পৌর নির্বাচনের পর সংকট আরও গভীর হল by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেশ যে রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিল, সে সংকটটি ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের পর আরও গভীর হয়েছে। রাজনৈতিক সংকটটির সূত্রপাত হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মধ্য দিয়ে। এ সংশোধনীতে মহাজোট সরকার প্রায় সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল ও নাগরিক সমাজের পরামর্শ উপেক্ষা করে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে সে ব্যবস্থা বিচারপতি খায়রুল হকের একটি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশ ব্যবহার করে এককভাবে বাতিল করে দিয়ে দলীয় ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। অথচ মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কোনো প্রতিশ্র“তি ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সংস্কার না করে, বিচারপতি হকের রায়ে আরও দু’বার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাধীন সংসদ নির্বাচনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার স্বার্থে এ ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। উল্লেখ্য, এ কাজটি করার আগে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ওই সময়ের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে এক বিরল ও অভিনব বৈচিত্র্য নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
সরকারি দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ সমর্থকরা ভেবেছিলেন সরকার হয়তো নিজেদের অধীনে ভালো এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে বিএনপির ৫ জানুয়ারি তারিখে দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। এ প্রক্রিয়ায় তারা হয়তো প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অবিতর্কিত ও দুর্নীতি-কারচুপিমুক্তভাবে করে নাগরিক মনে এ বিশ্বাস আনবে যে দলীয় সরকারাধীনে তারা ভালো নির্বাচন করতে সক্ষম। কিন্তু না, সরকারি দলের সমর্থকদের সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের অধীনে পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ, ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সবশেষে সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচন দেখার পর তারা বুঝতে পেরেছেন যে, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি যতটা মনোযোগী, তার চেয়ে বেশি মনোযোগী যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে জিততে। নির্বাচনে জিততে তারা নির্বাচনী সুষ্ঠুতা জলাঞ্জলি দিতেও প্রস্তুত। দশম সংসদ নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত তিন তিনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অনুষ্ঠান ভঙ্গিমা দেখে তাদের এ ধারণা হয়েছে। এখন তারা বুঝতে পেরেছে, এ সরকারের অধীনে দলীয়করণকৃত প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এবং সরকারে শরিক এরশাদের ভাষায় ‘মেরুদণ্ডহীন’ এবং হুকুমবরদার কাজী রকিব নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনে সরকারি দল প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে অধিকতর শক্তি প্রয়োগ করবে। কারণ, যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হেরে গেলেও তাদের কোনো ক্ষতি হতো না, ক্ষমতা ছাড়তে হতো না, সেই নির্বাচনে জিততেই যখন সরকারি দল এতটা মরিয়া হতে পারে, তখন সরকারে থাকা না থাকার সংসদ নির্বাচনে তারা কতটা বেপরোয়া হয়ে নির্বাচনে জিততে চাইবে তা নাগরিক সমাজ অনুধাবন করতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানে কাজী রকিব কমিশন মোটেও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে পারেনি। অবশ্য ‘নুন খাব যার, গুণ গাব তার’ নীতি অবলম্বন করা কিছু দেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষক রকিব ইসির কিছুটা প্রশংসা করলেও নাগরিক সমাজের বিবেচনায় এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিশনের চরিত্রে নিরপেক্ষ রেফারির পরিবর্তে হুকুমবরদারি চরিত্র প্রতিফলিত হয়। সাংগঠনিকভাবে এলোমেলো অবস্থায় থাকায় নির্বাচনের তারিখ দু’সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার বিএনপির অনুরোধ ইসি আমলে নেয়নি। বিবেচনায় নেয়নি আইন-শৃংখলা রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধও। নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস-সহিংসতায় যারা নিহত এবং আহত হলেন সে দায় কি নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে না? পৌরসভা নির্বাচনের সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর থেকে নাশকতা দমনের নামে শত শত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলেও ইসি সে ব্যাপারে নীরব ছিল। পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী নভেম্বর মাসের প্রথম দু’সপ্তাহে ৮ হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং এ গ্রেফতার প্রক্রিয়া ডিসেম্বর মাসেও অব্যাহত ছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি সুবিধাভোগীদের অংশগ্রহণ করতে দিলে নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ হয় না জেনেও নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে ইসির পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তার দু’জনই সরকারি সুবিধাভোগীদের প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে নিজেদের হুকুমবরদারি চরিত্র উন্মোচন করেন।
পৌর নির্বাচনের প্রাক্কালে এ নির্বাচনকে লক্ষ করে খালেদা জিয়া একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চাইলে কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেল তা প্রচারে সাহস করেনি বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে সরকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খালেদা জিয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের বাধা দূর করে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারত। কিন্তু কমিশন এ ব্যাপারটি না শোনার ভান করে স্বচ্ছন্দবোধ করেছে। তাছাড়া নিজস্ব লোকবল থাকা সত্ত্বেও ইসি সরকারি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সমালোচিত হয়। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গকারী সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিদের প্রতি কঠোর মনোভাব না দেখিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে অনুরোধ করে ইসির স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক দায়িত্বশীলতা ভূলুণ্ঠিত করেন। চতুর্থ উপজেলা পরিষদ এবং তিন সিটি নির্বাচনের মতো পৌরসভা নির্বাচনেও ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে ব্যর্থ হয়।
স্বীকার্য, সব বড় দল অংশগ্রহণ করায় পৌর নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়ে নতুন মাত্রা পায় এবং ভোটাররা এ সরকারামলের পূর্ববর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর চেয়ে এ নির্বাচনটিতে অধিক হারে ভোট প্রদান করেন। নির্বাচনের আগেই প্রার্থী না থাকায় সাতজন মেয়র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে ১৯ পৌরসভার ভোট গ্রহণ স্থগিত এবং একটি পৌরসভার ভোট বাতিল করা হয়। ২০৭ পৌরসভার মেয়র পদে ভোট কাস্ট হয় ৭৩.৯২ ভাগ। এর মধ্যে পাঁচ পৌরসভায় ৯০ ভাগের বেশি এবং ৭৪ পৌরসভায় ৮০ ভাগের বেশি ভোট পড়াকে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সন্দেহজনক বিবেচনা করেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৌর নির্বাচনে একজন ভোটারকে তিন ধরনের ব্যালটে সিল দিতে হয়। এর জন্য অন্তত তিন মিনিট লাগার কথা, যে কারণে ৯০ ভাগের বেশি ভোট পড়াটা অবিশ্বাস্য।’ বেশি ভোট পড়ার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, যেসব ভোট কেন্দ্র সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারতে পেরেছে, বা যেসব কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না, অথবা থাকলেও হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে, ওই কেন্দ্রগুলোতে অনেক বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে। তা ছাড়া দুই দলের মধ্যে যেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার কথা, সেখানে এ নির্বাচনের ফলাফলে যুগপৎ আসন এবং ভোটের ব্যবধান দেখেও দুর্নীতি-কারচুপির মাত্রা অনুধাবন করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের ২০৭ মেয়র আসনের বেসরকারি ফলাফলে আওয়ামী লীগের ১৬৮ এবং বিএনপির ১৯টি আসন পাওয়া নাগরিক সমাজের ধারণার সঙ্গে মেলে না। একইভাবে বিজয়ী ও বিজিতদের ভোটপ্রাপ্তির উচ্চ ব্যবধানেও এ অসঙ্গতি বিধৃত। যেমন, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এবং রাজশাহীর কেশরহাটে যেখানে সরকারি দলের মেয়রপ্রার্থী পান যথাক্রমে ২০ হাজার ৬৯০ এবং ৭ হাজার ৩৪৩ ভোট, সেখানে ওই দুই পৌরসভায় বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থী পান যথাক্রমে ৪৬৪ এবং ৯৯ ভোট। এ কেমন হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার নমুনা!
নির্বাচন দিনের ভোট কেন্দ্রের পরিবেশ, সন্ত্রাস-সহিংসতা, দুর্নীতি-কারচুপি এবং নির্বাচন সংক্রান্ত সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, পৌর নির্বাচনটি কালিমাযুক্ত নির্বাচনের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। নির্বাচনের দিন কেন্দ্র দখল, কিছু কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারদের আয়ত্তে নিয়ে ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া, প্রার্থী ও ভোটারদের হুমকি-ধমকি করা, জাল ভোটের উৎসব করা, বিরোধীদলীয় সমর্থকদের প্রকাশ্যে ভোটদানে বাধ্য করা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মারধর করা, সন্ত্রাসজনিত কারণে ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়াসহ এ নির্বাচনে আরও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। এ নির্বাচনের ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এভাবে ভোট ডাকাতি করে বিজয়ী হওয়ার মধ্যে আনন্দ নেই। কারণ তারা নির্বাচনে আইনশৃংখলা বাহিনীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। তাই হাসিনা-রকিবের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’ পৌর নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে তিনি আরও বলেন, ‘দেশের জনগণ এ ফল মানে না, অন্য কোনো দলও মানছে না। কেবল যারা চুরি করে জিতে এসেছে তারাই বেশি করে ঢোল পেটাচ্ছে, নানা রকম উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে।’ পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আর একবার প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে এখনও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি হয়নি। নাগরিক মনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে শংকা ছিল, পৌর নির্বাচন সে শংকাকে আরও গভীর করেছে।
হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্নীতি-কারচুপি হয়েছে। এসব নির্বাচনে যারা সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে দুর্নীতি-কারচুপি করেছে তাদের শাস্তি না দিয়ে আশকারা দেয়া হয়েছে। কাজেই নির্বাচনী স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিকতা (!) প্রসঙ্গে নাগরিক সমাজ একটি ধারণা পেয়েছে। এখন সরকার কোন মুখে বলবে যে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ হবে? সরকার যদি স্বচ্ছ নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ তা বিশ্বাস করবে না। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়টি নিয়ে যে সংকট চলমান ছিল দুর্নীতি-কারচুপি ও কালিমাযুক্ত পৌরসভা নির্বাচন সে সংকটটিকে আরও গভীর করল।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.