গ্যাস গেল কোথায়? by ডক্টর তুহিন মালিক
ইদানীং
কাউকে নিমন্ত্রণ করেন না আমার মা। কারণ রাত ১১টার আগে চুলা জ্বলে না
আমাদের পুরান ঢাকার চকবাজারের বাসায়। আগের রাতের খাবারটা পর্যন্ত পরদিন
দুপুরে গরম করে খাবারও কোনোরকম সুযোগ নাই চরম গ্যাস সংকটের কারণে। কয়লার
তন্দুরে বানানো বাখরখানিটাই আপাতত বাঁচিয়ে রেখেছে সকালের নাস্তাটাকে।
ঐতিহ্যের বাখরখানি এখন অনেকটা যেন নিত্যদিনের অনুরোধে ঢেঁকি গেলারই মতো।
রান্না করে খাবার খেতে পারার এখন আর কোনো সুযোগই নাই ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও
গাজীপুরের মানুষের কাছে। রান্নার জন্য চাই গ্যাস। অথচ চরম গ্যাস সংকটে
ভুগছে রাজধানীসহ আশেপাশের সব এলাকা। তবে মধ্যরাতে দেখা মেলে গ্যাসের।
সারাদিন সংসারের কাজকর্ম সেরে রাত জেগে গৃহিণীদের রান্নাবান্না করতে হচ্ছে।
দিনে গ্যাসের চুলায় যে আগুন পাওয়া যায় তাতে ভাত রান্না করতে তিন দিন সময়ের
প্রয়োজন। গত মঙ্গলবার গ্যাসের দাবিতে ফতুল্লা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রুটে
ঝাড়ু হাতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসী। রাত ১২টার পর যখন
গার্মেন্টস বন্ধ হয় তখন এলাকার চুলা জ্বলে বলে অভিযোগ করে তারা। শিল্প
প্রতিষ্ঠানগুলো কমপ্রেসারের সাহায্যে গ্যাস লাইনের পুরো গ্যাসটাই টেনে নিয়ে
যাবার কারণেই নাকি চুলায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার গ্যাস
সংকট সমাধান না করে জনগণকে পরামর্শ দিয়েই চলেছে। গত বুধবার বিদ্যুৎ,
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী স্পষ্টতই জানিয়ে দেন, আবাসিক খাতে
গ্যাসের এই সমস্যা থাকবেই। তিনি জনগণকে এলপিজি গ্যাস ব্যবহারের পরামর্শ
দিয়ে নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করলেন। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান ‘আমাদের মূল
লক্ষ্য হলো শিল্প এলাকায় প্রথমে গ্যাস সরবরাহ করা। আমরা সেদিকেই ধাবিত
হচ্ছি।’ তবে শিল্পখাতকে সুবিধা দেয়ার জন্য আবাসিকে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট
তৈরি করা হচ্ছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী কোনো
সদুত্তর দিতে পারেননি। আসলে দেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ১২ শতাংশ
গৃহস্থালিতে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ শিল্পখাতের মাত্র ২ ভাগ কমিয়ে আবাসিক খাতে
গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করে দিলেই তো এই সমস্যা মিটে যায়। অথচ এর বদলে
মন্ত্রীরা আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। এ যেন মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কীয় সংসদীয় স্থায়ী
কমিটিও সুপারিশ করে চলেছে বাসাবাড়িতে গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের।
দুই... মন্ত্রীদের প্রেসক্রিপশন মতে গ্যাসের আবাসিক সংযোগ বন্ধ হলে একটা পরিবারে কমপক্ষে সিলিন্ডারপ্রতি মাসে ৩৫০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা গুনতে হবে। নিম্নবিত্ত পরিবারের কথা বাদই দিলাম, এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারে চুলা জ্বালানোর খরচ নির্বাহ করাটাই দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। পরিবারের রান্নাটা একটু বেশি হলেই রান্নার খরচ ৮/১০ হাজার টাকায় গিয়ে পৌঁছাবে। অথচ পুরো ঢাকা শহর এখন যেন সিএনজিময়। প্রাইভেট কার আর অটোরিকশা তো বটেই, বাস-ট্রাক পর্যন্ত এখন গ্যাসে চলে। পারলে যেখানে আমরা মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে রিকশা পর্যন্ত সিএনজি দিয়ে চালাতে প্রস্তুত, সেখানে আবাসিক গ্যাস বন্ধের এহেন হুঁশিয়ারিতে রাজধানীবাসী সত্যিই আতঙ্কিত। খাবারের জন্য রান্না আগে, না গাড়ির গ্যাস আগে- এটা ভাববার সময় এখন এসেছে। সরকার বলছে, গ্যাসের উপর ভাসছে দেশ, অথচ রান্নার জন্য গ্যাস নেই কেন? এ কথার জবাব দিবে কে? খুবই দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার যেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে নামমাত্র দামে আমাদের গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে, তা আবার চড়ামূল্যে তাদের কাছ থেকেই কিনে নিচ্ছে। আর সেখানে রান্নার জন্য দেশের মানুষকে রাত জেগে সেই গ্যাসের জন্যই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তীর্থের কাকের মতো! এতে কর্তাব্যক্তিদের পকেট ভারী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে এদেশের দরিদ্র মানুষকে। ভাত রান্নার গ্যাস বন্ধের হুঁশিয়ারি হজম করা ছাড়া তো অন্য কোনো উপায়ও নেই জনগণের।
তিন... যতই দিন যাচ্ছে রাজধানীতে গ্যাস সংকট ততই প্রকট হয়ে উঠছে। কোনো কোনো এলাকায় রাতে তির তির করে গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও দিন-রাত গ্যাস সরবরাহ পাওয়াটাই একেবারে কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকদের একটি বড় অংশের রান্না-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কর্মজীবী মানুষকে রাত জেগে বসে থাকতে হচ্ছে গ্যাস এলে রান্না করতে হবে। নগরের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাসের কাছে রয়েছে অযুহাতের লম্বা ফিরিস্তি। যথারীতি সরকারি বুলি আওড়ানো হয়- অমুক জায়গায় অত মেগাওয়াট প্ল্যান্ট বন্ধ, গ্যাসের চাপ কম, শীতের কারণে প্রেসার নাই, উৎপাদনের চাইতে চাহিদা বেশি, উন্নয়ন বাড়ছে তাই চাহিদা বাড়ছে ইত্যাদি সব গৎবাঁধা বুলি। পুরান ঢাকার চকবাজার, উর্দু রোড, ইসলামবাগ, বংশাল, হাজারীবাগ, লালবাগ, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর থেকে শুরু করে ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর অথবা খিলগাঁও, সিপাহীবাগ, মিরপুর, মনিপুর কিংবা রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, বনশ্রী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, পোস্তগোলা, উত্তরা, এমনকি গুলশান-বনানীতেও সর্বত্রই একই অবস্থা। ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মানুষেরও এই একই ভোগান্তি।
চার... এদিকে গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘শীতকালে গ্যাস সংকট হয়। গ্যাসের চাপও কমে যায়। এই সমস্যা প্রতি শীতেই হয়।’ আসলে বাংলাদেশে শীতকাল কি এই সরকারের আমলেই এসেছে? আগে কখনও কি দেশে শীতকাল আসেনি? অথচ রাজধানীতে গ্যাস সংকট চলছে গত ছয় সাত বছর ধরেই। দুটি কারণে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। রাজধানীর বহু এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকীর্ণ ব্যাসার্ধের পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাস চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। জাতীয় গ্রিডলাইনে যখন গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকে না তখনও কোনো কোনো এলাকায় রান্নার উপযোগী গ্যাস পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। চাহিদার তুলনায় যখন গ্যাস সরবরাহ কম থাকে তখন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ফলে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় দেখা দেয় গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকটের আরেকটি কারণ হলো, পাইপলাইনে গ্যাসের সঙ্গে থাকা তরল জ্বালানি কনডেনসেট জমে যাওয়া। এ মুহূর্তে গৃহস্থালি পর্যায়েই শুধু নয়, শিল্প কলকারখানায়ও গ্যাস চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে যে গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে এর মধ্যে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে; ১৭ শতাংশ শিল্পে; ১৬ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ারে; ১২ শতাংশ গৃহস্থালিতে; ৭ শতাংশ সার-কারখানায়; ৫ শতাংশ সিএনজিতে; ১ শতাংশ বাণিজ্যিক এবং দশমিক ১ শতাংশ চা-বাগানে ব্যবহূত হচ্ছে। সার কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে গড়ে ২৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পাচ্ছে গড়ে ৬৬ থেকে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। পাচ্ছে গড়ে সাড়ে ৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রায় ৯শ’টি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ৩৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়াও আবাসিক ও অন্যান্য গ্রাহকদের ১ হাজার ১শ’ ৬৪ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশের বিতরণ কোম্পানির অধীনে বৈধ আবাসিক গ্যাস গ্রাহকের সংখ্যা ২৩ লাখের ঊর্ধ্বে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, বৈধ আবাসিক সংযোগে দৈনিক গ্যাস ব্যবহার হয় ২৫ কোটি ঘনফুটের মতো। যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ১২ শতাংশ। আর বর্তমানে আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ২৭ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ মাত্র ২ কোটি ঘনফুট আবাসিক খাতে বৃদ্ধি করা হলেই এই সংকট আর থাকে না।
পাঁচ... আশংকার বিষয় হচ্ছে, দেশে বর্তমানে মাত্র ১০ থেকে ১২ বছরের ব্যবহারের মতো গ্যাস মজুত রয়েছে। অথচ অচিরেই যখন দেশ গ্যাসশূন্য হয়ে পড়বে এটা মোকাবিলার কোনো বাস্তবিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে নেই। অন্যদিকে সাগরের ১০, ১১, ১২, ১৬, ১৮, ১৯ নম্বর ব্লকে কোনোরকম দরপত্র ছাড়াই একটি বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার কাজ এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। যার মধ্যে মাত্র দুটি ব্লকেই রয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই গ্যাস তুলতে হলে কূপ খনন ও পাইপলাইন তৈরিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। সেদিকে কার্যকর কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে সরকার কেন এভাবে সাধারণ মানুষের চুলার গ্যাসের উপর হামলা চালাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। অথচ গ্যাসের সঠিক ব্যবহারের জন্য কোনো জাতীয় নীতিমালা এখন পর্যন্ত করতে পারেনি সরকার। সরকার ক্ষমতায় এসে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও আজ অবধি কার্যত কিছুই করা হয়নি। তবে এই নীতিমালার খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে বহুবার। খসড়া নীতিমালায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ এবং সার-কারখানায় গ্যাস বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়। আবাসিক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়। গ্যাসের একক নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প জ্বালানির সংস্থানের কথা বলা হয়েছে এতে। কিন্তু খাতওয়ারি গ্যাসের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করাসহ সংকটকালীন গ্যাস ব্যবস্থাপনার কোনো কথা এই খসড়া নীতিমালায় নেই। যেখানে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ১২ শতাংশ দিয়ে জ্বলছে আমাদের রান্নার চুলাগুলো সেখানে দরিদ্র জনগণের চুলার উপর এত বিরাগের কারণ কি?
ছয়... সরকারের দাবিকৃত ‘গ্যাসে ভাসা দেশে’ ভাত রান্নার জন্য গৃহস্থালি কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার অধিকার এদেশের জনগণের রয়েছে। জনগণের বেঁচে থাকার এই আবশ্যকীয় অধিকারটুকু নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। কেননা, আমাদের সংবিধানে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুই যে শুধু মৌলিক অধিকার তা কিন্তু নয়। মানুষের জীবনধারণের জন্য মৌলিক সেবা পাওয়ার অধিকারও মানবাধিকার। তাই দরিদ্র জনগণের ভাত রান্নার জন্য মাসে তিন থেকে দশ হাজার টাকা খরচে বাধ্য করা হলে তা হবে চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ভাবতে কষ্ট হয়, যেখানে মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশনা দেখিয়ে নগদ অর্থের স্পীডমানির সুবাদে নতুন সংযোগ দেয়া হয় বলে খোদ সংসদীয় কমিটি অভিযোগ করে। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস সংযোগ বাণিজ্য হয় তিতাসে। সেখানে গরিব জনগণের রান্নার গ্যাস বন্ধের রক্তচক্ষুর আতঙ্কে ভুগতে হচ্ছে এদেশের সাধারণ মানুষকে। তাই গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আবাসিক কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেই হবে। এ সরবরাহ কোনোক্রমেই ব্যাহত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে জনগণকে আর ভয় না দেখিয়ে বা নতুন কোনো আতঙ্কে না ফেলে সরকারের উচিত অবিলম্বে জনদুর্ভোগ লাঘব করে রান্নার গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জনগণের পেটের ক্ষুধার আগুন মেটাতে চুলায় আগুনের দরকার। আর মানুষ চুলায় আগুন জ্বালাতে না পারলে প্রতিবাদের আগুন ধরাবার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকবে না।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
দুই... মন্ত্রীদের প্রেসক্রিপশন মতে গ্যাসের আবাসিক সংযোগ বন্ধ হলে একটা পরিবারে কমপক্ষে সিলিন্ডারপ্রতি মাসে ৩৫০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা গুনতে হবে। নিম্নবিত্ত পরিবারের কথা বাদই দিলাম, এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারে চুলা জ্বালানোর খরচ নির্বাহ করাটাই দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। পরিবারের রান্নাটা একটু বেশি হলেই রান্নার খরচ ৮/১০ হাজার টাকায় গিয়ে পৌঁছাবে। অথচ পুরো ঢাকা শহর এখন যেন সিএনজিময়। প্রাইভেট কার আর অটোরিকশা তো বটেই, বাস-ট্রাক পর্যন্ত এখন গ্যাসে চলে। পারলে যেখানে আমরা মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে রিকশা পর্যন্ত সিএনজি দিয়ে চালাতে প্রস্তুত, সেখানে আবাসিক গ্যাস বন্ধের এহেন হুঁশিয়ারিতে রাজধানীবাসী সত্যিই আতঙ্কিত। খাবারের জন্য রান্না আগে, না গাড়ির গ্যাস আগে- এটা ভাববার সময় এখন এসেছে। সরকার বলছে, গ্যাসের উপর ভাসছে দেশ, অথচ রান্নার জন্য গ্যাস নেই কেন? এ কথার জবাব দিবে কে? খুবই দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার যেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে নামমাত্র দামে আমাদের গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে, তা আবার চড়ামূল্যে তাদের কাছ থেকেই কিনে নিচ্ছে। আর সেখানে রান্নার জন্য দেশের মানুষকে রাত জেগে সেই গ্যাসের জন্যই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তীর্থের কাকের মতো! এতে কর্তাব্যক্তিদের পকেট ভারী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে এদেশের দরিদ্র মানুষকে। ভাত রান্নার গ্যাস বন্ধের হুঁশিয়ারি হজম করা ছাড়া তো অন্য কোনো উপায়ও নেই জনগণের।
তিন... যতই দিন যাচ্ছে রাজধানীতে গ্যাস সংকট ততই প্রকট হয়ে উঠছে। কোনো কোনো এলাকায় রাতে তির তির করে গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও দিন-রাত গ্যাস সরবরাহ পাওয়াটাই একেবারে কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকদের একটি বড় অংশের রান্না-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কর্মজীবী মানুষকে রাত জেগে বসে থাকতে হচ্ছে গ্যাস এলে রান্না করতে হবে। নগরের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাসের কাছে রয়েছে অযুহাতের লম্বা ফিরিস্তি। যথারীতি সরকারি বুলি আওড়ানো হয়- অমুক জায়গায় অত মেগাওয়াট প্ল্যান্ট বন্ধ, গ্যাসের চাপ কম, শীতের কারণে প্রেসার নাই, উৎপাদনের চাইতে চাহিদা বেশি, উন্নয়ন বাড়ছে তাই চাহিদা বাড়ছে ইত্যাদি সব গৎবাঁধা বুলি। পুরান ঢাকার চকবাজার, উর্দু রোড, ইসলামবাগ, বংশাল, হাজারীবাগ, লালবাগ, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর থেকে শুরু করে ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর অথবা খিলগাঁও, সিপাহীবাগ, মিরপুর, মনিপুর কিংবা রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, বনশ্রী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, পোস্তগোলা, উত্তরা, এমনকি গুলশান-বনানীতেও সর্বত্রই একই অবস্থা। ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মানুষেরও এই একই ভোগান্তি।
চার... এদিকে গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘শীতকালে গ্যাস সংকট হয়। গ্যাসের চাপও কমে যায়। এই সমস্যা প্রতি শীতেই হয়।’ আসলে বাংলাদেশে শীতকাল কি এই সরকারের আমলেই এসেছে? আগে কখনও কি দেশে শীতকাল আসেনি? অথচ রাজধানীতে গ্যাস সংকট চলছে গত ছয় সাত বছর ধরেই। দুটি কারণে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। রাজধানীর বহু এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকীর্ণ ব্যাসার্ধের পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাস চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। জাতীয় গ্রিডলাইনে যখন গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকে না তখনও কোনো কোনো এলাকায় রান্নার উপযোগী গ্যাস পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। চাহিদার তুলনায় যখন গ্যাস সরবরাহ কম থাকে তখন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ফলে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় দেখা দেয় গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকটের আরেকটি কারণ হলো, পাইপলাইনে গ্যাসের সঙ্গে থাকা তরল জ্বালানি কনডেনসেট জমে যাওয়া। এ মুহূর্তে গৃহস্থালি পর্যায়েই শুধু নয়, শিল্প কলকারখানায়ও গ্যাস চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে যে গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে এর মধ্যে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে; ১৭ শতাংশ শিল্পে; ১৬ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ারে; ১২ শতাংশ গৃহস্থালিতে; ৭ শতাংশ সার-কারখানায়; ৫ শতাংশ সিএনজিতে; ১ শতাংশ বাণিজ্যিক এবং দশমিক ১ শতাংশ চা-বাগানে ব্যবহূত হচ্ছে। সার কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে গড়ে ২৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পাচ্ছে গড়ে ৬৬ থেকে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। পাচ্ছে গড়ে সাড়ে ৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রায় ৯শ’টি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ৩৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়াও আবাসিক ও অন্যান্য গ্রাহকদের ১ হাজার ১শ’ ৬৪ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশের বিতরণ কোম্পানির অধীনে বৈধ আবাসিক গ্যাস গ্রাহকের সংখ্যা ২৩ লাখের ঊর্ধ্বে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, বৈধ আবাসিক সংযোগে দৈনিক গ্যাস ব্যবহার হয় ২৫ কোটি ঘনফুটের মতো। যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ১২ শতাংশ। আর বর্তমানে আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ২৭ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ মাত্র ২ কোটি ঘনফুট আবাসিক খাতে বৃদ্ধি করা হলেই এই সংকট আর থাকে না।
পাঁচ... আশংকার বিষয় হচ্ছে, দেশে বর্তমানে মাত্র ১০ থেকে ১২ বছরের ব্যবহারের মতো গ্যাস মজুত রয়েছে। অথচ অচিরেই যখন দেশ গ্যাসশূন্য হয়ে পড়বে এটা মোকাবিলার কোনো বাস্তবিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে নেই। অন্যদিকে সাগরের ১০, ১১, ১২, ১৬, ১৮, ১৯ নম্বর ব্লকে কোনোরকম দরপত্র ছাড়াই একটি বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার কাজ এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। যার মধ্যে মাত্র দুটি ব্লকেই রয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই গ্যাস তুলতে হলে কূপ খনন ও পাইপলাইন তৈরিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। সেদিকে কার্যকর কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে সরকার কেন এভাবে সাধারণ মানুষের চুলার গ্যাসের উপর হামলা চালাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। অথচ গ্যাসের সঠিক ব্যবহারের জন্য কোনো জাতীয় নীতিমালা এখন পর্যন্ত করতে পারেনি সরকার। সরকার ক্ষমতায় এসে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও আজ অবধি কার্যত কিছুই করা হয়নি। তবে এই নীতিমালার খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে বহুবার। খসড়া নীতিমালায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ এবং সার-কারখানায় গ্যাস বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়। আবাসিক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়। গ্যাসের একক নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প জ্বালানির সংস্থানের কথা বলা হয়েছে এতে। কিন্তু খাতওয়ারি গ্যাসের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করাসহ সংকটকালীন গ্যাস ব্যবস্থাপনার কোনো কথা এই খসড়া নীতিমালায় নেই। যেখানে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ১২ শতাংশ দিয়ে জ্বলছে আমাদের রান্নার চুলাগুলো সেখানে দরিদ্র জনগণের চুলার উপর এত বিরাগের কারণ কি?
ছয়... সরকারের দাবিকৃত ‘গ্যাসে ভাসা দেশে’ ভাত রান্নার জন্য গৃহস্থালি কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার অধিকার এদেশের জনগণের রয়েছে। জনগণের বেঁচে থাকার এই আবশ্যকীয় অধিকারটুকু নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। কেননা, আমাদের সংবিধানে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুই যে শুধু মৌলিক অধিকার তা কিন্তু নয়। মানুষের জীবনধারণের জন্য মৌলিক সেবা পাওয়ার অধিকারও মানবাধিকার। তাই দরিদ্র জনগণের ভাত রান্নার জন্য মাসে তিন থেকে দশ হাজার টাকা খরচে বাধ্য করা হলে তা হবে চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ভাবতে কষ্ট হয়, যেখানে মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশনা দেখিয়ে নগদ অর্থের স্পীডমানির সুবাদে নতুন সংযোগ দেয়া হয় বলে খোদ সংসদীয় কমিটি অভিযোগ করে। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস সংযোগ বাণিজ্য হয় তিতাসে। সেখানে গরিব জনগণের রান্নার গ্যাস বন্ধের রক্তচক্ষুর আতঙ্কে ভুগতে হচ্ছে এদেশের সাধারণ মানুষকে। তাই গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আবাসিক কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেই হবে। এ সরবরাহ কোনোক্রমেই ব্যাহত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে জনগণকে আর ভয় না দেখিয়ে বা নতুন কোনো আতঙ্কে না ফেলে সরকারের উচিত অবিলম্বে জনদুর্ভোগ লাঘব করে রান্নার গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জনগণের পেটের ক্ষুধার আগুন মেটাতে চুলায় আগুনের দরকার। আর মানুষ চুলায় আগুন জ্বালাতে না পারলে প্রতিবাদের আগুন ধরাবার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকবে না।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail: drtuhinmalik@hotmail.com
No comments