ফ্যাসিবাদ কি ফিরে এল? by রবার্ট ও. প্যাক্সটন
গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মম্ভরি বাগাড়ম্বর |
নতুন
বছর কেমন কাটবে বিশ্ববাসীর? পৃথিবীর প্রথম সারির নেতা ও ভাবুকেরা তুলে
ধরেছেন তার এক আগাম ছবি। বাংলাদেশে শুধু প্রথম আলোকে দেওয়া প্রজেক্ট
সিন্ডিকেটের নিবন্ধ নিয়ে চার দিনব্যাপী বিশেষ আয়োজন। আজ ছাপা হলো শেষ দুটি
লেখা।
২০১৫ সালে ‘ফ্যাসিবাদ’ আবারও সাধারণভাবে সর্বাধিক ব্যবহৃত রাজনৈতিক অভিধায় পরিণত হয়েছে। যখন আমরা এমন ভাষা ও আচরণের সামনে পড়ি, ভাসা-ভাসাভাবে যা হিটলার ও মুসোলিনির সঙ্গে মিলে যায়, তখন ফ্যাসিবাদের তকমা ব্যবহারের প্ররোচনা এড়ানো কঠিন। হাল আমলে খাপছাড়াভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, টি পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও জঙ্গি ইসলামি ঘাতকদের বেলায় গড়পড়তাভাবে এই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের শক্তিগুলোকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে আখ্যায়িত করার ঝোঁকটা বোধগম্য হলেও এ প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।
১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিবাদের জন্মের সময় (প্রথমে ইতালিতে, পরে জার্মানিতে) তা ছিল (তাদের ধারণায়) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিক্রিয়া। মুসোলিনি ও হিটলার দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি তিরস্কার আর জার্মানি পরাজয়ের শিকার হয়েছিল। কারণ গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেশ দুটির জাতীয় ঐক্য ও ইচ্ছাশক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
তাই এ দুই নেতা তাঁদের অনুসারীদের উর্দি পরালেন এবং তাঁদের কাজ ও চিন্তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চেষ্টা করলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁরা জনগণের জীবনের সব দিকের ওপর চরম কর্তৃত্ব প্রসারিত করতে চাইলেন। এমনকি মুসোলিনির অধীনে খেলার আয়োজন এবং তা তদারক করত ‘ইল দোপোলাভারো’ নামের রাষ্ট্রীয় সংস্থা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অন্য এক রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান ঘটছিল: সাম্যবাদ।
ফ্যাসিবাদীরা এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবন্ধক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছিল (এবং এলিটদের সমর্থন পেয়েছিল)। আন্তর্জাতিকতাবাদী সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ফ্যাসিবাদীরা হাজির করেছিল জাতীয় সমাজতন্ত্রের রূপরেখা। যখন তারা ধ্বংস করছিল সমাজতন্ত্রী দলগুলোকে, উঠিয়ে দিচ্ছিল স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন, তখন একবারও তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সামাজিক কল্যাণের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্ন করেনি (অবশ্য অভ্যন্তরীণ শত্রু, যেমন ইহুদিরা এর বাইরে ছিল)।
আজ যে আন্দোলন নিজেদের নাম দিয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট’, দৃশ্যত তারা এই ছাঁচে ভালোভাবেই মিলে যায়। এর অনুসারীদের ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত পরিচয় আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত। এরই চূড়ান্ত রূপ হলো চরম আত্মদান: সুইসাইড বা আত্মঘাত। কিন্তু তা হলেও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য আছে। ইসলামিক স্টেট যতটা না রাষ্ট্র, তার চেয়ে বেশি খেলাফত হতে ইচ্ছুক। এটা ধর্মের কর্তৃত্বের প্রতি এমনভাবে নিবেদিত যে তা বিদ্যমান জাতিরাষ্ট্রের সীমা অমান্য তো করেই, এমনকি সেসবকে হুমকিতেও ফেলে। এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে যায় লোকচক্ষুর অগোচরে এবং স্থানীয় শাখাগুলোর ওপর কৌশল ও কর্মসূচিগত উদ্যোগের ভার বণ্টন করা থাকে। কোনো ভৌগোলিক কেন্দ্রের প্রয়োজন তাদের নেই।
ফ্যাসিবাদীরা ছিল জাতীয়তাবাদী। তাদের শিকড় ছিল জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে, সেই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী এবং আরও বর্ধিত করাই ছিল তাদের আরাধ্য। ফ্যাসিবাদী নেতারা ও সরকারগুলো ধর্মকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের অধীনস্থ করতে যথাসম্ভব সবকিছু্ করেছিল। ইসলামিক স্টেটকে আমরা বড়জোর ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের একটি ধরন বলতে পারি। কিন্তু এটা চিরায়ত ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ একনায়কতন্ত্র এবং সেগুলোর চটকদার নেতাদের থেকে মৌলিকভাবেই আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্রের টি পার্টির অবস্থান ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রবাদিতার থেকে অনেক দূরে। সব ধরনের সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা এবং অন্যের প্রতি দায়দায়িত্বের তীব্র বিরোধিতার বৈশিষ্ট্যের কারণে টি পার্টিকে বরং ডানপন্থী নৈরাজ্যবাদ বলাই সঠিক হয়। এটা হলো লাগামছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। সমাজের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা মানতে না চাওয়া তো ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর সামাজিক দায়বদ্ধতার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ফ্যাসিবাদী চিন্তার একেবারে বিপরীত।
ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের শিকড় অবশ্যই রোপিত আছে ভিচি ফ্রান্সে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান দখলদারির অধীনস্থ ফ্রান্সকে বলা হয় ভিচি ফ্রান্স। তখন প্যারিসের বদলে ভিচি শহরে ছিল এই সরকারের সদর দপ্তর)। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জ্যঁ মারি ল্য পেন গোড়া থেকেই ফ্রান্সের রিপাবলিকান ঐতিহ্যের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে আসছেন। ল্য পেনের মেয়ে মারিনের নেতৃত্বে এই দলের ক্রমবর্ধমান সাফল্যের কারণ আর কিছু নয়, রাস্তার বিক্ষোভ এবং হলোকস্ট অস্বীকার থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা।
সব মিলিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়টা স্বতন্ত্র। দৃশ্যত মনে হয়, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়নের জন্য তিনি বেশ কিছু ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা ধার করেছেন। যেমন: জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদী দম্ভ, জাতীয় পতন ও দুর্বলতার ভয়, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, তথাকথিত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনের শাসন বাতিল করার ব্যগ্রতা। তাঁর তর্জন-গর্জন, জনসভা মাতানোর শৈলী এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের দক্ষতাও মুসোলিনি ও হিটলারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এসব লক্ষণ ফ্যাসিবাদী ভাব ও ভঙ্গির খুব কাছাকাছি হলেও উভয়ের অন্তর্লীন মতাদর্শগত সারবস্তু খুবই আলাদা। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় সাধারণত সম্পদের যতটা মালিকানা মেনে নেওয়া হয়, এদের বেলায় সম্পদের ভূমিকা তার থেকেও বেশি। ট্রাম্প ফ্যাসিবাদের ভাব ও ভঙ্গি বরণ করেছেন যতটা না এসবের কুৎসিত ইতিহাস বিষয়ে সজ্ঞান থেকে, খুব সম্ভব তার চেয়ে বেশি কৌশলগত সুবিধার জন্য।
স্পষ্টতই ট্রাম্পের ভাষা ও বক্তব্যের ধরন যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, সে ব্যাপারে তিনি আগাগোড়াই দায়িত্বহীন। এতে অবাক হওয়া উচিত নয়। কেননা, তিনি যে ঘৃণা ছড়ান, তার প্রভাবের বিষয়েও তিনি একই রকম দায়িত্বহীন। এটা খুবই খারাপ ব্যাপার যে ঘৃণাজীবী এসব মানুষ ও আন্দোলনকে বর্ণনা করার জন্য ফ্যাসিবাদের মতো তেজস্ক্রিয় আর কোনো অভিধা আমরা তৈরি করতে পারিনি।
এর বদলে আরও সাধারণ শব্দ দিয়ে আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে, যেমন: ইসলামিক স্টেটের জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদ, টি পার্টির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল নৈরাজ্যবাদ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায় গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থে আত্মম্ভরি বাগাড়ম্বর। এর বাইরে কিছু প্রান্তিক আন্দোলনও দেখা যাচ্ছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ‘এরিয়ান নেশন’ এবং গ্রিসে ‘গোল্ডেন ডন’ আন্দোলন। এগুলো সরাসরি নাৎসি প্রতীক এবং শারীরিক সহিংসতার ব্যবহার ঘটায়। ফ্যাসিবাদ অভিধাটি এদের জন্যই বরাদ্দ করা ভালো।
২০১৫ সালে ‘ফ্যাসিবাদ’ আবারও সাধারণভাবে সর্বাধিক ব্যবহৃত রাজনৈতিক অভিধায় পরিণত হয়েছে। যখন আমরা এমন ভাষা ও আচরণের সামনে পড়ি, ভাসা-ভাসাভাবে যা হিটলার ও মুসোলিনির সঙ্গে মিলে যায়, তখন ফ্যাসিবাদের তকমা ব্যবহারের প্ররোচনা এড়ানো কঠিন। হাল আমলে খাপছাড়াভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, টি পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও জঙ্গি ইসলামি ঘাতকদের বেলায় গড়পড়তাভাবে এই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের শক্তিগুলোকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে আখ্যায়িত করার ঝোঁকটা বোধগম্য হলেও এ প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।
১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিবাদের জন্মের সময় (প্রথমে ইতালিতে, পরে জার্মানিতে) তা ছিল (তাদের ধারণায়) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিক্রিয়া। মুসোলিনি ও হিটলার দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি তিরস্কার আর জার্মানি পরাজয়ের শিকার হয়েছিল। কারণ গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেশ দুটির জাতীয় ঐক্য ও ইচ্ছাশক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
তাই এ দুই নেতা তাঁদের অনুসারীদের উর্দি পরালেন এবং তাঁদের কাজ ও চিন্তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চেষ্টা করলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁরা জনগণের জীবনের সব দিকের ওপর চরম কর্তৃত্ব প্রসারিত করতে চাইলেন। এমনকি মুসোলিনির অধীনে খেলার আয়োজন এবং তা তদারক করত ‘ইল দোপোলাভারো’ নামের রাষ্ট্রীয় সংস্থা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অন্য এক রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান ঘটছিল: সাম্যবাদ।
ফ্যাসিবাদীরা এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবন্ধক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছিল (এবং এলিটদের সমর্থন পেয়েছিল)। আন্তর্জাতিকতাবাদী সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ফ্যাসিবাদীরা হাজির করেছিল জাতীয় সমাজতন্ত্রের রূপরেখা। যখন তারা ধ্বংস করছিল সমাজতন্ত্রী দলগুলোকে, উঠিয়ে দিচ্ছিল স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন, তখন একবারও তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সামাজিক কল্যাণের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্ন করেনি (অবশ্য অভ্যন্তরীণ শত্রু, যেমন ইহুদিরা এর বাইরে ছিল)।
আজ যে আন্দোলন নিজেদের নাম দিয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট’, দৃশ্যত তারা এই ছাঁচে ভালোভাবেই মিলে যায়। এর অনুসারীদের ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত পরিচয় আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত। এরই চূড়ান্ত রূপ হলো চরম আত্মদান: সুইসাইড বা আত্মঘাত। কিন্তু তা হলেও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য আছে। ইসলামিক স্টেট যতটা না রাষ্ট্র, তার চেয়ে বেশি খেলাফত হতে ইচ্ছুক। এটা ধর্মের কর্তৃত্বের প্রতি এমনভাবে নিবেদিত যে তা বিদ্যমান জাতিরাষ্ট্রের সীমা অমান্য তো করেই, এমনকি সেসবকে হুমকিতেও ফেলে। এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে যায় লোকচক্ষুর অগোচরে এবং স্থানীয় শাখাগুলোর ওপর কৌশল ও কর্মসূচিগত উদ্যোগের ভার বণ্টন করা থাকে। কোনো ভৌগোলিক কেন্দ্রের প্রয়োজন তাদের নেই।
ফ্যাসিবাদীরা ছিল জাতীয়তাবাদী। তাদের শিকড় ছিল জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে, সেই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী এবং আরও বর্ধিত করাই ছিল তাদের আরাধ্য। ফ্যাসিবাদী নেতারা ও সরকারগুলো ধর্মকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের অধীনস্থ করতে যথাসম্ভব সবকিছু্ করেছিল। ইসলামিক স্টেটকে আমরা বড়জোর ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের একটি ধরন বলতে পারি। কিন্তু এটা চিরায়ত ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ একনায়কতন্ত্র এবং সেগুলোর চটকদার নেতাদের থেকে মৌলিকভাবেই আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্রের টি পার্টির অবস্থান ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রবাদিতার থেকে অনেক দূরে। সব ধরনের সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা এবং অন্যের প্রতি দায়দায়িত্বের তীব্র বিরোধিতার বৈশিষ্ট্যের কারণে টি পার্টিকে বরং ডানপন্থী নৈরাজ্যবাদ বলাই সঠিক হয়। এটা হলো লাগামছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। সমাজের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা মানতে না চাওয়া তো ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর সামাজিক দায়বদ্ধতার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ফ্যাসিবাদী চিন্তার একেবারে বিপরীত।
ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের শিকড় অবশ্যই রোপিত আছে ভিচি ফ্রান্সে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান দখলদারির অধীনস্থ ফ্রান্সকে বলা হয় ভিচি ফ্রান্স। তখন প্যারিসের বদলে ভিচি শহরে ছিল এই সরকারের সদর দপ্তর)। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জ্যঁ মারি ল্য পেন গোড়া থেকেই ফ্রান্সের রিপাবলিকান ঐতিহ্যের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে আসছেন। ল্য পেনের মেয়ে মারিনের নেতৃত্বে এই দলের ক্রমবর্ধমান সাফল্যের কারণ আর কিছু নয়, রাস্তার বিক্ষোভ এবং হলোকস্ট অস্বীকার থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা।
সব মিলিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়টা স্বতন্ত্র। দৃশ্যত মনে হয়, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়নের জন্য তিনি বেশ কিছু ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা ধার করেছেন। যেমন: জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদী দম্ভ, জাতীয় পতন ও দুর্বলতার ভয়, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, তথাকথিত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনের শাসন বাতিল করার ব্যগ্রতা। তাঁর তর্জন-গর্জন, জনসভা মাতানোর শৈলী এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের দক্ষতাও মুসোলিনি ও হিটলারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এসব লক্ষণ ফ্যাসিবাদী ভাব ও ভঙ্গির খুব কাছাকাছি হলেও উভয়ের অন্তর্লীন মতাদর্শগত সারবস্তু খুবই আলাদা। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় সাধারণত সম্পদের যতটা মালিকানা মেনে নেওয়া হয়, এদের বেলায় সম্পদের ভূমিকা তার থেকেও বেশি। ট্রাম্প ফ্যাসিবাদের ভাব ও ভঙ্গি বরণ করেছেন যতটা না এসবের কুৎসিত ইতিহাস বিষয়ে সজ্ঞান থেকে, খুব সম্ভব তার চেয়ে বেশি কৌশলগত সুবিধার জন্য।
স্পষ্টতই ট্রাম্পের ভাষা ও বক্তব্যের ধরন যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, সে ব্যাপারে তিনি আগাগোড়াই দায়িত্বহীন। এতে অবাক হওয়া উচিত নয়। কেননা, তিনি যে ঘৃণা ছড়ান, তার প্রভাবের বিষয়েও তিনি একই রকম দায়িত্বহীন। এটা খুবই খারাপ ব্যাপার যে ঘৃণাজীবী এসব মানুষ ও আন্দোলনকে বর্ণনা করার জন্য ফ্যাসিবাদের মতো তেজস্ক্রিয় আর কোনো অভিধা আমরা তৈরি করতে পারিনি।
এর বদলে আরও সাধারণ শব্দ দিয়ে আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে, যেমন: ইসলামিক স্টেটের জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদ, টি পার্টির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল নৈরাজ্যবাদ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায় গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থে আত্মম্ভরি বাগাড়ম্বর। এর বাইরে কিছু প্রান্তিক আন্দোলনও দেখা যাচ্ছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ‘এরিয়ান নেশন’ এবং গ্রিসে ‘গোল্ডেন ডন’ আন্দোলন। এগুলো সরাসরি নাৎসি প্রতীক এবং শারীরিক সহিংসতার ব্যবহার ঘটায়। ফ্যাসিবাদ অভিধাটি এদের জন্যই বরাদ্দ করা ভালো।
রবার্ট ও. প্যাক্সটন |
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ও. প্যাক্সটন: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর ইমেরিটাস, অ্যানাটমি অব ফ্যাসিজম গ্রন্থের লেখক।
রবার্ট ও. প্যাক্সটন: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর ইমেরিটাস, অ্যানাটমি অব ফ্যাসিজম গ্রন্থের লেখক।
No comments