সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কারও নয় by আবদুল্লাহ আল মামুন ও হাবিবুর রহমান খান
দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি কাল মঙ্গলবার। গত বছর থেকে পাঁচ
জানুয়ারিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ এবং বিএনপি ‘গণতন্ত্র
হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দল একই
দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু কাউকেই অনুমতি দেয়া
হয়নি। প্রথম বছর এ দিনকে ঘিরে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিদগ্ধ মানুষের
আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। টানা তিন মাস অবরোধের কবলে পড়ে দেশ। গত
বছরের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকায় এবার শুরু থেকেই সাবধান সরকার।
রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখবে আ’লীগ
ঢাকার ১৮ স্পটে সমাবেশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে রাজপথের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখবে আওয়ামী লীগ। শুধু কর্মসূচি পালন নয়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামতে দেয়া হবে না। গত বছর টানা তিন মাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষমতাসীনরা এমন পরিকল্পনা করেছে।
আওয়ামী লীগ আগামীকাল রাজধানীর ১৮ স্পটে র্যালি ও সমাবেশ কর্মসূচি দিয়েছে। মূলত এই ১৮টি স্পট থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোনোভাবেই তাদের সহিংসতার সুযোগ দেয়া হবে না। সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না তারা (বিএনপি) রাজপথে থাকবে। আন্দোলন করতে হলে তো নেতাকর্মী থাকতে হবে। তাদের নেতাকর্মী কোথায়? তারা অসংগঠিত। তারা আন্দোলন গড়ে তুলবে এটা দুরাশা। আষাঢ় মাসের গর্জনের মতোই মনে হয়েছে তাদের আন্দোলনের ঘোষণা। বিএনপির আন্দোলন করার কোনো প্রস্তুতি নেই। এ মুহূর্তে জনগণও আন্দোলনের মুডে নেই বা পছন্দ করছে না। তাছাড়া সরকারবিরোধী কোনো জনপ্রিয় ইস্যুও তাদের হাতে নেই।’
নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের এ নীতিনির্ধারক বলেন, পুলিশ কী ভাবছে আমি জানি না। তবে পুলিশ নিরাপত্তাজনিত কারণে এখানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুমতি দেয়নি। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করেই নয়াপল্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আগামীকাল ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচির বিষয়ে সরকার যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে তা স্বীকার করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। রোববার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি হুশিয়ার করে বলেন, বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে তবে জনগণ ও আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের আরও কঠিন শিক্ষা দেবে। হানিফ বলেন, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা করার অধিকার বিএনপির নেই। তাদের উচিত ৫ জানুয়ারি ‘অনুতপ্ত দিবস’ পালন করা।
আগামীকাল ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন শাসক দলের নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে এ যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কাল সারা দেশে জেলা-উপজেলায় আনন্দ র্যালি ও সমাবেশের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার ১৮টি স্পটে আনন্দ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মসূচির বিষয়ে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘শুনেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওই দিন কাউকে সমাবেশের অনুমতি দেবে না ডিএমপি। যদি না দেয় তবে আমরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে (বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) সমাবেশ করব।’
দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো যুগান্তরকে জানিয়েছে, কৌশলগত কারণে পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপিকে ‘ফ্রি’ রাখা হয়। কার্যত তাদের ব্যাপারে সরকারের আগের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ চলমান মামলাগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। পুলিশকেও আগের অবস্থানেই থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে রোববার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, আগামীকাল ৫ জানুয়ারি দুই রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে ঘিরে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকলে কোনো দলকেই সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। ডিএমপি কমিশনার বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ কর্মসূচি ছাড়াও শাসক দল আওয়ামী লীগ রাজধানীর মিরপুর ১২ পূরবী সিনেমা হল, শ্যামপুর-জুরাইন রেলগেট, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী মাঠ, বাড্ডা-রামপুরা পেট্রলপাম্প, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক, মিরপুর ১ (গোলচত্বর), লালবাগ, গুলশান, সূত্রাপুর, তেজগাঁও, সবুজবাগ-খিলগাঁও, উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর-টাউন হল, কাফরুল, গুলিস্তান-বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এবং বনানী ও মহাখালী এলাকায় বেলা আড়াইটার আগে অবস্থান নেবে। মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের চলাচল সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে দলটির নেতাকর্মীরা।
শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি
সোহরাওয়ার্দীর পর নয়াপল্টন চায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পর এবার নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে বিএনপি। রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দলটির নেতারা অপেক্ষা করবেন। সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকার জন্য কর্মসূচি দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে গতবারের মতো কঠোর আন্দোলনের বিষয়েও অনেকেই মত দিচ্ছেন। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিএনপি। এদিন উপলক্ষে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি চেয়ে ডিএমপি’র কাছে আবেদন করে। বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছেন দলটির নেতারা।
নয়াপল্টনেও অনুমতি না দিলে কী করবেন জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘কী করব সেটা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনও সময় আছে। অনেক সময় দেখা গেছে, জনসভার আগের রাতেও কর্মসূচির অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি। গতবারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কী করবেন এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম আলাপ-আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজধানীতে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষে ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি পালন করবে দলটি। এই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। শনিবার দলের যৌথসভায় ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। অঙ্গসংগঠনগুলোকেও পৃথকভাবে প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজধানীতে সমাবেশ না হলেও ঢাকার বাইরে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে বিক্ষোভ সমাবেশ পালিত হবে।
ঢাকায় কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও প্রকাশ্যে তেমন প্রস্তুতি নেই। ঢাকা মহানগরের কোনো নেতাকে এখনও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। সোহরাওয়ার্দী বা নয়াপল্টন কোথাও অনুমতি না পেলে রাজপথে নামার মতো অবস্থায় নেই ঢাকা মহানগর বিএনপি। গত বছর ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বাদে সারা দেশে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। শুধু ঢাকায় নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারেননি। এতে ঢাকা মহানগর নিয়ে তীব্র সমালোচনায় পড়েন দলের হাইকমান্ড। এবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
ঢাকায় সমাবেশ করতে দেয়া না হলে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হতে পারে। রাজধানীর থানা বা ওয়ার্ডে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে কেউ কেউ পরামর্শ দিলেও সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলের কেউ কেউ মনে করেন, সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে উল্টো উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের উসকানিতে পা দেয়া ঠিক হবে না। তাদের মতে, সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের পর সরকার দেশে বিদেশে নানা সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। কারচুপির অভিযোগ থেকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে নিতে তারা নতুন কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হলে এতে সংঘাত সৃষ্টি করে এর দায় বিএনপির ওপর চাপাতে পারেন। সংঘাত-সংঘর্ষ হলে নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হতে পারে নতুন মামলা। গ্রেফতার করা হতে পারে সক্রিয় নেতাদের। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আপাতত কোনো ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো বলে মনে করেন দলের ওই অংশের নেতারা।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। তারা যদি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি দেবে। আওয়ামী লীগ যদি ১৮ স্থানে সমাবেশ করতে পারে বিএনপি কেন এক স্থানে পারবে না।
এদিকে সোমবার বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, ‘আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশাপাশি রোববার নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভার অনুমতি চেয়েছি। এবার দেখব আপনারা (সরকার) কতটুকু শান্তির পক্ষে, আপনারা কতটুকু স্বস্তি, কতটুকু গণতন্ত্রের পক্ষে। নোংরামি করে অপরাজনীতি দিয়ে নিজেদের চেহারা ঢাকা যাবে না। আমরা বলব, আপনারা (সরকার) গণতন্ত্র, ন্যায় ও সত্যের পথে আসুন। মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তির জন্য, জনগণের স্বস্তির জন্য সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে আবারও সরকারকে বলতে চাই, শান্তিপূর্ণ জনসভার জন্য অনুমতি দিন। এটি গণতন্ত্রের একটি অংশ। এই জায়গা বাধা দেবেন না। আপনারা যদি মনে করেন, ওই জায়গা (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) না দিয়ে পার্টি অফিসের সামনে দেবেন, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই।
বিএনপির পর একই স্থানে আওয়ামী লীগও জনসভার পাল্টা ঘোষণার সমালোচনা করে রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের হঠাৎ কর্মসূচি ঘোষণা অত্যন্ত হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা দেশবাসী সহজে বুঝতে পারে ও জানে। পায়ে পাড়া দিয়ে বিএনপির কর্মসূচি বানচাল করায় আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্ব ফুটে উঠেছে। কারণ এই কর্মসূচি দিয়ে তারা নিজেরাই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এরা জনগণের কণ্ঠের আওয়াজে চমকে উঠছে। আতংকিত হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে বিএনপির কর্মসূচিকে বানচাল করতে চাচ্ছে।
ঢাকার ১৮ স্পটে সমাবেশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে রাজপথের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখবে আওয়ামী লীগ। শুধু কর্মসূচি পালন নয়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামতে দেয়া হবে না। গত বছর টানা তিন মাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষমতাসীনরা এমন পরিকল্পনা করেছে।
আওয়ামী লীগ আগামীকাল রাজধানীর ১৮ স্পটে র্যালি ও সমাবেশ কর্মসূচি দিয়েছে। মূলত এই ১৮টি স্পট থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোনোভাবেই তাদের সহিংসতার সুযোগ দেয়া হবে না। সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না তারা (বিএনপি) রাজপথে থাকবে। আন্দোলন করতে হলে তো নেতাকর্মী থাকতে হবে। তাদের নেতাকর্মী কোথায়? তারা অসংগঠিত। তারা আন্দোলন গড়ে তুলবে এটা দুরাশা। আষাঢ় মাসের গর্জনের মতোই মনে হয়েছে তাদের আন্দোলনের ঘোষণা। বিএনপির আন্দোলন করার কোনো প্রস্তুতি নেই। এ মুহূর্তে জনগণও আন্দোলনের মুডে নেই বা পছন্দ করছে না। তাছাড়া সরকারবিরোধী কোনো জনপ্রিয় ইস্যুও তাদের হাতে নেই।’
নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের এ নীতিনির্ধারক বলেন, পুলিশ কী ভাবছে আমি জানি না। তবে পুলিশ নিরাপত্তাজনিত কারণে এখানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুমতি দেয়নি। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করেই নয়াপল্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আগামীকাল ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচির বিষয়ে সরকার যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে তা স্বীকার করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। রোববার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি হুশিয়ার করে বলেন, বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে তবে জনগণ ও আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের আরও কঠিন শিক্ষা দেবে। হানিফ বলেন, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা করার অধিকার বিএনপির নেই। তাদের উচিত ৫ জানুয়ারি ‘অনুতপ্ত দিবস’ পালন করা।
আগামীকাল ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন শাসক দলের নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে এ যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কাল সারা দেশে জেলা-উপজেলায় আনন্দ র্যালি ও সমাবেশের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার ১৮টি স্পটে আনন্দ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মসূচির বিষয়ে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘শুনেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওই দিন কাউকে সমাবেশের অনুমতি দেবে না ডিএমপি। যদি না দেয় তবে আমরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে (বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) সমাবেশ করব।’
দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো যুগান্তরকে জানিয়েছে, কৌশলগত কারণে পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপিকে ‘ফ্রি’ রাখা হয়। কার্যত তাদের ব্যাপারে সরকারের আগের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ চলমান মামলাগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। পুলিশকেও আগের অবস্থানেই থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে রোববার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, আগামীকাল ৫ জানুয়ারি দুই রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে ঘিরে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকলে কোনো দলকেই সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। ডিএমপি কমিশনার বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ কর্মসূচি ছাড়াও শাসক দল আওয়ামী লীগ রাজধানীর মিরপুর ১২ পূরবী সিনেমা হল, শ্যামপুর-জুরাইন রেলগেট, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী মাঠ, বাড্ডা-রামপুরা পেট্রলপাম্প, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক, মিরপুর ১ (গোলচত্বর), লালবাগ, গুলশান, সূত্রাপুর, তেজগাঁও, সবুজবাগ-খিলগাঁও, উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর-টাউন হল, কাফরুল, গুলিস্তান-বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এবং বনানী ও মহাখালী এলাকায় বেলা আড়াইটার আগে অবস্থান নেবে। মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের চলাচল সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে দলটির নেতাকর্মীরা।
শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি
সোহরাওয়ার্দীর পর নয়াপল্টন চায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পর এবার নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে বিএনপি। রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দলটির নেতারা অপেক্ষা করবেন। সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকার জন্য কর্মসূচি দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে গতবারের মতো কঠোর আন্দোলনের বিষয়েও অনেকেই মত দিচ্ছেন। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিএনপি। এদিন উপলক্ষে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি চেয়ে ডিএমপি’র কাছে আবেদন করে। বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছেন দলটির নেতারা।
নয়াপল্টনেও অনুমতি না দিলে কী করবেন জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘কী করব সেটা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনও সময় আছে। অনেক সময় দেখা গেছে, জনসভার আগের রাতেও কর্মসূচির অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি। গতবারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কী করবেন এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম আলাপ-আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজধানীতে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষে ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি পালন করবে দলটি। এই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। শনিবার দলের যৌথসভায় ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। অঙ্গসংগঠনগুলোকেও পৃথকভাবে প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজধানীতে সমাবেশ না হলেও ঢাকার বাইরে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে বিক্ষোভ সমাবেশ পালিত হবে।
ঢাকায় কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও প্রকাশ্যে তেমন প্রস্তুতি নেই। ঢাকা মহানগরের কোনো নেতাকে এখনও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। সোহরাওয়ার্দী বা নয়াপল্টন কোথাও অনুমতি না পেলে রাজপথে নামার মতো অবস্থায় নেই ঢাকা মহানগর বিএনপি। গত বছর ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বাদে সারা দেশে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। শুধু ঢাকায় নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারেননি। এতে ঢাকা মহানগর নিয়ে তীব্র সমালোচনায় পড়েন দলের হাইকমান্ড। এবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
ঢাকায় সমাবেশ করতে দেয়া না হলে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হতে পারে। রাজধানীর থানা বা ওয়ার্ডে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে কেউ কেউ পরামর্শ দিলেও সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলের কেউ কেউ মনে করেন, সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে উল্টো উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের উসকানিতে পা দেয়া ঠিক হবে না। তাদের মতে, সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের পর সরকার দেশে বিদেশে নানা সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। কারচুপির অভিযোগ থেকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে নিতে তারা নতুন কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হলে এতে সংঘাত সৃষ্টি করে এর দায় বিএনপির ওপর চাপাতে পারেন। সংঘাত-সংঘর্ষ হলে নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হতে পারে নতুন মামলা। গ্রেফতার করা হতে পারে সক্রিয় নেতাদের। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আপাতত কোনো ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো বলে মনে করেন দলের ওই অংশের নেতারা।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। তারা যদি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি দেবে। আওয়ামী লীগ যদি ১৮ স্থানে সমাবেশ করতে পারে বিএনপি কেন এক স্থানে পারবে না।
এদিকে সোমবার বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, ‘আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশাপাশি রোববার নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভার অনুমতি চেয়েছি। এবার দেখব আপনারা (সরকার) কতটুকু শান্তির পক্ষে, আপনারা কতটুকু স্বস্তি, কতটুকু গণতন্ত্রের পক্ষে। নোংরামি করে অপরাজনীতি দিয়ে নিজেদের চেহারা ঢাকা যাবে না। আমরা বলব, আপনারা (সরকার) গণতন্ত্র, ন্যায় ও সত্যের পথে আসুন। মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তির জন্য, জনগণের স্বস্তির জন্য সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে আবারও সরকারকে বলতে চাই, শান্তিপূর্ণ জনসভার জন্য অনুমতি দিন। এটি গণতন্ত্রের একটি অংশ। এই জায়গা বাধা দেবেন না। আপনারা যদি মনে করেন, ওই জায়গা (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) না দিয়ে পার্টি অফিসের সামনে দেবেন, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই।
বিএনপির পর একই স্থানে আওয়ামী লীগও জনসভার পাল্টা ঘোষণার সমালোচনা করে রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের হঠাৎ কর্মসূচি ঘোষণা অত্যন্ত হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা দেশবাসী সহজে বুঝতে পারে ও জানে। পায়ে পাড়া দিয়ে বিএনপির কর্মসূচি বানচাল করায় আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্ব ফুটে উঠেছে। কারণ এই কর্মসূচি দিয়ে তারা নিজেরাই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এরা জনগণের কণ্ঠের আওয়াজে চমকে উঠছে। আতংকিত হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে বিএনপির কর্মসূচিকে বানচাল করতে চাচ্ছে।
No comments