নতুন বছরের অর্থনীতিটা কেমন হবে? by ড. আর এম দেবনাথ
নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
প্রথম
তিন মাস বাদে ২০১৫ সালটি ভালোয় ভালোয়ই গেছে- রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে।
ইতিমধ্যেই ২০১৬ সালের তিনদিন বিগত। এই মুহূর্তে আলোচনা করলে দুই বছরের
আলোচনা করতে হয়- কেমন গেল ২০১৫, আর কেমন যাবে ২০১৬ সাল। বিশাল আলোচনা,
সন্দেহ নেই। তবে আলোচনা আর কী করব! তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাই
না। মনে হয় এক রকম, কাগজে দেখি আরেক রকম। বোঝাতে হলে বিষয়টি ব্যাংক দিয়ে
শুরু করতে হয়। সবাই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখলাম ব্যাংকের ব্যবসা ভালো
নয়, প্রচুর টাকা অব্যবহৃত হিসেবে পড়ে রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকই বলছে
অক্টোবর শেষে ২০১৫ সালে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯ ভাগ। আর একই সময়ে
ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১১ দশমিক ৫ ভাগ। অর্থাৎ আমানত বেশি, ঋণ মানুষ নিচ্ছে
কম। অর্থাৎ ঋণের চাহিদা কম। ঋণ ব্যবহার করার মতো অবস্থা পুরোপুরি দেশে নেই।
আবার ঋণের ওপর সুদের হার বেশ কমেছে। ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ড দাবির মুখে
ব্যাংকগুলো তা করেছে। অবশ্য ঋণের ওপর সুদ কমাতে গিয়ে আমানতের ওপরও সুদের
হার কমাতে হয়েছে। দুইয়ের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ‘স্প্রেড’ হ্রাস পেয়েছে।
‘স্প্রেড’ মানে ঋণের ওপর সুদ এবং আমানতের ওপর সুদের পার্থক্য। খুবই ভালো
খবর ‘স্প্রেড’ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত হার হচ্ছে ৫ শতাংশ। অথচ তা
এখন ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থাও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে
সুবিধাজনক নয়। শোনা যায়, মোট ১১টি ব্যাংকে এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
‘অবজারভার’ (পুলিশ) বসানো হয়েছে পুলিশিং করার জন্য। তারা ব্যাংকের দেখভাল
করবে। এত কথা কেন বললাম প্রারম্ভেই। বললাম, দেখা যাচ্ছে এরপরও ব্যাংকগুলোর
লাভের কমতি নেই। প্রায় সবারই লাভ বেড়েছে। মজা হচ্ছে এতদসত্ত্বেও অনেক
ব্যাংক বহু মধ্যবয়স্ক লোককে নানা ‘অপবাদে’ চাকরিচ্যুত করেছে। প্রশ্ন,
ব্যবসায়ীদের কথা হচ্ছে ব্যবসা করা যাচ্ছে না, বিনিয়োগ হচ্ছে না, বেচাকেনা
কম। মধ্যবিত্তের হাতে টাকা নেই। তাহলে ব্যাংকের মুনাফা কোত্থেকে এল? কীভাবে
তারা মন্দা বাজারে গেল বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা করে। এসব বোঝা আমার পক্ষে
খুবই কঠিন। হয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন নতুবা ব্যাংকের মুনাফার হিসাব
ভিত্তিহীন। এখন কোনটা যে সত্যি বলা কঠিন।
যাই বলি না কেন, সরকারের তথ্য অস্বীকার করার মতো তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে বাস্তব বলে একটা কথা আছে। তালগাছকে বেলগাছ বলা যাবে না। সত্যের মধ্যেই, তথ্যেই মধ্যেই ফাঁকফোকর থাকে। গোমড় ওখানেই। আমাদের ‘জিডিপি’ বাড়ছে। বিগত পাঁচ বছর ধরে ৬ শতাংশের ওপরে বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫১ হারে। এটা সরকারি তথ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য। আবার এও সত্য আমরা এক ফাঁকে জিডিপি ‘ক্যালকুলেশন’ পদ্ধতি পরিবর্তন করেছি। এই পরিবর্তনের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে কী প্রভাব পড়েছে তা তো বলা হচ্ছে না। এমন সব অনেক কথা আছে। বেফাঁস কথা আছে। উত্তেজনার মুহূর্তে আমরা এসব আলোচনা করি না। ২০১৫ সালে আমরা ‘মধ্যম আয়ের’ দেশ হয়েছি। কিন্তু খবর তো এখানে শেষ নয়। এখন জাপানসহ ‘দানবীররা’ (লেন্ডাররা) বলছে ঋণের ওপর সুদের হার বেশি দিতে হবে না। অনেক শর্ত আরও কঠিন হবে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে কী হবে তা তো আমাদেরকে বলা দরকার। আনন্দ করলাম, পরের দিনের দুঃখের কথা জানলাম না, এটা তো হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ‘বিচক্ষণ মুদ্রানীতি’ দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে এই হার মাত্র ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। এই আনন্দের সংবাদের সঙ্গে দুটো দিক জড়িত। মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের ওপরে। ব্যাংক আমানতের ওপরে সুদের হার কত? ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতি পাশাপাশি দেখলে বোঝা যাবে সঞ্চয়কারীদের ‘খুন’ করা হচ্ছে। নিুবিত্ত, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, বিধবা মহিলা, সাধারণ মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত- যারা সুদের ওপর চলেন তাদের কী অবস্থা হল? অবস্থা খুব সহজ : ব্যাংক আমানতের ওপর কোনো সুদ দিচ্ছে না। এটা জাপান নয় যে ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ না দিয়ে বরং উল্টো সার্ভিস চার্জ কাটবে। এই গেল আনন্দের খবরের ভেতরে দুঃখের একটু খোঁচা। তারপরও কথা আছে। আমদানিনির্ভর দেশ আমরা। পৃথিবীতে জিনিসপত্রে দাম এখন কম। জ্বালানি তেলের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিু। এমতাবস্থায় আমদানিজাত মূল্যস্ফীতি তো শূন্য। তাহলে কৃতিত্ব কাকে দেব? বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টাদের যারা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর জন্য ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের ‘এলিট বয়’ হিসাবে ডলারে কাজ করছেন। যেমন কয়দিন আগে অমর্ত্য সেন কথিত ভারতীয় এক ‘এলিট বয়’ আমাদের পিঠ চাপড়ে গেছেন (জানি না তিনি নকশালী ছিলেন কীনা)। প্রশ্ন তো আছে। এই যে উন্নতি, বাজার অর্থনীতি, ৬ শতাংশ গ্রোথ-সবই সত্য। কিন্তু ফলটা তো তারা নিয়ে নিচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে কোন দেশে? যে দেশের ‘বোসরা’ এসে বলছে ‘অপূর্ব’, আগামী দিনের এমার্জিং টাইগার (পাঠক এমার্জিং টাইগার মালয়েশিয়ার কথা একটু মনে রাখবেন)। ২০১৫ সালে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির হার বাড়ল না। আগের বছরের তুলনায় কম। আমানতের প্রবৃদ্ধির তুলনায়ও কম। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে ‘ঋণপত্র সেটেলমেন্ট’-এর পরিমাণ কম। বিনিয়োগকারীদের বিদেশ থেকে ঋণ করতে দেয়া হচ্ছে। ঋণ ওখানে সস্তা। এই টাকা বিনিয়োগে লাগার কথা। অথচ ‘সেটেলমেন্ট’ কম। যদিও ঋণপত্র খোলার হার অনেক বেশি। খোলার হার ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। একটু অস্বাভাবিক নয় কি? ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ এলসি খোলার হার বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ এলসি সেটেলমেন্ট হচ্ছে কম। এর অর্থ কী? রয়েছে আরেক সমস্যা। শিল্পপতিরা প্রতিদিন বলছেন গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ব্যাংকের সুদের হার বেশি। এমতাবস্থায় তারা এত বেশি হারে বছরের শেষে এসে হঠাৎ করে বিপুল এলসি খুলছেন- এর অর্থ কী? নানা সন্দেহ, সন্দেহ আমার নয়। সরকারের এজেন্সিগুলোই প্রায়ই বলছে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ করে টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। হিসাবে কিন্তু মিলে। সারা বিশ্বে সব জিনিসের দাম কম বললে ভুল নয়। মালের ক্রেতা নেই। চীনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্ডার নিচ্ছে। জিনিসের দাম যদি বাড়া নয়, কমে থাকে তাহলে এত বড় অংকের ‘এলসি’ কেন? এত টাকার মাল দিয়ে কী তৈরি হবে দেশে? ২০১৫ সালের অর্থনীতিতে এসব প্রশ্ন উঠছে, উঠছে মানে তুলে রাখলাম।
দেখা যাচ্ছে, রফতানির পারফরম্যান্স ২০১৫ সালে ভালোই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে আমদানি ও রফতানির পার্থক্য। আমরা রফতানির কথাই বেশি বলি। কিন্তু রফতানির বিপরীতে যে ‘হিউজ’ আমদানি হয় এবং আমাদের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ অবস্থা যে খারাপ তা আলোচনায় আসছে। রেমিটেন্সের পরিমাণ কিন্তু স্থবির। এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ ‘এক পুতের’ মায়ের এই দুশ্চিন্তা হয়ই। মোটের ওপর সত্যিকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে রেমিটেন্স- অর্থাৎ এক পুত। এই অবস্থায় এখানে গণ্ডগোল হলে সর্বত্র গণ্ডগোল বাধবে। এত সবের পর একটা কথা বলতেই হবে ২০১৫ সালে আমরা খেয়ে-পরে ছিলাম। উপসের খবর নেই। খাদ্যাভাবের খবর নেই। ফসলহানির খবর নেই। চালের দামের অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের খবর নেই। ডাইভার সাহেবরাও এখন নাজিরশাইল চাল খায়। এসব আনন্দের খবর। শাকসবজির দাম আয়ত্তের মধ্যে। বাজারে জিনিসপত্রের অভাব নেই। ব্যাংকারদের তো পোয়াবারো। সরকারি ব্যাংকের সবাই দিনে ২০০ টাকা পায় ‘লাঞ্চ’ করার জন্য। এই টাকা দিয়ে ঢাকায় কমপক্ষে ৫ কেজি সবজি পাওয়া যায়। দুধের দামটা একটু বেশি। মাছ আমাদের বেড়েছে। চাষের মাছ, ক্ষতি কী? মানুষ তা পাচ্ছে। ২০১৫ সালের সরকারের এটা বড় পারফরম্যান্স। আর ব্যর্থতা যা, তা রোজই আলোচিত হয়। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ব্যবসার পরিবেশ নেই। সুদের হার বেশি। এতদসত্ত্বেও কিন্তু সাড়ে ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে লক্ষ সমালোচনা হতে পারে। এটা দোষণীয় কিছু নয়। তবে ২০১৬ সালটি কিন্তু হতে পারে একটি ক্রিটিক্যাল ইয়ার।
আমরা জানি বেতন বৃদ্ধির কথা। বাজেট ঘোষিত হয়েছে অনেক আগেই। যে লক্ষ্যমাত্রা ধরে বাজেট করা হয়েছে সেই অনুপাতে কাজ না হলে কিন্তু বিপদ হতে পারে। ইকোনমিক মিনিস্ট্রিগুলো সম্বন্ধে ভাবা দরকার। সার্ভিসের লোক হলেই যাকে-তাকে যেখানে-সেখানে বসানো উচিত নয়। পরিসংখ্যান জানেন না, তিনি যদি হন পরিসংখ্যান প্রধান, পরিকল্পনা জানেন না তিনি যদি হন পরিকল্পনা প্রধান, ফিন্যান্স জানেন না তিনি যদি হন অর্থ প্রধান, ব্যাংকিং জানেন না তিনি যদি হন ব্যাংকিং প্রধান- তাহলে বিপদ হওয়ার আশংকা আছে। কোর এরিয়া ফেলে নিয়োগ দেয়া দরকার। বাজেট অঙ্ক নয়। কম্পিউটার লাগিয়ে যোগ-বিয়োগ করে দিলাম আর হয়ে গেল তা নয়। অর্থনীতির মৌলিক দিকগুলো শক্তিশালী আছে। পাটাতন এখনও শক্ত। যদি রেভেনিউ ঠিক না থাকে তাহলে সব চুরমার হয়ে যেতে পারে। কাগজে দেখলাম ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ‘মিসম্যাচ’। ‘মিসম্যাচ’ হতে পারে। এর জন্য ‘রিকনসিলিয়েশন’ করতে হয় নিয়মিতভাবে। এটা না হলে বিপদ। আশা করি সরকার তার রাজস্ব আয়ের বিষয়টি নিয়ে ভাববে। পরিকল্পনা কমিশনে পরিকল্পনা নিয়েই ঝামেলা আছে শোনা যায়। অনেক মন্ত্রীই টার্গেট ঠিক নেই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন- কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। ইকোনমিক মিনিস্ট্রিজের মধ্যে গ্রেটার কোপারেশন দরকার। যে ভিত গড়ে উঠেছে, বেশি খরচের জন্য সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে তা হয় না। এত বড় বেতন বৃদ্ধি অথচ কেউ খুশি নয়। এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। কেউ ভেতর থেকে সর্বনাশের বীজ বপন করছে কিনা। সরকার সাবধান থাকলে ভালো করবে।
ড. আরএম দেবনাথ : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
যাই বলি না কেন, সরকারের তথ্য অস্বীকার করার মতো তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে বাস্তব বলে একটা কথা আছে। তালগাছকে বেলগাছ বলা যাবে না। সত্যের মধ্যেই, তথ্যেই মধ্যেই ফাঁকফোকর থাকে। গোমড় ওখানেই। আমাদের ‘জিডিপি’ বাড়ছে। বিগত পাঁচ বছর ধরে ৬ শতাংশের ওপরে বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫১ হারে। এটা সরকারি তথ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য। আবার এও সত্য আমরা এক ফাঁকে জিডিপি ‘ক্যালকুলেশন’ পদ্ধতি পরিবর্তন করেছি। এই পরিবর্তনের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে কী প্রভাব পড়েছে তা তো বলা হচ্ছে না। এমন সব অনেক কথা আছে। বেফাঁস কথা আছে। উত্তেজনার মুহূর্তে আমরা এসব আলোচনা করি না। ২০১৫ সালে আমরা ‘মধ্যম আয়ের’ দেশ হয়েছি। কিন্তু খবর তো এখানে শেষ নয়। এখন জাপানসহ ‘দানবীররা’ (লেন্ডাররা) বলছে ঋণের ওপর সুদের হার বেশি দিতে হবে না। অনেক শর্ত আরও কঠিন হবে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে কী হবে তা তো আমাদেরকে বলা দরকার। আনন্দ করলাম, পরের দিনের দুঃখের কথা জানলাম না, এটা তো হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ‘বিচক্ষণ মুদ্রানীতি’ দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে এই হার মাত্র ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। এই আনন্দের সংবাদের সঙ্গে দুটো দিক জড়িত। মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের ওপরে। ব্যাংক আমানতের ওপরে সুদের হার কত? ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতি পাশাপাশি দেখলে বোঝা যাবে সঞ্চয়কারীদের ‘খুন’ করা হচ্ছে। নিুবিত্ত, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, বিধবা মহিলা, সাধারণ মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত- যারা সুদের ওপর চলেন তাদের কী অবস্থা হল? অবস্থা খুব সহজ : ব্যাংক আমানতের ওপর কোনো সুদ দিচ্ছে না। এটা জাপান নয় যে ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ না দিয়ে বরং উল্টো সার্ভিস চার্জ কাটবে। এই গেল আনন্দের খবরের ভেতরে দুঃখের একটু খোঁচা। তারপরও কথা আছে। আমদানিনির্ভর দেশ আমরা। পৃথিবীতে জিনিসপত্রে দাম এখন কম। জ্বালানি তেলের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিু। এমতাবস্থায় আমদানিজাত মূল্যস্ফীতি তো শূন্য। তাহলে কৃতিত্ব কাকে দেব? বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টাদের যারা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর জন্য ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের ‘এলিট বয়’ হিসাবে ডলারে কাজ করছেন। যেমন কয়দিন আগে অমর্ত্য সেন কথিত ভারতীয় এক ‘এলিট বয়’ আমাদের পিঠ চাপড়ে গেছেন (জানি না তিনি নকশালী ছিলেন কীনা)। প্রশ্ন তো আছে। এই যে উন্নতি, বাজার অর্থনীতি, ৬ শতাংশ গ্রোথ-সবই সত্য। কিন্তু ফলটা তো তারা নিয়ে নিচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে কোন দেশে? যে দেশের ‘বোসরা’ এসে বলছে ‘অপূর্ব’, আগামী দিনের এমার্জিং টাইগার (পাঠক এমার্জিং টাইগার মালয়েশিয়ার কথা একটু মনে রাখবেন)। ২০১৫ সালে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির হার বাড়ল না। আগের বছরের তুলনায় কম। আমানতের প্রবৃদ্ধির তুলনায়ও কম। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে ‘ঋণপত্র সেটেলমেন্ট’-এর পরিমাণ কম। বিনিয়োগকারীদের বিদেশ থেকে ঋণ করতে দেয়া হচ্ছে। ঋণ ওখানে সস্তা। এই টাকা বিনিয়োগে লাগার কথা। অথচ ‘সেটেলমেন্ট’ কম। যদিও ঋণপত্র খোলার হার অনেক বেশি। খোলার হার ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। একটু অস্বাভাবিক নয় কি? ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ এলসি খোলার হার বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ এলসি সেটেলমেন্ট হচ্ছে কম। এর অর্থ কী? রয়েছে আরেক সমস্যা। শিল্পপতিরা প্রতিদিন বলছেন গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ব্যাংকের সুদের হার বেশি। এমতাবস্থায় তারা এত বেশি হারে বছরের শেষে এসে হঠাৎ করে বিপুল এলসি খুলছেন- এর অর্থ কী? নানা সন্দেহ, সন্দেহ আমার নয়। সরকারের এজেন্সিগুলোই প্রায়ই বলছে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ করে টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। হিসাবে কিন্তু মিলে। সারা বিশ্বে সব জিনিসের দাম কম বললে ভুল নয়। মালের ক্রেতা নেই। চীনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্ডার নিচ্ছে। জিনিসের দাম যদি বাড়া নয়, কমে থাকে তাহলে এত বড় অংকের ‘এলসি’ কেন? এত টাকার মাল দিয়ে কী তৈরি হবে দেশে? ২০১৫ সালের অর্থনীতিতে এসব প্রশ্ন উঠছে, উঠছে মানে তুলে রাখলাম।
দেখা যাচ্ছে, রফতানির পারফরম্যান্স ২০১৫ সালে ভালোই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে আমদানি ও রফতানির পার্থক্য। আমরা রফতানির কথাই বেশি বলি। কিন্তু রফতানির বিপরীতে যে ‘হিউজ’ আমদানি হয় এবং আমাদের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ অবস্থা যে খারাপ তা আলোচনায় আসছে। রেমিটেন্সের পরিমাণ কিন্তু স্থবির। এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ ‘এক পুতের’ মায়ের এই দুশ্চিন্তা হয়ই। মোটের ওপর সত্যিকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে রেমিটেন্স- অর্থাৎ এক পুত। এই অবস্থায় এখানে গণ্ডগোল হলে সর্বত্র গণ্ডগোল বাধবে। এত সবের পর একটা কথা বলতেই হবে ২০১৫ সালে আমরা খেয়ে-পরে ছিলাম। উপসের খবর নেই। খাদ্যাভাবের খবর নেই। ফসলহানির খবর নেই। চালের দামের অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের খবর নেই। ডাইভার সাহেবরাও এখন নাজিরশাইল চাল খায়। এসব আনন্দের খবর। শাকসবজির দাম আয়ত্তের মধ্যে। বাজারে জিনিসপত্রের অভাব নেই। ব্যাংকারদের তো পোয়াবারো। সরকারি ব্যাংকের সবাই দিনে ২০০ টাকা পায় ‘লাঞ্চ’ করার জন্য। এই টাকা দিয়ে ঢাকায় কমপক্ষে ৫ কেজি সবজি পাওয়া যায়। দুধের দামটা একটু বেশি। মাছ আমাদের বেড়েছে। চাষের মাছ, ক্ষতি কী? মানুষ তা পাচ্ছে। ২০১৫ সালের সরকারের এটা বড় পারফরম্যান্স। আর ব্যর্থতা যা, তা রোজই আলোচিত হয়। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ব্যবসার পরিবেশ নেই। সুদের হার বেশি। এতদসত্ত্বেও কিন্তু সাড়ে ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে লক্ষ সমালোচনা হতে পারে। এটা দোষণীয় কিছু নয়। তবে ২০১৬ সালটি কিন্তু হতে পারে একটি ক্রিটিক্যাল ইয়ার।
আমরা জানি বেতন বৃদ্ধির কথা। বাজেট ঘোষিত হয়েছে অনেক আগেই। যে লক্ষ্যমাত্রা ধরে বাজেট করা হয়েছে সেই অনুপাতে কাজ না হলে কিন্তু বিপদ হতে পারে। ইকোনমিক মিনিস্ট্রিগুলো সম্বন্ধে ভাবা দরকার। সার্ভিসের লোক হলেই যাকে-তাকে যেখানে-সেখানে বসানো উচিত নয়। পরিসংখ্যান জানেন না, তিনি যদি হন পরিসংখ্যান প্রধান, পরিকল্পনা জানেন না তিনি যদি হন পরিকল্পনা প্রধান, ফিন্যান্স জানেন না তিনি যদি হন অর্থ প্রধান, ব্যাংকিং জানেন না তিনি যদি হন ব্যাংকিং প্রধান- তাহলে বিপদ হওয়ার আশংকা আছে। কোর এরিয়া ফেলে নিয়োগ দেয়া দরকার। বাজেট অঙ্ক নয়। কম্পিউটার লাগিয়ে যোগ-বিয়োগ করে দিলাম আর হয়ে গেল তা নয়। অর্থনীতির মৌলিক দিকগুলো শক্তিশালী আছে। পাটাতন এখনও শক্ত। যদি রেভেনিউ ঠিক না থাকে তাহলে সব চুরমার হয়ে যেতে পারে। কাগজে দেখলাম ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ‘মিসম্যাচ’। ‘মিসম্যাচ’ হতে পারে। এর জন্য ‘রিকনসিলিয়েশন’ করতে হয় নিয়মিতভাবে। এটা না হলে বিপদ। আশা করি সরকার তার রাজস্ব আয়ের বিষয়টি নিয়ে ভাববে। পরিকল্পনা কমিশনে পরিকল্পনা নিয়েই ঝামেলা আছে শোনা যায়। অনেক মন্ত্রীই টার্গেট ঠিক নেই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন- কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। ইকোনমিক মিনিস্ট্রিজের মধ্যে গ্রেটার কোপারেশন দরকার। যে ভিত গড়ে উঠেছে, বেশি খরচের জন্য সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে তা হয় না। এত বড় বেতন বৃদ্ধি অথচ কেউ খুশি নয়। এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। কেউ ভেতর থেকে সর্বনাশের বীজ বপন করছে কিনা। সরকার সাবধান থাকলে ভালো করবে।
ড. আরএম দেবনাথ : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
No comments