পরবিরোধী এক ঘৃণ্য রাজনীতির জন্ম হয়েছে। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ৫ জানুয়ারি (২০১৫) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একই স্থানে ও একই সময় সমাবেশের আহ্বানে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যে সম্ভাবনা, তাতে আসবে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। বিএনপি দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপি’ হলেও বিএনপি ‘কারচুপি’র প্রতিবাদে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপির এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে এবং গণতন্ত্র ক্রমেই হয়ে উঠবে একদলীয়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ‘শক্তিশালী বিরোধী দলের’ অভাব অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে উৎসাহ জোগাবে মাত্র। বাংলাদেশে বিএনপির আবির্ভাব একটি বাস্তবতা। এ দেশের জনগোষ্ঠীর ৩২ থেকে ৩৩ ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি। সুতরাং এ দলটিকে বাদ দেয়া যাবে না। বিএনপি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কতটুকু ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে কিংবা তাদের ‘নির্বাচন বয়কটের’ সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক ছিল, তা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিতে বিএনপি ফিরে আসায়, সরকারের উচিত ছিল বিএনপির এই ‘অবস্থান’কে সমর্থন করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে মাত্র। এই উত্তাপ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments